- বইয়ের নামঃ প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ
- লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ
- প্রকাশনাঃ গার্ডিয়ান পাবলিকেশন্স
- বিভাগসমূহঃ আত্মোন্নয়নমূলক
একজন অবিশ্বাসীর বিশ্বাস
একজন অবিশ্বাসীর বিশ্বাস
আমি রুমে ঢুকেই দেখি সাজিদ কম্পিউটারের সামনে উবুঁ হয়ে বসে আছে। খটাখট কি যেন টাইপ করছে হয়তো। আমি জগ থেকে পানি ঢালতে লাগলাম। প্রচন্ড রকম তৃষ্ণার্ত। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাবার জোগাড়। সাজিদ কম্পিউটার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,- ‘কি রে, কিছু হইলো?’
আমি হতাশ গলায় বললাম,- ‘নাহ। ‘
– ‘তার মানে তোকে একবছর ড্রপ দিতেই হবে?’- সাজিদ জিজ্ঞেস করলো।
আমি বললাম,- ‘কি আর করা। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। ‘
সাজিদ বললো,- ‘তোদের এই এক দোষ,বুঝলি? দেখছিস পুওর এ্যাটেন্ডেন্সের জন্য এক বছর ড্রপ খাওয়াচ্ছে, তার মধ্যেও বলছিস, আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। ভাই, এইখানে কোন ভালোটা তুই পাইলি,বলতো?’
.
সাজিদ সম্পর্কে কিছু বলে নেওয়া দরকার। আমি আর সাজিদ রুমমেট। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক্রো বায়োলজিতে পড়ে। প্রথম জীবনে খুব ধার্মিক ছিলো। নামাজ-কালাম করতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে কিভাবে কিভাবে যেন এগনোষ্টিক হয়ে পড়ে। আস্তে আস্তে স্রষ্টার উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে এখন পুরোপুরি নাস্তিক হয়ে গেছে। ধর্মকে এখন সে আবর্জনা জ্ঞান করে। তার মতে পৃথিবীতে ধর্ম এনেছে মানুষ। আর ‘ইশ্বর’ ধারনাটাই এইরকম স্বার্থান্বেষী কোন মহলের মস্তিষ্কপ্রসূত।
সাজিদের সাথে এই মূহুর্তে তর্কে জড়াবার কোন ইচ্ছে আমার নেই। কিন্তু তাকে একদম ইগনোর করেও যাওয়া যায়না।
আমি বললাম,- ‘আমার সাথে তো এর থেকেও খারাপ কিছু হতে পারতো,ঠিক না?’
– ‘আরে, খারাপ হবার আর কিছু বাকি আছে কি?’
— ‘হয়তো। ‘
– ‘যেমন?’
– ‘এরকমও তো হতে পারতো,ধর, আমি সারাবছর একদমই পড়াশুনা করলাম না। পরীক্ষায় ফেইল মারলাম। এখন ফেইল করলে আমার এক বছর ড্রপ যেতো। হয়তো ফেইলের অপমানটা আমি নিতে পারতাম না। আত্মহত্যা করে বসতাম। ‘
সাজিদ হা হা হা হা করে হাসা শুরু করলো। বললো,- ‘কি বিদঘুটে বিশ্বাস নিয়ে চলিস রে ভাই। ‘
এই বলে সে আবার হাসা শুরু করলো। বিদ্রুপাত্মক হাসি।
.
রাতে সাজিদের সাথে আমার আরো একদফা তর্ক হোলো।
সে বললো,- ‘আচ্ছা, তোরা যে স্রষ্টায় বিশ্বাস করিস, কিসের ভিত্তিতে?’
আমি বললাম,- ‘বিশ্বাস দু ধরনের। একটা হোলো, প্রমানের ভিত্তিতে বিশ্বাস। অনেকটা,শর্তারোপে বিশ্বাস বলা যায়। অন্যটি হোলো প্রমান ছাড়াই বিশ্বাস। ‘
সাজিদ হাসলো। সে বললো,- ‘দ্বিতীয় ক্যাটাগরিকে সোজা বাঙলায় অন্ধ বিশ্বাস বলে রে আবুল,বুঝলি?’
আমি তার কথায় কান দিলাম না। বলে যেতে লাগলাম-
‘প্রমানের ভিত্তিতে যে বিশ্বাস, সেটা মূলত বিশ্বাসের মধ্যে পড়েনা। পড়লেও, খুবই ট্যাম্পোরেরি। এই বিশ্বাস এতই দূর্বল যে, এটা হঠাৎ হঠাৎ পালটায়। ‘
সাজিদ এবার নড়েচড়ে বসলো। সে বললো,- ‘কি রকম?’
আমি বললাম,- ‘এই যেমন ধর,সূর্য আর পৃথিবীকে নিয়ে মানুষের একটি আদিম কৌতূহল আছে। আমরা আদিকাল থেকেই এদের নিয়ে জানতে চেয়েছি, ঠিক না?’
– ‘হু, ঠিক। ‘
– ‘আমাদের কৌতূহল মেটাতে বিজ্ঞান আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে, ঠিক?’
– ‘হ্যাঁ। ‘
– ‘আমরা একাট্টা ছিলাম। আমরা নির্ভুলভাবে জানতে চাইতাম যে, সূর্য আর পৃথিবীর রহস্যটা আসলে কি। সেই সুবাধে, পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা নানান সময়ে নানান তত্ব আমাদের সামনে এনেছেন। পৃথিবী আর সূর্য নিয়ে প্রথম ধারনা দিয়েছিলেন গ্রিক জ্যোতির বিজ্ঞানি টলেমি। টলেমি কি বলেছিলো সেটা নিশ্চয় তুই জানিস?’
সাজিদ বললো,- ‘হ্যাঁ। সে বলেছিলো সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে। ‘
– ‘একদম তাই। কিন্তু বিজ্ঞান কি আজও টলেমির থিওরিতে বসে আছে? নেই। কিন্তু কি জানিস, এই টলেমির থিওরিটা বিজ্ঞান মহলে টিকে ছিলো পুরো ২৫০ বছর। ভাবতে পারিস? ২৫০ বছর পৃথিবীর মানুষ, যাদের মধ্যে আবার বড় বড় বিজ্ঞানি, ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ার ছিলো, তারাও বিশ্বাস করতো যে, সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে।
এই ২৫০ বছরে তাদের মধ্যে যারা যারা মারা গেছে, তারা এই বিশ্বাস নিয়েই মারা গেছে যে, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে। ‘
সাজিদ সিগারেট ধরালো। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললো,- ‘তাতে কি? তখন তো আর টেলিস্কোপ ছিলো না, তাই ভুল মতবাদ দিয়েছে আর কি। পরে নিকোলাস কোপারনিকাস এসে তার থিওরিকে ভুল প্রমান করলো না?’
– ‘হ্যাঁ। কিন্তু কোপারনিকাসও একটা মস্তবড় ভুল করে গেছে। ‘
সাজিদ প্রশ্ন করলো,- ‘কি রকম?’
– ‘অদ্ভুত! এটা তো তোর জানার কথা। যদিও কোপারনিকাস টলেমির থিওরির বিপরীত থিওরি দিয়ে প্রমান করে দেখিয়েছিলেন যে, সূর্য পৃথিবীর চারপাশে নয়, পৃথিবীই সূর্যের চারপাশে ঘোরে। কিন্তু, তিনি এক জায়গায় ভুল করেন। এবং সেই ভুলটাও বিজ্ঞান মহলে বীরদর্পে টিকে ছিলো গোটা ৫০ বছর। ‘
– ‘কোন ভুল?’
– ‘উনি বলেছিলেন, পৃথিবীই সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে, কিন্তু সূর্য ঘোরে না। সূর্য স্থির। কিন্তু আজকের বিজ্ঞান বলে, – নাহ, সূর্য স্থির নয়। সূর্যও নিজের কক্ষপথে অবিরাম ঘূর্ণনরত অবস্থায়। ‘
সাজিদ বললো,- ‘সেটা ঠিক বলেছিস। কিন্তু বিজ্ঞানের এটাই নিয়ম যে, এটা প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হবে। এখানে শেষ বা ফাইনাল বলে কিছুই নেই। ‘
– ‘একদম তাই। বিজ্ঞানে শেষ/ফাইনাল বলে কিছু নেই। একটা বৈজ্ঞানিক থিওরি ২ সেকেন্ডও টেকে না, আবার আরেকটা ২০০ বছরও টিকে যায়। তাই, প্রমান বা দলিল দিয়ে যা বিশ্বাস করা হয় তাকে আমরা বিশ্বাস বলিনা। এটাকে আমরা বড়জোর চুক্তি বলতে পারি। চুক্তিটা এরকম,- ‘তোমায় ততোক্ষণ বিশ্বাস করবো, যতক্ষণ তোমার চেয়ে অথেনটিক কিছু আমাদের সামনে না আসছে। ‘
সাজিদ আবার নড়েচড়ে বসলো। সে কিছুটা একমত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
আমি বললাম,- ‘ধর্ম বা সৃষ্টিকর্তার ধারনা/অস্তিত্ব হচ্ছে ঠিক এর বিপরীত। দ্যাখ, বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মধ্যকার এই গূঢ় পার্থক্য আছে বলেই আমাদের ধর্মগ্রন্থের শুরুতেই বিশ্বাসের কথা বলা আছে। বলা আছে- ‘এটা তাদের জন্য যারা বিশ্বাস করে। ‘ (সূরা বাকারা,০২)।
যদি বিজ্ঞানে শেষ বা ফাইনাল কিছু থাকতো, তাহলে হয়তো ধর্মগ্রন্থের শুরুতে বিশ্বাসের বদলে বিজ্ঞানের কথাই বলা হতো। হয়তো বলা হতো,- ‘এটা তাদের জন্যই যারা বিজ্ঞানমনষ্ক। ‘
কিন্তু যে বিজ্ঞান সদা পরিবর্তনশীল, যে বিজ্ঞানের নিজের উপর নিজেরই বিশ্বাস নেই, তাকে কিভাবে অন্যরা বিশ্বাস করবে?’
সাজিদ বললো,- ‘কিন্তু যাকে দেখিনা, যার পক্ষে কোন প্রমান নেই, তাকে কি করে আমরা বিশ্বাস করতে পারি?’
– ‘সৃষ্টিকর্তার পক্ষে অনেক প্রমান আছে, কিন্তু সেটা বিজ্ঞান পুরোপুরি দিতে পারেনা। এটা বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, সৃষ্টিকর্তার নয়। বিজ্ঞান অনেক কিছুরই উত্তর দিতে পারেনা। লিষ্ট করতে গেলে অনেক লম্বা একটা লিষ্ট করা যাবে। ‘
সাজিদ রাগি রাগি গলায় বললো,- ‘ফাইজলামো করিস আমার সাথে?’
আমি হাসতে লাগলাম। বললাম,- ‘আচ্ছা শোন, বলছি। তোর প্রেমিকার নাম মিতু না?’
– ‘এইখানে প্রেমিকার ব্যাপার আসছে কেনো?’
– ‘আরে বল না আগে। ‘
– ‘হ্যাঁ। ‘
– ‘কিছু মনে করিস না। কথার কথা বলছি। ধর, আমি মিতুকে ধর্ষণ করলাম। রক্তাক্ত অবস্থায় মিতু তার বেডে পড়ে আছে। আরো ধর, তুই কোনভাবে ব্যাপারটা জেনে গেছিস। ‘
– ‘হু। ‘
– ‘এখন বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা কর দেখি, মিতুকে ধর্ষণ করায় কেনো আমার শাস্তি হওয়া দরকার?’
সাজিদ বললো,- ‘ক্রিটিক্যাল কোয়েশ্চান। এটাকে বিজ্ঞান দিয়ে কিভাবে
ব্যাখ্যা করবো?’
– ‘হা হা হা। আগেই বলেছি। এমন অনেক ব্যাপার আছে, যার উত্তর বিজ্ঞানে নেই। ‘
– ‘কিন্তু এর সাথে স্রষ্টায় বিশ্বাসের সম্পর্ক কি?’
– ‘সম্পর্ক আছে। স্রষ্টায় বিশ্বাসটাও এমন একটা বিষয়, যেটা আমরা, মানে মানুষেরা, আমাদের ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য প্রমানাদি দিয়ে প্রমান করতে পারবো না। স্রষ্টা কোন টেলিষ্কোপে ধরা পড়েন না। উনাকে অণুবীক্ষণযন্ত্র দিয়েও খুঁজে বের করা যায়না। উনাকে জাষ্ট ‘বিশ্বাস করে নিতে হয়। ‘
সাজিদ এবার ১৮০ ডিগ্রি এঙ্গেলে বেঁকে বসলো। সে বললো,- ‘ধুর! কিসব বাল ছাল বুঝালি। যা দেখিনা, তাকে বিশ্বাস করে নেবো?’
আমি বললাম,- ‘হ্যাঁ। পৃথিবীতে অবিশ্বাসী বলে কেউই নেই। সবাই বিশ্বাসী। সবাই এমন কিছু না কিছুতে ঠিক বিশ্বাস করে, যা তারা আদৌ দেখেনি বা দেখার কোন সুযোগও নেই। কিন্তু এটা নিয়ে তারা প্রশ্ন তুলে না। তারা নির্বিঘ্নে তাতে বিশ্বাস করে যায়। তুইও সেরকম। ‘
সাজিদ বললো,- ‘আমি? পাগল হয়েছিস? আমি না দেখে কোন কিছুতেই বিশ্বাস করিনা, করবোও না। ‘
– ‘তুই করিস। এবং, এটা নিয়ে তোর মধ্যে কোনদিন কোন প্রশ্ন জাগে নি। এবং, আজকে এই আলোচনা না করলে হয়তো জাগতোও না। ‘
সে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। বললাম,- ‘জানতে চাস?’
