বেদনা-মণি
একটি শুধু বেদনা মানিক আমার মনের মণিকোঠায়
সেই তো আমার বিজন ঘরে দুঃখ রাতের আঁধার টুটায়।
সেই মানিকের রক্ত-আলো
ভুলাল মোর মন ভুলাল গো।
সেই মানিকের করুণ কিরণ আমার বুকে মুখে লুটায়।
আজ রিক্ত আমি কান্না হাসির দাবি দাওয়ার বাঁধন ছিঁড়ে
ওই বেদনা-মণির শিখার মায়াই রইল একা জীবন ঘিরে।
এ কালফণী অনেক খুঁজি
পেয়েছে ওই একটি পুঁজি গো!
আমার চোখের জলে ওই মণিদীপ আগুন হাসির ফিনিক ফোটায়।
ব্যথা-নিশীথ
এই নীরব নিশীথ রাতে
শুধু জল আসে আঁখিপাতে।
কেন কি কথা স্মরণে রাজে?
বুকে কার হতাদর বাজে?
কোন্ ক্রন্দন হিয়া-মাঝে
ওঠে গুমরি’ ব্যর্থতাতে
আর জল ভরে আঁখি-পাতে।।
মম বর্থ জীবন-বেদনা
এই নিশীথে লুকাতে নারি,
তাই গোপনে একাকী শয়নে
শুধু নয়নে উথলে বারি।
ছিল সেদিনো এমনি নিশা,
বুকে জেগেছিল শত তৃষা
তারি ব্যর্থ নিশাস মিশা
ওই শিথিল শেফালিকাতে
আর পূরবীতে বেদনাতে।।
মনের মানুষ
ফিরনু যেদিন দ্বারে দ্বারে কেউ কি এসেছিল?
মুখের পানে চেয়ে এমন কেউ কি হেসেছিল?
অনেক তো সে ছিল বাঁশি,
অনেক হাসি, অনেক ফাঁসি,
কই কেউ কি ডেকেছিল আমায়, কেউ কি যেচেছিল?
ওগো এমন করে নয়ন-জলে কেউ কি ভেসেছিল?
তোমরা যখন সবাই গেলে হেলায় ঠেলে পায়ে,
আমার সকল সুধাটুকুন পিয়ে,
সেই তো এসে বুকে করে তুলল আপন নায়ে
আচমকা কোন্ না-চাওয়া পথ দিয়ে।
আমার যত কলঙ্কে সে
হেসে বরণ করলে এসে
আহা বুক-জুড়ানো এমন ভালো কেউ কি বেসেছিল?
ওগো জানত কে যে মনের মানুষ সবার শেষে ছিল।
মরমি
কোন মরমির মরম ব্যথা আমার বুকে বেদনা হানে,
জানি গো, সেও জানেই জানে।
আমি কাঁদি তাইতে যে তার ডাগর চোখে অশ্রু আনে,
বুঝেছি তা প্রাণের টানে।
বাইরে বাঁধি মনকে যত
ততই বাড়ে মর্ম-ক্ষত,
মোর সে ক্ষত ব্যথার মতো
বাজে গিয়ে তারও প্রাণে
কে কয়ে যায় হিয়ার কানে।
উদাস বায়ু ধানের খেতে ঘনায় যখন সাঁঝের মায়া,
দুই জনারই নয়ন-পাতায় অমনি নামে কাজল-ছায়া!
