- বইয়ের নামঃ জিঞ্জির
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- প্রকাশনাঃ আগামী প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অগ্র-পথিক
অগ্র-পথিক হে সেনাদল,
জোর কদম চল রে চল।
রৌদ্রদগ্ধ মাটিমাখা শোন ভাইরা মোর,
বসি বসুধায় নব অভিযান আজিকে তোর!
রাখ তৈয়ার হাথেলিতে হাথিয়ার জোয়ান,
হান রে নিশিত পাশুপতাস্ত্র অগ্নিবাণ!
কোথায় হাতুড়ি কোথা শাবল?
অগ্র-পথিক রে সেনাদল,
জোর কদম চল রে চল॥
কোথায় মানিক ভাইরা আমার, সাজ রে সাজ!
আর বিলম্ব সাজে না, চালাও কুচকাওয়াজ!
আমরা নবীন তেজ-প্রদীপ্ত বীর তরুণ
বিপদ বাধার কণ্ঠ ছিঁড়িয়া শুষিব খুন!
আমরা ফলাব ফুল-ফসল।
অগ্র-পথিক রে যুবাদল,
জোর কদম চল রে চল॥
প্রাণ-চঞ্চল প্রাচী-র তরুণ, কর্মবীর,
হে মানবতার প্রতীক গর্ব উচ্চশির!
দিব্যচক্ষে দেখিতেছি, তোরা দৃপ্তপদ
সকলের আগে চলিবি পারায়ে গিরি ও নদ,
মরু-সঞ্চর গতি-চপল।
অগ্র-পথিক রে পাঁওদল,
জোর কদম চল রে চল॥
স্থবির শ্রান্ত প্রাচী-র প্রাচীন জাতিরা সব
হারায়েছে আজ দীক্ষাদানের সে-গৌরব।
অবনত-শির গতিহীন তারা। মোরা তরুণ
বহিব সে ভার, লব শাশ্বত ব্রত দারুণ
শিখাব নতুন মন্ত্রবল।
রে নব পথিক যাত্রীদল,
জোর কদম চল রে চল॥
আমরা চলিব পশ্চাতে ফেলি পচা অতীত,
গিরি-গুহা ছাড়ি খোলা প্রান্তরে গাহিব গীত।
সৃজিব জগৎ বিচিত্রতর, বীর্যবান,
তাজা জীবন্ত সে নব সৃষ্টি শ্রম-মহান,
চলমান-বেগে প্রাণ-উছল।
রে নবযুগের স্রষ্টাদল,
জোর কদম চল রে চল॥
অভিযান-সেনা আমরা ছুটিব দলে দলে
বনে নদীতটে গিরি-সংকটে জলে থলে।
লঙ্ঘিব খাড়া পর্বত-চূড়া অনিমিষে,
জয় করি সব তসনস করি পায়ে পিষে,
অসীম সাহসে ভাঙি আগল!
না জানা পথের নকিব-দল,
জোর কদম চল রে চল॥
পাতিত করিয়া শুষ্ক বৃদ্ধ অটবিরে
বাঁধ বাঁধি চলি দুস্তর খর স্রোত-নীরে।
রসাতল চিরি হীরকের খনি করি খনন,
কুমারী ধরার গর্ভে করি গো ফুল সৃজন,
পায়ে হেঁটে মাপি ধরণিতল!
অগ্র-পথিক রে চঞ্চল,
জোর কদম চল রে চল॥
আমরা এসেছি নবীন প্রাচী-র নবস্রোতে
ভীম পর্বত ক্রকচ-গিরির১ চূড়া হাতে,
উচ্চ অধিত্যকা প্রণালিকা হইয়া বার;
আহত বাঘের পদ-চিন ধরি হয়েছি বার ;
পাতাল ফুঁড়িয়া, পথ-পাগল।
অগ্রবাহিনী পথিক-দল,
জোর কদম চল রে চল॥
আয়র্ল্যান্ড, আরব, মিশর, কোরিয়া চীন,
নরওয়ে, স্পেন, রাশিয়া, – সবার ধারি গো ঋণ!
সবার রক্তে মোদের লোহুর আভাস পাই,
এক বেদনার ‘কমরেড’ভাই মোরা সবাই।
সকল দেশের মোরা সকল ।
রে চির-যাত্রী পথিক-দল,
জোর কদম চল রে চল॥
বলগা্-বিহীন শৃঙ্খল-ছেঁড়া প্রিয় তরুণ!
তোদের দেখিয়া টগবগ করে বক্ষে খুন।
কাঁদি বেদনায়, তবু রে তোদের ভালোবাসায়
উল্লাসে নাচি আপনা-বিভোল,নব আশায়।
ভাগ্য-দেবীর লীলা-কমল,
অগ্রপথিক রে সেনাদল!
জোর কদম চল রে চল॥
তরুণ তাপস! নব শক্তিরে জাগায়ে তোল।
করুণার নয়–ভয়ংকরীর দুয়ার খোল।
নাগিনি-দশনা রণরঙ্গিণী শস্ত্রকর
তোর দেশ-মাতা, তাহারই পতাকা তুলিয়া ধর।
রক্ত-পিয়াসি অচঞ্চল
নির্মম-ব্রত রে সেনাদল!
জোর কদম চল রে চল॥
অভয়-চিত্ত ভাবনা-মুক্ত যুবারা, শুন!
মোদের পিছনে চিৎকার করে পশু, শকুন।
ভ্রুকুটি হানিছে পুরাতন পচা গলিতে শব,
রক্ষণশীল বুড়োরা করছি তারই স্তব
শিবারা চেঁচাক, শিব অটল!
নির্ভীক বীর পথিক-দল,
জোর কদম চল রে চল॥
আগে – আরও আগে সেনা-মুখ যথা করিছে রণ,
পলকে হতেছে পূর্ণ মৃতের শূন্যাসন,
আছে ঠাঁই আছে, কে থামে পিছনে? হ আগুয়ান!
যুদ্ধের মাঝে পরাজয় মাঝ চলো জোয়ান!
জ্বাল রে মশাল জ্বাল অনল!
অগ্রযাত্রী রে সেনাদল,
জোর কদম চল রে চল॥
নতুন করিয়া ক্লান্ত ধরার মৃত শিরায়
স্পন্দন জাগে আমাদের তরে, নব আশায়।
আমাদেরই তারা – চলিছে যাহারা দৃঢ় চরণ
সম্মুখ পানে, একাকী অথবা শতেক জন।
মোরা সহস্র-বাহু-সবল।
রে চির-রাতের সন্ত্রিদল,
জোর কদম চল রে চল॥
জগতের এই বিচিত্রতম মিছিলে ভাই
কত রূপ কত দৃশ্যের লীলা চলে সদাই!–
শ্রমরত ওই কালি-মাখা কুলি, নৌ-সারং,
বলদের মাঝে হলধর চাষা দুখের সং,
প্রভু স-ভৃত্য পেষণ-কল, –
অগ্র-পথিক উদাসী-দল,
জোর কদম চল রে চল॥
নিখিল গোপন ব্যর্থ-প্রেমিক আর্ত-প্রাণ
সকল কারার সকল বন্দী আহত-মান,
ধরার সকল সুখী ও দুঃখী, সৎ, অসৎ,
মৃত, জীবন্ত, পথ-হারা, যারা ভোলেনি পথ, –
আমাদের সাথি এরা সকল।
অগ্র-পথিক রে সেনাদল,
জোরকদম চল রে চল॥
ছুঁড়িতেছে ভাঁটা জ্যোতির্চক্র ঘূর্ণমান
হেরো পুঞ্জিত গ্রহ-রবি-তারা দীপ্তপ্রাণ;
আলো-ঝলমল দিবস, নিশীথ স্বপ্নাতুর, –
বন্ধুর মতো চেয়ে আছে সবে নিকট-দূর।
এক ধ্রুব সবে পথ-উতল।
নব যাত্রিক পথিক দল,
জোর কদম চল রে চল॥
আমাদের এরা, আছে এরা সবে মোদের সাথ,
এরা সখা – সহযাত্রী মোদের দিবস-রাত।
ভ্রূণ-পথে আসে মোদের পথের ভাবী পথিক,
এ মিছিলে মোরা অগ্র-যাত্রী সুনির্ভিক।
সুগম করিয়া পথ পিছল
অগ্র-পথিক রে সেনাদল,
জোর কদম চল রে চল॥
ওগো ও প্রাচী-র দুলালি দুহিতা তরুণীরা,
ওগো জায়া ওগো ভগিনীরা। ডাকে সঙ্গীরা।
উঠুক তোমার মণি-মঞ্জীর ঘন বাজি
আমাদের পথে চল-চপল।
অগ্র-পথিক তরুণ-দল
জোর কদম চল রে চল॥
ওগো অনাগত মরু-প্রান্তর বৈতালিক!
শুনিতেছি তব আগমনি-গীতি দিগ্বিদিক।
আমাদেরই মাঝে আসিতেছ তুমি দ্রুত পায়ে। –
ভিন-দেশী কবি! থামাও বাঁশরি বট-ছায়ে,
তোমার সাধনা আজি সফল।
অগ্র-পথিক চারণ-দল
জোর কদম চল রে চল॥
আমরা চাহি না তরল স্বপন, হালকা সুখ,
আরাম-কুশন, মখমল-চটি, পানসে থুক
শান্তির বাণী, জ্ঞান-বানিয়ার বই-গুদাম,
ছেঁদো ছন্দের পলকা, উর্ণা, সস্তা নাম,
পচা দৌলত; – দুপায়ে দল!
কঠোর দুখের তাপসদল,
জোর কদম চল রে চল॥
পান-আহার ভোজে মত্ত কি যত ঔদরিক?
দুয়ার জানালা বন্ধ করিয়া ফেলিয়া চিক
আরাম করিয়া ভুঁড়োরা ঘুমায়?–বন্ধু, শোন,
মোটা ডালরুটি, ছেঁড়া কম্বল,ভূমি-শয়ন,
আছে তো মোদের পাথেয়-বল!
ওরে বেদনার পূজারি দল,
মোছ রে অশ্রু, চল রে চল॥
নেমেছে কি রাতি? ফুরায় না পথ সুদুর্গম?
কে থামিস পথে ভগ্নোৎসাহ নিরুদ্যম?
বসে নে খানিক পথ-মঞ্জিলে, ভয় কী ভাই,
থামিলে দুদিন ভোলে যদি লোকে – ভুলুক তাই!
মোদের লক্ষ্য চির-অটল!
অগ্র-পথিক ব্রতীর দল,
বাঁদরে বুক, চল রে চল॥
শুনিতেছি আমি, শোন ওই দূরে তূর্য-নাদ
ঘোষিছে নবীন উষার উদয়-সুসংবাদ!
ওরে ত্বরা কর! ছুটে চল আগে – আরও আগে!
গান গেয়ে চলে অগ্র-বাহিনী, ছুটে চল তারও পুরোভাগে!
তোর অধিকার কর দখল!
অগ্র-নায়ক রে পাঁওদল!
জোর কদম চল রে চল॥
অগ্রপথিক হে সেনাদল, জোর কদম চল রে চল
মার্চের সুর
অগ্রপথিক হে সেনাদল, জোর কদম চল রে চল।
রৌদ্রদগ্ধ মাটিমাখা শোন ভাইরা মোর,
বাসি বসুধায় নব অভিযান আজিকে তোর!
রাখ তৈয়ার হাথেলিতে হাথিয়ার জোয়ান,
হানরে নিশিত পশুপতাস্ত্র অগ্নিবাণ।
কোথায় হাতুড়ি কোথা শাবল?
অগ্রপথিক রে সেনাদল, জোর কদম চল রে চল॥
কোথায় মানিক ভাইরা আমার, সাজ রে সাজ!
আর বিলম্ব সাজে না চালাও কুচকাওয়াজ!
আমরা নবীন তেজ-প্রদীপ্ত বীর তরুণ
বিপদ বাধার কণ্ঠ ছিঁড়িয়া শুষিব খুন!
আমরা ফলাব ফুল-ফসল।
অগ্রপথিক রে যুবাদল, জোর কদম চল রে চল!
প্রাণ-চঞ্চল প্রাচী-র তরুণ, কর্মবীর,
হে মানবতার প্রতীক গর্ব উচ্চশির!
দিব্যচক্ষে দেখিতেছি, তোরা দৃপ্তপদ
সকলের আগে চলিবি পারায়ে গিরি ও নদ,
মরু-সঞ্চর গতি চপল।
অগ্র-পথিক রে পাঁওদল, জোর কদম চল রে চল॥
স্থবির শ্রান্ত প্রাচী-র প্রাচীন জাতিরা সব
হারায়েছে আজ দীক্ষা দানের সে গৌরব।
অবনত-শির গতিহীন তারা, মোরা তরুণ
বহিব সে ভার, লব শাশ্বত ব্রত দারুণ,
শিখাব নতুন মন্ত্রবল।
রে নব পথিক যাত্রীদল, জোর কদম চল রে চল॥
আমরা চলিব পশ্চাতে ফেলি পচা অতীত,
গিরি-গুহা ছাড়ি খোলা প্রান্তরে গাহিব গীত।
সৃজিব জগৎ বিচিত্রতর, বীর্যবান,
তাজা জীবন্ত সে নব সৃষ্টি শ্রম-মহান
চলমা-বেগে প্রাণ-উছল।
রে নব যুগের স্রষ্টাদল, জোর কদম চল রে চল॥
অভিযান সেনা আমরা ছুটিব দলে দলে
বনে নদীতটে গিরি-সংকটে জলে থলে।
লঙ্ঘিব খাড়া পর্বত-চূড়া অনিমেষে,
জয় করি সব তসনস করি পায়ে পিষে –
অসীম সাহসে ভাঙি আগল!
