আশা
হয়ত তোমার পাব’ দেখা,
যেখানে ঐ নত আকাশ চুমছে বনের সবুজ রেখা।।
ঐ সুদূরের গাঁয়ের মাঠে,
আ’লের পথে বিজন ঘাটে;
হয়ত এসে মুচকি হেসে
ধ’রবে আমার হাতটি একা।।
ঐ নীলের ঐ গহন-পারে ঘোম্টা-হারা তোমার চাওয়া,
আনলে খবর গোপন দূতী দিক্পারের ঐ দখিনা হাওয়া।।
বনের ফাঁকে দুষ্টু তুমি
আসে- যাবে নয়্না চুমি’
সেই সে কথা লিখছে হেতা
দিগ্বলয়ের অরুণ-লেখা।
কমল-কাঁটা
আজকে দেখি হিংসা-মদের মত্ত-বারণ-রণে
জাগ্ছে শুধু মৃণাল-কাঁটা আমার কমল-বনে।
উঠল কখন ভীম কোলাহল,
আমার বুকের রক্ত-কমল
কে ছিঁড়িল-বাঁধ-ভরা জল
শুধায় ক্ষণে ক্ষণে।
ঢেউ-এর দোলায় মরাল-তরী নাচ্বে না আন্মনে।।
কাঁটাও আমার যায় না কেন, কমল গেল যদি!
সিনান-বধূর শাপ শুধু আজ কুড়াই নিরবধি!
আস্বে কি আর পথিক-বালা?
প’রবে আমার মৃণাল-মালা?
আমার জলজ-কাঁটার জ্বালা
জ্ব’লবে মোরই মনে?
ফুল না পেয়েও কমল-কাঁটা বাঁধবে কে কঙ্কণে?
কার বাঁশি বাজিল?
কার বাঁশি বাজিল
নদীপারে আজি লো?
নীপে নীপে শিহরণ কম্পন রাজিল –
কার বাঁশি বাজিল?
বনে বনে দূরে দূরে
ছল করে সুরে সুরে
এত করে ঝুরে ঝুরে
কে আমায় যাচিল?
পুলকে এ-তনুমন ঘন ঘন নাচিল।
ক্ষণে ক্ষণে আজি লো কার বাঁশি বাজিল?
কার হেন বুক ফাটে মুখ নাহি ফোটে লো!
না-কওয়া কী কথা যেন সুরে বেজে ওঠে লো!
মম নারী-হিয়া মাঝে
কেন এত ব্যথা বাজে?
কেন ফিরে এনু লাজে
নাহি দিয়ে যা ছিল?
যাচা-প্রাণ নিয়ে আমি কেমনে সে বাঁচি লো?
কেঁদে কেঁদে আজি লো কার বাঁশি বাজিল?
চাঁদমুকুর
চাঁদ হেরিতেছে চাঁদমুখ তার সরসীর আরশিতে।
ছুটে তরঙ্গ বাসনাভঙ্গ সে অঙ্গ পরশিতে।
হেরিছে রজনি রজনি জাগিয়া
চকোর উতলা চাঁদের লাগিয়া,
কাঁহা পিউ কাঁহা ডাকিছে পাপিয়া
কুমুদীরে কাঁদাইতে।
না জানি সজনি কত সে রজনি কেঁদেছে চকোরী পাপিয়া,
হেরেছে শশীরে সরসী-মুকুরে ভীরু ছায়াতরু কাঁপিয়া।
কেঁদেছে আকাশে চাঁদের ঘরনি
চির-বিরহিণী রোহিণী ভরণী,
অবশ আকাশ বিবশা ধরণি
কাঁদানিয়া চাঁদনীতে।
হুগলি
ফাল্গুন ১৩৩১
চির-চেনা
নামহারা ওই গাঙের পারে বনের কিনারে
বেতস-বেণুর বনে কে ওই বাজায় বীণা রে।
লতায়-পাতায় সুনীল রাগে
সে-সুর সোহাগ-পুলক লাগে,
সে সুর ঘুমায় দিগঙ্গনার শয়নলীনা রে।
আমি কাঁদি, এ সুর আমার চিরচেনা রে।
ফাগুন-মাঠে শিস দিয়ে যায় উদাসী তার সুর,
শিউরে ওঠে আমের মুকুল ব্যথায় ভারাতুর।
সে সুর কাঁপে উতল হাওয়ায়,
কিশলয়ের কচি চাওয়ায়,
সে চায় ইশারায় অস্তাচলের প্রাসাদ-মিনারে।
আমি কাঁদি, এই তো আমার চিরচেনা রে।
কুমিল্লা
জ্যৈষ্ঠ ১৩২৯
চিরন্তনী প্রিয়া
এসো এসো এসো আমার চির-পুরানো!