দুইটি হিয়াই কেমন কেমন
বদ্ধ ভ্রমর পদ্মে যেমন,
হায়, অসহায় মূকের বেদন
বাজল শুধু সাঁঝের গানে,
পুবের বায়ুর হুতাশ তানে।
মানস-বধূ
যেমন ছাঁচি পানের কচি পাতা প্রজাপতির ডানার ছোঁয়ায়,
ঠোঁট দুটি তার কাঁপন-আকুল একটি চুমায় অমনি নোয়ায়।
জল-ছলছল উড়ু-উড়ু চঞ্চল তার আঁখির তারা,
কখন বুঝি দেবে ফাঁকি সুদূর পথিক-পাখির পারা,
নিবিড় নয়ন-পাতার কোলে,
গভীর ব্যথার ছায়া দোলে,
মলিন চাওয়া (ছাওয়া) যেন দূরের সে কোন্ সবুজ ধোঁয়ায়।
সিঁথির বীথির খসে-পড়া কপোল-ছাওয়া চপল অলক
পলক-হারা, সে মুখ চেয়ে নাচ ভুলেছে নাকের নোলক।
পাংশু তাহার চূর্ণ কেশে,
মুখ মুছে যায় সন্ধে এসে,
বিধুর অধর-সীধু যেন নিঙড়ে কাঁচা আঙুর চোয়ায়।
দিঘল শ্বাসের বাউল বাজে নাসার সে তার জোড়-বাঁশিতে,
পান্না-ক্ষরা কান্না যেন ঠোঁট-চাপা তার চোর হাসি সে।
ম্লান তার লাল গালের লালিম,
রোদ-পাকা আধ-ডাঁশা ডালিম,
গাগরি ব্যথার ডুবায় কে তার টোল খাওয়া গাল-চিবুক-কুয়ায়।
চায় যেন সে শরম-শাড়ির ঘোমটা চিরি পাতা ফুঁড়ি,
আধফোঁটা বউ মউল-বউল, বোলতা-ব্যাকুল বকুল কুঁড়ি
বোল-ভোলা তার কাঁকন চুড়ি
ক্ষীরের ভিতর হিরের ছুরি,
দু-চোখ-ভরা অশ্রু যেন পাকা পিয়াল শালের ঠোঙায়।
বুকের কাঁপন হুতাশ-ভরা, বাহুর বাঁধন কাঁদন-মাখা,
নিচোল বুকের কাঁচল আঁচল স্বপন-পারের পরির পাখা।
খেয়াপারের ভেসে-আসা
গীতির মতো পায়ের ভাষা,
চরণ-চুমায় শিউরে পুলক হিমভেজা দুধ-ঘাসের রোঁয়ায়।
সে যেন কোন্ দূরের মেয়ে আমার কবিমানস-বধূ;
বুকপোরা আর মুখভার তার পিছলে পড়ে ব্যথার মধু।
নিশীথ-রাতের স্বপন হেন,
পেয়েও তারে পাইনে যেন,
মিলন মোদের স্বপন-কূলে কাঁদনভরা চুমায় চুমায়।
নামহারা সেই আমার প্রিয়া, তারেই চেয়ে জনম গোঁয়ায়।
মুক্তি-বার
লক্ষ্মী আমার! তোমার পথে আজকে অভিসার।
অনেক দিনের পর পেয়েছি মুক্তি-রবিবার।
দিনের পরে দিন গিয়েছে, হয়নি আমার ছুটি,
বুকের ভিতর মৌন-কাঁদন পড়ত বৃথাই লুটি।
আজ পেয়েছি মুক্ত হাওয়া,
লাগল চোখে তোমার চাওয়া,
তাই তো প্রাণে বাঁধ টুটেছে রুদ্ধ কবিতার।
তোমার তরে বুকের তলায়
অনেক দিনের অনেক কথা জমা,
কানের কাছে মুখটি থুয়ে
গোপন সে সব কইব প্রিয়তমা।
এবার শুধু কথায়-গানে রাত্রি হবে ভোর,
শুকতারাতে কাঁপবে তোমার নয়ন-পাতার লোর।
তোমায় সেধে ডাকবে বাঁশি,
মলিন মুখে ফুটবে হাসি,
হিম-মুকুরে উঠবে ভাসি করুণ ছবি তার।
রৌদ্রদগ্ধের গান
এবার আমার জ্যোতির্গেহে তিমির প্রদীপ জ্বালো।
আনো অগ্নিবিহীন দীপ্তিশিখার তৃপ্তি অতল কালো।
তিমির প্রদীপ জ্বালো।
নয়ন আমার তামস-তন্দ্রালসে
ঢুলে পড়ুক ঘুমের সবুজ রসে,
রৌদ্র-কুহুর দীপক-পাখা পড়ুক টুটুক খসে,
আমার নিদাঘদাহে অমামেঘের নীল অমিয়া ঢালো।
তিমির প্রদীপ জ্বালো।
মেঘে ডুবাও সহস্রদল রবি-কমলদীপ,
ফুটাও আঁধার-কদম-ঘুমশাখে মোর স্বপন মণিনীপ।
নিখিলগহন-তিমির তমাল গাছে
কালো কালার উজল নয়ন নাচে,
আলো-রাধা যে কালোতে নিত্য মরণ-যাচে –
ওগো আনো আমার সেই যমুনার জলবিজুলির আলো।
তিমির প্রদীপ জ্বালো।
দিনের আলো কাঁদে আমার রাতের তিমির লাগি
সেথায় আঁধার-বাসরঘরে তোমার সোহাগ আছে জাগি।
ম্লান করে দেয় আলোর দহন-জ্বালা
তোমার হাতের চাঁদ-প্রদীপের থালা,
শুকিয়ে ওঠে তোমার তারা-ফুলের গগন-ডালা।
ওগো অসিত আমার নিশীথ-নিতল শীতল কালোই ভালো।
তিমির প্রদীপ জ্বালো।
সমস্তিপুরের ট্রেন-পথে
ফাল্গুন ১৩৩০
[কার্তিক ১৩২৯]