না-জানা পথের নকিব-দল, জোর কদম চল রে চল॥
পাতিত করিয়া শুষ্ক বৃদ্ধ অটবিরে
বাঁধ বাঁধি চলি দুস্তর খর স্রোত-নীরে।
রসাতল চিরি হীরকের খনি করি খনন,
কুমারী ধরার গর্ভে করি গো ফুল সৃজন,
পায়ে হেঁটে মাপি ধরণিতল!
অগ্র-পথিক রে চঞ্চল, জোর কদম চল রে চল॥
আমরা এসেছি নবীন প্রাচী-র নবস্রোতে
ভীম পর্বত ক্রকচ-গিরির চূড়া হতে,
উচ্চ অধিত্যকা প্রণালিকা হইয়া পার
আহত বাঘের পদ-চিন ধরি হয়েছি বার;
পাতাল ফুঁড়িয়া, পথ পাগল।
অগ্র-বাহিনী পথিক দল, জোর কদম চল রে চল॥
অভয়-চিত্ত ভাবনা-মুক্ত যুবারা শুন!
মোদের পিছনে চিৎকার করে পশু, শকুন।
ভ্রূকুটি হানিছে পুরাতন পচা গলিত শব,
রক্ষণশীল বুড়োরা, করিছে তাহারই স্তব,
শিবারা চেঁচাক, শিব অটল!
নির্ভীক বীর পথিক-দল, জোর কদম চল রে চল॥
আগে – আরও আগে সেনা-মুখ যথা করিছে রণ,
পলকে হতেছে পূর্ণ মৃতের শূন্যাসন,
আছে ঠাঁই আছে, কে থামে পিছনে? হ আগুয়ান,
যুদ্ধের মাঝে পরাজয় মাঝে চলো জোয়ান!
জ্বালা রে মশাল জ্বাল অনল!
অগ্রযাত্রী রে সেনাদল, জোর কদম চল রে চল॥
ওগো ও প্রাচী-র দুলালি দুহিতা তরুণীরা,
ওগো জায়া ওগো ভগিনীরা! ডাকে সঙ্গীরা!
তোমরা নাই গো, লাঞ্ছিত মোরা তাই আজি,
উঠুক তোমার মণি-মঞ্জীর ঘন বাজি
আমাদের পথে চল-চপল
অগ্র-পথিক তরুণ-দল, জোর কদম চল রে চল॥
নেমেছে কি রাতি, ফুরায় না পথ সুদুর্গম?
কে থামিস পথে ভগ্নোৎসাহ নিরুদ্যম?
বসে নে খানিক পথ-মঞ্জিলে, ভয় কী ভাই,
থামিলে দু-দিন ভোলে যদি লোকে – ভুলুক তাই!
মোদের লক্ষ্য চির-অটল!
অগ্র-পথিক ব্রতীর দল, বাঁধ রে বুক, চল রে চল॥
শুনিতেছি আমি, শোন ওই দূরে তূর্য-নাদ
ঘোষিছে নবীন উষার উদয়-সুসংবাদ!
ওরে ত্বরা কর! ছুটে চল আগে – আরও আগে;
গান গেয়ে চলে অগ্রবাহিনী, ছুটে চল তারও
পুরোভাগে!
তোর অধিকার কর দখল!
অগ্র-নায়ক রে পাঁওদল! জোর কদম চল রে চল॥
অঘ্রাণের সওগাত
ঋতুর খাঞ্চা ভরিয়া এল কি ধরণির সওগাত?
নবীন ধানের আঘ্রাণে আজি অঘ্রাণ হল মাত।
‘গিন্নি-পাগল’চালের ফিরনি
তশতরি ভরে নবীনা গিন্নি
হাসিতে হাসিতে দিতেছে স্বামীরে, খুশিতে কাঁপিছে হাত।
শিরনি বাঁধেন বড়ো বিবি, বাড়ি গন্ধে তেলেসমাত!
মিয়াঁ ও বিবিতে বড়ো ভাব আজি খামারে ধরে না ধান।
বিছানা করিতে ছোট বিবি রাতে চাপা সুরে গাহে গান!
‘শাশবিবি’ কন, “আহা, আসে নাই
কতদিন হল মেজলা জামাই।”
ছোট মেয়ে কয়, “আম্মা গো, রোজ কাঁদে মেজো বুবুজান!”
দলিজের পান সাজিয়া সাজিয়া সেজো-বিবি লবেজান!
হল্লা করিয়া ফিরিছে পাড়ায় দস্যি ছেলের দল।
ময়নামতীর শাড়ি-পরা মেয়ে গয়নাতে ঝলমল!
নতুন পৈঁচি-বাজুবন্দ পরে
চাষা-বউ কথা কয় না গুমোরে,
জারিগান আর গাজির গানেতে সারা গ্রাম চঞ্চল!
বউ করে পিঠা ‘পুর’-দেওয়া মিঠা, দেখে জিভে সরে জল!
মাঠের সাগরে জোয়ারের পরে লেগেছে ভাটির টান।
রাখাল ছেলের বিদায়-বাঁশিতে ঝুরিছে আমন ধান!
কৃষক-কণ্ঠে ভাটিয়ালি সুর
রোয়ে রোয়ে মরে বিদায়-বিধুর!
ধান ভানে বউ, দুলে দুলে ওঠে রূপ-তরঙ্গে বান!
বধূর পায়ের পরশে পেয়েছে কাঠের ঢেঁকিও প্রাণ!
হেমন্ত-গায় হেলান দিয়ে গো রৌদ্র পোহায় শীত!
কিরণ-ধারায় ঝরিয়া পড়িছে সূর্য – আলো-সরিৎ!
দিগন্তে যেন তুর্কি কুমারী
কুয়াশা-নেকাব রেখেছে উতারি।
চাঁদের প্রদীপ জ্বালাইয়া নিশি জাগিছে একা নিশীথ!
নতুনের পথ চেয়ে চেয়ে হল হরিত পাতারা পীত।
নবীনের লাল ঝান্ডা উড়ায়ে আসিতেছে কিশলয়,
রক্ত-নিশান নহে যে রে ওরা রিক্ত শাখার জয়!
‘মুজ্দা’ এনেছে অগ্রহায়ণ –
আসে নওরোজ খোলো গো তোরণ!
গোলা ভরে রাখো সারা বছরের হাসি-ভরা সঞ্চয়।
বাসি বিছানায় জাগিতেছে শিশু সুন্দর নির্ভয়!
কলিকাতা
১০ কার্তিক ১৩৩৩
আয় বেহেশ্তে কে যাবি আয়
আয় বেহেশ্তে কে যাবি, আয়
প্রাণের বুলন্দ দরওয়াজায়,
‘তাজা-ব-তাজা’-র গাহিয়া গান
চির-তরুণের চির-মেলায়!
আয় বেহেশ্তে কে যাবি আয়॥
যুবা-যুবতির সে দেশে ভিড়,
সেথা যেতে নারে বুঢ্ঢা পির,
শাস্ত্র-শকুন জ্ঞান-মজুর
যেতে নারে সেই হুরি-পরির
শারাব সাকির গুলিস্তাঁয়।
আয় বেহেশ্তে কে যাবি আয়॥
সেথা হরদম খুশির মৌজ,
তির হানে কালো-আঁখির ফৌজ,
পায়ে পায়ে সেথা আর্জি পেশ,
দিল চাহে সদা দিল-আফরোজ,
পিরানে পরান বাঁধা সেথায়।
আয় বেহেশ্তে কে যাবি আয়॥
করিল না যারা জীবনে ভুল,
দলিল না কাঁটা, ছেঁড়েনি ফুল,
দারোয়ান হয়ে সারা জীবন
আগুলিল বেড়া, ছুঁল না গুল, –
যেতে নারে তারা এ-জলসায়।
আয় বেহেশ্তে কে যাবি আয়॥
বুড়ো নীতিবিদ – নুড়ির প্রায়
পেল নাকো এক বিন্দু রস
চিরকাল জলে রহিয়া, হায়! –
কাঁটা বিঁধে যার ক্ষত আঙুল
দোলে ফুলমালা তারই গলায়।
আয় বেহেশ্তে কে যাবি আয়॥
তিলে তিলে যারা পিষে মারে
অপরের সাথে আপনারে,
ধরণির ঈদ-উৎসবে
রোজা রেখে পড়ে থাকে দ্বারে,
কাফের তাহারা এ-ঈদগায়!–
আয় বেহেশ্তে কে যাবি আয়॥
বুলবুল গেয়ে ফেরে বলি
যাহারা শাসায়ে ফুলবনে
ফুটিতে দিল না ফুলকলি;
ফুটিলে কুসুম পায়ে দলি
মারিয়াছে, পাছে বাস বিলায়!
হারাম তারা এ-মুশায়েরায়!
আয় বেহেশ্তে কে যাবি আয়॥
হেথা কোলে নিয়ে দিলরুবা
শারাবি গজল গাহে যুবা।
প্রিয়ার বে-দাগ কপোলে গো
এঁকে দেয় তিল মনোলোভা,
প্রেমের-পাপীর এ-মোজরায়।
আয় বেহেশতে কে যাবি আয়॥
আসিতে পারে না হেথা বে-দীন
মৃত প্রাণ-হীন জরা-মলিন
নৌ-জোয়ানীর এ-মহ্ফিল
খুন ও শারাব হেথা অ-ভিন,
হেথা ধনু বাঁধা ফুলমালায়!
আয় বেহেশ্তে কে যাবি আয়॥
পেয়ালার হেথা শহিদি খুন
তলোয়ার-চোঁয়া তাজা তরুণ
আঙ্গুর-হৃদি চুয়ানো গো
গেলাসে শারাব রাঙা অরুণ।
শহিদে প্রেমিকে ভিড় হেথায়।
আয় বেহেশ্তে কে যাবি আয়॥
প্রিয়া-মুখে হেথা দেখি গো চাঁদ,
চাঁদে হেরি প্রিয়-মুখের ছাঁদ।
সাধ করে হেথা করি গো পাপ,
সাধ করে বাঁধি বলির বাঁধ
এ রস-সাগরে বালু-বেলায়!
আয় বেহেশ্তে কে যাবি আয়॥
ঈদ-মোবারক
শত যোজনের কত মরুভূমি পারায়ে গা,
কত বালুচরে কত আঁখি-ধারা ঝরায়ে গো,
বরষের পরে আসিলে ঈদ!
ভুখারির দ্বারে সওগাত বয়ে রিজওয়ানের,
কণ্টক-বনে আশ্বাস এনে গুল-বাগের,
সাকিরে ‘জামের’ দিলে তাগিদ!
খুশির পাপিয়া পিউ পিউ গাহে দিগ্বিদিক,
বধূ জাগে আজ নিশীথ-বাসরে নির্ণিমিখ!
কোথা ফুলদানি, কাঁদিছে ফুল!
সুদূর প্রবাসে ঘুম নাহি আসে কার সখার,
মনে পড়ে শুধু সোঁদা-সোঁদা বাস এলো খোঁপার,
আকুল কবরী উলঝলুল!!
ওগো কাল সাঁঝে দ্বিতীয় চাঁদের ইশারা কোন
মুজদা১ এনেছে, সুখে ডগমগ মুকুলি মন!
আশাবরি-সুরে ঝুরে সানাই।
আতর সুবাসে কাতর হল গো পাথর-দিল,
দিলে দিলে আজ বন্ধকি দেনা – নাই দলিল,
কবুলিয়তের নাই বালাই॥
আজিকে এজিদে হাসেন হোসেন গলাগলি,
দোজখে২ ভেশতে৩ ফুলে ও আগুনে ঢলাঢলি,
শিরী ফরহাদে জড়াজড়ি।
সাপিনির মতো বেঁধেছে লায়লি কায়েসে গো,
বাহুর বন্ধে চোখ বুঁজে বঁধু আয়েসে গো!
গালে গালে চুমু গড়াগড়ি॥
দাউ দাউ জ্বলে আজি স্ফূর্তির জাহান্নাম,
শয়তান আজ ভেশতে বিলায় শারাব-জাম,
দুশমন দোস্ত এক-জামাত!
আজি আরফাত-ময়দান পাতা গাঁয়ে গাঁয়ে,
কোলাকুলি করে বাদশা-ফকিরে ভায়ে ভায়ে,
কাবা ধরে নাচে ‘লাত-মানাত’॥
আজি ইসলামি-ডঙ্কা গরজে ভরি জাহান,
নাই বড়ো ছোটো – সকল মানুষ এক সমান,
রাজা প্রজা নয় কারও কেহ।
কে আমির তুমি নওয়ার বাদশা বালাখানায়?
