“সহসা অসমাপ্ত গানে” থামবার ধরন যে সাধারণত কালিদাসের নয় তার পর্যাপ্ত প্রমাণ তাঁর রচনায় রয়েছে। তবে তিনি প্রকৃতই সৌন্দর্যরসিক, তাই এমন সুকুমার রুচি এক্ষেত্রে তাতে আরোপ করা সঙ্গত ও শোভন দুইই হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত ‘ঋতুসংহার’ সনেটটিও এমন শোভন ‘শোধনে’র দৃষ্টান্ত, কেননা মূল ‘ঋতুসংহার প্রকৃতির আবেগপ্রাবল্যের স্তোত্রও বটে আনন্দস্তোত্রও বটে।
কিন্তু কালিদাসের ভোগবাদের এই উল্লেখের সঙ্গে সঙ্গে সত্যের অনুরোধে না উল্লেখ করে’ উপায় নেই যে অন্যান্য বড় প্রতিভার মতো কালিদাসকেও দুই একটি লক্ষণের দ্বারা বুঝে ফেলার চেষ্টা করা বিড়ম্বনা। এই ভোগবাদী কবি আশ্চর্যভাবে ত্যাগবাদীও। মহারাজ অজের রাজ্যভোগ আর দিগবিজয়ী রঘুর সন্ন্যাসের কৃচ্ছ সাধনা এই দুয়ের যে ছবি তিনি পাশাপাশি দাঁড় করিয়েছেন তা মনোরম। আমরা কয়েকটি শ্লোকের বাংলা অনুবাদ উদ্ধৃত করছি :
যুবা নৃপতি প্রজাদের পর্যবেক্ষণের জন্য আরোহণ করলেন ধর্মাসন। বর্ষীয়ান নৃপতি চিত্তের একাগ্রতা বিধানের জন্য নির্জনে পরিগ্রহ করলেন কুশাসন। একজন চারপাশের রাজাদের বশীভূত করলেন প্রভু-শক্তির দ্বারা। অপরজন সমাধিযোগের অভ্যাসের দ্বারা বশীভূত করলেন দেহস্থ পঞ্চ মরুৎ। তরুণ নৃপতি ভস্মসাৎ করলেন জগতের শত্রুদের সব আয়োজন। বর্ষীয়ান নৃপতি ভস্মসাৎ করতে প্রবৃত্ত হলেন স্বকর্মসমূহকে জ্ঞানময় বহ্নির দ্বারা।
প্রকৃত মহত্ত্বের ছবি আঁকতেও কালিদাসের অশেষ আগ্রহ; ভারত রাজ্যলোভী না হয়ে রামের অনুপস্থিতিকালে দীর্ঘকাল রাজ্য পরিচালনা করেন, এজন্য কবি তাকে বলেছেন, “অসিধারব্রত’ অভ্যাসকারী–শিয়ং ‘যুবাপ্যঙ্কগতামভোক্তা’ অঙ্কগতা স্ত্রীকে যুবক হয়েও তিনি ভোগ করেননি।’ [৩]
একই সঙ্গে ভোগ ও ত্যাগ রবীন্দ্রনাথেও বিদ্যমান, কিন্তু কালিদাসের সঙ্গে এক্ষেত্রে তাঁর পার্থক্য সূক্ষ্ম এবং গভীর। তরুণ নৃপতির রাজ্যশাসন আর প্রবীণ নৃপতির আত্মশাসনের যে ছবি কালিদাস এঁকেছেন তা থেকে এবং তার আরো বহু উক্তি থেকে এ সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে যে কালিদাসের চোখে সংসার ও সন্ন্যাস যেন দুই স্বতন্ত্র জগৎ, একটিকে সম্পূর্ণ বর্জন করে তবেই যেন অন্যটিতে প্রবেশ পথ পাওয়া যায়। যেন কালিদাস বলতে চান : যতদিন মানুষ সংসারে আছে ততদিন সে মুখ্যত ভোগধর্মী; অবশ্য মহৎদের জন্য এই ভোগ স্কুল চর্বচোষ্যাদি ভোগের সঙ্গে সঙ্গে–কখনো সে-সব অতিক্রম করে–কীর্তি-ভোগ বা যশ ভোগও বটে: ‘নন্দিনী’কে রক্ষার জন্য রাজা দিলীপ সিংহকে বলেছেন :