– ‘হু। ‘
– ‘আবার বলছি, কিছু মনে করিস না। যুক্তির খাতিরে বলছি। ‘
– ‘বল। ‘
– ‘আচ্ছা, তোর বাবা-মা’র মিলনেই যে তোর জন্ম হয়েছে, সেটা তুই দেখেছিলি? বা,এই মূহুর্তে কোন এভিডেন্স আছে তোর কাছে? হতে পারে তোর মা তোর বাবা ছাড়া অন্য কারো সাথে দৈহিক সম্পর্ক করেছে তোর জন্মের আগে। হতে পারে, তুই ঐ ব্যক্তিরই জৈব ক্রিয়ার ফল। তুই এটা দেখিস নি।
কিন্তু কোনদিনও কি তোর মা’কে এটা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলি? করিস নি। সেই ছোটবেলা থেকে যাকে বাবা হিসেবে দেখে আসছিস, এখনো তাকে বাবা ডাকছিস। যাকে ভাই হিসেবে জেনে আসছিস, তাকে ভাই। বোনকে বোন।
তুই না দেখেই এসবে বিশ্বাস করিস না? কোনদিন জানতে চেয়েছিস তুই এখন যাকে বাবা ডাকছিস, তুই আসলেই তার ঔরসজাত কিনা? জানতে চাস নি। বিশ্বাস করে গেছিস। এখনো করছিস। ভবিষ্যতেও করবি। স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাসটাও ঠিক এমনই রে। এটাকে প্রশ্ন করা যায়না। সন্দেহ করা যায়না। এটাকে হৃদয়ের গভীরে ধারন করতে হয়। এটার নামই বিশ্বাস।’
.
সাজিদ উঠে বাইরে চলে গেলো। ভাবলাম, সে আমার কথায় কষ্ট পেয়েছে হয়তো।
পরেরদিন ভোরে আমি যখন ফজরের নামাজের জন্য অযূ করতে যাবো, দেখলাম, আমার পাশে সাজিদ এসে দাঁড়িয়েছে।আমি তার মুখের দিকে তাকালাম।সে আমার চাহনির প্রশ্নটা বুঝতে পেরেছে। সে বললো,- ‘নামাজ পড়তে উঠেছি।’
একটি সাম্প্রদায়িক আয়াত, এবং…
একটি সাম্প্রদায়িক আয়াত, এবং………….
সেদিন শাহবাগ মোড়ে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। আমি, সাজিদ, রুপম, মিলু, তারেক, শাহরিয়ার আর মিশকাত।
প্রথমেই বলে রাখি, আমাদের মধ্যে সাজিদ হল এক্স-এথেইস্ট। আগে নাস্তিক ছিল, এখন আস্তিক। রুপম আর শাহরিয়ার এখনো নাস্তিক। মার্কস-ই হলো তাদের ধ্যান-জ্ঞান। নিল এক নস্টিক স্রষ্টা কি সত্যিই আছে নাকি আদৌ নাই সেই ব্যাপারে কোন সমাধানে মিলু এগনোষ্টিক। স্রষ্টা কি সত্যিই আছে, নাকি আদৌ নেই- সেই ব্যাপারে কোন সমধানে এখনো আসতে পারেনি। তারেক, মিশকাত আর আমি, আমরা মোটামুটি কোন দিকেই যাই নি এখনও।
সপ্তাহের প্রতি রোববারে আমরা এখানে আড্ডা দেই। আড্ডা না বলে এটাকে পাঠচক্র বলাই যুতসই। সপ্তাহান্তে এখানে এসে আমরা পুরো এক সপ্তাহে কে কি পড়েছি, পড়ে কি বুঝেছি, কি বুঝিনি এসব আলোচনা করি। ভারি ইংরেজিতে যেটাকে বলা হয় ‘বুক রিভিউ’ আরকি।
আজকের আলোচক দু’জন। শাহরিয়ার আর সাজিদ। শাহরিয়ার আলোচনা করবে প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ এর উপর, আর সাজিদ আলোচনা করবে ‘আল কুরানের’ উপর। দু’জনই তুখোড় আলোচক। ‘রিপাবলিক’ নিয়ে শাহরিয়ারের আলোচনা বেশ জম্পেশ ছিল। রিপাবলিকে প্লেটো নীতি নৈতিকতা, মূল্যবোধ, শিষ্টাচার, রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের সংজ্ঞা, রাষ্ট্রের গঠন, উপাদান, পরিবার, নারী-পুরুষের মনস্তত্ব, সমাজে নারী-পুরুষের মূল্যায়ন ইত্যাদির উপর যে সবিস্তর আলোচনা করেছিলেন, শাহরিয়ার খুবই চমৎকার ভাবে তার সারসংক্ষেপ আমাদের সামনে তুলে ধরলো। মনে হচ্ছিল প্লেটোই যেন আমাদের সামনে আঙুল উঁচিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন কোন জিনিসটার কি ব্যাখ্যা, কি কাজ, কি ধর্ম।
শাহরিয়ারের আলোচনা শেষ হলে সাজিদ তার আলোচনা শুরু করে। সেও আল কুরআন নাযিল হবার কারণ, এতে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবার, নারী-পুরুষ এবং এতদসংক্রান্ত যে বিষয়গুলো আছে তার একটি চমৎকার সংক্ষিপ্ত আলোচনা তুলে ধরল। আলোচনা শেষ করার আগে সাজিদ এই বলে শেষ করল যে, আল কোরআন নাজিল হয়েছে সমগ্র মানব জাতির জন্য। এটি যে শুধু মুসলিমদের জন্য, তা নয়। আমাদের সুশীলিয় পরিভাষায় যেটাকে অসাম্প্রদায়িক বলে আর কি।
এতটুকু বলে সাজিদ থেমে গেল।
দুজনের আলোচনায় বেশ প্রফুল্ল ছিল। কিন্তু গন্ডগোল পাকালো রুপম। সাজিদ আল কুরানকে অসাম্প্রদায়িক কিতাব বলছে, এটা সে মেনে নিতে পারেনি।
বলে নিই রুপম সাজিদের ক্লাসমেট। তাই দুজনের মধ্যকার সম্পর্কটি আমি-তুমি বা আমি-আপনি নয়, তুই-তুকারির সম্পর্ক।
রুপম খুবই অবজ্ঞার সুরে সাজিদকে উদ্দেশ্য করে বলল, -‘কোরআন অসম্প্রদায়িক, এইটাও আমাকে শুনতে হলো, হা হা হা হা।’
সাজিদ বলল, -‘হ্যাঁ। অবশ্যই।’
এরপর রুপাম বলল, -‘কোরআনের সাম্প্রদায়িক আয়াত মনে হয় তুই এখনো পড়িস নি। তাই জানিস না।’
-‘আমি না পড়ে থাকলে, তুই পড়ে আমাকে শোনা।’ সাজিদ বলল।
রুপম ইংরেজিতে সূরা আলে ইমরানের ১১৮ নং আর আল মায়েদার ৫১ নং আয়াতটি পড়ে শোনাল। সাথে অনুবাদ করেও পড়লো। সে বলল-
“O you, who believe ! do not take for intimate friends from among others than your own people”
“হে বিশ্বাসীরা, তোমরা মুমিন ব্যতীত অন্য কাউকে বন্ধু হিসেবে গ্রহন কর না”
দেখ, কোরআনই তোদের বলছে, আমাদের মানে অমুসলিমদের বন্ধুরূপে না নিতে। আর তুই বসে বসে এখানে কোরআনকে অসাম্প্রদায়িকতার সার্টিফিকেট দিচ্ছিস। হাস্যকর না? এটা অসাম্প্রদায়িকতার নতুন সংজ্ঞা বুঝি? অমুসলিমদের বন্ধু বানাবা না, খবরদার ! হা হা হা।
আমি একটু চিন্তায় পরলাম। অবজ্ঞা সুরে বলেও রুপমের কথা একেবারে ফেলে দেবার মতো নয়।
অপেক্ষা করছি সাজিদের উত্তরের জন্য।
সাজিল একটু ঝেড়ে কেশে নিল। এরপর বলতে শুরু করল-
‘দেখ রুপম ! কোরআন নাজিল হয়েছে হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর উপর। এখন কোরানের আয়াতগুলো কি আমাদের বুঝতে হবে ঠিক সেভাবে, যেভাবে মুহাম্মদ সাঃ বুঝিয়েছেন। প্লেটোর রিপাবলিক তুই তোর মন মতো ব্যাখ্যা করতে পারিস না বা বুঝে নিতে পারিস না। তোকে ঠিক সেভাবে বুঝতে হবে যেভাবে প্লেটো বুঝিয়েছে। এইটুকু তো কমন সেন্সের ব্যাপার। তাই না?’
রুপম বলল, ‘হুম’
-‘এখন কুরআনকেও আমরা সেই ভাবেই বুঝবো যে ভাবে মোহাম্মদ সাঃ বুঝিয়েছেন। প্রথমে তুই যে আয়াতের কথা বললি সেই আয়াতে আসি। ঐ আয়াতে আল্লাহ আমাদের বলেছেন -অমুসলিমদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ না করতে। এখানে আল্লাহ তালা ‘বন্ধু’ শব্দটার জন্য যে এরাবিক ওয়ার্ড টি ব্যাবহার করেছেন তাহলো ‘আউলিয়া’ রাইট?
রুপম বলল, -‘হতে পারে। আমি তো আর আরবি বুঝি না।’
রূপম আরবি বুঝার কথাও না। সে হিন্দু ফ্যামিলি থেকে উঠে আসা। ব্লগে মুক্তমনা তথা নাস্তিকদের লেখা-যোখা পড়ে কোরান নিয়ে যা একটু জানে। সাজিদ আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, -‘আরিফ, মোবাইল খুলে কোরআনের অ্যাপস থেকে আয়াতটি তেলোয়াত করে শোনা।’
আমি শোনালাম। রুপম বিশ্বাস করল যে, সেই আয়াতে ‘বন্ধু’ শব্দের জন্য আরবি ‘আউলিয়া’ শব্দই ব্যবহার করা হয়েছে।
সাজিদ বললো, -‘শুনলি?’
-‘হ্যাঁ।’
-‘এখন আমরা এটাকে ব্যাখ্যা করব। এর্যাবিকে ‘আউলিয়া’ শব্দটির জন্য দুটি অর্থ করা যায়। এক- বন্ধু, দুই -অভিভাবক। আমরা এখানে সেই অর্থটা নেব, যেটা রাসূল সাঃ থেকে প্রমাণ হয়ে আসবে । তার আগে দুটি বিষয় ক্লিয়ার করি। আউলিয়া শব্দের জন্য বন্ধু আর অভিভাবক দুই অর্থ করা গেলেও এই দুই শব্দের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। বন্ধু মানে বন্ধু। এই যেমন তুই আমার বন্ধু। আমি তোর সাথে এখানে বসে আড্ডা দিচ্ছি, খাচ্ছি। অনেক রাত এক সাথে ঘুমিয়েছি। ক্লাস শেষ করি একসাথে ইত্যাদি। আবার আমার বাবা-মাও আমার বন্ধু। কিন্তু তুই আর আমার বাবা-মা কি একই রকম বন্ধু? না পার্থক্য আছে। তারা আমার অভিভাবক বন্ধু। তোর সাথে বন্ধুত্বের যে ডেফিনিশন, তাদের সাথে সামথিং মোর দ্যান দ্যাট, রাইট?’
রুপম মাথা নাড়ালো।
সাজিদ আবার বলতে লাগল, -‘আমার বাবা-মা আমার যাবতীয় সিক্রেট জানে। আমার দুর্বলতা কোথায় জানে। তুই জানিস?’
-‘নাহ।’
-‘এবার মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনীতে যা। তুই সেখানে দেখবি- তিনি অমুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব করেছেন। অমুসলিমদের সাথে ব্যবসা বাণিজ্য করেছেন। তাদের সাথে খেয়েছেন, কাজ করেছেন, কতো কি। মানে এখন আমি যা যা তোর সাথে করি, সেরকম। তাই না?’
আমাদের সবাই মাথা নাড়ালাম রূপম ও মাথা নাড়ালো।
-‘তাহলে দেখা যাচ্ছে এই আয়াতে ‘আউলিয়া’ অর্থে আমরা বন্ধু শব্দ টা নিতে পারব না, কারণ আল্লাহ তালা যদি ‘আউলিয়া’ শব্দটি দ্বারা বন্ধুই বুঝাতেন, তাহলে রাসূল সাঃ কখনোই অমুসলিমদের সাথে ওঠাবসা করতেন না। তাহলে প্রশ্ন এখানে ‘আউলিয়া’ শব্দের কোন অর্থ বুঝানো হয়েছে? হ্যাঁ, এখানে ‘আউলিয়া’ শব্দ দিয়ে বুঝানো হয়েছে ‘অভিভাবক’। আল্লাহ আমাদের বলেছেন, – ‘হে বিশ্বাসীরা ! তোমরা অমুসলিমদের অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করো না।’
একজন অভিভাবক হলো সেই, যে আমাদের যাবতীয় গোপন খবর জানবে। আমাদের শক্তি, আমাদের কৌশল, আমাদের দুর্বলতা জানবে। এখন আল্লাহ বলেছেন, অমুসলিমদের অভিভাবক হিসেবে নিও না। মানে, অমুসলিমদের কাছে তোমরা তোমাদের সিক্রেট বলে দিও না। কারণ এতে কোনো এক সময় হিতে বিপরীত হতে পারে। বিপদ হতে পারে।
-‘কি রকম বিপদ?’-তারেক জিজ্ঞেস করল।
সাজিদ বলল, -‘যেমন, ইসলামের প্রথম জিহাদ কোনটি? বদর যুদ্ধ তাই না?’
-‘হ্যাঁ।’ -আমি বললাম
-‘সেই যুদ্ধে মুসলিমদের সৈন্য সংখ্যা কত ছিল? মাত্র ৩১৩ জন। আর প্রতিপক্ষের সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় এক হাজার না কত। তাইতো?’