সকল কালের কলঙ্ক তুমি; জাগালে হায়
ইসলামে তুমি সন্দেহ॥
ইসলাম বলে, সকলের তরে মোরা সবাই,
সুখ-দুখ সম-ভাগ করে নেব সকলে ভাই,
নাই অধিকার সঞ্চয়ের!
কারও আঁখি-জলে কারও ঝাড়ে কি রে জ্বলিবে দীপ?
দুজনার হবে বুলন্দ-নসিব১, লাখে লাখে হবে বদনসিব?
এ নহে বিধান ইসলামের॥
ঈদ-অল-ফিতর আনিয়াছে তাই নববিধান,
ওগো সঞ্চয়ী, উদ্বৃত্ত যা করিবে দান,
ক্ষুধার অন্ন হোক তোমার!
ভোগের পেয়ালা উপচায়ে পড়ে তব হাতে,
তৃষ্ণাতুরের হিস্সা আছে ও পিয়ালাতে,
দিয়া ভোগ করো, বীর, দেদার॥
বুক খালি করে আপনারে আজ দাও জাকাত,২
কোরো না হিসাবি, আজি হিসাবের অঙ্কপাত!
একদিন করো ভুল হিসাব।
দিলে দিলে আজ খুনসুড়ি করে দিল্লগি,
আজিকে ছায়েলা-লায়েলা-চুমায় লাল যোগী!
জামশেদ বেঁচে চায় শারাব॥
পথে পথে আজ হাঁকিব বন্ধু, ঈদ-মোবারক! আসসালাম!
ঠোঁটে ঠোঁটে আজ বিলাব শিরনি ফুল-কালাম!
বিলিয়ে দেওয়ার আজিকে ঈদ!
আমার দানের অনুরাগে-রাঙা ঈদগা রে!
সকলের হাতে দিয়ে দিয়ে আজ আপনারে –
দেহ নয়, দিল হবে শহিদ॥
উমর ফারুক
তিমির রাত্রি –‘এশা’র আজান শুনি দূর মসজিদে
প্রিয়া-হারা কান্নার মতো এ-বুকে আসিয়া বিঁধে!
আমির-উল-মুমেনিন,
তোমার স্মৃতি যে আজানের ধ্বনি – জানে না মুয়াজ্জিন!
তকবির শুনি শয্যা ছাড়িয়া চকিতে উঠিয়া বসি,
বাতায়নে চাই – উঠিয়াছে কি রে গগনে মরুর শশী?
ও-আজানা ও কি পাপিয়ার ডাক, ও কি চকোরীর গান?
মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে ও কি ও তোমারই সে আহ্বান?
আবার লুটায়ে পড়ি!
‘সেদিন গিয়াছে’–শিয়রের কাছে কহিছে কালের ঘড়ি!
উমর! ফারুক! আখেরি নবির ওগো দক্ষিণ-বাহু!
আহ্বান নয় – রূপ ধরে এসো! – গ্রাসে অন্ধতা-রাহু
ইসলাম-রবি, জ্যোতি আজ তার দিনে দিনে বিমলিন!
সত্যের আলো নিভিয়া – জ্বলিছে জোনাকির আলো ক্ষীণ!
শুধু অঙ্গুলি-হেলনে শাসন করিতে এ জগতের
দিয়াছিলে ফেলি মুহম্মদের চরণে যে-শমশের,
ফিরদৌস ছাড়ি নেমে এসো তুমি সেই শমশের ধরি,
আর একবার লোহিত-সাগরে লালে লাল হয়ে মরি!
নওশার বেশে সাজাও বন্ধু মোদের পুনর্বার
খুনের সেহেরা পরাইয়া দাও হাতে বাঁধি হাতিয়ার!
দেখাইয়াদাও – মৃত্যু যথায় রাঙা দুলহিন৬ -সাজে
করে প্রতীক্ষা আমাদের তরে রাঙা রণ-ভূমি মাঝে!
মোদের ললাট-রক্তে রাঙিবে রিক্ত সিঁথি তাহার,
দুলাব তাহার গলায় মোদের লোহু-রাঙা তরবার!
সেনানী! চাই হুকুম!
সাত সমুদ্র তেরো নদী পারে মৃত্যু-বধূর ঘুম
টুটিয়াছে ওই যক্ষ-কারায় সহে নাকো আর দেরি,
নকিব কণ্ঠে শুনবি কখন নব অভিযান ভেরি!…
নাই তুমি নাই, তাই সয়ে যায় জমানার অভিশাপ,
তোমার তখ্তে বসিয়া করিছে শয়তান ইনসাফ !
মোরা ‘আসহাব-কাহাফের’ মতো দিবানিশি দিই ঘুম,
‘এশা’র আজান কেঁদে যায় শুধু – নিঃঝুম নিঃঝুম!
কত কথা মনে জাগে,
চড়ি কল্পনা-বোররাকে যাই তেরশো বছর আগে
যেদিন তোমার প্রথম উদয় রাঙা মরু-ভাস্কর,
আরব যেদিন হল আরাস্তা, মরীচিকা সুন্দর।
গোষ্ঠে বসিয়া বালক রাখাল মহম্মদ সেদিন
বারে বারে কেন হয়েছে উতলা! কোথা বেহেশ্তি বীণ
বাজিতেছে যেন! কে যেন আসিয়া দাঁড়িয়েছে তাঁর পিছে,
বন্ধু বলিয়া গলা জড়াইয়া কে যেন সম্ভাষিছে!
মানসে ভাসিছে ছবি –
হয়তো সেদিন বাজাইয়া বেণু মোদের বালক নবি
অকারণ সুখে নাচিয়া ফিরেছে মেষ-চরণের মাঠে!
খেলায়েছে খেলা বাজাইয়া বাঁশি মক্কার মরু বাটে!
খাইয়াছে চুমু দুম্বা শিশুরে জড়াইয়া ধরি বুকে,
উড়ায়ে দিয়েছে কবুতরগুলি আকাশে অজানা সুখে!
সূর্য যেন গো দেখিয়াছে – তার পিছনে অমারাতি
রৌশন-রাঙা করিছে কে যেন জ্বালায়ে চাঁদের বাতি।
উঠেছিল রবি আমাদের নবি, সে মহা-সৌরলোকে,
উমর, একাকী তুমি পেয়েছিলে সে আলো তোমার চোখে!
কে বুঝিবে লীলা-রসিকের খেলা! বুঝি ইঙ্গিতে তার
বেহেশ্ত-সাথি খেলিতে আসিলে ধারার পুনর্বার।
তোমার রাখাল-দোস্তের মেষ চরিত সুদূর গোঠে,
হেথা ‘আজনান’ -ময়দানে তব পরাণ ব্যথিয়া ওঠে!
কেন কার তরে এ প্রাণ-পোড়ানি নিজেই জান না বুঝি,
তোমার মাঠের উটেরা হারায়, তুমি তা দেখ না খুঁজি!
ইহারাই মাঝে বা হয়তো কখন দুঁহুঁ দোঁহা দেখেছিলে,
খেজুর-মেতির গল-হার যেন বদল করিয়া নিল,
হইলে বন্ধু মেষ-চারণের ময়দানে নিরালয়,
চকিত দেখায় চিনিল হৃদয় চির-চেনা আপনায়!
খেলার প্রভাত কাটিল কখন, ক্রমে বেলা বেড়ে চলে,
প্রভাতের মালা শুকায়ে ঝরিল খর মরু বালুতলে।
দীপ্ত জীবন মধ্যাহ্নের রৌদ্র তপ্ত পথে
প্রভাতের সখা শত্রুর বেশে আসিল রক্ত-রথে।
আরবে সেদিন ডাকিয়াছে বান, সেদিন ভূবন জুড়ি,
‘হেরা’-গুহা হতে ঠিকরিয়া ছুটি মহাজ্যোতি বিচ্ছুরি!
প্রতীক্ষমাণ তাপসী ধরণি সেদিন শুদ্ধস্নাতা
উদাত্ত স্বরে গাহিতেছিল গো কোরাণের সাম-গাথা!
পাষাণের তলে ছিল এত জল, মরুভূমে এত ঢল?
সপ্ত সাগর সাতশত হয়ে যেন করে টলমল!
খোদার হাবিব এসেছে আজিকে হইয়া মানব-মিতা,
পুণ্য-প্রভায় ঝলমল করে ধরা পাপ-শঙ্কিতা ।
সেদিন পাথারে উঠিল যে মৌজ তাহারে শাসন-হেতু
নির্ভীক যুবা দাঁড়াইলে আসি ধরি বিদ্রোহ-কেতু!
উদ্ধত রোষে তরবারি তব ঊর্দ্ধে আন্দোলিয়া
বলিলে, “রাঙাবে এ তেগ মুসলমানের রক্ত দিয়া !”
উন্মাদ বেগে চলিলে ছুটিয়া! – একী এ কী ওঠে গান?
এ কোন লোকের অমৃত মন্ত্র? কার মহা আহ্বান?
ফতেমা – তোমার সহোদরা – গাহে কোরান-অমিয়-গাথা,
এ কোন মন্ত্রে চোখে আসে জল, হায় তুমি জান না তা!
উন্মাদ-সম কেঁদে কও, “ওরে, শোনা পুন সেই বাণী!
কে শিখাল তোরে এ গান সে কোন বেহেশ্তে আনি
এ কী হল মোর? অভিনব এই গীতি শুনি হায় কেন
সকল অঙ্গ শিথিল হইয়া আসিছে আবেশে যেন!
কী যেন পুলক কী যেন আবেগ কেঁপে উঠি বারে বারে,
মানুষের দুঃখে এমন করিয়া কে কাঁদিছে কোন পারে?”
“আশহাদু আন-লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু” বলি
কহিল ফাতেমা–“এই যে কোরান, খোদার কালাম গলি
নেমেছে ভুবনে মহম্মদের অমর কণ্ঠে, ভাই!
এই ইসলাম, আমরা ইহারই বন্যায় ভেসে যাই!”…
উমর আনিল ইমান। – গরজি গরজি উঠিল স্বর
গগন পবন মন্থর করি –“আল্লাহু আকবর!”
সম্ভ্রমে-নত বিশ্ব সেদিন গাহিল তোমার স্তব –
“এসেছেন নবি, এত দিনে এল ধরায় মহামানব!”
পয়গম্বর রবি ও রুসল – এঁরা তো খোদার দান!
তুমি রাখিয়াছ, হে অতি-মানুষ, মানুষের সম্মান!
কোরান এনেছে সত্যের বাণী, সত্যে দিয়াছে প্রাণ,
তুমি রূপ – তব মাঝে সে সত্য হয়েছে অধিষ্ঠান।
ইসলাম দিল কি দান বেদনা-পীড়িত এ ধরণিরে,
কোন নব বাণী শুনাইতে খোদা পাঠাল শেষ নবিরে, –
তোমারে হেরিয়া পেয়েছি জওয়াব সেসব জিজ্ঞাসার!
কী যে ইসলাম, হয়তো বুঝিনি, এইটুকু বুঝি তার
উমর সৃজিতে পারে যে ধর্ম, আছে তার প্রয়োজন!
ওগো, মানুষের কল্যাণ লাগি তারই শুভ আগমন
প্রতীক্ষায় এ দুঃখিনী ধরা জাগিয়াছে নিশিদিন
জরা-জর্জর সন্তানে ধরি বক্ষে শান্তিহীন!
তপস্বিনীর মতো
তাহারই আশায় সেধেছে ধরণি অশেষ দুখের ব্রত।
ইসলাম – সে তো পরশ-মাণিক তারে কে পেয়েছে খুঁজি!
পরশে তাহার সোনা হল যারা তাদেরেই মোরা বুঝি।
আজ বুঝি – কেন কেন বলিয়াছিলেন শেষ পয়গম্বর –
“মোর পরে যদি নবি হত কেউ, হত সে এক উমর!”
পাওনিকো ‘ওই’, হওনিকো নবি, তাইতো পরান ভরি
বন্ধু ডাকিয়া আপনার বলি বক্ষে জড়ায়ে ধরি!
খোদারে আমরা করি গো সেজদা, রসুলে করি সালাম,
ওঁরা ঊর্ধ্বের, পবিত্র হয়ে নিই তাঁহাদের নাম,
তোমারে স্মরিতে ঠেকাই না কর ললাটে ও চোখে-মুখে
প্রিয় হয়ে আছ তুমি হতমান মানুষ জাতির বুকে।
করেছ শাসন অপরাধীদের তুমি করনিকো ক্ষমা,
করেছ বিনাশ অসুন্দরের। বলনিকো মনোরমা।
মিথ্যাময়ীরে। বাঁধনিকো বাসা মাটির ঊর্ধ্বে উঠি।
তুমি খাইয়াছ দুঃখীর সাথে ভিক্ষার খুদ খুঁটি!
অর্ধ পৃথিবী করেছ শাসন ধুলার তখ্তে বসি
খেঁজুর পাতার প্রাসাদ তোমার বারে বারে গেছে খসি
সাইমুম-ঝড়ে। পড়েছে কুঠির, তুমি পড়নিকো নুয়ে,
ঊর্ধ্বের যারা – পড়েছে তাহারা, তুমি ছিলে খাড়া ভুঁয়ে!
