- বইয়ের নামঃ ছায়ানট
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- প্রকাশনাঃ নজরুল ইন্সটিটিউট
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অ-কেজোর গান
ওই ঘাসের ফুলে মটরশুটির ক্ষেতে
আমার এ-মন-মৌমাছি ভাই উঠেছে আজ মেতে।
ওই রোদ-সোহাগী পউষ-প্রাতে
অথির প্রজাপতির সাথে
বেড়াই কুঁড়ির পাতে পাতে
পুষ্পল মৌ খেতে।
আমি আমন ধানের বিদায়-কাঁদন শুনি মাঠে রেতে।
আজ কাশ-বনে কে শ্বাস ফেলে যায় মরা নদীর কূলে,
ও তার হলদে আঁচল চলতে জড়ায় অড়হরের ফুলে!
ওই বাবলা ফুলের নাকছবি তার,
গায় শাড়ি নীল অপরাজিতার,
চলেছি সেই অজানিতার
উদাস পরশ পেতে।
আমায় ডেকেছে সে চোখ-ইশারায় পথে যেতে যেতে।
ওই ঘাসের ফুলে মটরশুটির ক্ষেতে
আমার এ-মন-মৌমাছি ভাই উঠেছে তাই মেতে।
অ-বেলায়
বৃথাই ওগো কেঁদে আমার কাটল যামিনী।
অবেলাতেই পড়ল ঝরে কোলের কামিনী –
ও সে শিথিল কামিনী।
খেলার জীবন কাটিয়ে হেলায়
দিন না যেতেই সন্ধেবেলায়
মলিন হেসে চড়ল ভেলায়
মরণ-গামিনী।
আহা একটু আগে তোমার দ্বারে কেন নামিনি।
আমার অভিমানিনী।
ঝরার আগে যে কুসুমে দেখেও দেখি নাই
ও যে বৃথাই হাওয়ায় ছড়িয়ে গেল, ছোট্ট বুকের একটু সুরভি
আজ তারই সেই শুকনো কাঁটা বিঁধচে বুকে ভাই –
আহা সেই সুরভি আকাশ কাঁদায় ব্যথায় যেন সাঁঝের পুরবি
জানলে না সে ব্যথাহতা
পাষাণ-হিয়ার গোপন কথা,
বাজের বুকেও কত ব্যথা
কত দামিনী!
আমার বুকের তলায় রইল জমা গো –
না-কওয়া সে অনেক দিনের অনেক কাহিনি।
আহা ডাক দিলি তুই যখন, তখন কেন থামিনি!
আমার অভিমানিনী।
দৌলতপুর, কুমিল্লা
বৈশাখ ১৩২৮
অকরুণ পিয়া
আমার পিয়াল বনের শ্যামল পিয়ার ওই বাজে গো বিদায়বাঁশি,
পথ-ঘুরানো সুর হেনে সে আবার হাসে নিদয় হাসি।
পথিক বলে পথের গেহ
বিলিয়েছিল একটু স্নেহ,
তাই দেখে তার ঈর্ষাভরা কান্নাতে চোখ গেল ভাসি।
তখন মোদের কিশোর বয়স যেদিন হঠাৎ টুটল বাঁধন,
সেই হতে কার বিদায়-বেণুর জগৎ জুড়ে শুনছি কাঁদন।
সেই কিশোরীর হারা মায়া
ভুবন ভরে নিল কায়া,
দুলে আজও তারই ছায়া আমার সকল পথে আসি।
অনাদৃতা
ওরে অভিমানিনী!
এমন করে বিদায় নিবি ভুলেও জানিনি।
পথ ভুলে তুই আমার ঘরে দু-দিন এসেছিলি,
সকল সহা! সকল সয়ে কেবল হেসেছিলি।
হেলায় বিদায় দিনু যারে
ভেবেছিনু ভুলব তারে হায়!
ভোলা কি তা যায়?
ওরে হারা-মণি! এখন কাঁদি দিবস-যামিনী।
অভাগি রে! হাসতে এসে কাঁদিয়ে গেলি,
নিজেও শেষে বিদায় নিলি কেঁদে,
ব্যথা দেওয়ার ছলে নিজেই সইলি ব্যথা রে,
বুকে সেই কথাটাই কাঁটার মতন বেঁধে!
যাবার দিনে গোপন ব্যথা বিদায়-বাঁশির সুরে
কইতে গিয়ে উঠল দু-চোখ নয়নজলে পুরে!
না কওয়া তোর সেই সে বাণী,
সেই হাসিগান সেই মু-খানি, হায়!
আজও খুঁজি সকল ঠাঁই।
তোরে যাবার দিনে কেঁদে কেন ফিরিয়ে আনিনি?
ওরে অভিমানিনী।
অমর-কানন
অমর কানন
মোদের অমর-কানন!