-‘হু’
-‘ধর, সেই যুদ্ধের আগে মুসলিমরা যদি অমুসলিমদের কাছে গিয়ে বলতো, -জানো আমরা না মাত্র ৩১৩ জন নিয়ে ওদের সাথে লড়বো।
এইটা কি ঠিক হতো? না, হতো না। কেউ না কেউ এই খবর প্রতিপক্ষের কানে পৌঁছে দিত। তখন কি হতো? প্রতিপক্ষের মনে সাহস বেড়ে যেত। এটা কি শুভ হতো? আজকের দিনে কোন দেশ কি এই ফর্মুলা এপ্লাই করবে? আমেরিকা কি তার সামরিক শক্তির কথা চীন বা রাশিয়ার কাছে শেয়ার করে? করে না। ঠিক একইভাবে আল্লাহ বলেছেন, -ওদের তোমরা অভিভাবক হিসেবে নিও না।
এটা একটা সেইফটি। এখানে বন্ধু বানাতে নিষেধ করেনি, নিষেধ করেছে অভিভাবক না বানাতে।’
আমরা চুপ করে আছি। রুপমও কিছু বলছে না।
এবার সাজিদ বলল, -‘রুপম, ফার্স্ট ইয়ার থেকেই আমি তোর বন্ধু। আমাদের বন্ধুত্বের আজকে চার বছর চলছে। এই চার বছরের বন্ধুত্বের তুই কোনদিন আমাকে তোর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর দিয়েছিস? হা হা হা। দিস নি। তোর ক্রেডিট কার্ডের গোপন নাম্বার কোনদিন আমায় বলেছিস? বলিস নি। এমন কি কোন দিন তোর ফেসবুক পাসওয়ার্ডটিও তো দিলি না বেটা। হা হা হা। কেন দিলি না? কারণ, আমি তোর বন্ধু, তোর অভিভাবক নই।
এখন কি আমি তোকে বলতে পারি, রুপম তুই বেটা আস্ত একটা সাম্প্রদায়িক ফ্রেন্ড, বলতে পারি? হা হা হা।
সাজিদ রূপমের মুখের দিকে চেয়ে আছে কোন একটি উত্তরের আশায়। রুপম কিছু না বলে পিক করে হেসে দিল। মনে হচ্ছে সাজিদের কথায় সে খুব মজা পেয়েছে।
কুরআন কি মুহাম্মদ (সা.) এর বানানো গ্রন্থ
কুরআন কি মুহাম্মদ (সা.) এর বানানো গ্রন্থ
বিরাট আলিশান একটি বাড়ি। মোঘল আমলের সম্রাটেরা যেরকম বাড়ি বানাতো, অনেকটাই সেরকম। বাড়ির সামনে দৃষ্টিনন্দন একটি ফুলের বাগান। ফুলের বাগানের মাঝে ছোট ছোট কৃত্রিম ঝর্ণা আছে। এই বাড়ির মালিকের প্রশংসা করতেই হয়। ঢাকা শহরের মধ্যে এটি যেন একটুকরো স্বর্গখন্ড।
কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হল, বাগানের কোথাও লাল রঙের কোন ফুল নেই। এত বড় বাগানবাড়ি, অথচ কোথাও একটি গোলাপের চারা পর্যন্ত নেই। বিস্ময়য়ের ব্যাপার তো বটেই।
আমরা এসেছি সাজিদের দুর সম্পর্কের খালুর বাসায়। ঢাকা শহরে বড় বড় ব্যবসা আছে। বিদেশেও নিজের ব্যবসা বাণিজ্য শাখা প্রশাখা ছড়িয়েছেন। ছেলেমেয়েদের কেউ লন্ডন, কেউ কানাডা আর কেউ সুইজাল্যান্ডে থাকে। ভদ্রলোক উনার স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকাতেই রয়ে গেছেন কেবল শিকড়ের টানে।
তবে, ঢাকায় নিজের বাড়িখানাকে যেভাবে তৈরি করেছেন, বোঝার উপায় নেই যে, এটি ঢাকার কোন বাড়ি, নাকি মস্কোর কোন ভিআইপি ভবন।
আমাকে এদিক সেদিক তাকাতে দেখে সাজিদ প্রশ্ন করল, -‘এভাবে চোরের মত এদিক ওদিক তাকাচ্ছিস কেনো?’
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার মত করে বললাম, -‘না, আসলে তোর খালুকে নিয়ে ভাবছি।’
-‘ওনাকে নিয়ে ভাবার কি আছে?’
আমি বললাম, -‘অসুস্থ মানুষদের নিয়ে ভাবতে হয়। এটাও এক প্রকার মানবতা, বুঝলি?’
সাজিদ আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বলল, -‘অসুস্থ মানে? কে অসুস্থ?’
-‘তোর খালু’
-‘তোকে কে বললো উনি অসুস্থ?’
আমি দাঁড়ালাম। বললাম, -‘তুই এত কিছু খেয়াল করিস, এটা করিস নি?’
-‘কোনটা?’
-‘তোর খালুর বাগানের কোথাও কিন্তু লাল রঙের কোন ফুলগাছ নেই। প্রায় সব রঙের ফুল গাছ আছে, লাল ছাড়া। এমনকি, গোলাপের একটি চারাও নেই।’
-‘তো?’
-‘তো আর কি? তিনি হয়তো রেড কালার ব্লাইন্ড। স্পেশিফিকলি, রেড কালার ব্লাইন্ড।’
সাজিদ কিছু বললো না। হয়তো সে এটা নিয়ে আর কোন কথা বলতে চাচ্ছে না। অথবা আমার যুক্তিতে সে হার মেনেছে।
সাজিদ কলিংবেল বাজালো।
ঘরের দরজা খুলে দিলো একটি তের-চৌদ্দ বছর বয়সী ছেলে। সম্ভবত কাজের ছেলে।
আমরা ভেতরে ঢুকলাম। ছেলেটি বলল, -‘আপনারা এখানে বসুন। আমি কাকাকে ডেকে দিচ্ছি।’
ছেলেটা একদম শুদ্ধ বাংলায় কথা বলছে। বাড়ির মালিককে স্যার বা মালিক না বলে কাকা বলছে। সম্ভবত উনার কোন গরীব আত্মীয়ের ছেলে হবে হয়তো। যাদের খুব বেশি টাকা পয়সা হয়, তারা গ্রাম থেকে গরীব আত্মীয়দের বাসার কাজের চাকরি দিয়ে দয়া করে।
ছেলেটা ভদ্রলোকটি ডাকার জন্য সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। ঘরের ভেতরটা আরো চমৎকার। নানান ধরনের দামি দামি মার্বেল পাথর দিয়ে দেয়াল সাজানো।
দু’তলার কোন এক রুম থেকে রবীন্দ্রনাথের গানের সুর ভেসে আসছে, -‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে…..’
আমি সাজিদকে বললাম, -‘কিরে তোর এরকম মোঘলাই স্টাইলের একটা খালু আছে, কোনদিন বললি না যে?’
সাজিদ রসকষহীন চেহারায় বলল, -‘মোঘলাই স্টাইলের খালু তো, তাই বলা হয়নি।’
-‘তোর খালুর নাম কি?’
-‘এম এম আলী।’
ভদ্রলোকের নামটা ওনার বাড়ির মতোই গাম্ভীর্যপূর্ণ। আমি জিজ্ঞেস করলাম, -‘এম এম আলী মানে কি?’
সাজিদ আমার দিকে তাকালো। বলল, -‘মোহাম্মদ মহব্বত আলী।’
ভদ্রলোকের বাড়ি আর ঐশ্বর্যের সাথে নামটা একদম যাচ্ছে না। এজন্য হয়ত মোহাম্মদ মহব্বত আলী নামটাকে শর্টকাট করে এম এম আলী করে নিয়েছেন।
ভদ্রলোক আমাদের সামনের সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসলেন। মধ্যবয়স্ক। চেহারায় বার্ধক্যের কোন ছাপ নেই। চুল পেকেছে, তবে কলপ করায় তা ভালোমতো বোঝা যাচ্ছে না।
তিনি বললেন। -‘তোমাদের মধ্যে সাজিদ কে?’
আমি লোকটার প্রশ্ন শুনে অবাক হলাম খুব। সাজিদের খালু, অথচ সাজিদকে চিনে না। এটা কি রকম কথা?
সাজিদ বলল, -‘জি, আমি।’
-‘হুম, I guessed that’ –লোকটা বলল। আরো বলল, -‘তোমার কথা বেশ শুনেছি, তাই তোমার সাথে আলাপ করার ইচ্ছে জাগলো।’
আমাদের কেউ কিছু বললাম না। চুপ করে আছি।
লোকটা আবার বলল, -‘প্রথমে আমার সম্পর্কে দরকারি কিছু কথা বলে নিই। আমার পরিচয় তো তুমি জানোই, সাজিদ। যেটা জানো না, সেটা হলো, -বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে আমি একজন অবিশ্বাসী। খাঁটি বাংলায় নাস্তিক। হুমায়ুন আজাদকে তো চেনো, তাই না? আমরা একই ব্যাচের ছিলাম। আমি নাস্তিক হলেও আমার ছেলেমেয়েরা কেউই নাস্তিক নয়। সে যাহোক, এটা নিয়ে আমার মাথা ব্যাথা নেই। আমি ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী।’
সাজিদ বলল, -‘খালু, আমি সব জানি।’
লোকটা অবাক হবার ভান করে বললো, -‘জানো? ভেরি গুড। ক্লেভার বয়।’
-‘খালু, আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন কেন তা বলুন।’
-‘ওয়েট ! তাড়াহুড়া কিসের?’ -লোকটা বলল।
এরই মধ্যেই কাজের ছেলেটা ট্রেতে করে চা নিয়ে এল। আমরা চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। লোকটাকে একটি আলাদা কাপে চা দেয়া হল। সেটা চা নাকি কফি, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
লোকটি বলল, -‘সাজিদ, আমি মনে করি, তোমাদের ধর্মগ্রন্থ, আই মিন আল-কোরআন, সেটা কোন ঐশী গ্রন্থ নয়। এটা মোহাম্মদের নিজের লেখা একটি বই। মোহাম্মদ করেছে কি, এটাকে জাস্ট স্রষ্টার বাণী বলে চালিয়ে দিয়েছে।’
এইটুকু বলে লোকটা আমাদের দুজনের দিকে তাকাল। হয়তো বোঝার চেষ্টা করলো আমাদের রিএকশন কি হয়।
কিছু বলার আগেই লোকটি আবার বলল, ‘হয়তো বলবে, মুহাম্মদ লিখতে-পড়তে জানত না। সে কিভাবে এরকম একটি গ্রন্থ লিখবে? ওয়েল। এটা খুব লেইম লজিক। মুহাম্মদ লিখতে পড়তে না জানলে কি হবে, তার ফলোয়ারদের অনেকে লিখতে পড়তে পারতো। উচ্চশিক্ষিত ছিল। তারা করেছে কাজটা মোহাম্মদের ইশারায়।’
সাজিদ তার কাপে শেষ চুমুক দিল। তখনও সে চুপচাপ।
লোকটা বলল, -‘কিছু মনে না করলে আমি একটি সিগারেট ধরাতে পারি? অবশ্য কাজটি ঠিক হবে না জানি।’
আমি বললাম, -‘শিওর !’
এতক্ষণ পরে লোকটি আমার দিকে ভালো মত তাকালো। একটি মুচকি হাসি দিয়ে বলল, -‘Thank you’
সাজিদ বলল, -‘খালু, আপনি খুবই লজিক্যাল কথা বলেছেন। কোরআন মুহাম্মদ সা. এর নিজের বানানো হলেও হতে পারে। কারণ, কুরআন যে ফেরেশতা নিয়ে আসতো বলে দাবি করা হয়, সেই জিব্রাইল আঃ কে মুহাম্মদ সা. ছাড়া কেউই কোনো দিন দেখেনি।’
লোকটা বলে উঠল, -‘এক্সাক্টলি, মাই সান’
-‘তাহলে, কোরানকে আমরা টেস্ট করতে পারি, কি বলেন খালু?’
-‘হ্যাঁ হ্যাঁ, করা যায়…..’
সাজিদ বলল, -‘কোরআন মুহাম্মদ সা. এর বানানো কিনা, তা বুঝতে হলে আমাদের ধরে নিতে হবে যে, মুহাম্মদ সা. স্রষ্টার কোন দূত নন। তিনি খুবই সাধারন, অশিক্ষিত একজন প্রাচীন মানুষ।’
লোকটা বলল, -‘সত্যিকার অর্থে মোহাম্মদ অসাধারণ কোন লোক ছিলেন না। স্রষ্টার দূত তো পুরোটাই ভুয়া।’
সাজিদ মুচকি হাসলো। বললো, -‘তাহলে এটাই ধরে নেই?’
-‘হুম’- লোকটার সম্মতি।
সাজিদ বলতে লাগল। -‘খালু ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি হযরত ইউসুফ আঃ এর জন্ম হয়েছিল বর্তমান ফিলিস্তিনে। ইউসুফ আঃ ছিলেন হযরত ইয়াকুব আঃ এর কনিষ্ঠতম পুত্র। ইয়াকুব আঃ এর কাছে ইউসুফ আঃ ছিলেন প্রাণাধিক প্রিয়। কিন্তু, ইয়াকুব আঃ এর ভালোবাসা ইউসুফ আঃ এর জন্য কাল হলো। তার ভাইয়েরা ষড়যন্ত্র করে ইউসুফ আঃ কে কূপে নিক্ষেপ করে দেয়। এরপর, কিছু বনিকদল কূপ থেকে ইউসুফ আঃ কে উদ্ধার করে তাকে মিশরে নিয়ে আসে। তিনি মিশরের রাজ পরিবারে বড় হন। ইতিহাস মতে, এটি ঘটে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের আমেনহোটেপ এর রাজত্বকালের আর তিনশো বছর পূর্বে। খালু, এই বিষয়ে আপনার কোন দ্বিমত আছে?’
লোকটা বলল, -‘নাহ। কিন্তু, এগুলো দিয়ে তুমি কি বোঝাতে চাও?’
সাজিদ বলল, -‘খালু, ইতিহাস থেকে আমরা আরো জানতে পারি, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে চতুর্থ আমেনহোটেপ এর আগে যে সকল শাসকেরা মিশরকে শাসন করেছে, তাদের সবাইকেই ‘রাজা’ বলে ডাকা হতো। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে চতুর্থ আমেনহোটেপ এর পরে যে সকল শাসকেরা মিশরকে শাসন করেছিল তাদের সবাইকে ‘ফেরাউন’ বলে ডাকা হতো। ইউসুফ সা. মিশরকে শাসন করেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব চতুর্দশ শতকের চতুর্থ আমেনহোটেপ এর আগে। আর, মুসা আঃ মিশরে জন্ম লাভ করেছিলেন চতুর্থ আমেনহোটেপ এর কমপক্ষে আরও ২০০ বছর পরে। অর্থাৎ, যখন জন্মগ্রহণ করেন, তখন মিশরের শাসকদের আর ‘রাজা’ বলা হতো না, ‘ফেরাউন’ বলা হতো।’
-‘হুম, তো?’