শত প্রলোভন বিলাস বাসন ঐশ্বর্যের মদ
করেছে সালাম দূর হতে সব, ছুঁইতে পারেনি পদ।
সবারে ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরিয়া তুমিছিলে সব নিচে,
বুকে করে সবে বেড়া করি পার, আপনি রহিলে পিছে!
হেরি পশ্চাতে চাহি –
তুমি চলিয়াছ রৌদ্রদগ্ধ দূর মরুপথ বাহি
জেরুজালেমের কিল্লা যথায় আছে অবরোধ করি
বীর মুসলিম সেনা দল তব বহু দিন মাস ধরি।
দুর্গের দ্বার খুলিবে তাহারা, বলেছে শত্রু শেষে –
উমর যদি গো সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করে এসে।
হায় রে আধেক ধরার মালিক আমিরুল-মুমেনিন
শুনে সে খবর একাকী উষ্ট্রে চলেছে বিরামহীন
সাহারা পারায়ে! ঝুলিতে দুখানা শুকনো ‘খবুজ’ রুটি,
একটি মশকে একটুকু পানি খোর্মা দু-তিন মুঠি!
প্রহরীবিহীন সম্রাট চলে একা পথে উটে চড়ি
চলিছে একটি মাত্র ভৃত্য উষ্টের রশি ধরি!
মরুর সূর্য ঊর্ধ্ব আকাশে আগুন বৃষ্টি করে,
সে আগুন-তাতে খই সম ফোটে বালুকা মরুর পরে।
কিছুদূর যেতে উট হতে নামি কহিলে ভৃত্যে, “ভাই
পেরেশান বড়ো হয়েছে চলিয়া! এইবার আমি যাই
উষ্ট্রের রশি ধরিয়া অগ্রে, তুমি উঠে বসো উটে ;
তপ্ত বালুতে চলি যে চরণে রক্ত উঠেছে ফুটে!”
…ভৃত্য দস্ত চুমি
কাঁদিয়া কহিল “উমর! কেমনে এ আদেশ করো তুমি?
উষ্ট্রের পিঠে আরাম করিয়া গোলাম রহিবে বসি
আর হেঁটে যাবে খলিফা উমর ধরি সে উটের রশি”
খলিফা হাসিয়া বলে,
“তুমি জিতে গিয়ে বড়ো হতে চাও, ভাই রে এমনই ছলে!
রোজ-কিয়ামতে আল্লা যেদিন কহিবে “উমর! ওরে,
করেনি খলিফা মুসলিম-জাঁহা তোর সুখ তরে তোরে!”
কী দিব জওয়াব, কি করিয়া মুখ দেখাব রসুলে ভাই?
আমি তোমাদের প্রতিনিধি শুধু! মোর অধিকার নাই
আরাম সুখের, – মানুষ হইয়া নিতে মানুষের সেবা!
ইসলাম বলে সকলে সমান, কে বড়ো ক্ষুদ্র কেবা!
ভৃত্য চড়িল উটের পিঠে উমর ধরিল রশি,
মানুষে স্বর্গে তুলিয়া ধরিয়া ধুলায় নামিল শশী
জানি না, সেদিন আকাশে পুষ্পবৃষ্টি হইল কিনা,
কী গান গাহিল মানুষে সেদিন বন্দি বিশ্ববাণী!
জানি না, সেদিন ফেরেশতা তব করেছে কি না স্তব, –
অনাগত কাল গিয়েছিল শুধু, “জয় জয় হে মানব!”…
আসিলে প্যালেস্টাইন, পারায়ে দুস্তর মরুভূমি,
ভৃত্য তখন উটের উপরে, রশি ধরে চল তুমি!
জর্ডন নদী হও যবে পার, শত্রুরা কহে হাঁকি –
“যার নামে কাঁপে অর্ধ পৃথিবী, এই সেই উমর নাকি?”
খুলিল রুদ্ধ দূর্গা-দুয়ার! শত্রুরা সম্ভ্রমে
কহিল –“খলিফা আসেনি, এসেছে মানুষ জেরুজালমে!”
সন্ধিপত্র স্বাক্ষর করি শত্রু-গির্জা-ঘরে
বলিলে, “বাহিরে যাইতে হইবে এইবার নামাজ তরে!”
কহে পুরোহিত, “আমাদের এই আঙিনায় গির্জায়,
পড়িলে নামাজ হবে না কবুল আল্লার দরগায় ?”
হাসিয়া বলিলেন, “তার তরে নয়, আমি যদি হেথা আজ
নামাজ আদায় করি, তবে কাল অন্ধ লোক-সমাজ
ভাবিবে – খলিফা করেছে ইশারা হেথায় নামাজ পড়ি
আজ হতে যেন এই গির্জারে মোরা মসজিদ করি!
ইসলামের এ নহেকো ধর্ম, নহে খোদার বিধান,
কারও মন্দির গির্জারে করে মজিদ মুসলমান!”
কেঁদে কহে যত ইসাই ইহুদি অশ্রু সিক্ত আঁখি –
“এই যদি হয় ইসলাম – তবে কেহ রহিবেনা বাকি,
সকলে আসিবে ফিরে
গণতন্ত্রের ন্যায় সাম্যের শুভ্র এ মন্দিরে!”
তুমি নির্ভীক এ খোদা ছাড়া করনিকো কারে ভয়
সত্যব্রত তোমায় তাইতে সবে উদ্ধত কয়।
মানুষ হইয়া মানুষের পূজা মানুষরই অপমান
তাই মহাবীর খালেদেরে তুমি পাঠাইলে ফরমান
সিপাহ-সালারে ইঙ্গিতে তব করিলে মামুলি সেনা,
বিশ্ব-বিজয়ী বীরেরে শাসিতে এতটুকু টলিলে না।
ধরাধাম ছাড়ি শেষ নবী যবে করিল মহাপ্রয়াণ,
কে হবে খালিফা – হয়নি তখনও কলহের অবসান,
নব-নন্দনী বিবি ফাতেমার মহলে আসিয়া সবে
করিতে লাগিল জটলা – ইহার পরে কে খালিফা হবে!
বজ্রকণ্ঠে তুমিই সেদিন বলিতে বলিতে পারিয়াছিলে –
“নবিসূতা! তবে মহল জ্বালাব, এ সভা ভেঙে না দিলে!”
মানব-প্রেমিক! আজিকে তোমারে স্মরি,
মনে পড়ে যত মহত্ত্ব-কথা – সেদিন সে বিভাবরী
নগর-ভ্রমণে বাহিরিয়া তুমি দেখিতে পাইলে দূরে
মায়েরে ঘিরিয়া ক্ষুধাতুর দুটি শিশু সকরুণ সুরে
কাঁদিতেছে আর দুঃখিণী মাতা ছেলেরে ভুলাতে, হায়,
উনানে শূণ্য হাঁড়ি চড়াইয়া কাঁদিয়া অকূলে চায়!
শুনিয়া সকল – কাঁদিতে কাঁদিতে ছুটে গেলে মদিনাতে
বয়তুল-মাল হইতে লইয়া ঘৃত আটা নিজ হাতে,
বলিলে, “এসব চাপাইয়া দাও আর পিঠের পরে,
আমি লয়ে যাব বহিয়া এ-সব দুখিনী মায়ের ঘরে।”
কত লোক আসি আপনি চাহিল বহিতে তোমার বোঝা,
বলিলে, “বন্ধু, আমার এ ভার আমিই বহিব সোজা!
রোজ-কিয়ামতে কে বহিবে বলো আমার পাপের ভার?
মম অপরাধে ক্ষুধায় শিশুরা কাঁদিয়াছে, আজই তার
প্রায়শ্চিত্ত করিব আপনি!” – চলিলে নিশীথ রাতে
পৃষ্ঠে বহিয়া খাদ্যের বোঝা দুখিনীর আঙিনাতে –
এত যে কোমল প্রাণ,
করুণার বশে তবু গো ন্যায়ের করনিকো অপমান!
মদ্যপানের অপরাধে প্রিয় পুত্রেরে নিজ করে
মেরেছ দোররা, মরেছে পুত্র তোমার চোখের পরে।
ক্ষমা চাহিয়াছে পুত্র, বলেছ পাষাণে বক্ষ বাঁধি –
“অপরাধ করে তোরই মত স্বরে কাঁদিয়াছে অপরাধী!”
আবু শাহমার গোরে
কাঁদিতে যাইয়া ফিরিয়া আসি গো তোমারে সালাম করে।
খাস দরবার ভরিয়া গিয়াছে হাজার দেশের লোকে,
‘কোথায় খলিফা’ কেবলই প্রশ্ন ভাসে উৎসুক চোখে,
একটি মাত্র পিরান কাচিয়া শুকায়নি তাহা বলে
রৌদ্রে ধরিয়া বসিয়া আছে গো খলিফা আঙিনা-তলে!
… হে খলিফাতুল-মুসলেমিন! হে চীরধারী সম্রাট!
অপমান তব করিব না আজ করিয়া নান্দী পাঠ,
মানুষেরে তুমি বলেছ বন্ধু, বলিয়াছ ভাই, তাই
তোমারে এমন চোখের পানিতে স্মরি গো সর্বদাই!
বন্ধু গো, প্রিয়, এ হাত তোমারে সালাম করিতে গিয়া
ওঠে না ঊর্ধ্বে, বক্ষে তোমারে ধরে শুধু জড়াইয়া!…
মাহিনা মোহররম –
হাসেন হোসেন হয়েছে শহিদ, জানে শুধু হায় কৌম,
শহিদি বাদশা! মোহর্রমে যে তুমিও গিয়াছ চলি
খুনের দরিয়া সাঁতারি – এজাতি গিয়াছে গো তাহা ভুলি!
মোরা ভুলিয়াছি, তুমি তো ভোলনি! আজও আজানের মাঝে
মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে বন্ধু, তোমারই কাঁদন বাজে
বন্ধু গো জানি, আমাদের প্রেমের আজও ও গোরের বুকে
তেমনি করিয়া কাঁদিছ হয়তো কত না গভীর দুখে!
ফিরদৌস হতে ডাকিছে বৃথাই নবি পয়গম্বর,
মাটির দুলাল মানুষের সাথে ঘুমাও মাটির পর!
হে শহিদ! বীর! এই দোয়া কর আরশের পায়া ধরি –
তোমারই মতন মরি যান হেসে খুনের সেহেরা পরি।
মৃত্যুর হতে মরিতে চাহি না, মানুষের প্রিয় করে
আঘাত খাইয়া যেন গো আমার শেষ নিঃশ্বাস পড়ে!
কলকাতা
১৬ই পৌষ ১৩৩৪
এ মোর অহংকার
এ মোর অহংকার
নাই বা পেলাম আমার গলায় তোমার গলার হার,
তোমায় আমি করব সৃজন, এ মোর অহংকার!
এমনই চোখের দৃষ্টি দিয়া
তোমায় যারা দেখল প্রিয়া,
তাদের কাছে তুমি তুমিই। আমার স্বপনে
তুমি নিখিল রূপের রানি মানস-আসনে! –
সবাই যখন তোমায় ঘিরে করবে কলরব,
আমি দূরে ধেয়ান-লোকে রচব তোমার স্তব।
রচব সুরধুনী-তীরে
আমার সুরের উর্বশীরে,
নিখিল কণ্ঠে দুলবে তুমি গানের কন্ঠ-হার –
কবির প্রিয়া অশ্রুমতী গভীর বেদনার!
যেদিন আমি থাকব নাকো, থাকবে আমার গান,
বলবে সবাই, “কে সে কবির কাঁদিয়েছিল প্রাণ?”
আকাশ-ভরা হাজার তারা
রইবে চেয়ে তন্দ্রাহারা,
সখার সাথে জাগবে রাতে, চাইবে আকাশে,
আমার গানে পড়বে মনে আমায় আভাসে!
বুকের তলা করবে ব্যথা, বলবে কাঁদিয়া,
“বন্ধু! সে কে তোমার গানের মানসী প্রিয়া?”
হাসবে সবাই, গাইবে গীতি,–
তুমি নয়ন-জলে তিতি
নতুন করে আমার গানে আমার কবিতায়
গহিন নিরালাতে বসে খুঁজবে আপনায়!
রাখতে যেদিন নারবে ধরা তোমায় ধরিয়া,
ওরা সবাই ভুলবে তোমায় দুদিন স্মরিয়া,
আমার গানের অশ্রুজলে
আমার বাণীর পদ্মদলে
দুলবে তুমি চিরন্তনী চির-নবীনা!
রইবে শুধু বাণী, সেদিন রইবে নাকো বীণা!
তৃষ্ণা-‘ফোরাত’-কূলে কবে ‘সাকিনা’১ -সমা
এক লহমার হলে বধূ, হায় মনোরমা!
মুহূর্ত সে কালের রেখা
আমার গানে রইল লেখা
চিরকালের তরে প্রিয়! মোর সে শুভক্ষণ
মরণ-পারে দিল আমায় অনন্ত জীবন।
নাই বা পেলাম কণ্ঠে আমার তোমার কণ্ঠহার,
তোমায় আমি করব সৃজন এ মোর অহংকার!
