প্রতিবেশিনী
আমার ঘরের পাশ দিয়ে সে চলত নিতুই সকাল-সাঁঝে।
আর এ পথে চলবে না সে সেই ব্যথা হায় বক্ষে বাজে।
আমার দ্বারের কাছটিতে তার ফুটত লালী গালের টোলে,
টলত চরণ, চাউনি বিবশ কাঁপত নয়ন-পাতার কোলে –
কুঁড়ি যেমন প্রথম খোলো গো!
কেউ কখনও কইনি কথা,
কেবল নিবিড় নীরবতা
সুর বাজাত অনাহতা
গোপন মরম-বীণার মাঝে।
মূক পথের আজ বুক ফেটে যায় স্মরি তারই পায়ের পরশ
বুক-খসা তার আঁচর-চুমু,
রঙিন ধুলো পাংশু হল, ঘাস শুকাল যেচে বাচাল
জোড়-পায়েলার রুমঝুমু!
আজও আমার কাটবে গো দিন রোজই যেমন কাটত বেলা,
একলা বসে শূন্য ঘরে – তেমনি ঘাটে ভাসবে ভেলা –
অবহেলা হেলাফেলায় গো!
শুধু সে আর তেমন কর
মন রবে না নেশায় ভরে
আসার আশায় সে কার তরে
সজাগ হয়ে সকল কাজে।
ডুকরে কাঁদে মন-কপোতী –
‘কোথায় সাথির কূজন বাজে?
সে পা-র ভাষা কোথায় রাজে?’
প্রিয়ার রূপ
অধর নিসপিস
নধর কিসমিস
রাতুল তুলতুল কপোল;
ঝরল ফুল-কুল,
করল গুল ভুল
বাতুল বুলবুল চপল।
নাসায় তিলফুল
হাসায় বিলকুল,
নয়ান ছলছল উদাস,
দৃষ্টি চোর-চোর
মিষ্টি ঘোর-ঘোর,
বয়ান ঢলঢল হুতাশ।
অলক দুলদুল
পলক ঢুল ঢুল,
নোলক চুম খায় মুখেই,
সিঁদুর মুখটুক
হিঙুল টুকটুক,
দোলক ঘুম যায় বুকেই।
ললাট ঝলমল
মলাট মলমল
টিপটি টলটল সিঁথির,
ভুরুর কায় ক্ষীণ
শুরুর নাই চিন,
দীপটি জ্বলজ্বল দিঠির।
চিবুক টোল খায়,
কী সুখ-দোল তায়
হাসির ফাঁস দেয় – সাবাস।
মুখটি গোলগাল,
চুপটি বোলচাল
বাঁশির শ্বাস দেয় আভাস।
আনার লাল লাল
দানার তার গাল,
তিলের দাগ তায় ভোমর;
কপোল-কোল ছায়
চপল টোল, তায়
নীলের রাগ ভায় চুমোর॥
বাদল-দিনে
১
আদর-গর-গর
বাদর দর-দর
এ-তনু ডর-ডর
কাঁপিছে থর-থর।
নয়ন ঢল-ঢল
সজল ছল-ছল,
কাজল কালো জল
ঝরে লো ঝরঝর।
২
ব্যাকুল বন-রাজি শ্বসিছে ক্ষণে ক্ষণে,
সজনি! মন আজি গুমরে মনে মনে।
বিদরে হিয়া মম
বিদেশে প্রিয়তম,
এ জনু পাখি সম
বরিষা-জরজর।
৩
কাহার ও মেঘোপরি গমন গম-গম?
সখী রে মরি মরি, ভয়ে গা ছম-ছম।
গগনে ঘন ঘন
সঘনে শোনো-শোনো
ঝনন রণরণ –
সজনি ধরো ধরো।
৪
জলদ-দামা বাজে জলদে তালে তালে,
কাজরি-নাচা নাচে ময়ূর ডালে ডালে।
শ্যামল মুখ স্মরি
সখিয়া বুক মোরি
উঠিছে ব্যথা ভরি
আঁখিয়া ভরভর।
৫
বিজুরি হানে ছুরি চমকি রহি রহি
বিধুরা একা ঝুরি বেদনা কারে কহি।
সুরভি কেয়া-ফুলে
এ হৃদি বেয়াকুলে,
কাঁদিছে দুলে দুলে
বনানী মর-মর।
৬
নদীর কলকল, ঝাউয়ের ঝল-মল,
দামিনী জ্বলজ্বল, কামিনী টল-মল।
আজি লো বনে বনে
শুধানু জনে জনে,
কাঁদিল বায়ুসনে
তটিনী তরতর।
৭
আদুরি দাদুরি লো কহো লো কহো দেখি,
এমন বাদরি লো ডুবিয়া মরিব কি?
একাকী এলোকেশে,
কাঁদিব ভালোবেসে,
মরিব লেখা-শেষে,
সজনি সরো সরো।
বিজয়িনী
হে মোর রাণি! তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে।
আমার বিজয়-কেতন লুটায় তোমার চরণ-তলে এসে।
আমার সমর-জয়ী অমর তরবারী
দিনে দিনে ক্লানি- আনে, হ’য়ে ওঠে ভারী,
এখন এ ভার আমার তোমায় দিয়ে হারি,
এই হার-মানা-হার পরাই তোমার কেশে।।
ওগো জীবন-দেবী।
আমায় দেখে কখন তুমি ফেললে চোখের জল,
আজ বিশ্বজয়ীর বিপুল দেউল তাইতে টলমল!