-‘কিন্তু খালু, কোরআনে ইউসুফ আঃ এবং মুসা আঃ দুইজনের কথাই আছে। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, কোরআন ইউসুফ আঃ এর বেলায় শাসকদের ক্ষেত্রে ‘রাজা’ শব্দ ব্যবহার করলেও, একই দেশের, মুসা আঃ এর সময়কার শাসকদের বেলায় ব্যবহার করেছে ‘ফিরাউন’ শব্দটি। বলুন তো খালু, মরুভুমির বালুতে উট চরানো বালক মুহাম্মদ সা. ইতিহাসের এই পাঠ কোথায় পেলেন? তিনি কিভাবে জানতেন যে ইউসুফ আলাই সালাম এর সময়ের শাসকদের রাজা বলা হতো মুসা আলাই সাল্লাম এর সময়কার শাসকদের ফেরাউন এবং ঠিক সেই মতো শব্দ ব্যবহার করে তাদের পরিচয় দেওয়া হল?
মহব্বত আলী নামের ভদ্রলোকটি হো হো হো করে হাসতে লাগলো। বললো, -‘মুসা আর ইউসুফ এর কাহিনী তো বাইবেলেও ছিল। সেখান থেকে কপি করেছে, সিম্পল।’
সাজিদ মুচকি হেসে বলল, -‘খালু ম্যাটার অফ সরো দ্যাট, বাইবেল এই জায়গায় চরম একটি ভুল করেছে। বাইবেল ইউসুফ আঃ এবং মুসা আঃ দুজনে সময়কার শাসকদের জন্যই ‘ফেরাউন’ শব্দ ব্যবহার করেছে, যা ঐতিহাসিক ভুল। আপনি চাইলে আমি আপনাকে বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে প্রমাণ দেখাতে পারি।’
লোকটা কিছুই বলল না চুপ করে আছে। সম্ভবত উনার প্রমান দরকার হচ্ছে না। সাজিদ বলল, -‘যে ভুল হয় বাইবেল করেছে, সে ভুল অশিক্ষিত আরবের বালক মুহাম্মদ সা. এসে ঠিক করে দিল, তা কিভাবে সম্ভব, যদি না তিনি কোন প্রেরিত দূত হন, আর কোরআন কোন ঐশী গ্রন্থ না হয়?’
লোকটি চুপ করে আছে। এর মধ্যেই তিনটি সিগারেট খেয়ে শেষ করেছে। নতুন আরেকটি ধরাতে ধরাতে বলল, -‘হুম, কিছুটা যোক্তিক।’
সাজিদ আবার বলতে লাগল, -‘খালু, কোরআনে একটি সূরা আছে। সূরা আল ফজর নামে। ৬ নম্বর আয়াতটি এরকম, -‘তোমরা কি লক্ষ্য করনি, তোমাদের পালনকর্তা ইরাম গোত্রের সাথে কিরূপ ব্যবহার করেছেন?’
এই সূরা ফাজরে মূলত আদ জাতি সম্পর্কে বলা হয়েছে। আদ জাতির আলাপের মধ্যে হঠাৎ করে ‘ইরাম’ নামে একটি শব্দ চলে এলো, যা কেউই জানত না এটা আসলে কি। কেউ কেউ বলল, এটা আদ জাতির কোন বীর পালোয়ানের নাম, কেউ কেউ বলল, এই ইরাম হতে পারে আদ জাতির শারীরিক কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্য। কারণ এই সূরায় আদ জাতির শক্তিমত্তা নিয়ে আয়াত আছে। মোদ্দাকথা এই ইরাম আসলে কি সেটা সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা কেউ দিতে পারেনি তখন। এমনকি গোটা পৃথিবীর কোন ইতিহাসে ইরাম নিয়ে কিছুই বলা ছিল না। কিন্তু ১৯৭৩ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি সিরিয়ার মাটির নিচে শহর এর সন্ধান পায়। এটি ছিল আদ জাতিদের শহর। সেই শহরে পাওয়া যায় সুপ্রাচীন উচু উচু দালান। এমনকি এই শহরে আবিষ্কার হয় তখনকার একটি লাইব্রেরী। লাইব্রেরীতে একটি তালিকা পাওয়া যায়। এই তালিকায় তারা যেসকল শহরের সাথে বাণিজ্য করতো সেসব শহরের নাম উল্লেখ ছিল। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য এই -সেই তালিকায় ‘ইরাম’ নামের একটি শহরের নাম পাওয়া যায়, যেটা আদ জাতিদের একটি শহর ছিল। শহরটি ছিলো পাহাড়ের মধ্যে। এতেও ছিল সুউচ্চ দালান ।
চিন্তা করুন, যে ‘ইরাম’ শব্দের সঠিক ব্যাখ্যা এর পূর্বে তাফসিরকারকরাও করতে পারেনি। কেউ এটাকে বীরের নাম, কেউ এটাকে আদ জাতির শারীরিক বৈশিষ্ট্যের নাম বলে ব্যাখ্যা করেছে।
১৯৭৩ সালের আগে যে ‘ইরাম’ শহরের সন্ধান পৃথিবীর তাবৎ ইতিহাসে ছিল না, কোন ভূগোলবিদ, ইতিহাসবিদই এই শহরের সম্পর্কে কিছুই জানতো না, প্রায় ৪৩ শত বছর আগের আদ জাতিরদের সেই শহরের নাম কিভাবে কোরআন উল্লেখ করলো? যেটা আমরা জেনেছি ১৯৭৩ সালে, সেটা মুহাম্মদ সা. কিভাবে আরবের মরুভূমিতে বসে ১৪০০ বছর আগে জানলো? হাউ পসিবল? তিনিতো অশিক্ষিত ছিলেন। কোনদিন ইতিহাস-বা ভূগোল পড়েননি। কিভাবে জানলেন খালু?’
আমি খেয়াল করলাম, লোকটার চেহারা থেকে মোঘলাই ভাবটা সরে যেতে শুরু করেছে। পুত্রতুল্য ছেলের কাছ থেকে তিনি এতটা শক খাবেন, হয়তো আশা করেন নি।
সাজিদ আবার বলতে লাগল-
‘খালু আর রহমান নামে কোরআন একটি সূরা আছে। এই সূরার ৩৩ নম্বর আয়াতে বলা হচ্ছে, –
‘হে জিন ও মানুষ ! তোমরা যদি আসমান ও জমিনের সীমানায় প্রবেশ করতে পারো, তবে কর। যদি তোমরা তা পারবেনা প্রবল শক্তি ছাড়া।’
মজার ব্যাপার হলো, এই আয়াতটি মহাকাশ ভ্রমন নিয়ে। চিন্তা করুন, আজ থেকে চোদ্দশ বছর আগে আরবের লোক যাদের কাছে যানবাহন বলতে কেবল ছিল উট আর গাধা, ঠিক সেই সময়ে বসে মুহাম্মদ সা. মহাকাশ ভ্রমন নিয়ে কথা বলছে, ভাবা যায়?
সে যাহোক, আয়াতটিতে বলা হল, -‘যদি পারো আসমান ও জমিনের সীমানায় প্রবেশ করতে, তবে কর।’
এটি একটি কন্ডিশন ও (শর্তবাচক) বাক্য। এ বাক্যে শর্ত দেওয়ার জন্য If (যদি) ব্যবহার করা হয়েছে।
খালু, আপনি যদি অ্যারাবিক ডিকশনারি দেখেন, তাহলে দেখবেন আরবিতে ‘যদি’ শব্দের জন্য দুটি শব্দ আছে। একটি হল ‘লাও’ অন্যটি হলো ‘ইন’। দুটোর অর্থই ‘যদি’। কিন্তু এই দুটোর মধ্যে একটি সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। পার্থক্যটি হল -আরবিতে শর্তবাচক বাক্যে ‘লাও’ তখনই ব্যবহার করা হয়, যখন সেই শর্ত কোনোভাবেই পূরণ সম্ভব হবে না। কিন্তু শর্ত বাচক বাক্যে ‘যদি’ শব্দের জন্য ‘ইন’ ব্যবহার করা হয়, তখন নিশ্চয়ই এই শর্তটা পূরণ সম্ভব।
আশ্চর্যজনক ব্যাপার, কোরআনের সূরা আর রহমান এর ৩৩ নম্বর আয়াতে ‘লাও’ ব্যবহার না করে ‘ইন’ ব্যবহার করা হয়েছে। মানে কোন একদিন জ্বিন এবং মানুষেরা মহাকাশ ভ্রমণে সফল হবেই। আজকে কি মানুষ মহাকাশ জয় করে নি? মানুষ চাঁদে যায়নি? মঙ্গলে যাচ্ছে না ?
দেখুন, চৌদ্দশ বছর আগে যখন মানুষের ধারণা ছিল একটি ষাঁড় তার দুই শিং এর মধ্যে পৃথিবীকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক তখন কোরআন ঘোষণা করছে, মহাকাশ ভ্রমনের কথা। সাথে বলেও দিচ্ছে, একদিন তা আমরা পারবো। আরবের নিরক্ষর মুহাম্মদ সা. কিভাবে এই কথা বলতে পারে?’
এম এম আলী ওরফে মোহাম্মদ মহব্বত আলী নামের এই ভদ্রলোকের চেহারা থেকে ‘আমি নাস্তিক, আমি একেবারে নির্ভুল’ টাইপ ভাবটা একেবারে উধাও হয়ে গেল। এখন তাকে যুদ্ধাহত এক ক্লান্ত সৈনিকের মত দেখাচ্ছে।
সাজিদ বলল, -‘খালু, খুব অল্প পরিমাণ বললাম। এরকম আরো শ’খানেক যুক্তি দিতে পারব যা দিয়ে প্রমাণ করে দেওয়া যায়, কোরআন মুহাম্মদ সা. এর নকল করে লেখা কোন কিতাব নয়। এটি স্রষ্টার পক্ষ থেকে আসা একটি ঐশী গ্রন্থ। যদি বলেন, মোহাম্মদ সা. নিজের প্রভাব বিস্তারের জন্য এই কিতাবে লিখছে, আপনাকে বলতে হয়, এই কিতাবের জন্যই মুহাম্মদ সা. কে বরণ করতে হয়েছে অবর্ণনীয় কষ্ট, যন্ত্রণা। তাকে বলা হয়েছিল, তিনি যা প্রচার করেছেন তা থেকে বিরত হলে তাকে মক্কার রাজত্ব দেওয়া হবে। তিনি তা গ্রহণ করেননি। খালু, নিজের ভাল তো পাগলেও বুঝে। মুহাম্মদ সা. বুঝলাম না কেন? এইসবই কি প্রমাণ করে না কোরআনের ঐশী সত্যতা?’
লোকটা কোন কথাই বলছে না। সিগারেটের প্যাকেটে আর কোন সিগারেট নেই। আমরা ঊঠে দাড়ালাম। বের হতে যাবো, অমনি সাজিদ ঘাড় ফিরে লোকটাকে বলল, -‘খালু একটি ছোট প্রশ্ন ছিল।’
-‘বলো।’
-‘আপনার বাগানে লাল রঙের ফুল গাছ নেই কেন?’
লোকটি বলল, -‘আমি রেড কালার ব্লাইন্ড। লাল রং দেখি না।’
সাজিদ আমার দিকে ফিরল। অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, -‘জ্যোতিষী আরিফ আজাদ, ইউ আর কারেক্ট।’
কুরআন কি মুহাম্মদ (সাঃ) এর নিজের কথা?
কুরআন কি মুহাম্মদ (সাঃ) এর নিজের কথা?
সাজিদ একটি মজার গল্প বলতে শুরু করলো। গল্প বলার আগে কয়েকবার ঝেড়ে কেশে নিল সে।
সাজিদ যখন কোন গল্প বলতে শুরু করে, তখন সে গল্পটির একটি সুন্দর নাম দেয়। এখন সে যে গল্পটি বলতে শুরু করেছে, সেটার নাম ‘নিউটন-আইনস্টাইন সমঝোতা এবং বোকা আইনস্টাইনের বিজ্ঞানী হাবলুর কাছে নতিস্বীকার।’
এখানে নিউটন আর আইনস্টাইনকে তো চিনিই, কিন্তু বিজ্ঞানী হাবলুটা যে আসলে কে, সেটা ঠিক বুঝলাম না। প্রথমে না বুঝলেও কিছু করার নেই। গল্প শুরু না হলে সাজিদকে এ নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না। এটা তার গল্প ক্লাসের প্রাথমিক শর্ত।
শুধু যে এটা বুঝি নি তা নয়। আরেকটি ব্যাপার বুঝলাম না। গল্পের নামে বলা হল ‘নিউটন-আইনস্টাইন এর সমঝোতা’ বিজ্ঞানী নিউটনের সাথে তো বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের কোনদিন সাক্ষাৎও হলো না। দুজন সম্পূর্ন দুই প্রজন্মের। তাদের মধ্যে তাহলে সমঝোতাই কিভাবে হল? মনের মধ্যে প্রশ্ন দুটো কুটকুটানি শুরু করে দিলো। না পারছি চেপে রাখতে, না পারছি উগড়ে দিতে।
সাজিদ গল্প বলা শুরু করলো। সাজিদের গল্প ক্লাসে উপস্থিত আছি আমি, রাব্বি, রোহান, মোস্তফা আর সবুজ। আমাদের মধ্যে রোহান নাস্তিক টাইপের। পুরোপুরি নাস্তিক নয়, এগনোষ্টিক বলা যেতে পারে। তার ধারণা, মুহাম্মদ সা. নিজের কথাগুলোকে ঈশ্বরের বাণী বলে চালিয়ে দিয়েছে।
যাহোক, আজকে কুরআনের বিশুদ্ধতা প্রমাণের জন্য তারা বসে নি। গল্প শুনতে বসেছে। এই সপ্তাহে সাজিদ গল্প বলবে। এর পরের সপ্তাহে আরেকজন। তার পরের সপ্তাহে আরেকজন, এভাবে।
সাজিদ বলতে শুরু করল, –
‘আজকে বলবো মহাকাশ নিয়ে গল্প। মহাকাশ নিয়ে বলার আগে বলে নিই, তখনও অ্যাস্ট্রোনমি তথা জ্যোতিবিদ্যা পদার্থবিদ্যার আওতাভুক্ত হয়নি। অন্তত মহাকাশ নিয়ে বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীদের মধ্যে ছিল ব্যাপক রকম মত পার্থক্য। এই জিনিসটা পদার্থবিদ্যার আওতায় আসার আগে এটা ফিলোসফির বিষয় ছিল। কারো ধারণা ছিল মহাকাশ অসীম, মানে মহাকাশের কোন শেষ নেই। কারো ধারণা ছিল মহাকাশ অসীম নয়, মহাকাশ সসীম। এটি একটি নির্দিষ্ট জায়গার মধ্যে সীমাবদ্ধ।
এ দুয়ের বাইরে গিয়ে আরেকদল মনে করত, মহাকাশ অসীম, তবে স্থির। অর্থাৎ, এর নির্দিষ্ট সীমা নেই ঠিক, কিন্তু এটি স্থির।
বিজ্ঞানী নিউটনও তৃতীয় ধারনাটির পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি তার বিখ্যাত ‘মহাকর্ষীয় তত্ত্ব’ আবিস্কার করে তখন বিজ্ঞানী মহলে ব্যাপক হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু, এত জনপ্রিয় একটি তত্ত্বের মধ্যে খুবই সূক্ষ্ম একটি ঘাপলা রয়ে গিয়েছিল।’
নিউটনের সূত্রের মধ্যে ঘাপলা ছিল শুনে ম্যানেজমেন্টের ছাত্র রাব্বি তার চোখ বড় বড় করে বলল, -‘বলিস কি? প্রতিষ্ঠিত সূত্রের মধ্যে ঘাপলা? এরকমও হয় নাকি?’