এই তো আমার চোখের জলে,
আমার গানে সুরের ছলে,
কাব্যে আমার, আমার ভাষায়, আমার বেদনায়,
নিত্যকালের প্রিয়া আমায় ডাকছ ইশারায়!…
চাই না তোমায় স্বর্গে নিতে, চাই না এ ধুলাতে
তোমার পায়ে স্বর্গ এনে ভুবন ভুলাতে!
ঊর্ধ্বে তোমার – তুমি দেবী,
কি হবে মোর সে-রূপ সেবি!
চাই না দেবীর দয়া, যাচি প্রিয়ার আঁখিজল,
একটু দুঃখে অভিমানে নয়ন টলমল!
যেমন করে খেলতে তুমি কিশোর বয়সে –
মাটির মেয়ের দিতে বিয়ে মনের হরষে,
বালু দিয়ে গড়তে গেহ,
জাগত বুকে মাটির স্নেহ,
ছিল না তো স্বর্গ তখন সূর্য তারা চাঁদ,
তেমনি করে খেলবে আবার পাতবে মায়া-ফাঁদ!
মাটির প্রদীপ জ্বালবে তুমি মাটির কুটিরে,
খুশির রঙে করবে সোনা ধূলি-মুঠিরে।
আধখানা চাঁদ আকাশ পরে
উঠবে যবে গরব-ভরে
তুমি বাকি আধখানা হাসবে ধরাতে,
তড়িৎ ছিঁড়ে পড়বে তোমার খোঁপায় জড়াতে!
তুমি আমার বকুল যূথী – মাটির তারা-ফুল
ঈদের প্রথম চাঁদ গো তোমার কানের পারসি দুল!
কুসমি-রাঙা শাড়িখানি
চৈতি সাঁঝে পড়বে রানি,
আকাশ-গাঙে জাগবে জোয়ার রঙের রাঙা বান,
তোরণ-দ্বারে বাজবে করুণ বারোয়াঁ মুলতান।
আমার-রচা গানে তোমায় সেই বেলাশেষে
এমনই সুরে চাইবে কেহ পরদেশি এসে!
রঙিন সাঁঝে ওই আঙিনায়
চাইবে যারা, তাদের চাওয়ায়
আমার চাওয়া রইবে গোপন! – এ মোর অভিমান,
যাচবে যারা তোমায়, রচি তাদের তরে গান!
নাই বা দিল ধরা আমায় ধরার আঙিনায়,
তোমায় জিনে গেলাম সুরের স্বয়ংবর-সভায়!
তোমার রূপে আমার ভুবন
আলোয় আলোয় হল মগন,
কাজ কি জেনে কাহার আশায় গাঁথছ ফুল-হার
আমি তোমায় গাঁথছি মালা এ মোর অহংকার!
কৃষ্ণনগর
২৬ চৈত্র, ১৩৩৪
খালেদ
খালেদ! খালেদ! শুনিতেছে নাকি সাহারার আহা-জারি?
কত ‘ওয়েসিস’ রচিল তাহার মরু-নয়নের বারি।
মরীচিকা তার সন্ধানী-আলো দিকে দিকে ফেরে খুঁজি
কোন নিরালায় ক্লান্ত সেনানী ডেরা গাড়িয়াছ বুঝি!
বালু-বোররাকে সওয়ার হইয়া ডাক দিয়া ফেরে ‘লু’,
তব তরে হায়! পথে রেখে যায় মৃগীরা মেশক-বু!
খর্জুর-বীথি আজিও ওড়ায় তোমার জয়ধ্বজা,
তোমার আশায় বেদুইন-বালা আজিও রাখিছে রোজা।
‘মোতাকারিব’-এর ছন্দে উটের সারি দুলে দুলে চলে,
দু-চোখ তাদের দিশাহারা পথে আলেয়ার মতো জ্বলে।
‘খালেদ! খালেদ!’পথ-মঞ্জিলে ক্লান্ত উটেরা কহে,
“বণিকের বোঝা বহা তো মোদের চিরকেলে পেশা নহে!”
‘সুতুর-বানের’ বাঁশি শুনে উট উল্লাস-ভরে নাচে,
ভাবে, নকিবের বাঁশরির পিছে রণ-দামামাও আছে।
ন্যুব্জ এ পিঠ খাড়া হত তার সওয়ারের নাড়া পেয়ে,
তলওয়ার তির গোর্জ নেজায় পিঠ যেত তার ছেয়ে।
খুন দেখিয়াছে, তূণ বহিয়াছে, নুন বহেনিকো কভু!
* * *
বালু ফেড়ে ওঠে রক্ত-সূর্য ফজরের শেষে দেখি,
দুশমান-খুনে লাল হয়ে ওঠে খালেদি আমামা এ কী!
খালেদ! খালেদ! ভাঙিবে নাকি ও হাজার বছরি ঘুম?
মাজার ধরিয়া ফরিয়াদ করে বিশ্বের মজলুম!–
শহিদ হয়েছ? ওফাত হয়েছে? ঝুটবাত! আলবত!
খালেদের জান কব্জ করিবে ওই মালেকুল-মৌত?
বছর গিয়াছে গেছে শতাব্দী যুগযুগান্ত কত,
জালিম৯ পারসি রোমক রাজার জুলুম সে শত শত
রাজ্য ও দেশ গেছে ছারেখারে! দুর্বল নরনারী
কোটি কোটি প্রাণ দিয়াছে নিত্য কত্ল-গাহেতে তারই!
উৎপীড়িতের লোনা আঁসু-জলে গলে গেল কত কাবা,
কত উজ তাতে ডুবে মলো হায়, কত নূহ্ হল তাবা!
সেদিন তোমার মালেকুল-মৌত কোথায় আছিল বসি?
কেন সে তখন জালিম রাজার প্রাসাদে প্রাসাদে পশি
বেছে বেছে ওই ‘সঙ্গ্-দিল’দের কব্জ করেনি জান?
মালেকুল-মৌত সেদিনও মেনেছে বাদশাহি ফরমান!–
মক্কার হাতে চাঁদ এল যবে তকদিরে আফতাব
কুল-মখলুক দেখিতে লাগিল শুধু ইসলামি খাব,
শুকনো খবুজ খোর্মা চিবায়ে উমর দারাজ-দিল
ভাবিছে কেমন খুলিবে আরব দিন-দুনিয়ার খিল, –
এমন সময় আসিল জোয়ান হাথেলিতে হাথিয়ার,
খর্জুর-শিষে ঠেকিয়াছে গিয়া উঁচা উষ্ণীয় তার!
কব্জা তাহার সব্জা হয়েছে তলওয়ার-মুঠ ডলে,
দু-চোখ ঝালিয়া আশায় দজ্লা ফোরাত পড়িছে গলে!
বাজুতে তাহার বাঁধা কোর-আন, বুকের দুর্মদ বেগ,
আলবোরজের চূড়া গুঁড়া-করা দস্তে দারুণ তেগ।
নেজার৪ ফলক উল্কার সম উগ্রগতিতে ছোটে,
তির খেয়ে তার আশমান-মুখে তারা-রূপে ফেনা ওঠে।
দারাজ দস্ত যেদিকে বাড়ায় সেইদিক পড়ে ভেঙে,
ভাস্কর-সম যেদিকে তাকায় সেইদিক ওঠে রেঙে!
ওলিদের বেটা খালেদ সে বীর যাহার নামের ত্রাসে
পারস্য-রাজ নীল হয়ে উঠে ঢলে পড়ে সাকি-পাশে!
রোম-সম্রাট শারাবের জাম -হাতে থরথর কাঁপে,
ইস্তাম্বুলি বাদশার যত নজ্জুম আয়ু মাপে!
মজলুম যত মোনাজাত করে কেঁদে কয় “এয়্ খোদা,
খালেদের বাজু-শমশের রেখো সহি-সালামতে সদা।”
আজরাইলও সে পারেনি এগুতে যে আজাজিলের আগে,
ঝুঁটি ধরে তার এনেছে খালেদ, ভেড়ি ধরে যেন বাঘে!
মালেকুল-মৌত করিবে কব্জ রু্হ্ সেই খালেদের?–
হাজার হাজার চামড়া বিছায়ে মাজারে ঘুমায় শের!
খালেদ! খালেদ! ফজর হল যে, আজান দিতেছে কৌম,
ওই শোনো শোনো –”আস্সালাতু খায়র মিনান্নৌম!”
যত সে জালিম রাজা-বাদশারে মাটিতে করেছে গুম
তাহাদেরই সেই খাকেতে খালেদ করিয়া তয়ম্মুখ
বাহিরিয়া এসো, হে রণ-ইমাম, জামায়েত আজ ভারী!
আরব, ইরান, তুর্ক, কাবুল দাঁড়ায়েছে সারি সারি!
আব-জমজম উথলি উঠিছে তোমার ওজুর তরে,
সারা ইসলাম বিনা ইমামেতে আজিকে নামাজ পড়ে!
খালেদ! খালেদ! ফজরে এলে না, জোহরকাটানু কেঁদে,
আসরে ক্লান্ত ঢুলিয়াছি শুধু বৃথা তহ্রিমা বেঁধে!
এবে কাফনের খেলকা পরিয়া চলিয়াছি বেলা-শেষে,
মগ্রেবের আজ নামাজ পড়িব আসিয়া তোমার দেশে!
খালেদ! খালেদ! সত্য বলিব, ঢাকিব না আজ কিছু,
সফেদ দেও আজ বিশ্ববিজয়ী, আমরা হটেছি পিছু!
তোমার ঘোড়ার খুরের দাপটে মরেছে যে পিপীলিকা,
মোরা আজ দেখি জগৎ জুড়িয়া তাহাদেরই বিভীষিকা!
হঠিতে হঠিতে আসিয়া পড়েছি আখেরি গোরস্থানে,
মগ্রেব-বাদে এশার১ নামাজ পাব কিনা কে সে জানে!
খালেদ! খালেদ! বিবস্ত্র মোরা পরেছি কাফন শেষে,
হাথিয়ার-হারা, দাঁড়ায়েছি তাই তহ্রিমা বেঁধে এসে!
ইমামতি তুমি করিবে না জানি, তুমি গাজি মহাবীর,
দিন-দুনিয়ার শহিদ নোয়ায় তোমার কদমে শির!
চারিটি জিনিস চিনেছিলে মতুমি, জানিতে না হের-ফের,
আল্লা, রসুল, ইসলাম আর শের-মারা শমশের!
খিলাফত তুমি চাওনিকো কভু চাহিলে – আমরা জানি, –
তোমার হাতের বে-দেরেগ৩ তেগ অবহেলে দিত আনি!
উমর যেদিন বিনা অজুহাতে পাঠাইল ফরমান, –
“সিপাহ্-সালার খালেদ পাবে না পূর্বের সম্মান,
আমার আদেশ – খালেদ ওলিদ সেনাপতি থাকিবে না,
সাদের অধীনে করিবে যুদ্ধ হয়ে সাধারণ সেনা!”
ঝরা জলপাই-পাতার মতন কাঁপিতে কাঁপিতে সাদ,
দিল ফরমান, নফসি নফসি জপে, গণে পরমাদ!
খালেদ! খালেদ! তাজিমের সাথে ফরমান পড়ে চুমি
সিপাহ-সালারের সকল জেওরখুলিয়া ফেলিলে তুমি।
শিশুর মতন সরল হাসিতে বদন উজালা করি
একে একে সব রেখে দিলে তুমি সাদের চরণ পরি!
বলিলে, “আমি তো সেনাপতি হতে আসিনি, ইবনে সাদ,
সত্যের তরে হইব শহিদ, এই জীবনের সাধ!
উমরের নয়, এ যে খলিফার ফরমান, ছি ছি আমি
লঙ্ঘিয়া তাহা রোজ-কিয়ামতে হব যশ-বদনামি?”
মার মুখো যত সেনাদলে ডেকে ইঙ্গিতে বুঝাইলে,
কুর্নিশ করি সাদেরে, মামুলি সেনাবাসে ডেরা নিলে!
সেনাদের চোখে আঁসু ধরে না কো, হেসে কেঁদে তারা বলে, –
“খালেদ আছিল মাথায় মোদের, এবার আসিল কোলে!”
মক্কায় যবে আসিলে ফিরিয়া, উমর কাঁদিয়া ছুটে,
এ কী রে, খলিফা কাহার বক্ষে কাঁদিয়া পড়িল লুটে!
“খালেদ! খালেদ!” ডাকে আর কাঁদে উমর পাগল-প্রায়
বলে, “সত্যই মহাবীর তুই, বুসা দিই তোকে, আয়!
তখ্তের পর তখ্ত যখন তোমার তেগের আগে
ভাঙিতে লাগিল, হাতুড়ি যেমন বাদামের খোসা ভাঙে, –
ভাবিলাম বুঝি তোমারে এবার মুগ্ধ আরব-বাসী
সিজদা করিবে, বীরপূজা বুঝি আসিল সর্বনাশী!
পরীক্ষা আমি করেছি খালেদ, ক্ষমা চাই ভাই ফের,
আজ হতে তুমি সিপাহ-সালার ইসলাম জগতের!”
