উপরোক্ত বিবরণে বুঝা যায় যে, স্বর্গে পিতৃপুরুষগণ বাস করেন এবং সেইখানের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা তাঁহারাই। সৎকর্মে মৃত্যুযন্ত্রণার ভয় থাকে না, অপকর্মে মৃত্যুযন্ত্রণার আশঙ্কা আছে ইত্যাদি।
সু-কিং নামক গ্রন্থখানা চীনদেশের সর্বোৎকৃষ্ট প্রাচীন গ্রন্থ বলিয়া পরিচিত। কনফুসিয়াস ঐ গ্রন্থ সকলন করিয়া যান। মৃত্যুর পর মানুষ কি অবস্থাপ্রাপ্ত হয়, ঐ গ্রন্থের নানা স্থানে তাহার উল্লেখ আছে। তবে কনফুসিয়াস মৃত্যুর পরবর্তীকালের অবস্থার বিষয়ে যে কিছু বলিয়া গিয়াছেন, এরূপ প্রমাণ পাওয়া যায় না।
জনৈক শিষ্য কর্তৃক জিজ্ঞাসিত হইলে, তদুত্তরে কনফুসিয়াস বলিয়াছিলেন, “বর্তমান জীবনের বিষয়ই আমরা অবগত নহি, মৃত্যুর পরে কি হইবে, কে বলিতে পারে?” এতদুক্তিতে কনফুসিয়াস প্রলয়ান্তে পুনঃ সৃষ্টি বা পরলোকে বিশ্বাসী ছিলেন বলিয়া মনে হয় না। তিনি মৃত্যু স্বীকার করিতেন না। তাহার দর্শনানুসারে দেহাংশ পঞ্চভূত, পঞ্চভূতে মিশিয়া যাইবে এবং অশরীরী আত্মা সংসারের মঙ্গল সাধন করিবে।
.
# বৌদ্ধ মত
খ্রী. পূ. ৫৫৬ অব্দে ভারতের কপিলাবস্তু নগরে বুদ্ধদেব জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার প্রবর্তিত ধর্মের নাম বৌদ্ধধর্ম। বৌদ্ধরা পরকাল বা স্বর্গ-নরকের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। বৌদ্ধ মতে, জীব কামনাবশে পুনঃ পুনঃ জন্মগ্রহণ করে এবং জন্মে জন্মে রোগ, শোক ও নানাবিধ দুঃখ ভোগ করিয়া থাকে। সংসারের নানান দুঃখভোগের চিরসমাপ্তির উপায় হইল জন্ম না লওয়া। যতদিন মানুষের মনে কোনোরূপ কামনা-বাসনার লেশমাত্র থাকিবে, ততদিন পর্যন্ত মানুষ পুনঃ পুনঃ জন্মলাভ ও সুখ-দুঃখ ভোগ করিতে থাকিবে। বিত্ত-সম্পদ ও আত্মীয়-পরিজনাদি যাবতীয় বিষয়ের তাবৎ কামনা হইতে মুক্ত হইতে পারিলে, তাহার আর পুনর্জন্ম হয় না। এমতাবস্থাকে বলা হয় মে এবং জন্মরহিতাবস্থাকে বলা হয় নির্বাণ।
বৌদ্ধদের ধর্মপদ নামক গ্রন্থে উক্ত হইয়াছে, “যিনি সকল বন্ধন ছিন্ন করিয়াছেন, যিনি সুখ দুঃখাদিতে অভিভূত নহেন, যাহার কর্মের শেষ হইয়াছে, ভবিষ্যতে তাহার আর সংসারযন্ত্রণা ভোগের আশঙ্কা নাই। … জীবন রক্ষার এবং সুখ সাধনের অনন্ত তৃষ্ণার পরিতৃপ্তির জন্য মানুষকে জন্মে-জন্মে জরা-মৃত্যুর অধীন হইতে হইতেছে। সেই তৃষ্ণার নিবৃত্তির নামই নির্বাণ।” বৌদ্ধ মতে নির্বাণই মনুষ্য জীবনের শেষ পরিণতি। উহাতে স্বর্গ-নরক বা বিচারাদির পরিকল্পনা নাই।
মলুক্য পুত্ত নামক জনৈক ব্যক্তি বুদ্ধদেবকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “দেব! যিনি পূর্ণ বুদ্ধ, মৃত্যুর পর তিনি কি পুনর্জীবন লাভ করিবেন?” বুদ্ধদেব তাহাতে উত্তর দিয়াছিলেন, “এস মলুক্য পুত্ত! আমার শিষ্যত্ব গ্রহণ কর। এই পৃথিবী অনন্তকাল স্থায়ী কি না, আমি তোমাকে তদ্বিষয়ে উপদেশ দিব।” মলুক্য পুত্ত কহিলেন, “আপনি তো আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না?” গৌতম বুদ্ধ উত্তর দিলেন, “হে মলুক্য পুত্ত! এই বিষয় জানিবার জন্য ব্যাকুল হইও না। যদি কোনো ব্যক্তি বিষাক্ত তীর দ্বারা বিদ্ধ হয়, আর সে যদি চিকিৎসককে বলে, কে আমার শরীরে এই তীর বিদ্ধ করিল, সে ব্যক্তি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, কি শূদ্র, তাহা না জানিতে পারিলে আমার ক্ষতস্থানে ঔষধ প্রয়োগ করিতে দিব না –মনে কর দেখি, সেই ব্যক্তির কি পরিণাম হইবে? সেই ক্ষতই তাহার আয়ু শেষ করিবে না কি? সেইরূপ মৃত্যুর পর কি ঘটিবে জানিতে না পারায়, যে ব্যক্তি তত্ত্বজ্ঞান লাভে এবং পবিত্র জীবন যাপনে প্রয়াস না পায়, তাহারও সেই দশা ঘটিবে। মলুক্য পুত্ত! তাই বলি, যে তত্ত্ব আজিও প্রকাশ হয় নাই, তাহা অপ্রকাশই থাকুক।”
.