সাজিদ বলল, -‘হ্যাঁ।’
-‘কিরকম ঘাপলা? -রাব্বির পাল্টা প্রশ্ন।
সাজিদ বলল, -‘নিউটনের সূত্র মতে, মহাবিশ্বের বস্তুগুলো একেঅপরকে নিজেদের দিকে আকর্ষণ করে। কিন্তু ঘাপলা হচ্ছে, যদি এমনটি হয়, তাহলে মহাশূন্যের বস্তুগুলো নির্দিষ্ট একটি পয়েন্টে এসে মিলিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যাবার কথা। এমনটি হয় না কেন?’
সমাজতত্ত্বের ছাত্র সবুজ বলল, -‘তাই তো। নিউটন এর কি ব্যাখ্যা দিয়েছে?’
সাজিদ বলল, -‘নিউটনের কাছে এর কোন ব্যাখ্যা ছিল না। এ ব্যাপারটা পরে ক্লিয়ার করেছে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন, তার বিখ্যাত ‘Theory of Relativity’ দিয়ে। আইনস্টাইন নিউটনের অমীমাংসিত প্রশ্নের সমাধানে বলেছেন, -এরকম হতো, যদি Time আর Space শাশ্বত বা পরম হতো। কিন্তু, Time আর Space কখনোই পরম নয়। এই বিখ্যাত তত্ত্ব দিয়ে বিজ্ঞানকে পরিচয় করিয়ে দিলেন নতুন এক জগতের সাথে। সেই জগতটির নাম ‘আপেক্ষিকতার জগত’।
রাব্বি বলল, -‘ও, আচ্ছা, এই জন্য গল্পের নাম দিয়েছিস ‘নিউটন-আইনস্টাইনের সমঝোতা’, তাই না?’
সাজিদ মুচকি হাসল। আমি একটা সুযোগ পেলাম প্রশ্ন করার। জিজ্ঞেস করলাম, -‘বিজ্ঞানী হাবলুটা আসলে কে?’
সাজিদ আমার প্রশ্নের কোন উত্তর দিল না। সে আবার গল্প বলতে শুরু করল- আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সূত্র ধরে, রাশিয়ান পদার্থবিদ আলেকজান্ডার ফ্রিদমান দাবি করেন যে, এই মহাবিশ্ব স্থির নয়, এটি একটি ক্রমবর্ধমান মহাবিশ্ব। স্যার আলেকজান্ডার ফ্রিদমান সাধারন ধারণা করেছিলেন বটে, কিন্তু যথেষ্ট ব্যাখ্যার অভাবে তার কথা বিজ্ঞানী মহল তখন আমলে নেয়নি। এরপর বেলজিয়ামের বিজ্ঞানী Georges Lemaitre সর্বপ্রথম বিজ্ঞানী মহলকে একটি শক্ত শক খাওয়ালেন। তিনি বললেন, এ মহাবিশ্ব একটি ক্ষুদ্র কনা, যাকে Super Atom বলা হয়, এর বিস্ফোরণের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে, এবং রাশিয়ান বিজ্ঞানী স্যার আলেকজান্ডার ফ্রিদমান এর সাথে সুর মিলিয়ে বললেন, মহাবিশ্ব স্থির নয়, এটি ক্রমাগত সম্প্রসারিত হয়ে চলেছে। বলাবাহুল্য, Georges Lemaitre এর এসব দাবিরও ভিত্তি ছিল আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সূত্রটি।
মোস্তফা জিজ্ঞেস করল, -‘ Georges Lemaitre এর এটিই কি সেই Big bang Theory?’
সাজিদ বলল, -‘হ্যাঁ। এটাই হলো বিগ ব্যাং থিওরি। কিন্তু মজার ব্যাপার কি জানিস? বিজ্ঞানী Georges Lemaitre আইনস্টাইনের সূত্রকে ভিত্তি করে এই দাবি করলেও আইনস্টাইন নিজেই Georges Lemaitre এর এই দাবিকে নাকচ করে দেয়।’
রাব্বি বলল, -‘বলিস কি? কেন?’
সাজিদ বলল, -‘হ্যাঁ, মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে, এটা আইনস্টাইন মেনে নিতে পারে নি। তিনি বললেন, Lemaitre তার ব্যাখ্যাতে ম্যাথমেটিক্যালি প্রচুর ভুল করেছেন। আইনস্টাইন আরো বলেন, -মহাবিশ্ব অসীম হলেও এটি সম্প্রসারিত হচ্ছে -এটি ভূল ব্যাখ্যা।
সে যাহোক, এই হল বিজ্ঞানীদের মধ্যে আর্গুমেন্ট। কিন্তু তাদের এই তর্কাতর্কিতে না জড়িয়ে, আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডইন হাবল বিজ্ঞানী মহলে একটি বোমা ফাটালেন।
আমি বললাম, -‘ও আচ্ছা, তুই বিজ্ঞানী হাবলকেই হাবলু বলেছিলি বুঝি?’
সাজিদ আবার মুচকি হাসলো। বললো। -‘হ্যা। শোন কি হলো, ১৯২০ সালে বিজ্ঞানী এডুইন হাবল ওরফে বিজ্ঞানী হাবলু একটি টেলিস্কোপ আবিষ্কার করে ফেললো। এই টেলিস্কোপটিই রাতারাতি পাল্টে দিলো তখনকার জ্যোতির্বিজ্ঞান জগতকে। মাউন্ট উইলসন অবজারভেটরিতে বিজ্ঞানী হাবল তার আবিষ্কৃত টেলিস্কোপ দিয়ে প্রমাণ করে দেখালেন যে, আমাদের মহাবিশ্বের ছায়াপথগুলো ক্রমাগত একটি অন্যটি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তিনি এটি প্রমাণ করেন Droppler Effect থিওরি দিয়ে। Droppler Effect হল এই- মহাবিশ্বের বস্তুগুলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য যদি আলোকতরঙ্গের উপর ফেলা হয়, তাহলে তরঙ্গ যদি লাল আলোর দিকে সরে আসে, তাহলে বুঝতে হবে ছায়াপথগুলো একটি অন্যটি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। যদি তা না করে সেটা নীল আলোর দিকে সরে যায়, তাহলে বুঝতে হবে ছায়াপথগুলো একটি অন্যটি থেকে দূরে সরে না গিয়ে বরং কাছাকাছি চলে আসছে। বারবার এই পরীক্ষাটি করে প্রমাণ করা হয়েছে যে, ছায়াপথগুলো একটি কাছাকাছি নয়, বরং একটি অন্যটি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ১৯৫০ সালে মাউন্ট পলমারে সে সময়ের সবচেয়ে বড় টেলিস্কোপ বসিয়ে এই ব্যাপারটি আরো নিখুঁতভাবে অভজার্ব করে বিজ্ঞানীরা। হাবলের এই দাবির সাথে বিজ্ঞানী Georges Lemaitre এর দাবি সম্পূর্ণ মিলে যায় এবং সেই এক্সপেরিমেন্ট থেকে বোঝা যায়, মোটামুটি ১০ -১৫ বিলিয়ন বছর আগে একটি ক্ষুদ্র কণা থেকেই আজকের মহাবিশ্বের সৃষ্টি। মজার ব্যাপার হল, আইনস্টাইন বিশ্বাস করতেন যে, মহাবিশ্ব অসীম হলেও স্থির, সম্প্রসারিত হচ্ছে না, বিজ্ঞানী Georges Lemaitre এর থিওরিকে ভুল বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, সেই আইনস্টাইনই নিজের ভুল স্বীকার করে নিয়ে বললেন, -‘বিজ্ঞানী হাবল এবং Georges Lemaitre এর দাবি সত্য। মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে।
তিনি বিজ্ঞানী Georges Lemaitre এর কাছে অনুতপ্ত হযন এবং নিজের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় ভুল দাবি করেন।
এখন বিজ্ঞানী মহলে এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, মহাবিশ্ব প্রতিনিয়ত সম্প্রসারিত হয়েই চলেছে আজ অদ্যাবধি।
এতোটুকু বলে সাজিদ থামল। আমরা এক নিঃশ্বাসে বিজ্ঞানের একটি মজার অধ্যায় থেকে ভ্রমণ করে এলাম। এবার সাজিত আমাদের মধ্যে যে এগনোষ্টিক, যে বিশ্বাস করে যে, কোরআন মুহাম্মদ সা. এর নিজের কথা, তার দিকে ফিরলো।
বলল, -‘রোহান, বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে তোর এসব অবশ্যই জানা থাকার কথা, তাই না?’
রোহান বললো, -‘হ্যাঁ, জানি।’
মাত্র গত শতাব্দীতে বসে আইনস্টাইনও যে মহাবিশ্ব নিয়ে ভুল জানতেন, তা তো তুই জানিস, তাই না?’
-‘হ্যাঁ।’
-‘বিজ্ঞানী Georges Lemaitre আর বিজ্ঞানী হাবলের আগে এই জিনিস তাবৎ দুনিয়ার কেউই জানত না, ঠিক না?’
-‘হ্যাঁ।’ -রোহানের স্বীকারোক্তি।
সাজিদ বলল, -‘আচ্ছা রোহান, আমি যদি বলি তাদের অনেক অনেক অনেক আগে, তাদের প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগে একজন ব্যক্তি সব কথা বলেছে, তুই বিলিভ করবি?’
রোহান চিতকার করে বললো, -‘Impossible, Quite Impossible’
সাজিদ তখন বলল, -‘শোন রোহান, কোরআনের সূরা আয-যারিয়াত এর ৪৭ নাম্বার আয়াতে আছে ‘আমরা নিজ হাতে আসমানকে সৃষ্টি করেছি এবং এটাকে সম্প্রসারিত করে চলেছি।’
এখানে আয়াতের শেষে আসমানের সম্প্রসারণ বুঝাতে যে ‘মূসিঊন’ শব্দ আছে সেটি একটি সক্রিয় বিশেষণ। চলমান ক্রিয়া নির্দেশক, যা নির্দেশ করে কোন কাজ অধিক কাল থেকে শুরু হয়ে বর্তমানে অবধি চলছে এবং ভবিষ্যতেও তা হয়ে চলবে। অর্থাৎ আল্লাহ বলেছেন, -তিনি মহাবিশ্বকে (এখানে আসমান = মহাবিশ্ব) নিজের হাতে সৃষ্টি করেছেন এবং সেটাকে প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি করে চলেছেন। ঠিক এই কথাগুলো বিজ্ঞানী Georges Lemaitre এবং বিজ্ঞানী হাবল আমাদের গত শতাব্দীতে জানিয়েছেন। বলতো, আজ থেকে চোদ্দশ বছর আগে মরুভূমিতে উট চরানো এক বালক এমন একটি কথা কিভাবে বললো, যা আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে মাত্র ১৯২৯ সালে? এই কথা না বাইবেলে ছিল, না ইঞ্জিলে। না ছিল কোন গ্রীক পুরাণে, না ছিল মিথোলজিতে। মহাকাশের এমন একটি রহস্যময় ব্যাপার মক্কার একজন নিরক্ষর, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবিহীন লোক মুহাম্মদ সা. কোথায় পেলেন? বল তো?’
অন্যান্য সময় হলে রোহান বলতো, মোহাম্মদ বাইবেল থেকে চুরি করেছে, নয়তো বলতো কোন গ্রিক পুরাণ থেকে মেরে দিয়েছে। কিন্তু সাজিদের বিস্তারিত গল্প শোনার পর তার এই দাবি যে ধোপে টিকবে না, সে সেটা বুঝতে পারলো।
সাজিদ বলল, -‘এটা কি সম্ভব নিরক্ষর মুহাম্মদ সা. এর দ্বারা যদি কোনো ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপ তাতে না থাকে?’
রোহান মাথা নিচু করে বললো, -‘নাহ।’
সাজিদ বললো, -‘তাহলে প্রমাণ হলো কোরআন মুহাম্মদ সা. এর লেখা নয়, এটি একটি ঐশ্বরিক কিতাব, যা নাজিল হয়েছে মুহাম্মদ সা. এর উপর।’
রোহান কিছু বলল না। তাকে কিছুটা চিন্তিত দেখালো। সম্ভবত সে বুঝতে পেরেছে যে, চোরের দশদিন, গেরস্থের একদিন।
(এটি ‘সাজিদ’ সিরিজের ১৫ তম পর্ব। সাজিদ একটি কাল্পনিক চরিত্র। এই চরিত্রটি কাল্পনিক নানান ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে নাস্তিক তথা ইসলাম ধর্ম বিদ্বেষীদের যুক্তিগুলোকে দর্শন, যুক্তি, বিজ্ঞান আর বস্তবতার আলোকে খণ্ডন করে। )
কোরআন কি বলে সূর্য পানির নিচে ডুবে যায়?