খালেদ! খালেদ! কীর্তি তোমার ভুলি নাই মোরা কিছু,
তুমি নাই তাই ইসলাম আজ হটিতেছে শুধু পিছু।
পুরানো দামামা পিটিয়া পিটিয়া ছিঁড়িয়ে গিয়াছে আজ,
আমামা অস্ত্র ছিল নাকো তবু দামামা ঢাকিত লাজ!
দামামা তো আজ ফাঁসিয়া গিয়াছে, লজ্জা কোথায় রাখি,
নামাজ রোজার আড়ালেতে তাই ভীরুতা মোদের ঢাকি!
খালেদ! খালেদ! লুকাব না কিছু, সত্য বলিব আজি,
ত্যাগী ও শহিদ হওয়া ছাড়া মোরা আর সব হতে রাজি!
রীশ-ই বুলন্দ্, শেরওয়ানি, চোগা, তসবি ও টুপি ছাড়া
পড়ে নাকো কিছু, মুসলিম-গাছ ধরে যত দাও নাড়া!
* * *
খালেদ! খালেদ! সবার অধম মোরা হিন্দুস্থানি,
হিন্দু না মোরা মুসলিম তাহা নিজেরাই নাহি জানি!
সকলে শেষে হামাগুড়ি দিই, –না, না, বসে বসে শুধু
মুনাজাত৬করি, চোখের সুমুখে নিরাশা-সাহারা ধুধু!
দাঁড়ায়ে নামাজ পড়িতে পারি না, কোমর গিয়াছে টুটি,
সিজদা করিতে ‘বাবা গো’বলিয়া ধূলিতলে পড়ি লুটি!
পিছন ফিরিয়া দেখি লাল-মুখ আজরাইলের ভাই,
আল্লা ভুলিয়া বলি, “প্রভু মোর তুমি ছাড়া নাই।”
টক্কর খেতে খেতে শেষে এই আসিয়া পড়েছি হেথা,
খালেদ! খালেদ! রি রি করে বুকে পরাধীনতার ব্যথা!
বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে আমরা তখনও বসে
বিবি-তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি ফেকা ও হাদিস চষে!
হানফী, ওহাবী, লা-মজহাবীর৯ তখনও মেটেনি গোল,
এমন সময় আজাজিল এসে হাঁকিল, ‘তল্পি তোল!’
ভিতরের দিকে যত মরিয়াছি, বাহিরের দিকে তত
গুনতিতে মোড়া বাড়িয়া চলেছি গোরু ছাগলের মতো!
খালেদ! খালেদ! এই পশুদের চামড়া দিয়ে কি তবে
তোমার পায়ের দুশমন-মারা দুটো পয়জারও হবে?
হায় হায় হায়, কাঁদে সাহারায় আজিও তেমনই ও কে?
দজলা-ফোরাত নতুন করিয়া মাতম করিছে শোকে!
খর্জুর পেকে খোর্মা হইয়া শুকায়ে পড়েছে ঝুরে
আঙুর বেদানা নতুন করিয়া বেদনার রসে পুরে।
এক রাশ শুখো আখরোট আর বাদাম ছাড়াতে লয়ে
আঙুল ছেঁচিয়া মুখ দিয়া চুষে মৌনা আরবি-বউয়ে!
জগতের সেরা আরবের তেজি যুদ্ধ-তাজির চালে
বেদুইন-কবি সংগীত রচি নাচিতেছে তালে তালে!
তেমনই করিয়া কাবার মিনারে চড়িয়া মুয়াজ্জিন
আজানের সুরে বলে, কোনোমতে আজও বেঁচে আছে দ্বীন!
খালেদ! খালেদ! দেখো দেখো ওই জমাতের পিছে কারা
দাঁড়ায়ে রয়েছে, নড়িতে পারে না, আহা রে সর্বহারা!
সকলের পিছে নহে বটে তবু জমাত-শামিল নয়,
উহাদের চোখে হিন্দের মতো নাই বটে নিদ্-ভয়!
পিরানের সব দামন ছিন্ন, কিন্তু সে সম্মুখে
পেরেশান৪ ওরা তবু দেখিতেছি ভাঙিয়া পড়েনি দুখে!
তকদির বেয়ে খুন ঝরে ওই উহারা মেসেরি বুঝি।
টলে তবু চলে বারে বারে হারে বারে বারে ওরা যুঝি।
এক হাতে বাঁধা হেম-জিঞ্জির আর এক হাত খোলা
কী যেন হারামি নেশার আবেশে চক্ষু ওদের ঘোলা!
ও বুঝি ইরাকি? খালেদ! খালেদ! আরে মজা দেখো, ওঠো,
শ্বেত-শয়তান ধরিয়াছে আজ তোমার তেগের মুঠো!
দুহাতে দুপায়ে আড়-বেড়ি দেওয়া ও কারা চলিতে নারে,
চলিতে চাহিলে আপনার ভায়ে পিছন হইতে মারে।
মরদের মতো চেহারা ওদের স্বাধীনের মতো বুলি,
অলস দু-বাজু দু-চোখ সিয়াহ অবিশ্বাসের ঠুলি!
শামবাসী৭ ওরা সহিতে শেখেনি পরাধীনতার চাপ,
তলওয়ার নাই, বহিছে কটিতে কেবল শূন্যে খাপ!
খালেদ! খালেদ! মিসমার হল তোমার ইরাক শাম,
জর্ডন নদে ডুবিয়াছে পাক জেরুজালেমের নাম!
খালেদ! খালেদ! দুধারি তোমার কোথা সেই তলোয়ার?
তুমি ঘুমায়েছ, তলোয়ার তব সে তো নহে ঘুমাবার!
জং ধরেনিকো কখনও তাহাতে জঙ্গের খুনে নেয়ে,
হাথেলিতে তব নাচিয়া ফিরেছে যেন বেদুইন মেয়ে!
খাপে বিরামের অবসর তার মেলেনি জীবনে কভু,
জুলফিকার৩ সে দুখান হয়েছে, ও তেগ টুটেনি তবু।
তুমি নাই তাই মরিয়া গিয়াছে তরবারিও কি তব?
হাত গেছে বলে হাত-যশও গেল? গল্প এ অভিনব!
খালেদ! খালেদ! জিন্দা হয়েছে আবার হিন্দা৪ বুড়ি,
কত হামজারে মারে জাদুকরি, দেশে দেশে ফেরে উড়ি!
ও কারা সহসা পর্বত ভেঙে তুহিন স্রোতের মতো,
শত্রুর শিরে উন্মদবেগে পড়িতেছে অবিরত!
আগুনের দাহে গলিছে তুহিন আবার জমিয়া উঠে,
শির উহাদের ছুটে গেল হায়! তবু নাহি পড়ে টুটে!
ওরা মরক্কো মরদের জাত মৃত্যু মুঠার পরে,
শত্রুর হাতে শির দিয়া ওরা শুধু হাতে পায়ে লড়ে!
খালেদ! খালেদ! সর্দার আর শির পায় যদি মূর
খাসা জুতো তারা করিবে তৈরি খাল দিয়া শত্রুর!
খালেদ! খালেদ! জাজিরাতুল সে আরবের পাক মাটি
পলিদ হইল, খুলেছে এখানে যুরোপ পাপের ভাঁটি!
মওতের দারু পিইলে ভাঙে না হাজার বছরি ঘুম?
খালেদ! খালেদ! মাজার আঁকড়ি কাঁদিতেছে মজলুম।
খোদার হাবিব বলিয়া গেছেন আসিবেন ইসা ফের,
চাই না মেহেদি, তুমি এসো বীর হাতে নিয়ে শমশের।
কৃষ্ণনগর,
২১ অগ্রহায়ণ, ’৩৩
খোশ আমদেদ
আসিলে কে গো অতিথি উড়ায়ে নিশান সোনালি।
ও চরণ ছুঁই কেমন হাতে মোর মাখা যে কালি॥
দখিনের হালকা হাওয়ায় আসলে ভেসে সুদূর বরাতি
শবে-রাত আজ উজালা গো আঙিনায় জ্বলল দীপালি॥
তালিবান ঝুমকি বাজায়, গায় মোবারক-বাদ৪ কোয়েলা।
উলসি উপচে পলো পলাশ অশোক ডালের ওই ডালি॥
প্রাচীন ওই বটের ঝুরির দোলনাতে হায় দুলিছে শিশু।
ভাঙা ওই দেউল-চূড়ে উঠল বুঝি নৌ-চাঁদের ফালি॥
এল কি অলখ-আকাশ বেয়ে তরুণ হারুণ-আল-রশীদ।
এল কি আল-বেরুনি হাফিজ খৈয়াম কায়েস গাজ্জালি৫॥
সানাইয়াঁ ভয়রোঁ বাজায়, নিদ-মহলায় জাগল শাহজাদি।
কারুণের রুপার পুরে নূপুর-পায়ে আসল রূপ-ওয়ালি।
খুশির এ বুলবুলিস্তানে মিলেছে ফরহাদ ও শিরীঁ।
লাল এ লায়লি লোকে মজনুঁ হরদম চালায় পেয়ালি॥
বাসি ফুল কুড়িয়ে মালা না-ই গাঁথিলি, রে ফুল-মালি!
নবীনের আসার পথে উজাড় করে দে ফুল ডালি॥
পদ্মা
২৭.২.২৭
জীবন
জাগরণের লাগল ছোঁয়াচ মাঠে মাঠে তেপান্তরে,
এমন বাদল ব্যর্থ হবে তন্দ্রাকাতর কাহার ঘরে?
তড়িৎ ত্বরা দেয় ইশারা, বজ্র হেঁকে যায় দরজায়,
জাগে আকাশ, জাগে ধরা−ধরার মানুষ কে সে ঘুমায়?
মাটির নীচে পায়ের তলায় সেদিন যারা ছিল মরি,
শ্যামল তৃণাঙ্কুরে তারা উঠল বেঁচে নতুন করি;
সবুজ ধরা দেখছে স্বপন আসবে কখন ফাগুন-হোলি,
বজ্রাঘাতে ফুটল না যে, ফুটবে আনন্দে সে কলি!
নওরোজ
রূপেরে সওদা কে করিবি তোরা আয় রে আয়,
নওরোজের এই মেলায়!
ডামাডোল আজি চাঁদের হাট
লুট হল রূপ হল লোপাট!
খুলে ফেলে লাজ শরম-টাট
রূপসিরা সব রূপ বিলায়
বিনি-কিম্মতে হাসি-ইঙ্গিতে হেলাফেলায়
নওরোজের এই মেলায়!
শা-জাদা উজির নওয়াব-জাদারা – রূপকুমার
এই মেলার খরিদ-দার!
নও-জোয়ানীর জহুরি ঢের
খুঁজিছে বিপণি জহরতের,
জহরত নিতে – টেড়া আঁখের
জহর কিনিছে নির্বিকার!
বাহানা করিয়া ছোঁয় গো পিরান জাহানারার
নওরোজের রূপকুমার!
ফিরি করে ফেরে শা-জাদি বিবি ও বেগম সাব
চাঁদ-মুখের নাই নেকাব?
শূন্য দোকানে পসারিনি
কে জানে কী করে বিকি-কিনি!
চুড়ি-কঙ্কণে রিনিঠিনি
কাঁদিছে কোমল কড়ি রেখাব।
অধরে অধরে দর-কষাকষি–নাই হিসাব!
হেম-কপোল লাল গোলাব।
হেরেম-বাঁদিরা দেরেম১ ফেলিয়া মাগিছে দিল,
নওরোজের নও-মফিল!
সাহেব গোলাম, খুনি আশেক,
বিবি বাঁদি, –সব আজিকে এক!
চোখে চোখে পেশ দাখিলা চেক
দিলে দিলে মিল এক সামিল।
বে-পরওয়া আজ বিলায় বাগিচা ফুল-তবিল!
নওরোজের নও-মফিল!
ঠোঁটে ঠোঁটে আজ মিঠি শরবত ঢাল উপুড়,
রণ-ঝনায় পায় নূপুর।
কিসমিস-ছেঁচা আজ অধর,
আজিকে আলাপ ‘মোখতসর’!
কার পায়ে পড়ে কার চাদর,
কাহারে জড়ায় কার কেয়ূর,
প্রলাপ বকে গো কলাপ মেলিয়া মন-ময়ূর,
আজ দিলের নাই সবুর।
আঁখির নিক্তি করিছে ওজন প্রেম দেদার
ভার কাহারা অশ্রু-হার।
চোখে চোখে আজ চেনাচেনি,
বিনি মূলে আজ কেনাকেনি,
নিকাশ করিয়া লেনাদেনি
‘ফাজিল কিছুতে কমে না আর!
পানের বদলে মুন্না মাগিছে পান্না-হার!
দিল সবার ‘বে-কারার৩!
সাধ করে আজ বরবাদ করে দিল সবাই
নিমখুন কেউ কেউ জবাই!
লিকপিক করে ক্ষীণ কাঁকাল,
পেশোয়াজ কাঁপে টালমাটাল,
গুরু ঊরু-ভারে তনু নাকাল,
টলমল আঁখি জল-বোঝাই!
হাফিজ উমর শিরাজ পালায়ে লেখে ‘রুবাই’!
নিমখুন কেউ কেউ জবাই!
শিরী লায়লিরে খোঁজ ফরহাদ খোঁজে কায়েস
নওরোজের এই সে দেশ!