আমাকে যদি মনে কর তোমার অবধ্য তবে আমার যশ-শরীরের প্রতি দয়ালু হও, একান্তবিধ্বংসী পাঞ্চভৌতিক এই পিন্ডে আমার মতো লোকের একান্ত অনাস্থা। লোকোপবাদে সীতাকে বর্জন কালে রামের হয়ে কবি বলেছেন :
লোকোপবাদ নিবৃত্তির অন্য উপায় নেই দেখে রাম পত্নীত্যাগে বদ্ধপরিকর হলেন। যশ যাদের ধন তাঁরা নিজেদের দেহ থেকে যশকে অধিকতর মূল্যবান জ্ঞান করেন, ভোগসুখের সামগ্রীর (স্রক্চন্দনবনিতার) তো কথাই নেই।
কিন্তু এইসব কীর্তিমানদের জীবনেও কালে কালে এমন সময় উপস্থিত হয় যখন ভোগ যশ সবের কথা একেবারে বিসর্জন দিয়ে এরা রত হন যোগে-আত্মায় পরমাত্মা দর্শনের ব্রতে। এ আত্মায় পরমাত্মাদর্শনের শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্তরূপে কালিদাস এঁকেছেন কৈলাসে ধ্যানরত মহাদেবের মূর্তি :
মনো নবদ্বারনিষিদ্ধবৃত্তি হৃদি ব্যবস্থাপ্য সমাধিবশ্যম্।
যমক্ষরং ক্ষেত্রবিদো বিদুস্তমাত্মানমাত্মন্যবলোকয়ন্তম।।[৪]
আত্মায় পরমাত্মা দর্শনের বা উপলব্ধির মাহাত্ম্য সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথও সচেতন, এ সম্পর্কে তাঁর নৈবেদ্যের এই কবিতা স্মরণ করা যেতে পারে :
হে রাজেন্দ্র তোমা-কাছে নত হতে গেলে
যে ঊর্ধ্বে উঠিতে হয়,সেথা বাহু মেলে
লহো ডাকি সুদুর্গম বন্ধুর কঠিন
শৈলপথে; অগ্রসর করো প্রতিদিন
যে মহান পথে তব বরপুত্রগণ
য়াছেন পদে পদে করিয়া অর্জন
মরণ-অধিক দুঃখ। ওগো অন্তরযামী,
অন্তরে যে রহিয়াছে অনির্বাণ আমি
দুঃখে তার লব আর দিব পরিচয়।
তারে যেন ম্লান নাহি করে কোনো ভয়,
তারে যেন কোনো লোভ না করে চঞ্চল।
সে যেন জ্ঞানের পথে রহে সমুজ্জ্বল,
জীবনের কর্মে যেন করে জ্যোতি দান,
মৃত্যুর বিশ্রাম যেন করে মহীয়ান।
কিন্তু তবু কালিদাসের আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিকতার বড় পার্থক্য এই যে রবীন্দ্রনাথ মুখ্যত গুহ্যসাধনাবাদী মরমী নন, ‘বিকাশধর্মী মানবতা’-পন্থী ভগবানে বা পরমাত্মায় তাঁর যতখানি আনন্দ তার চাইতে হয়ত তাঁর বেশি আনন্দ মানুষের জাগতিক জীবনের সর্বাঙ্গীন উল্কর্ষ সাধনায়। এ সম্বন্ধে তাঁর বহু উক্তি স্মরণ করা যেতে পারে, কয়েকটি উদ্ধৃত করছি :
সেই তো আমি চাই।
সাধনা যে শেষ হবে মোর
সে ভাবনা তো নাই।
ফলের তরে নয়তো খোঁজা
কে বইবে সে বিষম বোঝা
যেই ফলে ফল ধুলায় ফেলে
আবার ফুল ফোঁটাই। (গীতালি)
পান্থ তুমি পান্থ জনের সখা হে
পথে চলাই সেই তো তোমায় পাওয়া
যাত্রাপথের আনন্দগান যে গাহে
তারি কণ্ঠে তোমারি গান গাওয়া। (গীতালি)
পতন-অত্যুদয়-বন্ধুর পন্থা, যুগ যুগ ধাবিত যাত্রী,–
হে চির-সারথি, তব রথচক্রে মুখরিত পথ দিন রাত্রী।