কোরআন কি বলে সূর্য পানির নিচে ডুবে যায়?
সাজিদের খুব মন খারাপ। আমি রুমে ঢুকেই দেখলাম, সে তার খাটের উপর শক্তমুখ করে বসে আছে।
আমি বললাম, -‘ক্লাস থেকে কবে এলি?’
সে কোন উত্তর দিল না। আমি কাঁধ থেকে সাড়ে ১০ কেজি ওজনের ব্যাক্তি নামিয়ে রাখলাম টেবিলের উপর। তার দিকে ফিরে বললাম, -‘কি হয়েছে রে? মুখের অবস্থা তো নেপচুনের উপগ্রহ ট্রাইটন এর মত করে রেখেছিস।’
সে বলল, -‘ট্রাইটন দেখতে কি রকম?’
-‘আমি শুনেছি ট্রাইটন দেখতে নাকি বাংলা পাচের মতো।’
আমি জানি, সাজিদ এক্ষুনি একটা ছোটখাটো লেকচার দিতে শুরু করবে। সে আমাকে ট্রাইটন এর অবস্থান, আকার-আকৃতি, ট্রাইটন এর ভূপৃষ্ঠে নাইট্রোজেন, কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ, সূর্য আর নেপচুন থেকে ট্রাইটন এর দূরত্ব কত তা যথাযথ বিবরণ এবং তথ্যাদি দিয়ে প্রমাণ করে দেখাবে যে, ট্রাইটন দেখতে মোটেও বাংলা পাচের মতো নয়।
এই মুহূর্তে তার লেকচার বা বকবকানি কোনটাই শোনার আমার ইচ্ছে নেই। তাই যে করেই হোক, তাকে দ্রুত থামিয়ে দিতে হবে। আমি আবার বললাম, -‘ক্লাসে গিয়েছিলি?’
-‘হু।’
-‘কোন সমস্যা হয়েছে নাকি? মন খারাপ?’
সে আবার চুপ মেরে গেল। এই হল একটা সমস্যা। সাজিদ যেটা বলতে চাইবে না, পৃথিবী যদি উলটপালট হয়েও যায়, তবুও সে মুখ খুলে সেটা কাউকে বলবে না ।
সে বলল, -‘কিচেনে যা। ভাত বসিয়েছি, দেখে আয় কি অবস্থা।’
আমি আকাশ থেকে পড়ার মত করে বললাম, -‘ভাত বসিয়েছিস মানে? বুয়া আসেনি?’
-‘না।’
-‘কেন?।’
-‘অসুস্থ বলল।’
-‘তাহলে আজ খাব কি?’
সাজিদ জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। সেদিকে তাকিয়ে বলল, -‘ভাত বসিয়েছি। কলে যথেষ্ট পরিমাণে পানি আছে। পানি দিয়ে ভাত গিলা হবে।’
সিরিয়াস সময়গুলোতেও তার এ রকম রসিকতা আমার একেবারেই ভালো লাগে না। অগত্যা কিচেনের দিকে হাঁটা ধরলাম। যেটা ভেবেছিস ঠিক সেটা নয়, ভাত বসানোর পাশাপাশি সে ডিম সেদ্ধ করে রেখেছে। আমার পেছনে পেছনে সাজিত আসলো। এসে ভাত নামিয়ে কড়াইতে তেল, তেলে কিছু পেঁয়াজ কুচি, হালকা গুঁড়ো মরিচ, ১ চিমটি নুন দিয়ে কিছুক্ষন নাড়াচাড়া করে তাতে ডিম দুটো ছেড়ে দিল। পাশে পর্যবেক্ষকের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছি। মনে হচ্ছে সাজিদ কোন রান্না প্রতিযোগিতার প্রতিযোগী আর আমি চিফ জাস্টিস। অল্প কিছুক্ষণ পরেই ডিম দুটো বর্ণ লালচে হয়ে উঠলো। মাছকে হালকা ভাঁজলে যে রকম দেখায়, সেরকম সুন্দর একটি পোড়া গন্ধ বেরিয়েছে ।
আমি মুচকি হেসে বললাম, -‘খামোখা বুয়া রেখে এতগুলো টাকা অপচয় করি প্রতি মাসে। অথচ ভুবনবিখ্যাত বুয়া আবার রুমেই আছে। হা হা হা।
সাজিদ আমার দিকে ফিরে আমার কান মলে দিয়ে বলল, -‘সাহস তো কম না তোর। আমাকে বুয়া বলিস?’
আমি বললাম, -‘ওই দেখ পুড়ে যাচ্ছে।’
সাজিদ সেদিকে ফিরতেই আমি দিলাম এক ভোঁ দৌড় !
–গোসল সেরে, নামাজ পড়ে, খেয়ে দেয়ে উঠলাম। রুটিন অনুযায়ী সাজিদ এখন ঘুমোবে। রাতে যে বাড়তি অংশটা সে বই পড়ে কাটায়, সেটা দুপুর বেলা ঘুমিয়ে পুষিয়ে নেয়।
আমার আজকে কাজ নাই। চাইলেই ঘুরতে বেড়তে পারি। কিন্তু বাইরে যা রোদ ! সাহস হচ্ছিলো না।
এরই মধ্যে সাজিদ ঘুমিয়ে পড়েছে।
কিন্তু আমার মনের একটি কচকচানি রয়ে গেলো। সাজিদকে এরকম মন খারাপ অবস্থায় আমি আগে কখনো দেখি নি। কেন তার মন খারাপ সে ব্যাপারে জানতে না পারলে শান্তি পাচ্ছি না। কিন্তু সাজিদকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। সে কোনদিনও বলবে না। ভাবছি কি করা যায়?
তখন মনে পরলো তার সেই বিখ্যাত (আমার মতে) ডায়েরীটার কথা, যেটাতে তার জীবনের সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা গুলো হুবহু লিখে রাখে। আজকে তার মন খারাপের ব্যাপারটিও নিশ্চয় সে তুলে রেখেছে।
তার টেবিলের ড্রয়ার খুলে তার ডায়েরীটা নিয়ে উল্টাতে লাগলাম।
মাঝামাঝিতে এসে পেয়ে গেলাম মূল ঘটনাটা। যেরকম লেখা আছে, সেভাবেই তুলে ধরছি-
০৭/০৫/১৪
‘মফিজুর রহমান স্যার। এই ভদ্রলোক ক্লাসে আমাকে ওনার শত্রু মনে করেন। ঠিক শত্রু না, প্রতিদ্বন্দ্বী বলা যায়।
আমাকে নিয়ে উনার সমস্যা হলো, উনি উল্টাপাল্টা কথা বার্তা বলে ক্লাসের ছেলেমেয়েদের মনে ধর্ম, ধর্মীয় কিতাব, আল্লাহ রাসুল ইত্যাদি নিয়ে সন্দেহ ঢুকিয়ে দেবার চেষ্টা করেন। কিন্তু আমি প্রতিবারই উনার এহেন কাজের প্রতিবাদ করি। উনার যুক্তির বিপরীতে যুক্তি দিই। এমনও হয়েছে, যুক্তিতে আমার কাছে পরাজিত হয়ে উনি ক্লাস থেকেও চলে গিয়েছিলেন কয়েকবার।
এই কারণে এই বামপন্থী লোকটা আমাকে উনার চক্ষুশূল মনে করেন।
সে যাক গে ! আজকের কথা বলি।
আজকে ক্লাসে এসেই ভদ্রলোক আমাকে খুঁজে বের করলেন। বুঝতে পেরেছি, নতুন কোন উছিলা খুঁজে পেয়েছে আমাকে ঘায়েল করার।
ক্লাসে আসার আগে মনে হয় পান খেয়েছিলেন। ঠোঁটের এক কোণে চুন লেগে আছে।
আমাকে দাঁড় করিয়ে বড় বড় চোখ করে বললেন, -‘বাবা আইনস্টাইন, কি খবর?’
ভদ্রলোক আমাকে তাচ্ছিল্য করে ‘আইনস্টাইন’ বলে ডাকে। আমাকে আইনস্টাইন ডাকতে উনার অন্য শাগরেদবৃন্দগন হাসাহাসি শুরু করল।
আমি কিছু না বলে চুপ করে আছি। তিনি আবার বললেন, -‘শোন, বাবা আইনস্টাইন, তুমি তো অনেক বিজ্ঞান জানো। বলো তো দেখি সূর্য কি পানিতে ডুবে যায়?’
ক্লাস স্তিমিত হয়ে গেল। সবাই চুপচাপ।
আমি মাথা তুলে স্যারের দিকে তাকালাম। বললাম, -‘জি না স্যার। সূর্য কখনোই পানিতে ডুবে না।’
স্যার অবাক হবার ভঙ্গিতে বললেন, -‘ডুবে না ঠিক তো?’
-‘জি স্যার’
-‘তাহলে, সূর্যাস্ত আর সূর্যোদয় কেন হয় বাবা? বিজ্ঞান কি বলে?’
আমি বললাম, -‘স্যার, সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবী ঘুরে। সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরার সময়, পৃথিবী গোলার্ধের যে অংশটা সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে, সে অংশে তখন সূর্যোদয় হয়, দিন থাকে। ঠিক একইভাবে পৃথিবীর গোলার্ধের যে অংশটা তখন সূর্যের বিপরীত দিকে মুখ করে থাকে, তাতে তখন সুর্যাস্ত হয়, রাত নামে। আদতে, সূর্যাস্ত বা সূর্যোদয় বলে কিছুই নেই। সূর্য অস্ত যায় না। উদিত হয় না। পৃথিবীর ঘূর্ণনের কারনে আমাদের এমনটি মনে হয়।’
স্যার বললেন, -‘বাহ ! সুন্দর ব্যাখ্যা।’
উনি আমার দিকে ঝুকে এসে বললেন, -‘তা বাবা, এই ব্যাপারটার উপর তোমার আস্থা আছেতো? সূর্য পানিতে ডুবে-টুবে যাওয়তে বিশ্বাস কর কি?’
পুরো ক্লাসে তখনও পিনপতন নিরবতা।
আমি বললাম, -‘না স্যার। সূর্যের পানিতে ডুবে যাওয়া টাওয়াতে আমি বিশ্বাস করি না।’
এরপর স্যার বললেন, -‘বেশ ! তাহলে ধরে নিলাম, আজ থেকে তুমি আল কোরআনে বিশ্বাস করো না।’
স্যারের কথা শুনে আমি খানিকটা অবাক হলাম। পুরো ক্লাসও সম্ভবত আমার মতই হতবাক। স্যার মুচকি হেসে বললেন, -‘তোমাদের ধর্মীয় কিতাব, যেটাকে আবার বিজ্ঞানময় বলে দাবি করো তোমরা, সেই কোরআনে আছে, সূর্য নাকি পানিতে ডুবে যায়। হা হা হা।’
এইটুকু বলে স্যার কোরআনের সূরা কাহাফের ৮৬ নাম্বার আয়াতটি পড়ে শোনালেন- ‘(চলতে চলতে) এমননি ভাবে তিনি (জুলকারনাইন) সূর্যের অস্তগমনের জায়গায় গিয়ে পৌঁছলেন, সেখানে গিয়ে তিনি সুর্যকে (সাগরের) কালো পানিতে ডুবে যেতে দেখলেন। তার পাশে তিনি একটি জাতিকেও (বাস করতে) দেখলেন, আমি বললাম, হে যুলকারনাইন ! (এরা আপনার অধীনস্থ), আপনি ইচ্ছা করলেই তাদের শাস্তি দিতে পারেন, অথবা তাদের আপনি সদয় ভাবেও গ্রহণ করতে পারেন।’
এবার বললেন, -‘দেখো, তোমাদের বিজ্ঞানময় ধর্মীয় কিতাব বলছে যে, সূর্য নাকি সাগরের কালো পানিতে ডুবে যায়। হা হা হা। বিজ্ঞানময় কিতাব বলে কথা।’
ক্লাসের কেউ কেউ, স্যার এর মতই নাস্তিক, তারা হো হো করে হেসে উঠল। আমি কিছু বললাম না, চুপ করে ছিলাম।’
-এই টুকুই লেখা। আশ্চর্য ! সাজিদ মফিজুর রহমান নামের ভদ্রলোকের কথার কোন প্রতিবাদ করলোনা? সে তো এরকম করে না সাধারণত। তাহলে কি……..?
আমার মনে নানা ধরনের প্রশ্ন উকিঝুঁকি দিতে লাগল সেদিন।
-এর চার মাস পরের কথা।
হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় সাজিদ আমাকে এসে বলল, -‘আগামীকাল ডিপার্টমেন্ট থেকে ট্যুরে যাচ্ছি। তুই ও সাথে যাচ্ছিস।’
আমি বললাম, -‘আমি? পাগল নাকি? তোদের ডিপার্টমেন্ট ট্যুরে আমি কিভাবে যাব?
-‘ভাবনাটা আমার। তোকে যা বললাম জাস্ট তা শুনে যা।’
পরদিন সকালবেলা বের হলাম। তার ফ্রেন্ডদের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলো সাজিদ। স্যারেরাও আছেন। মফিজুর রহমান নামের ভদ্রলোকের সাথেও দেখা হল। বিরাট গোঁফওয়ালা। এই লোকের পূর্বপুরুষ সম্ভবত ব্রিটিশদের পিয়নের কাজ করত।
যাহোক আমরা যাচ্ছি বরিশালের কুয়াকাটা। পৌছাতে পাক্কা চার ঘন্টা লাগল।
সারাদিন অনেক ঘোরাঘুরি করলাম। স্যারগুলোকেও বেশ বন্ধু বৎসল মনে হল। ঘড়িতে তখন সময় পাঁচটা বেজে পঁচিশ মিনিট। আমি সমুদ্রের কাছাকাছি হোটেলে আছি। আমাদের সাথে মফিজুর রহমান স্যারও আছেন। সে সবার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘গাইজ, বি রেডি ! আমরা এখন কুয়াকাটার বিখ্যাত সূর্যাস্ত দেখব। তোমরা নিশ্চয়ই জানো, এটি দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র সমুদ্র সৈকত, যেখান থেকে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যায়।
আমরা সবাই প্রস্তুত ছিলাম আগে থেকেই। বেরোতে যাব, ঠিক তখনই সাজিদ বলে বসলো, -‘স্যার, আপনি সূর্যাস্ত দেখবেন?’
