এই বিকাশধর্মী মানুষের পরিণামে নির্বাণলাভ বা ব্ৰহ্মপদ লাভ রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে অশ্রদ্ধেয় হয়ত নয় কিন্তু বেশি আনন্দ তার এই কথা ভাবায় যে মানুষ স্বীয় সৃষ্টিধর্মগুণে এই সংসার-ক্ষেত্রে ঈশ্বরের সাহায্যকারী :
তুমি তো গড়েছ শুধু এ মাটির ধরণী তোমার
মিলাইয়া আলোকে আঁধার।
শূন্য হাতে সেথা মোরে রেখে
হাসিছ আপনি সেই শূন্যের আড়ালে গুপ্ত থেকে।
দিয়েছ আমার পরে তার
তোমার স্বর্গটি রচিবার। (বলাকা)
‘মানুষের ধর্ম’ গ্রন্থে সুপ্রাচীন সোহহম তত্ত্বের যে ব্যাখ্যা রবীন্দ্রনাথ দিয়েছেন তাও এই সম্পর্কে স্মরণীয়, তার মতে সোহহমের এ অর্থ নয় যে মানুষ ঈশ্বর, বরং এই অর্থ যে মানুষকে হতে হবে ঈশ্বরের মত সুন্দর ও শক্তিমান অর্থাৎ সৃষ্টিধর্মী। তাঁর এই বিখ্যাত বাণীও এই সম্পর্কে স্মরণীয় : যা শাস্ত্র তাই বিশ্বাস্য নয়, যা বিশ্বাস্য তাই শাস্ত্র। [৫]
কালিদাসের কালে, অথবা তার কিছু পূর্বে, ভারতবর্ষে প্রবল হয়েছিল বেদপন্থী ও বেদবিরোধীদের মধ্যে সংঘর্ষ। কালিদাস বেদপন্থী-বর্ণাশ্রমধর্মের শক্তিমান সমর্থক, তার আদর্শ নৃপতিরা বর্ণাশ্রমধর্মের সজাগ প্রহরী। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের যুগে ভারতবর্ষ যে সংঘর্ষ প্রত্যক্ষ করেছিল তা আরো ব্যাপক ও গভীর, তা হচ্ছে প্রাচ্য আর প্রতীচ্যের সংঘর্ষ। এই বিরাট সংঘর্ষ সমস্ত চেতনা দিয়ে অনুভব করবার শক্তি নিয়ে জন্মেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তাঁর চিন্তাধারার ও আদর্শের অপূর্ব মর্যাদা তাই থেকে।
রবীন্দ্রনাথ যেন সেকাল ও একালের মধ্যবর্তী সেতু। তার আদর্শ যে কালিদাসের আদর্শের চাইতে ব্যাপকতর, একালের মানুষের জন্য বেশি সত্য ও সার্থক, তা সহজেই বোঝা যায়, কেননা একালের মানুষের চিন্তায় বড় ব্যাপার কোনো ধরনের মরমী সাধনায় তেমন নয় যেমন বিকাশধমী মানবতা। কিন্তু জীবনাদর্শে রবীন্দ্রনাথ কালিদাসের চাইতে সমৃদ্ধতর বলেই তাকে যে কালিদাসের চাইতে স্বভাবত শ্রেষ্ঠতর কবি জ্ঞান করা হবে তা সত্য নয় কেননা কবির সত্যকার কৃতিত্ব অঙ্কনকুশলতায়। অবশ্য শ্রেষ্ঠ অঙ্কনকুশলতার সঙ্গে শ্রেষ্ঠ চিন্তাভাবনাও স্বভাবতই যুক্ত থাকে, কিন্তু কবির চিন্তাভাবনার মর্যাদা তার অঙ্কনকুশলতার মর্যাদা থেকেই। এর সুপরিচিত দৃষ্টান্ত দান্তে। ধর্মাদর্শে তিনি রোমান ক্যাথলিক, কিন্তু বিশিষ্ট আদর্শবাদী হয়েও মহত্ত্বঙ্খলিত জীবনের ছবি আঁকার কাজে তিনি এমন কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন যে সেজন্য জগতের কাব্যরসিকদের চিরশ্রদ্ধেয় হতে পেরেছেন। কালিদাসও জীবনের অর্থপূর্ণ আলেখ্য অঙ্কনে আশ্চর্য কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন বিশেষ করে তাঁর শকুন্তলায়– তাই তিনিও জগতের রসিকদের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন। কবি হিসাবে এমন শ্রদ্ধার্য যে রবীন্দ্রনাথও হয়েছেন সে বিষয়ে আমরা, তার একালের স্বভাষীরা, নিঃসন্দেহ। কিন্তু এই দাবির যথার্থতার বিচারক আমরা নই– কাল। কালিদাসের মতো সেই কালজয়ী কবি প্রতিষ্ঠা যে যে কারণে রবীন্দ্রনাথের লাভ হবে বলে আমাদের ধারণা তা সংক্ষেপে বিবৃত করা যায় এইভাবে :
কালিদাসের রচনায় রয়েছে অপূর্ব লালিত্য ও গাম্ভীর্য; রবীন্দ্রনাথের রচনাও তুল্যরূপে ললিত ও গম্ভীর। হয়তো এক্ষেত্রে কালিদাসই রবীন্দ্রনাথের বিশিষ্ট পথপ্রদর্শক। কিন্তু বিদ্যা এক্ষেত্রে যোগ্য শিষ্যে ন্যস্ত হয়েছিল।
কালিদাস আবির্ভূত হয়েছিলেন স্বাধীন ভারতবর্ষে, সেই স্বাধীন ভারতবর্ষে ছিলো মহাবিক্রম নৃপতিকুল। কালিদাসের শ্রেষ্ঠ নায়করা তাই শক্তিমান সৈনিক–অমিতপরাক্রম। রবীন্দ্রনাথের জন্ম পরাধীন ভারতবর্ষে। কিন্তু সেই হীন দশায়ও ভারতবর্ষের অন্তরে জেগেছিল নবশক্তির উল্লাস– বিরাট জগতে শ্রদ্ধেয় হবার স্বপ্ন। রবীন্দ্রনাথ সেই জাগরণের কবি, তাই তাঁর নায়করা ব্যবসায়ে বীর-সৈনিক না হলেও প্রকৃতপক্ষে বীরত্ব-ধর্মী, পরাজয় স্বীকার করা তাদের স্বভাব নয়, জীবনে নব নব মহিমার সম্ভাবনায় উদ্বোধিত হওয়া তাদের জন্মগত অধিকার।
কালিদাস সৃষ্টি করেছেন শকুন্তলাকে; অপূর্ব সেই নারী-মূর্তি–বোধ হয় শিল্পে নারীসৃষ্টির চরম– একাধারে সে উর্বশী আর লক্ষ্মী, মত আর স্বর্গ, বসন্ত আর হেমন্ত। রবীন্দ্রনাথও সৃষ্টি করেছেন এক চিরবন্দনীয় মাতৃমূতি– আনন্দময়ীকে–জগতের সাহিত্যে হয়ত অদ্বিতীয় মাতৃমূর্তি; কিন্তু শকুন্তলার মতো একই সঙ্গে মহিমা ও মোহনতা সেই মূর্তিতে নেই, তাই শিল্পসৃষ্টি হিসাবে শকুন্তলার গৌরব বেশি। কিন্তু এক পরমমোহন শিল্প-সৃষ্টি রবীন্দ্রনাথও করেছেন, সেটি হচ্ছে তাঁর নিজের অন্তরাত্মা-প্রকৃতির অযুত লীলায় অপরূপভাবে চঞ্চল, অথচ এত যে লীলাচাঞ্চল্য, সৌন্দর্যের পরমসূক্ষ্ম অনুভূতি, সব অজানার উদ্দেশ্য স্তবনিবেদন :
আমর সব চেতনা সব বেদনা
রচিল এ যে কী আরাধনা…[৬]
গম্ভীর ও অকুল স্তবনিবেদন জগতে ঢের হয়েছে, কিন্তু এমন মোহন স্তবনিবেদন হয়ত আর কোনো দ্বিতীয় কবির দ্বারা সম্ভবপর হয়নি।
———
১. বালচন্দ্রের মত বক্র অবিকশিত অতিলোহিত পলাশরাজি সদ্যঃ-বসন্তসমাগতা বনস্থলীরূপা নায়িকাদের অঙ্গে নক্ষত্রসমূহের মত শোভা পাইতে লাগিল। কুমারসম্ভব, তৃতীয় সর্গ।
২. তিনি (দশরথ) মিথিলায় উপনীত হইয়া সৈন্যদলসহ মিথিলা বেষ্টন করিয়া উহার উপবন ও পাদপরাজি পীড়িত করিতে লাগিলেন; মিথিলা তাহার প্রীতির অত্যাচার সহ্য করিল যুবতী যেমন সহ্য করে প্রগাঢ় প্রিয়-সম্ভোগ। রঘুবংশ, একাদশ সর্গ।