# চার্বাকীয় মত
চার্বাক বৈদিক যুগের একজন দার্শনিক পণ্ডিত। কথিত আছে যে, তিনি বৃহস্পতির শিষ্য ছিলেন। চার্বাকের দার্শনিক মতটি আসলে বৃহস্পতিরই মত। বৃহস্পতির নিকট এই মত প্রাপ্ত হইয়া চার্বাক উহা সাধারণ্যে প্রকাশ করিয়াছেন বলিয়া ঐ মতটিকে বলা হয় চার্বাক দর্শন। এই মতে –সচেতন দেহ ভিন্ন স্বতন্ত্র আত্মা নাই, পরলোক নাই, সুখই পরম পুরুষাৰ্থ, প্রত্যক্ষমাত্র প্রমাণ; মৃত্তিকা, জল, বায়ু ও অগ্নি হইতে সমস্ত পদার্থের উদ্ভব হইয়াছে ইত্যাদি।
চার্বাকের দর্শনশাস্ত্রের মূল মন্ত্র এই — “যতদিন জীবন ধারণ করা যায়, ততদিন আপনার সুখের জন্য চেষ্টা করা বিধেয়। কারণ সকলকেই একদিন কালগ্রাসে পতিত হইতে হইবে এবং মৃত্যুর পর এই দেহ ভস্মসাৎ হইয়া গেলে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকিবে না। পরলোক বলিয়া কিছুই নাই, সুতরাং পারলৌকিক সুখলাভের প্রত্যাশায় ধর্মোপার্জনের উদ্দেশ্যে আত্মাকে ক্লেশ প্রদান করা নিতান্ত মূঢ়ের কার্য। যে দেহ একবার ভস্মীভূত হয়, তাহার পুনর্জন্ম অসম্ভব। এই স্থূল দেহই আত্মা, দেহাতিরিক্ত অন্য কোনো আত্মা নাই। ক্ষিতি, জল, বহ্নি ও বায়ু –এই চারি। ভূতের সম্মিলনে দেহের উৎপত্তি। যেমন পীতবর্ণ হরিদ্রা ও শুভ্রবর্ণ চুনের সম্মিলনে রক্তিমার। উদ্ভব হয়, অথবা যেমন মাদকতাশূন্য গুড়-তণ্ডুলাদি হইতে সুরা প্রস্তুত হইলে উহা মাদক গুণযুক্ত হয়, সেইরূপ দেহের উৎপত্তি হইলেই তাহাতে স্বভাবত চৈতন্যের বিকাশ হয়। প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ, অনুমানাদি প্রমাণ বলিয়া গণ্য নহে। উপাদেয় খাদ্য ভোজন, উত্তম বস্ত্র পরিধান, স্ত্রীসম্ভোগ প্রভৃতি হইতে উৎপন্ন সুখই পরম পুরুষার্থ। এই সকল সুখের সহিত দুঃখ ভোগ করিতে হয় সত্য, কিন্তু সেই দুঃখে আস্থা প্রদর্শন না করিয়া তন্মধ্যস্থ সুখই উপভোগ করা কর্তব্য, দুঃখের ভয়ে সুখ পরিত্যাগ করা অনুচিত। কণ্টক-শল্কাদিপূর্ণ বলিয়া কে মৎস্যভক্ষণে পরামুখ হয়? তুষ দ্বারা আবৃত বলিয়া কেহ কি ধান্যকে পরিত্যাগ করে?