বুক জুড়ে আজ বসবে এসো হৃদয়-জুড়ানো!
আমার চির-পুরানো!
পথ বিপথে কতই আমার নিত্য নূতন বাঁধন এসে যাচে,
কাছে এসেই অমনি তারা পুড়ে মরে আমার আগুন আঁচে।
তারা এসে ভালোবাসার আশায়
একটুকুতেই কেঁদে ভাসায়,
ভীরু তাদের ভালোবাসা কেঁদেই ফুরানো।
বিজয়িনী চিরন্তনী মোর!
একা তুমিই হাস বিজয়-হাসি দীপ দেখিয়ে পথে ঘুরানো।
তুমি যেদিন মুক্তি দিলে হেসে বাঁধন কাটলে আপন হাতে,
প্রেম-গরবি আপন প্রেমের জোরে,
জানতে আমায় সইবে না কেউ বইবে না ভার
হার মেনে সে আসতে হবে আবার তোমার দোরে।
গরবিনি! গর্ব করে এই কপালে লিখলে জয়ের টিকা
‘চঞ্চল এই বাঁধন-হারায় বাঁধতে পারে এক এ সাহসিকা!’
প্রিয়! তাই কি আমার ভালোবাসা
সবাই বলে সর্বনাশা,
এই ধূমকেতু মোর আগুন-ছোঁয়া বিশ্ব-পোড়ানো?
সর্বনাশী চপল প্রিয়া মোর!
তবে অভিশাপের বুকে তুমিই হাসবে এসো
নয়ন ঝুরানো॥
চিরশিশু
নাম-হারা তুই পথিক-শিশু এলি অচিন দেশ পারায়ে।
কোন্ নামের আজ প’রলি কাঁকনম বাঁধনহারায় কোন্ কারা এ।।
আবার মনের মতন ক’রে
কোন্ নামে বল ডাক্ব তোরে!
পথ-ভোলা তুই এই সে ঘরে
ছিলি ওরে এলি ওরে
বারে বারে নাম হারায়ে।।
ওরে যাদু ওরে মাণিক, আঁধার ঘরের রতণ-মাণি!
ক্ষুধিত ঘর ভ’রলি এনে ছোট্ট হাতের একটু ননী।
আজ যে শুধু নিবিড় সুখে
কান্না-সায়র উথলে বুকে,
নতুন নামে ডাকতে তোকে
ওরে ও কে কন্ঠ র”খে’
উঠছে কেন মন ভারায়ে!
অস্ত হ’তে এলে পথিক উদয় পানে পা বাড়ায়ে।।
চৈতী হাওয়া
হারিয়ে গেছ অন্ধকারে-পাইনি খুঁজে আর,
আজ্কে তোমার আমার মাঝে সপ্ত পারাবার!
আজ্কে তোমার জন্মদিন-
স্মরণ-বেলায় নিদ্রাহীন
হাত্ড়ে ফিরি হারিয়ে-যাওয়ার অকূল অন্ধকার!
এই -সে হেথাই হারিয়ে গেছে কুড়িয়ে-পাওয়া হার!
শূন্য ছিল নিতল দীঘির শীতল কালো জল,
কেন তুমি ফুটলে সেথা ব্যথার নীলোৎপল?
আঁধার দীঘির রাঙলে মুখ,
নিটোল ঢেউ-এর ভাঙলে বুক,-
কোন্ পূজারী নিল ছিঁড়ে? ছিন্ন তোমার দল
ঢেকেছে আজ কোন্ দেবতার কোন্ সে পাষাণ-তল?
অস্ত-খেয়ার হারামাণিক-বোঝাই-করা না’
আস্ছে নিতুই ফিরিয়ে দেওয়ার উদয়-পারের গাঁ
ঘাটে আমি রই ব’সে
আমার মাণিক কই গো সে?
পারাবারের ঢেউ-দোলানী হান্ছে বুকে ঘা!
আমি খুঁজি ভিড়ের মাঝে চেনা কমল-পা!
বইছে আবার চৈতী হাওয়া গুম্রে ওঠে মন,
পেয়েছিলাম এম্নি হাওয়ায় তোমার পরশন।
তেম্নি আবার মহুয়া-মউ
মৌমাছিদের কৃষ্ণ-বউ
পান ক’রে ওই ঢুল্ছে নেশায়, দুল্ছে মহুল বন,
ফুল-সৌখিন্ দখিন হাওয়ায় কানন উচাটন!
প’ড়ছে মনে টগর চাঁপা বেল চামেলি যুঁই,
মধুপ দেখে যাদের শাখা আপ্নি যেত নুই।
হাস্তে তুমি দুলিয়ে ডাল,
গোলাপ হ’য়ে ফুটতো গাল
থর্কমলী আঁউরে যেত তপ্ত ও-গাল ছুঁই!