স্যার বললেন, -‘Why not? How can I miss such an amazing moment?’
সাজিদ বলল, -‘স্যার আপনি বিজ্ঞানের মানুষ হয়ে খুব অবৈজ্ঞানিক কথা বলেছেন। এমন একটি জিনিস আপনি কি করে দেখবেন বলছেন, যেটা আদতে ঘটেই না।’
এবার আমরা সবাই অবাক হলাম। যে যার চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। সাজিদ দাঁড়িয়ে আছে।
স্যার কপালের ভাঁজ দীর্ঘ করে বললেন, -‘What do you want to mean?’
সাজিদ হাসল। হেসে বলল, ‘স্যার, খুবই সোজা। আপনি বলেছেন- আপনি আমাদের নিয়ে সূর্যাস্ত দেখবেন। কিন্তু স্যার দেখুন, বিজ্ঞান বুঝে এমন লোক মাত্রই জানে, সূর্য আসলে অস্ত যায় না। পৃথিবী গোলার্ধের যে অংশ সূর্যের বিপরীতে মুখে অবস্থান করতে শুরু করে, সে অংশটা আস্তে আস্তে অন্ধকারে ছেয়ে যায়। কিন্তু সূর্য তার কক্ষপথেই থাকে। উঠেও না, ডুবেও না। তাহলে স্যার, সূর্যাস্ত কথাটা তো ভুল, তাই না?’
এবার আমি বুঝে গেছি আসল ব্যাপার। মজা নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি।
মফিজুর রহমান নামের লোকটা একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললো, -‘দেখো সাজিদ, সূর্য উদিত হয় না আর অস্ত যায় না, আমি তা জানি। কিন্তু এখান থেকে দাঁড়ালে আমাদের কি মনে হয়? মনে হয়, সূর্যটা যেন আস্তে আস্তে পানির নিচে ডুবে যাচ্ছে। এটাই আমাদের চর্মচক্ষুর সাধারন পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা। তাই, আমরা এটাকে সিম্পলি ‘সূর্যাস্ত’ নাম দিয়েছি। বলার সুবিধের জন্য এটা কে ‘সূর্যাস্ত’ বলাটা যুক্তিযুক্ত। দেখো, যদি আমি বলতাম, -‘ছেলেরা, একটুপর পৃথিবী গোলার্ধের যে অংশে বাংলাদেশের অবস্থান, সে অংশটা সূর্যের ঠিক বিপরীত দিকে মুখ নিতে চলেছে। তার মানে, এখানে এক্ষুনি আঁধার ঘনিয়ে সন্ধ্যা নামবে। আমাদের সামনে থেকে সূর্যটা লুকিয়ে যাবে। চলো, আমরা সেই দৃশ্য অবলোকন করে আসি।
আমি যদি এরকম বলতাম, ব্যাপারটা খুবই বিদঘুটে শোনাতো। ভাষা তার মাধুর্য হারতো। শ্রুতিমধুরতা হারাতো। এখন আমি এক শব্দেই বুঝিয়ে দিতে পারছি আমি কি বলতে চাচ্ছি, সেটা।’
সাজিদ মুচকি হাসল। সে বলল, -‘স্যার, আপনি একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। বিজ্ঞান পড়েন, বিজ্ঞান পড়ান। আপনি আপনার সাধারন চর্ম চক্ষু দিয়ে দেখতে পান যে, সূর্যটা পানিতে ডুবে যাচ্ছে। এই ব্যাপারটাকে আপনি সুন্দর করে বোঝানোর জন্য যদি ‘সূর্যাস্ত’ নাম দিতে পারেন, তাহলে সূরা কাহাফের জুলকারনাইন নামের লোকটি এরকম একটি সাগর পাড়ে এসে যখন দেখল- সূর্যটা পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে, সেই ঘটনাকে যদি আল্লাহতালা সবাইকে সহজে বোঝানোর জন্য সহজবোধ্য করার জন্য ভাষার শ্রুতিমধুরতা ধরে রাখার জন্য, কুলি থেকে মজুর, মাঝি থেকে কাজী, ব্লগার থেকে বিজ্ঞানী, ডাক্তার থেকে ইঞ্জিনিয়ার, ছাত্র থেকে শিক্ষক সবাইকে সহজে বোঝানোর জন্য যদি বলেন-
‘( চলতে চলতে) এমনিভাবে তিনি (জুলকারনাইন) যখন সূর্যের অস্ত গমনের জায়গায় গিয়ে পৌঁছলেন, সেখানে গিয়ে তিনি সুর্যকে (সাগরের) কালো পানিতে ডুবে যেতে দেখলেন’,
তখন কেন স্যার ব্যাপারটা অবৈজ্ঞানিক হবে? কোরান বলে না যে, সূর্য পানির নিচে ডুবে গেছে। কোরআন এখানে ঠিক সেটাই বলছে, যেটা জুলকারনাইন দেখেছিল এবং বুঝেছে। আপনি আমাদের সূর্যাস্ত দেখাবেন বলছেন মানে এই না যে, আপনি বলতে চাচ্ছেন সূর্যটা আসলে ডুবে যায়। আপনি সেটাই বোঝাতে চাচ্ছেন, যেটা আমরা বাহ্যিকভাবে দেখি। তাহলে, একই ব্যাপার আপনি পারলে, কোরআন কেন পারবে না স্যার?
আপনারা কথায় কথায় বলেন, ‘The sun rises in the east & sets in the west’ এগুলো নাকি Universal truth …
কিভাবে এইগুলো চিরন্তন সত্য হয় স্যার, যেখানে সূর্যের সাথে উঠা ডুবার কোন সম্পর্কই নাই?
কিন্তু এগুলো আপনাদের কাছে অবৈজ্ঞানিক নয়। আপনারা কথায় কথায় সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের কথা বলেন। অথচ, সেইম কথা কোরআন বললেই আপনারা চিৎকার করে বলে ওঠেন কুরআন অবৈজ্ঞানিক। কেন স্যার?’
সাজিব এক নাগাড়ে এতসব কথা বলে গেল। স্যারের মুখটা কিছুটা পানসে দেখা গেল। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ চার মাস ধরে, এরকম সুযোগের অপেক্ষা করছিলে তুমি, মিঃ আইনস্টাইন?’
আমরা সবাই হেসে দিলাম। সাজিদ ও মুচকি হাসলো বড় অদ্ভুত সে হাসি।
কোরআন মতে পৃথিবী কি সমতল না গোলাকার
কোরআন মতে পৃথিবী কি সমতল না গোলাকার
খুবই সিরিয়াস একই ব্যাপার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ঠিক আলোচনা নয়, আদতে হাসাহাসি হচ্ছে।
যারা হাসাহাসি করছে তাদের সবাই খুবই স্মার্ট। শুধু স্মার্টই নয়, ওভার স্মার্টও বলা যায়।
এরা কথায় কথায় বলে, আমরা বিজ্ঞান ছাড়া কিছু বুঝিনা। এরা উঠতে-বসতে, হাঁটতে-চলতে সবকিছুতেই বিজ্ঞানের প্রমাণ খুঁজে।
কেউ যখন তাদের বলে, বিজ্ঞানের এইটা এরকম নয়, ঐরকম, তখন তারা তেরেমেরে এসে বলবে, -‘বাপু, তুমি কি বিজ্ঞানী? বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা আছে? ক’ ক্লাশ বিজ্ঞান পড়েছ যে বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলতে আসছো? যাও, আগে পড়ো, পরে লেকচার দিবা।
আবার এই তারাই অনলাইনে কিছু ছাইপাশ পড়া মুক্তমনা তথা নাস্তিকদের লেখা পড়ে সেটাকে এত পরিমান বিশ্বাস করে যে, নিজের বাবা-মাকেও এরা এতো বিশ্বাস করে না।
এইসব নাস্তিকগুলোর অধিকাংশই এমন, যারা আরবিতে কোরআন পড়তে জানে না। কিছু ইংরেজি অনুবাদ এবং বাংলা অনুবাদের খিস্তি উড়িয়ে বলে, কুরআনের এইটা ভুল, ওইটা ভুল। কোরআনের এইটা অবৈজ্ঞানিক, ওইটা অবৈজ্ঞানিক।
লেখা পড়ে মনে হবে, এরা একজন বড় বড় মুফতি ছিল একসময়। কুরআনের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এত সব ভুলভাল দেখে তারা আজকে নাস্তিক হয়ে গেছে।
এরা আরবিতে কোরআন পড়াতো দূরে, অধিকাংশই ২৯ টি হরফ ঠিকমতো বলতেও পারবে না।
এই মুহূর্তে হাসাহাসি হচ্ছে কুরআনের পৃথিবীর আকার নিয়ে।
হাসাহাসি করছে বিপুল, সৌরভ আর নিপুন দা।
বিপুলকে আগে জুমার নামাজে দেখতাম। এখন সে নাকি ধর্ম কর্ম করছে না। বিপ্লব নিয়ে আছে। কমিউনিজম বিপ্লব। বিশ্ববিদ্যালয় আসলে ছেলেদের মধ্যে এমনিতেই রক্ত গরম রক্ত গরম টাইপ একটা ভাব থাকে। এই ভাবের সাথে যখন দু চারখানা মার্কস আর লেলিনের কিতাব যুক্ত হয়, তাহলেতো কথাই নেই। স্বপ্নের মধ্যেও তখন হেলাল হাফিজের পঙক্তি ‘এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ জপতে থাকে। বিপুলেরও একই অবস্থা। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে কি না কি পড়েছে, এখন ঈশ্বরকে অলীক কল্পনা মনে করা শুরু করেছে। অবশ্যই এর পিছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করছেন নিপুন দা। ইনি কট্টর বাম। আমাকেও কয়েকবার আরজ আলী মাতুব্বরের বই-টই পড়তে দিয়েছিল। আমি পড়ে হাসিমুখে ফেরত দিয়েছিলাম। আমার কাছ থেকে বই নেওয়ার সময় জিজ্ঞেস করলেন, -‘কী? কী বুঝলে ভাইয়া?’
আমি ফিক করে হেসে বললাম, -‘বুঝলাম যে, লোকটার মেন্টাল ট্রিটমেন্ট দরকার ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় তিনি বিনা চিকিৎসায় গত হয়েছেন।’
আমার মুখ থেকে এরকম কথা শুনে নিপুন দা চমকে গেলেন। এখন বুঝতে পারছি ইনিই বিপুল আর সৌরভের ব্রেইনওয়াশ করেছেন।
এরা এখন যা পড়ে হাসাহাসি করছে, তা একজন ব্লগারের লেখা। ব্লগারটা হিন্দু পরিবারের। হিন্দু পরিবারের হলেও উনি নিজের ধর্ম ত্যাগ করে একসময় নাস্তিকতা চর্চা শুরু করেন। পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার।
এই ব্লগার লিখেছেন, -‘মোহাম্মদের আল্লাহ কি জানতো না যে, পৃথিবী গোলাকার, সমতল নয়? তাহলে মোহাম্মদের আল্লাহ পৃথিবীকে সমতল বলল কেন? আসলে, কোরআন কোন ঈশ্বরের বাণী-টানী না। এটা স্রেফ মুহাম্মদের নিজের বানানো।
১৫০০ বছর আগে মানুষ বিশ্বাস করতো যে পৃথিবী হল সমতল। মুহাম্মদ তখন যা বিশ্বাস করত, তাই তা লিখে দিয়েছে আর বলে দিছে এইটা আসছে আল্লাহর কাছ থেইকা। হা হা হা। বোকা মুমিনগুলা এটারে আল্লাহর বাণী মনে কইরা বাকুম বাকুম করতাছে।’ (নাউজুবিল্লাহ)
প্রমান হিসেবে উল্লেখ করল এই আয়াতগুলো –‘তিনি (আল্লাহ) তোমাদের জন্য ভূমিকে করেছেন বিছানা স্বরূপ।’- সূরা নূহ ১৯
[And Allah has made the earth for you as a carpet (spread out)]
‘তিনিই তোমাদের জন্য জমিনকে করেছেন বিছানা স্বরূপ। আর তাতে তোমাদের জন্য করেছেন চলার পথ।’ সূরা তোয়াহা ৫৩
[He who has made for you the earth like a carpet spread out; has enabled to go about therein by roads (and channels)]
‘অতঃপর তিনি তার জমিনকে বিস্তীর্ণ করেছেন।’
-আন নাজিরাত ৩০
আমি আর সাজিদ পাশাপাশি বসে আছি। আমার তো গা জ্বলে যাচ্ছে এদের বিদ্রূপ ঠাট্টা দেখে। সাজিদ একদম শান্তভাবে বসে বসে এসব শুনছে। কি করে যে পারছে কে জানে।
নিপুন দা বলল, -‘কি সাজিদ মিয়া, তোমার কি কিছু বলার আছে এই ব্যাপারে?’
সাজিদ হাসলো। সচরাচর যেমন হাসে। এরপর বললো, -‘দাদা তোমরা বলে যাও। আমি না হয় আজ শুনেই যাই।’
-‘না, না। তোমাকেও বলতে হবে। বলতে হবে তুমি কি বিশ্বাস কর, পৃথিবীটা কার্পেটের মতো সমতল? নাকি বিশ্বাস কর পৃথিবীটা গোলাকার?’ –নিপুন দা বলল।
সাজিদ বলল, -‘আমি বিশ্বাস করি, পৃথিবীটা গোলাকার।’
-‘হা হা হা। তাহলে তো কোরানের সাথে বিপরীত হয়ে গেল। কোরআন বলছে পৃথিবীরে কার্পেটের মতো সমতল করে বিছানো হয়েছে। ইউ বিলিভ ইট?’
সাজিদ কিছু বললো না। একটু ঝেড়ে কেশে নিলো। এরপর বলল, -‘দাদা, অনেকক্ষণ ধরেই খেয়াল করছি তোমরা বলছো ‘সমতল সমতল’। আচ্ছা, কুরআনের ঠিক কোন জায়গায় বলা হয়েছে পৃথিবীটা সমতল?’