ঢুড়েঁ ফেরে হেথা যুবা সেলিম
নূরজাহানের দূর সাকিম,
আরংজিব আজ হইয়া ঝিম
হিয়ায় হিয়ায় চাহে আয়েস!
তখ্ত-তাউস কোহিনূর কারও নাই খায়েশ,
নওরোজের এই সে দেশ!
গুলে-বকৌলি ঊর্বশীর এ চাঁদনি-চক,
চাও হেথায় রূপ নিছক।
শারাব সাকি ও রঙে রূপে
আতর লোবান ধুনা ধূপে
সয়লাব সব যাক ডুবে,
আঁখি-তারা হোক নিষ্পলক।
চাঁদো মুখে আঁকো কালো কলঙ্ক তিল-তিলক।
চাও হেথায় রূপ নিছক!
হাসিস-নেশায় ঝিম মেরে আছে আজ সকল
লাল পানির রংমহল।
চাঁদ-বাজারে এ নওরোজের
দোকান বসেছে মোমতাজের
সওদা করিতে এসেছে ফের
শাজাহান হেথা রূপ-পাগল।
হেরিতেছে কবি সুদূরের ছবি
ভবিষ্যতের তাজমহল–
নওরোজের স্বপ্ন-ফল!
নাকিব
নব-জীবনের নব-উত্থান-আজান ফুকারি এসো নকিব।
জাগাও জড়! জাগাও জীব!
জাগে দুর্বল, জাগে ক্ষুধা-ক্ষীণ,
জাগিছে কৃষাণ ধুলায়-মলিন,
জাগে গৃহহীন, জাগে পরাধীন
জাগে মজলুম বদ-নসিব!
মিনারে মিনারে বাজে আহ্বান –
‘আজ জীবনের নব উত্থান!’
শঙ্কাহরণ জাগিছে জোয়ান
জাগে বলহীন জাগিছে ক্লীব,
নব জীবনের নব উত্থান –
আজান ফুকারি এসো নকিব!
হুগলি,
১৩ অগ্রহায়ণ, ১৩৩২
বার্ষিক সওগাত
বন্ধু গো সাকি আনিয়াছ নাকি বরষের সওগাত –
দীর্ঘ দিনের বিরহের পরে প্রিয়-মিলনের রাত।
রঙিন রাখি, শিরীন শারাব, মুরলী, রবাব, বীণ,
গুলিস্তানের বুলবুল পাখি, সোনালি রুপালি দিন।
লালা-ফুল সম দাগ-খাওয়া দিল, নার্গিস-ফুলি আঁখ,
ইস্পাহানির হেনা-মাখা হাত, পাতলি কাঁখ!
নৈশাপুরের গুলবদনির চিবুক গালের টোল,
রাঙা লেড়কির ভাঙা ভাঙা হাসি, শিরীন শিরীন বোল।
সুরমা-কাজল স্তাম্বুলি চোখ, বসোরা গুলের লালি,
নব বোগাদাদি আলিফ-লায়লা, শাজাদি জুলফ-ওয়ালি।
পাকা খর্জুর, ডাঁশা আঙ্গুর, টোকো-মিঠে কিসমিস,
মরু-মঞ্জীর আব-জমজম,যবের ফিরোজা শিস।
আশা-ভরা মুখ,তাজা তাজা বুক, নৌ-জোয়ানির গান,
দুঃসাহসীর মরণ-সাধনা, জেহাদের অভিযান।
আরবের প্রাণ, ফারেসের বাজু নৌ-তুর্কির,
দারাজ দিলীর আফগানি দিল, মূরের জখমি শির।
নীল দরিয়ায় মেসেরের আঁসু, ইরাকের টুটা তখ্ত,
বন্দী শামের জিন্দান-খানা, হিন্দের বদবখ্ত! –
তাঞ্জাম-ভরা আঞ্জাম এ যে কিছুই রাখনি বাকি,
পুরানো দিনের হাতে বাঁধিয়াছ নতুন দিনের রাখি।…
চোখের পানির ঝালর-ঝুলানো হাসির খাঞ্চাপোশ
– যেন অশ্রুর গড়খাই-ঘেরা দিল্খোস ফেরদৌস –
ঢাকিয়ো বন্ধু তব সওগাতি-রেকাবি তাহাই দিয়ে,
দিবসের জ্বালা ভুলে যেতে চাই রাতের শিশির পিয়ে !
বেদনার বানে সয়লাব সব, পাইনে সাথির হাত,
আনো গো বন্ধু নূহের কিশতি– ‘বার্ষিকী সওগাত!’
[কৃষ্ণনগর
২৫ অগ্রহায়ণ,১৩৩৩]
ভীরু
১
আমি জানি তুমি কেন চাহ নাকো ফিরে।
গৃহকোণ ছাড়ি আসিয়াছ আজ দেবতার মন্দিরে।
পুতুল লইয়া কাটিয়াছে বেলা
আপনারে লয়ে শুধু হেলা-ফেলা,
জানিতে না, আজ হৃদয়ের খেলা আকুল নয়ন-নীরে,
এত বড়ো দায় নয়নে নয়নে নিমেষের চাওয়া কি রে?
আমি জানি তুমি কেন চাহ নাকো ফিরে॥
২
আমি জানি তুমি কেন চাহ নাকো ফিরে।
জানিতে না আখিঁ আঁখিতে হারায় ডুবে যায় বাণী ধীরে।
তুমি ছাড়া আর ছিল নাকো কেহ
ছিল না বাহির ছিল শুধু গেহ,
কাজল ছিল গো জল ছিল না, ও উজল আঁখির তীরে।
সেদিনও চলিতে ছলনা বাজেনি ও-চরণ-মঞ্জীরে!
আমি জানি তুমি কেন চাহ নাকো ফিরে।॥
৩
আমি জানি তুমি কেন চাহ নাকো ফিরে।
সেদিনও তোমার বনপথে যেতে পায়ে জড়াত না লতা।
সেদিনও বেভুল তুলিয়াছ ফুল
ফুল বিঁধিতে গো, বিঁধেনি আঙুল,
মালার সাথে যে হৃদয়ও শুকায়, জানিতে না সে বারতা।
জানিতে না, কাঁদে মুখর মুখের আড়ালে নিঃসঙ্গতা
আমি জানি তুমি কেন কহ নাকো কথা॥
৪
আমি জানি তব কপটতা, চতুরালি!
তুমি জানিতে না, ও কপোলে থাকে ডালিম দানার লালি!
জানিতে না ভীরু রমণীর মন
মধুকর-ভারে লতার মতন
কেঁপে মরে কথা কন্ঠে জড়ায়ে নিষেধ করে গো খালি।
আঁখি যত চায় তত লজ্জায় লজ্জা পাড়ে গো গালি!
আমি জানি তব কপটতা, চতুরালি!
৫
আমি জানি, ভীরু! কীসের এ বিস্ময়।
জানিতে না কভু নিজেরে হেরিয়া নিজেরই করে যে ভয়।
পুরুষ পুরুষ–শুনেছিলে নাম,
দেখেছ পাথর করনি প্রণাম,
প্রণাম করেছ লুব্ধ দু-কর চেয়েছে চরণ ছোঁয়।
জানিতে না, হিয়া পাথর পরশি পরশ-পাথরও হয়!
আমি জানি, ভীরু, কীসের এ বিষ্ময়॥
৬
কীসের তোমার শঙ্কা এ, আমি জানি।
পরাণের ক্ষুধা দেহের দু-তীরে করিতেছে কানাকানি।
বিকচ বুকের বকুল-গন্ধ
পাপড়ি রাখিতে পারে না বন্ধ,
যত আপনারে লুকাইতে চাও তত হয় জানাজানি।
অপাঙ্গে আজ ভিড় করেছে গো লুকানো যতেক বাণী।
কীসের তোমার শঙ্কা এ, আমি জানি॥
৭
আমি জানি, কেন বলিতে পার না খুলি।
গোপনে তোমায় আবেদন তার জানায়েছে বুলবুলি।
যে-কথা শুনিতে মনে ছিল সাধ
কেমনে সে পেল তারই সংবাদ?
সেই কথা বঁধু তেমনই করিয়া বলিল নয়ন তুলি।
কে জানিত এত জাদু-মাখা তার ও কঠিন অঙ্গুলি।
আমি জানি কেন বলিতে পার না খুলি॥
৮
আমি জানি কেন যে নিরাভরণা,
ব্যাথার পরশে হয়েছে তোমরা সকল অঙ্গ সোনা।
মাটির দেবীরে পরায় ভূষণ,
সোনার সোনায় কীবা প্রয়োজন?
দেহ-কূল ছাড়ি নেমেছে মনের অকূল নিরঞ্জনা।
বেদনা আজিকে রূপেরে তোমার করিতেছে বন্দনা।
আমি জানি তুমি কেন যে নিরাভরণা॥
৯
আমি জানি, ওরা বুঝিতে পারে না তোরে।
নিশীথে ঘুমালে কুমারী বালিকা, বধূ জাগিয়াছে ভোরে!
ওরা সাঁতরিয়া ফিরিতেছে ফেনা,
শুক্তি যে ডোব – বুঝিতে পারে না!
মুক্তা ফলেছে – আঁখির ঝিনুক ডুবেছে আঁখির লোরে।
বোঝা কত ভার হলে – হৃদয়ের ভরাডুবি হয়, ওরে,
অভাগিনি নারী, বুঝাবি কেমন করে॥
কৃষ্ণনগর
৩২ শ্রাবণ, ১৩৩৪
মিসেস এম. রহমান
মোহর্রমের চাঁদ ওঠার তো আজিও অনেক দেরি,
কেন কারবালা-মাতম উঠিল এখনই আমায় ঘেরি?
ফোরাতের মৌজ ফোঁপাইয়া ওঠে কেন গো আমার চোখে!
নিখিল-এতিম২ ভিড় করে কাঁদে আমার মানস-লোকে!
মর্সিয়া-খান৩! গাস নে অকালে মর্সিয়া শোকগীতি,
সর্বহারার অশ্রু-প্লাবনে সয়লাব হবে ক্ষিতি!…
আজ যবে হায় আমি
কুফার৪ পথে গো চলিতে চলিতে কারবালা-মাঝে থামি,
হেরি চারিধারে ঘিরিয়াছে মোরে মৃত্যু-এজিদ-সেনা,
ভায়েরা আমার দুশমন-খুনে মাখিতেছে হাতে হেনা,
আমি শুধু হায় রোগ-শয্যায় বাজু কামড়ায়ে মরি!
দানা-পানি নাই পাতার খিমায়৫ নির্জীব আছি পড়ি!
এমন সময় এল ‘দুলদুল’পৃষ্ঠে শূন্য জিন,
শূন্যে কে যেন কাঁদিয়া উঠিল – ‘জয়নাল আবেদিন!’
শীর্ণ-পাঞ্জা দীর্ণ-পাঁজর পর্ণকুটির ছাড়ি
উঠিতে পড়িতে ছুটিয়া আসিনু, রুধিল দুয়ার দ্বারী!
বন্দিনী মার ডাক শুনি শুধু জীবন-ফোরাত-পারে,
“এজিদের বেড়া পারায়ে এসেছি, জাদু তুই ফিরে যারে!”
কাফেলা১ যখন কাঁদিয়া উঠিল তখন দুপুর নিশা !–
এজিদে পাইব, কোথা পাই হায় আজরাইলের২ দিশা ! –
জীবন ঘিরিয়া ধু ধু করে আজ শুধু সাহারার বালি,
অগ্নি-সিন্ধু করিতেছি পান দোজখ করিয়া খালি !
আমি পুড়ি, সাথে বেদনাও পুড়ে, নয়নে শুকায় পানি,
কলিজা চাপিয়া তড়পায় শুধু বুক-ভাঙা কাতরানি !
মাতা ফাতেমার লাশের ওপর পড়িয়া কাতর স্বরে
হাসান হোসেন কেমন করিয়া কেঁদেছিল, মনে পড়ে !
অশ্রু-প্লাবনে হাবুডুবু খাই বেদনার উপকূলে,
নিজের ক্ষতিই বড়ো করি তাই সকলের ক্ষতি ভুলে !
ভুলে যাই – কত বিহগ-শিশুরা এই স্নেহ-বট-ছায়ে
আমরাই মতন আশ্রয় লভি ভুলেছে আপন মায়ে।
কত সে ক্লান্ত বেদনা-দগ্ধ মুসাফির এরই মূলে
বসিয়া পেয়েছে মার তসল্লি৩, সব গ্লানি গেছে ভুলে !
আজ তারা সবে করিছে মাতব আমার বাণীর মাঝে,
একের বেদনা নিখিলের হয়ে বুকে এত ভারী বাজে!
আমারে ঘিরিয়া জমিছে অথই শত নয়নের জল,
মধ্যে বেদনা-শতদল আমি করিতেছি টলমল!
নিখিল-দরদি দিলের আম্মা! নাহি মোর অধিকার
সকলের মাঝে সকলে ত্যজিয়া শুধু একা কাঁদিবার!