আজ বিদ্রোহীর এই রক্ত-রথের চূড়ে,
বিজয়িনী! নীলাম্বরীর আঁচল তোমার উড়ে,
যত তৃণ আমার আজ তোমার মালায় পূরে’,
আমি বিজয়ী আজ নয়ন-জলে ভেসে।।
বিধুরা পথিকপ্রিয়া
আজ নলিন-নয়ান মলিন কেন বলো সখী বলো বলো।
পড়ল মনে কোন্ পথিকের বিদায় চাওয়া ছলছল?
বলো সখী বলো বলো
মেঘের পানে চেয়ে চেয়ে বুক ভিজালে চোখের জলে,
ওই সুদূরের পথ বেয়ে কি দূরের পথিক গেছে চলে –
আবার ফিরে আসবে বলে গো?
স্বর শুনে কার চমকে ওঠ? আ-হা!
ও লো ও যে বিহগ-বেহাগ নির্ঝরিণীর কল-কল।
ও নয় লো তার পায়ের ভাষা, আ-হা,
শীতের শেষের ঝরা-পাতার বিদায় ধ্বনি ও,
কোন কালোরে কোন ভালোরে বাসলে ভালো, আ-হা!
খুঁজছ মেঘে পরদেশি কোন পলাতকার নয়ন-অমিয়?
চুমছ কারে? ও নয় তোমার চির-চেনার চপল হাসির আলো-ছায়া,
ও যে গুবাক-তরুর চিকন পাতায় বাদল-চাঁদের মেঘলা মায়া।
ওঠো পথিক-পূজারিনি উদাসিনী বালা!
সে যে সবুজ-দেশের অবুঝ পাখি কখন এসে যাচবে বাঁধন,
কে জানে ভাই, ঘরকে চলো।
ও কী? চোখে নামল আবার বাদল-ছায়া ঢলঢল?
চলো সখি ঘরকে চলো।
বিবাগিনী
করেছ পথের ভিখারিনি মোরে কে গো সুন্দর সন্ন্যাসী?
কোন বিবাগির মায়া-বনমাঝে বাজে ঘরছাড়া তব বাঁশি?
ওগো সুন্দর সন্ন্যাসী।
তব প্রেমরাঙা ভাঙা জোছনা
হেরো শিশির-অশ্রু-লোচনা,
ওই চলিয়াছে কাঁদি বরষার নদী গৈরিকরাঙা-বসনা।
ওগো প্রেম-মহাযোগী, তব প্রেম লাগি নিখিল বিবাগি পরবাসী!
ওগো সুন্দর সন্ন্যাসী।
মম একা ঘরে নাথ দেখেছিনু তোমা ক্ষীণ দীপালোকে হীন করি,
হেরি বাহির আলোকে অনন্তলোকে এ কী রূপ তব মরি মরি!
দিয়া বেদনার পরে বেদনা
নাথ একী এ বিপুল চেতনা
তুমি জাগালে আমার রোদনে, অন্ধে দেখালে বিশ্ব-দ্যোতনা।
ওগো নিষ্ঠুর মোর! অশুভ ও-রূপ তাই এত বাজে বুকে আসি।
ওগো সুন্দর সন্ন্যাসী।
বেদনা-অভিমান
ওরে আমার বুকের বেদনা!
ঝঞ্ঝা-কাতর নিশীথ রাতের কপোত সম রে
আকুল এমন কাঁদন কেঁদো না।
কখন সে কার ভুবনভরা ভালোবাসা হেলায় হারালি,
তাইতো রে আজ এড়িয়ে চলে সকল স্নেহে পথে দাঁড়ালি!
ভিজে ওঠে চোখের পাতা তোর,
একটি কথায় – অভিমানী মোর!
ডুকরে কাঁদিস বাঁধনহারা, ‘ওগো, আমায় বাঁধন বেঁধো না’।
বাঁধন গৃহের সইল না তোর,
তাই বলে কি মায়াও ঘরের ডাক দেবে না তোকে?
অভিমানী গৃহহারা রে!
চললে একা মরুর পথেও
সাঁঝের আকাশ মায়ের মতন ডাকবে নত চোখে,
ডাকবে বধূ সন্ধ্যাতারা যে!
জানি ওরে, এড়িয়ে যারে চলিস তারেই পেতে চলিস পথে।
জোর করে কেউ বাঁধে না তাই বুক ফুলিয়ে চলিস বিজয়রথে।
ওরে কঠিন! শিরীষকোমল তুই!
মর্মর তোর মর্মে ছাপা বেল কামিনী জুঁই!
বুকপোরা তোর ভালবাসা, মুখে মিছে বলিস ‘সেধো না’।
আমার বুকের বেদনা।
দৌলতপুর, কুমিল্লা
জ্যৈষ্ঠ ১৩২৮