বন কে বলে রে ভাই, আমাদের তপোবন,
আমাদের তপোবন।
এর দক্ষিণে ‘শালী’ নদী কুলুকুলু বয়,
তার কূলে কূলে শালবীথি ফুলে ফুলময়,
হেথা ভেসে আসে জলে-ভেজা দখিনা মলয়,
হেথা মহুয়ার মউ খেয়ে মন উচাটন।
দূর প্রান্তর-ঘেরা আমাদের বাস,
দুধহাসি হাসে হেথা কচি দুব-ঘাস,
উপরে মায়ের মতো চাহিয়া আকাশ,
বেণু-বাজা মাঠে হেথা চরে ধেনুগণ
মোরা নিজ হাতে মাটি কাটি, নিজে ধরি হাল,
সদা খুশিভরা বুক হেথা হাসিভরা গাল,
মোরা বাতাস করি গো ভেঙে হরিতকি-ডাল,
হেথা শাখায় শাখায় শাখী, গানের মাতন।
প্রহরী মোদের ভাই ‘পুরবি’ পাহাড়,
‘শুশুনিয়া’ আগুলিয়া পশ্চিমি দ্বার,
ওড়ে উত্তরে উত্তরি কাননবিথার,
দূরে ক্ষণে ক্ষণে হাতছানি দেয় তালী-বন।
হেথা খেত-ভরা ধান নিয়ে আসে অঘ্রান,
হেথা প্রাণে ফোটে ফুল, হেথা ফুলে ফোটে প্রাণ,
ও রে রাখাল সাজিয়া হেথা আসে ভগবান,
মোরা নারায়ণ-সাথে খেলা খেলি অনুখন।
মোরা বটের ছায়ায় বসি করি গীতাপাঠ,
আমাদের পাঠশালা চাষি-ভরা মাঠ,
গাঁয়ে গাঁয়ে আমাদের মায়েদের হাট,
ঘরে ঘরে ভাইবোন বন্ধুস্বজন।
গঙ্গাজলঘাটি, বাঁকুড়া
আষাঢ় ১৩৩২
আপন-পিয়াসী
আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন
খুঁজি তারে আমি আপনার,
আমি শুনি যেন তার চরণের ধ্বনি
আমারি তিয়াসী বাসনায়।।
আমারই মনের তৃষিত আকাশে
কাঁদে সে চাতক আকুল পিয়াসে,
কভু সে চকোর সুধা-চোর আসে
নিশীথে স্বপনে জোছনায়।।
আমার মনের পিয়াল তমালে হেরি তারে স্নেহ-মেঘ-শ্যাম,
অশনি-আলোকে হেরি তারে থির-বিজুলি-উজল অভিরাম।।
আমারই রচিত কাননে বসিয়া
পরানু পিয়ারে মালিকা রচিয়া,
সে মালা সহসা দেখিনু জাগিয়া,
আপনারি গলে দোলে হায়।।
আলতা-স্মৃতি
ওই রাঙা পায়ে রাঙা আলতা প্রথম যেদিন পরেছিলে,
সেদিন তুমি আমায় কি গো ভুলেও মনে করেছিলে –
আলতা যেদিন পরেছিলে?
জানি, তোমার নারীর মনে নিত্য-নূতন পাওয়ার পিয়াস
হঠাৎ কেন জাগল সেদিন, কণ্ঠ ফেটে কাঁদল তিয়াস!
মোর আসনে সেদিন রানি
নূতন রাজায় বরলে আনি,
আমার রক্তে চরণ রেখে তাহার বুকে মরেছিলে –
আলতা যেদিন পরেছিলে।
মর্মমূলে হানলে আমার অবিশ্বাসের তীক্ষ্ম ছুরি,
সে-খুন সখায় অর্ঘ্য দিলে যুগল চরণ-পদ্মে পুরি।
আমার প্রাণের রক্তকমল
নিঙড়ে হল লাল পদতল,
সেই শতদল দিয়ে তোমার নতুন রাজায় বরেছিলে –
আলতা যেদিন পরেছিলে।
আমায় হেলায় হত্যা করে দাঁড়িয়ে আমার রক্ত-বুকে
অধর-আঙুর নিঙড়েছিলে সখার তৃষা-শুষ্ক মুখে।
আলতা সে নয়, সে যে খালি
আমার যত চুমোর লালি!
খেলতে হোরি তাইতে, গোরি, চরণতরি ভরেছিলে –
আলতা যেদিন পরেছিলে।
জানি রানি, এমনি করে আমার বুকের রক্তধারায়
আমারই প্রেম জন্মে জন্মে তোমার পায়ে আলতা পরায়!
এবারও সেই আলতা-চরণ
দেখতে প্রথম পায়নি নয়ন!
মরণ-শোষা রক্ত আমার চরণ-ধারে ধরেছিলে –
আলতা যেদিন পরেছিলে।
কাহার পুলক-অলক্তকের রক্তধারায় ডুবিয়ে চরণ
উদাসিনী! যেচেছিলে মনের মনে আমার মরণ?
আমার সকল দাবি দলে
লিখলে ‘বিদায়’ চরণতলে!
আমার মরণ দিয়ে তোমার সখার হৃদয় হরেছিলে –
আলতা যেদিন পরেছিলে।
বহরমপুর জেল
অগ্রহায়ণ ১৩৩১ [১৩৩০]