আসিয়াছি মাগো জিয়ারত৪ লাগি আজি অগ্রজ হয়ে
মা-হারা আমার ব্যথাতুর ছোটো ভাইবোনগুলি লয়ে ।
অশ্রুতে মোর অন্ধ দু-চোখ, তবু ওরা ভাবিয়াছে –
হয়তো তোমার পথের দিশা মা জানা আছে মোর কাছে!
জীবন-প্রভাতে দেউলিয়া হয়ে যারা ভাষাহীন গানে
ভিড় করে মাগো চলেছিল সব গোরস্থানের পানে,
পক্ষ মেলিয়া আবরিলে তুমি সকলে আকুল স্নেহে,
যত ঘর-ছাড়া কোলাকুলি করে তব কোলে তব গেহে!
‘কত বড়ো তুমি’বলিলে, বলিতে, “আকাশ শূন্য বলে
এত কোটি তারা চন্দ্র সূর্য গ্রহে ধরিয়াছে কোলে।
শূন্য সে বুক তবু ভরেনি রে, আজও সেথা আছে ঠাঁই,
শূন্য ভরিতে শূন্যতা ছাড়া দ্বিতীয় সে কিছু নাই!”
গোর-পলাতক মোরা বুঝি নাই মাগো তুমি আগে থেকে
গোরস্থানের দেনা শুধিয়াছ আপনারে বাঁধা রেখে!
ভুলাইয়া রাখি গৃহহারাদেরে দিয়া স্ব-গৃহের চাবি
গোপনে মিটালে আমাদের ঋণ – মৃত্যুর মহাদাবি!
সকলের তুমি সেবা করে গেলে, নিলেনা কারুর সেবা,
আলোক সবারে আলো দেয়, দেয় আলোকেরে আলো কেবা?
আমাদেরও চেয়ে গোপন গভীর কাঁদে বাণী ব্যথাতুর,
থেমে গেছে তার দুলালি মেয়ের জ্বালা-ক্রন্দন-সুর!
কমল-কাননে থেমে গেছে ঝড় ঘূর্ণির ডামাডোল,
কারার বক্ষে বাজে নাকো আর ভাঙন-ডঙ্কা-রোল!-
বসিবে কখন জ্ঞানের তখ্তে বাংলার মুসলিম!
বারে বারে টুটে কলম তোমার না লিখিতে শুধু ‘মিম’১।
* * *
সে ছিল আরব-বেদুইনদের পথ-ভুলে-আসা মেয়ে,
কাঁদিয়া উঠিত হেরেমের উঁচা প্রাচীরের পানে চেয়ে!
সকলের সাথে সকলের মতো চাহিত সে আলো বায়ু,
বন্ধন-বাঁধ ডিঙাতে না পেরে ডিঙাইয়া গেল আয়ু!
সে বলিতে, “ওই হেরেম-মহল নারীদের তরে নহে,
নারী নহে যারা ভুলে বাঁদি-খানা ওই হেরেমের মোহে!
নারীদের এই বাঁদি করে রাখা অবিশ্বাসের মাঝে
লোভী পুরুষের পশু-প্রবৃত্তি হীন অপমান রাজে!
আপনা ভুলিয়া বিশ্বপালিকা নিত্য-কালের নারী
করিছে পুরুষ-জেলদারোগার কামনার তাঁবেদারি!
বলে না কোরান, বলে না হাদিস, ইসলামি ইতিহাস,
নারী নর-দাসী, বন্দিনী রবে হেরেমেতে বারোমাস!
হাদিস কোরান ফেকা২ লয়ে যারা করিছে ব্যবসাদারি,
মানে নাকো তারা কোরানের বাণী – সমান নর ও নারী!
শাস্ত্র ছাঁকিয়া নিজেদের যত সুবিধা বাছাই করে
নারীদের বেলা গুম হয়ে রয় গুমরাহ্৩ যত চোরে!’”
দিনের আলোকে ধরেছিলে এই মুনাফেকদের৪ চুরি,
মসজিদে বসে স্বার্থের তরে ইসলামে হানা ছুরি!
আমি জানি মা গো আলোকের লাগি তব এই অভিযান
হেরেম-রক্ষী যত গোলামের কাঁপায়ে তুলিত প্রাণ!
গোলাগুলি নাই, গালাগালি আছে, তাই দিয়ে তারা লড়ে,
বোঝে নাকো থুথু উপরে ছুঁড়িলে আপনারই মুখে পড়ে!
আমরা দেখেছি, যত গালি ওরা ছুঁড়িয়া মেরেছে গায়ে,
ফুল হয়ে সব ফুটিয়া উঠিয়া ঝরিয়াছে তব পায়ে!
* * *
কাঁটার কুঞ্জে ছিলে নাগমাতা সদা উদ্যত-ফণা
আঘাত করিতে আসিয়া ‘আঘাত’করিয়াছে বন্দনা!
তোমার বিষের নীহারিকা-লোকে নিতি নব নব গ্রহ
জন্ম লভিয়া নিষেধ-জগতে জাগায়েছে বিদ্রোহ!
জহরের তেজ পান করে মাগো তব নাগ-শিশু যত
নিয়ন্ত্রিতের শিরে গাড়িয়াছে ধ্বজা বিজয়োদ্ধত!
মানেনি কো তারা শাসন-ত্রাসন বাধা-নিষেধের বেড়া –
মানুষ থাকে না খোঁয়াড়ে বন্ধ, থাকে বটে গোরু-ভেড়া!
এসমে-আজম তাবিজের মতো আজও তব রুহ্ পাক
তাদেরে ঘেরিয়া আছে কি তেমনই বেদনায় নির্বাক?
অথবা ‘খাতুনে-জান্নাত’ মাতা ফাতেমার গুলবাগে
গোলাব-কাঁটায় রাঙা গুল হয়ে ফুটেছে রক্তরাগে?
* * *
তোমার বেদনা-সাগরে জোয়ার জাগিল যাদের টানে,
তারা কোথা আজ? সাগর শুকালে চাঁদ মরে কোনখানে?
যাহাদের তরে অকালে, আম্মা, জান দিলে কোরবান,
তাদের জাগায় সার্থক হোক তোমার আত্মদান!
মধ্যপথে মা তোমার প্রাণের নিবিল যে দীপ-শিখা,
জ্বলুক নিখিল-নারী-সীমান্তে হয়ে তাই জয়টিকা!
বন্দিনীদের বেদনার মাঝে বাঁচিয়া আছ মা তুমি,
চিরজীবী মেয়ে, তবু যাই ওই কবরের ধূলি চুমি!
মৃত্যুর পানে চলিতে আছিলে জীবনের পথ দিয়া,
জীবনের পানে চলিছ কি আজ মৃত্যুরে পারাইয়া?
কৃষ্ণনগর,
১৫ পৌষ, ১৩৩৩
সুবহ্-উম্মেদ
‘সুবহ্-উম্মেদ’
[পূর্বাশা]
সর্বনাশের পরে পৌষ মাস
এল কি আবার ইসলামের?
মন্বন্তর-অন্তে কে দিল
ধরণিরে ধন-ধান্য ঢের?
ভুখারির রোজা রমজান পরে
এল কি ঈদের নওরোজা?
এল কি আরব-আহবে আবার
মূর্ত মর্ত-মোর্তজা?
হিজরত করে হজরত কি রে
এল এ মেদিনী-মদিনা ফের?
নতুন করিয়া হিজরি গণনা
হবে কি আবার মুসলিমের?
* * *
বরদ-বিজয়ী বদরুদ্দোজা৪
ঘুচাল কি অমা রৌশনিতে?
সিজাদ করিল নিজ্দ হেজাজ৬
আবার ‘কাবা’র মসজিদে।
আরবে করিল ‘দারুল-হার’–
ধসে পড়ে বুঝি ‘কাবা’র ছাদ!
‘দীন দীন’রবে শমশের-হাতে
ছুটে শের-নর ‘ইবনে সাদ’!
মাজার ফাড়িয়া উঠিল হাজার
জিন্দান-ভাঙা জিন্দা বীর!
গারত হইল করদ হুসেন,
উঁচু হল পুন শির নবির!
আরব আবার হল আরাস্তা,
বান্দারা যত পড়ে দরুদ।
পড়ে শুকরানা‘আরবা রেকাত’
আরফাতে যত স্বর্গ-দূত।
ঘোষিল ওহদ, ‘আল্লা আহদ !’
ফুকারে তূর্য তুর পাহাড়
মন্দ্রে বিশ্ব-রন্ধ্রে-রন্ধ্রে
মন্ত্র আল্লা-হু-আকবার!
জাগিয়া শুনিনু প্রভাতি আজান
দিতেছে নবীন মোয়াজ্জিন।
মনে হল এল ভক্ত বেলাল
রক্ত এ-দিনে জাগাতে দীন!
জেগেছে তখন তরুণ তুরাণ
গোর চিরে যেন আঙ্গোরায়।
গ্রিসের গরুরী গারত করিয়া
বোঁও বোঁও তলোয়ার ঘোরায়।
রংরেজ৭ যেন শমশের যত
লালফেজ-শিরে তুর্কিদের।
লালে-লাল করে কৃষ্ণসাগর
রক্ত-প্রবাল চূর্ণি ফের।
মোতি হার সম হাথিয়ার দোলে
তরুণ তুরাণি বুকে পিঠে!
খাট্টা-মেজাজ গাঁট্টা মারিছে
দেশ-শত্রুর গিঁঠে গিঁঠে!
মুক্ত চন্দ্র-লাঞ্ছিত ধ্বজা
পতপত ওড়ে তুর্কিতে,
রঙিন আজি ম্লান আস্তানা
সুরখ রঙের সুর্খিতে
বিরান১০ মুলুক ইরানও সহসা
জাগিয়াছে দেখি ত্যজিয়া নিদ!
মাশুকের বাহু ছাড়ায়ে আশিক
কসম করিছে হবে শহিদ!
লায়লির প্রেমে মজনুন আজি
‘লা-এলা’র তরে ধরেছে তেগ।
শিরীন শিরীরে ভুলে ফরহাদ
সারা ইসলাম পরে আশেক!
পেশতা-আপেল-আনার-আঙুর-
নারঙ্গি-শেব-বোস্তানে
মুলতুবি আজ সাকি ও শরাব
দীওয়ান-ই-হাফিজ জুজদানে!
নার্গিস লালা লালে-লাল আজি
তাজা খুন মেখে বীর প্রাণের,
ফিরদৌসীর রণ-দুন্দুভি
শুনে পিঞ্জরে জেগেছে শের!
হিংসায়-সিয়া শিয়াদের তাজে
শিরাজী-শোণিমা লেগেছে আজ।
নৌ-রুস্তম উঠেছে রুখিয়া
সফেদ দানবে দিয়াছে লাজ?
মরা মরক্কো মরিয়া হইয়া
মাতিয়াছে করি মরণ-পণ,
স্তম্ভিত হয়ে হেরিছে বিশ্ব–
আজও মুসলিম ভোলেনি রণ!
জ্বালাবে আবার খেদিব-প্রদীপ
গাজি আবদুল করিম বীর,
দ্বিতীয় কামাল রীফ-সর্দার–
স্পেন ভয়ে পায়ে নোয়ায় শির!
রীফ৬ শরিফ সে কতটুকু ঠাঁই
আজ তারই কথা ভুবনময়!–
মৃত্যুর মাঝে মৃত্যুঞ্জয়ে
দেখেছে যাহারা, তাদেরই জয়!
মেষ-সম যারা ছিল এতদিন
শের হল আজ সেই মেসের!
এ-মেষের দেশ মেষ-ই রহিল
কাফ্রির অধম এরা কাফের!
নীল দরিয়ায় জেগেছে জোয়ার
‘মুসা’র উষার টুটেছে ঘুম।
অভিশাপ-‘আসা’ গর্জিয়া আসে
গ্রাসিবে যন্ত্রী-জাদু-জুলুম।
ফেরাউন১ আজও মরেনি ডুবিয়া?
দেরি নাই তার, ডুবিবে কাল!
জালিম-রাজার প্রাসাদে প্রাসাদে
জ্বলেছে খোদার লাল মশাল!
কাবুল লইল নতুন দীক্ষা
কবুল করিল আপনা জান।
পাহাড়ি তরুর শুকনো শাখায়
গাহে বুলবুল খোশ এলহান!
পামির ছাড়িয়া আমির আজিকে
পথের ধুলায় খোঁজে মণি!
মিলিয়াছে মরা মরু-সাগরে রে
আব-হায়াতের৩ প্রাণ-খনি!
খর-রোদ-পোড়া খর্জুর তরু–
তারও বুক ফেটে ক্ষরিছে ক্ষীর!
“সুজলা সুফলা শস্য-শ্যামলা”
ভারতের বুকে নাই রুধির!
জাগিল আরব ইরান তুরান
মরক্কো আফগান মেসের।–
সর্বনাশের পরে পৌষমাস
এলো কি আবার ইসলামের?
* * *
কসাই-খানার সাত কোটি মেষ
ইহাদেরই শুধু নাই কি ত্রাণ
মার খেয়ে খেয়ে মরিয়া হইয়া
উঠিতে এদের নাই প্রাণ?
জেগেছে আরব ইরান তুরান
মরক্কো আফগান মেসের।
এয়্ খোদা! এই জাগরণ-রোলে
এ-মেষের দেশও জাগাও ফের!