বকুল শাখা-ব্যকুল হ’ত টলমলাত ভুঁই!
চৈতী রাতের গাইত’ গজল বুলবুলিয়ার রব,
দুপুর বেলায় চবুতরায় কাঁদত কবুতর!
ভুঁই- তারকা সুন্দরী
সজনে ফুলের দল ঝরি’
থোপা থোপা লা ছড়াত দোলন-খোঁপার’ পর।
ঝাজাল হাওয়ায় বাজত উদাস মাছরাঙার স্বর!
পিয়ালবনায় পলাশ ফুলের গেলাস-ভরা মউ!
খেত বঁধুর জড়িয়ে গলা সাঁওতালিয়া বউ!
লুকিয়ে তুমি দেখতে তাই,
বলতে, ‘আমি অমনি চাই!
খোঁপায় দিতাম চাঁপা গুঁজে, ঠোঁটে দিতাম মউ!
হিজল শাখায় ডাকত পাখি “ বউ গো কথা কউ”
ডাকত ডাহুক জল- পায়রা নাচত ভরা বিল,
জোড়া ভুর” ওড়া যেন আসমানে গাঙচিল
হঠাৎ জলে রাখত্ে পা,
কাজলা দীঘির শিউরে গা-
কাঁটা দিয়ে উঠত মৃণাল ফুটত কমল-ঝিল!
ডাগর চোখে লাগত তোমার সাগর দীঘির নীল!
উদাস দুপুর কখন গেছে এখন বিকেল যায়,
ঘুম জড়ানো ঘুমতী নদীর ঘুমুর পরা পায়!
শঙ্খ বাজে মন্দিরে,
সন্ধ্যা আসে বন ঘিরে,
ঝাউ-এর শাখায় ভেজা আঁধার কে পিঁজেছে হায়!
মাঠের বাঁশী বন্-উদাসী ভীম্পলাশী গায়অ
বাউল আজি বাউল হ’ল আমরা তফাতে!
আম-মুকুলের গুঁজি-কাঠি দাও কি খোঁপাতে?
ডাবের শীতল জল দিয়ে
মুখ মাজ’কি আর প্রিয়ে?
প্রজাপতির ডাক-ঝরা সোনার টোপাতে
ভাঙা ভুর” দাও কি জোড়া রাতুল শোভাতে?
বউল ঝ’রে ফ’লেছ আজ থোলো থোলো আম,
রসের পীড়ায় টস্টসে বুক ঝুরছে গোপাবজাম!
কামরাঙারা রাঙল ফের
পীড়ন পেতে ঐ মুখের,
স্মরণ ক’রে চিবুক তোমার, বুকের তোমার ঠাম-
জামর”লে রস ফেটে পড়ে, হায়, কে দেবে দাম!
ক’রেছিলাম চাউনি চয়ন নয়ন হ’তে তোর,
ভেবেছিলুম গাঁথ্ব মালা পাইনে খুঁজে ডোর!
সেই চাহনি নীল-কমল
ভ’রল আমার মানস-জল,
কমল-কাঁটার ঘা লেগেছে মর্মমূলে মোর!
বক্ষে আমার দুলে আঁখির সাতনরী-হার লোর!
তরী আমার কোন্ কিনারায় পাইনে খুঁজে কুল,
স্মরণ-পারের গন্ধ পাঠায় কমলা নেবুর ফুল!
পাহাড়তলীর শালবনায়
বিষের মত নীল ঘনায়!
সাঁঝ প’রেছে ঐ দ্বিতীয়ার-চাঁদ-ইহুদী-দুল!
হায় গো, আমার ভিন্ গাঁয়ে আজ পথ হ’য়েছে ভুল!
কোথায় তুমি কোথায় আমি চৈতে দেখা সেই,
কেঁদে ফিরে যায় যে চৈত-তোমার দেখা নেই!
কন্ঠে কাঁদে একটি স্বর-
কোথায় তুমি বাঁধলে ঘর?
তেমনি ক’রে জাগছে কি রাত আমার আশাতেই?
কুড়িয়ে পাওয়া বেলায় খুঁজি হারিয়ে যাওয়া খেই!
পারাপারের ঘাটে প্রিয় রইনু বেঁধে না’,
এই তরীতে হয়ত তোমার প’ড়বে রাঙা পা!
আবার তোমার সুখ-ছোঁওয়ায়
আকুল দোলা লাগবে না’য়,
এক তরীতে যাব মোরা আর-না-হারা গাঁ
পারাপারের ঘাটে প্রিয় রইনু বেঁধে না’।।