নিপুন দা বলল, -‘আরে, কোরআন বলছে পৃথিবীকে বিছানার মত বিছানো হয়েছে। এর মানে কি এই নয় যে, পৃথিবীটাকে সমতল বলা হয়েছে?’
সাজিদ বলল, -‘দাদা, প্রথমেই বলে রাখি, অনুবাদ দিয়ে কোরআনকে জাস্টিফাই করাটা ভুল। দেখো, সমতল শব্দের আরবি প্রতিশব্দ হলো ‘সাবি’ ‘আল মুস্তাবি’ এসব। কোরান যদি সত্যিই পৃথিবীকে সমতল বলতো, তাহলে কোরআন নিশ্চয়ই এই শব্দগুলো ব্যবহার করত। কিন্তু কোরআন এখানে এসব শব্দ ব্যবহার করে নি।
কোরআন এখানে ব্যবহার করেছে ‘ফারাশ’ ‘বাস্বাত’ ‘দাহাহা’ এই জাতীয় শব্দ, যার অর্থ সমতল নয়। এগুলোর অর্থ ‘কার্পেট বা বিছানার মত করে বিছানো’ Spread Out। এগুলো দিয়ে কোনভাবেই বুঝা যায় না যে, পৃথিবী সমতল।
নিপুন দা অনেকটাই বিদ্রূপ করে বলল, -‘তাহলে কি বুঝায় এগুলো দিয়ে স্যার সাজিদ?’
সাজিদ বলল, -‘Let me finish…….
আমরা কোরানের সে আয়াতে চলে যাই, যেটাকে নিয়ে তোমাদের আপত্তি। যেটাতে নাকি বলা হচ্ছে, পৃথিবী সমতল। আয়াতটি হলো, -‘তিনি তোমাদের জন্য জমিনকে করেছেন বিছানা স্বরূপ। আর তাতে তোমাদের জন্য করেছেন চলার পথ।’
দেখো দাদা, আল্লাহ বলছেন, তিনি আমাদের জন্য জমিনকে করেছেন বিছানা স্বরূপ, কার্পেটের মতো করে। আচ্ছা দাদা, বিছানা বলতে আমরা কি বুঝি? আমরা বুঝি, বিছানা এমন একটি জিনিস, যা নরম, আরামদায়ক। যাতে বিশ্রাম নেওয়া যায়। যদি এটাকে রূপক হিসাবে ধরি, তাহলে এটা এমন কিছু যাতে স্বচ্ছন্দ বেঁচে থাকা যায়, চলাফেরা করা যায়। আজকের বিজ্ঞানও আমাদের সেটা বলছে।
বিজ্ঞান আমাদের বলছে, আমাদের পৃথিবীর ভূত্বক মোট সাতটি স্তরে বিভক্ত। এই স্তরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উপরের স্তরের নাম হল Crust। এই স্তরের পুরুত্ব ভূপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার গভীর পর্যন্ত। এটিই সেই স্তর, যে স্তরে আমরা বসবাস করি, চলাফেরা করি। এরপরে আসে Mentle।
এই স্তরের পুরুত্ব ২৯০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা হল ৯০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই তাপমাত্রায় মানুষ তো দূরের কথা, একটি ক্ষুদ্র জীবও মুহূর্তে ভস্ম হয়ে যাবে। চিন্তা করো তো, পৃথিবীর যে আমরা বাস করছি, হাঁটছি, চলছি, তার থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার গভীরে এই ভয়াল স্তর অবস্থিত।
এটা তো মাত্র দ্বিতীয় স্তরের কথা। এরপরের স্তরের নাম হলো Outer Core। উইকিপিডিয়া মতে, এর পুরুত্ব ২৮৯০ কিলোমিটার এবং এই স্তরের তাপমাত্রা হলো ৩৭০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চিন্তা কর, পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ এইসব স্তরে কি ঘটে?
এরপরের স্তরের নাম হলো Inner Core। এটা তো আরো ভয়াবহ। এভাবে যত নিচে নামা হয়, স্তরগুলো ততই ভয়ানক। আমরা যে আগ্নেয়গিরি লাভা দেখি, এটা এই সব স্তরের ছোট একটি বিস্ফোরণ মাত্র। কিন্তু আমরা যে স্তরে থাকি, সেই Crust স্তরের তাপমাত্রা অন্য ৬ স্তরের তাপমাত্রার তুলনায় মাত্র ১%, যা আমাদের বসবাসের উপযোগী।
এখন, এই দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ যদি বলেন, আমি তোমাদের জন্য ভূমিকে করেছি বিছানা স্বরূপ, তাতে কি বোঝা যায়, এটা দ্বারা পৃথিবীর শেইপ বুঝিয়েছেন? একদম না। এটা দিয়ে যে আল্লাহর ভূত্বকের স্তর এর কথাই মিন করেছেন যা, আমাদের বসবাসের উপযোগী, তা আয়াতের পরের অংশ থেকেই বোঝা যায়। এর পরের অংশেই আছে ‘আর’, তাতে তোমাদের জন্য করেছেন চলার পথ।’
এটা তো একদম ক্লিয়ার আছে যে এটা পৃথিবীর আকার নয়, ভূমির ব্যাপারে বলা হয়েছে। এবং, ভূমির সে অংশের ব্যাপারে, যে অংশে আমরা মানুষেরা বসবাস করছি। যেটা আমাদের বসবাসের জন্য উপযোগী। তাহলে এটা দিয়ে পৃথিবীকে সমতল বানিয়ে দেওয়া যায় কি করে? স্রেফ মনগড়া ব্যাখ্যা।’
নিপুন দা চুপ করে আছে। বিপুল বলে উঠল, -‘আচ্ছা সাজিদ ভাই, আপনার কথা মানলাম যে এখানে পৃথিবীর আকার নয়, ভূমির স্তরের কথা বলা হয়েছে আর সেটাকে বিছানার সাথে উপমা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আপনি কি কোরআনের এমন একটি আয়াত দেখাতে পারবেন যে, যেখানে বলা হচ্ছে পৃথিবী গোল? সমতল নয়?’
বিপুলের কথা শুনে সাজিদ হেসে উঠলো। বলল, -‘বিপুল, তার আগে তুমি বলোতো, কুরআন কি মানুষকে পৃথিবীর শেইপ কিরকম, পদার্থবিদ্যায় কি কি খাটে, রসায়নে কোন যৌগের সাথে কোন যৌগের বিক্রিয়া ঘটে এসব শেখানোর জন্য নাজিল হয়েছে?
-‘না।’ -বিপুল বলল।
-‘তাহলে তুমি কি করে এক্সপোর্ট করো যে কোরআন পৃথিবীর আকার, আয়তন নিয়ে বলবে?’
এবার বিপুলও চুপ। কিন্তু সাজিদ আর চুপ হল না। সে বলে যেতে লাগলো, -‘ঠিক আছে বিপুল। তুমি যখন আশা করছ, সোনা আমি প্রমাণ করে দেখাতে পারি যে কোরআন পৃথিবীর আকার নিয়ে বলছে, এবং, সেটা গোলাকার।’
এবার আমি, নিপুন দা, বিপুল আর সৌরভ চোখ বড় বড় করে সাজিদের দিকে তাকালাম। বলে কি বেট্যা !!! কোরান পৃথিবীকে গোলাকার যদি বলেই থাকে, তাহলে এতক্ষণ এত কাহিনী বলার কি দরকার ছিল?
নিপুন দা হো হো করে হেসে উঠল। বলল, -‘এবার কি নতুন তত্ত্ব শেখানো হবে নাকি? হা হা হা।
নিপুন দা’র সাথে সাথে বিপুল আর সৌরভও হেসে উঠল। তাদের সাথে সাজিদ হাসছে। আমার তখন সাজিদের উপর খুব রাগ হচ্ছে।
সাজিদ বলল, -‘নিপুন দা, একটু মনোযোগ দিয়ে শুনবে প্লিজ। কোরআন সরাসরি পৃথিবীকে গোলাকার বলেনি। বলার দরকার ছিলো না। কারণ, কোরআন জিওগ্রাফির কোন বই নয় যে, এখানে পৃথিবীর আকার আকৃতি নিয়ে বলাই লাগবে। তবে, কোরআন কিছু ইঙ্গিত দিয়েছে। জ্ঞানীদের উচিত তা বুঝে নেওয়া।
নিপুন দা বলল, -‘ও তাই বুঝি? তা বুঝাই দেন দেখি মহাজ্ঞানী সাজিদ ভাই। হা হা হা।’
সাজিদ বলল, –
‘প্রথমত,
সূরা আয যুমারের ৫ নং আয়াত। বলা হচ্ছে, “তিনি রাত দ্বারা দিনকে আচ্ছাদিত করেন এবং রাতকে আচ্ছাদিত করেন দিন দ্বারা। ”
এই আয়াতে রাত দিন দ্বারা এবং দিন রাত দ্বারা আচ্ছাদিত হওয়া বুঝাতে যে আরবি শব্দ ব্যবহার হয়েছে তা হল “ كوريا”। এই শব্দটির একদম সঠিক অর্থ হল প্যাঁচানো / জড়ানো।
ক্লাসিক্যাল আরবি ডিকশনারিতে এর অর্থের ব্যাখ্যাতে বলা হয়েছে, এটি ঠিক এমন -কোন পাগড়ির মধ্যে একটি কাপড় অন্য একটি কাপড়ের মধ্যে যেভাবে পেঁচিয়ে ঢোকানো হয়। একটি অন্যটির মধ্যে পেঁচিয়ে ঢুকে যাচ্ছে। জীবনে কখনো পাগড়ী দেখলে বা পাগড়ী বেঁধে থাকলে ব্যাপারটা ভালো বুঝার কথা।
আল্লাহ বলেছেন, তিনি রাত দ্বারা দিনকে এবং দিন দ্বারা রাতকে ঠিক সেভাবেই আচ্ছাদিত করেন।
এখন রাতকে দিন দ্বারা এবং দিনকে রাত দ্বারা এভাবে আচ্ছাদিত করা তখনই সম্ভব, যখন পৃথিবীর আকার গোল হবে।
আমরা দেখি কিভাবে দিনরাত্রি হয়। প্রথমে ভোর, এরপর আস্তে আস্তে দুপুর, এরপর বিকেল, এরপর গোধূলী, এরপর সন্ধ্যা, এরপর একসময় দিন রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে যায় যে ভাবে আস্তে আস্তে পাগড়ির একটা অংশ অন্য অংশের মধ্যে ঢুকে পড়ে।
যদি পৃথিবী সমতল হতো, এটা লম্বা কাঠ বা তক্তার মত, তাহলে কি এভাবে দিনরাত্রি হতো? না। তখন এই দিন, আবার চোখের পলকে রাত নেমে পড়তো।
তাহলে সূরা যুমারের এই আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, আল্লাহ রাতকে দিন এবং দিনকে রাতে আচ্ছাদিত করার যে প্রক্রিয়া বলেছেন সেটা তখনই সম্ভব, যখন পৃথিবী গোলাকার হবে। তাহলে কোরান ইন্ডিরেক্টলি ইঙ্গিত করেছে যে পৃথিবী গোলাকার।
দ্বিতীয়তঃ,
সূরা আর রহমানের ১৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘তিনিই দুই অস্তাচল আর দুই উদয়াচলের মালিক।
এখানে অস্তাচল আর উদয়চল বলতে সূর্যের উদয়-অস্তের কথা বলা হচ্ছে।
আমরা জানি, পৃথিবীতে একদিনে দুইবার সূর্যোদয় আর দুইবার সূর্যাস্ত ঘটে থাকে। আমরা বাংলাদেশে যখন সূর্যকে পূর্ব দিকে উদিত হতে দেখি, তখন আমেরিকানরা দেখে যে সেখানে সূর্যটা পশ্চিমে ডুবে যাচ্ছে। তাহলে আমাদের এখানে যখন সকাল, তাদের কাছে তা সন্ধ্যা। আবার, আমরা যখন সূর্যকে পশ্চিমে ডুবে যেতে দেখি, তারা তখন সূর্য পূর্ব দিকে উদিত হতে দেখে। তার মানে, পৃথিবীতে মোট দু’বার সকাল-সন্ধ্যা পরিলক্ষিত হয়। এখন দুবার সূর্যাস্ত আর দুবার সূর্যোদয় তখনই সম্ভব যখন পৃথিবীর আকার গোল হবে। পৃথিবীর আকার যদি সমতল বা চ্যাপ্টা হত, তাহলে পৃথিবীতে একবারই সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয় ঘটতো। তক্তা সদৃশ্ পৃথিবীর একপাশে সূর্য উঠে অন্যপাশে ডুবে যেত। কিন্তু সেরকম হয় না। কারণ, পৃথিবী গোলাকার ।
এইজন্য পৃথিবীতে আমরা দুইবার সূর্যাস্ত আর সূর্যোদয় দেখতে পাই।
আল্লাহ কোরআনে একই কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, -‘তিনিই মালিক দুই অস্তাচল আর উদয়াচলের।’ তাহলে তিনি নিশ্চয় জানেন, পৃথিবী গোলাকার। তাই তিনি দুই সূর্যাস্ত আর দুই সূর্যোদয়ের কথা বলেছেন। তিনি যদি পৃথিবীকে ফ্ল্যাট তথা সমতলই বলবেন, তাহলে অবশ্যই তিনি এক অস্তাচল আর উদয়াচলের কথাই বলতেন। কিন্তু তিনি তা বলেননি। তার মানে, কোরআন ইঙ্গিত করছে যে, পৃথিবী গোলাকার।
এতোটুকু বলে সাজিদ থামল। বিপুল চুপ করে আছে। নিপুণ দা’ও চুপ। তাদের হয়তো আর কিছু বলার নেই এই মুহূর্তে। সৌরভ বললো, -‘সবই বুঝলাম। কিন্তু পৃথিবীর ভূমিকে বিছানা বলার কি দরকার? এত জটিল করে।’
সাজিদ হাসলো। বললো, -‘সৌরভ আমি যখন সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি, তখন নিপুন দা আমাকে একটি লাভ লেটার দিয়েছিল বিপাশা দি কে দেবার জন্য। কি নিপুন দা, দেওনি?’
নিপুন দা লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে বলল, -‘হ্যাঁ। কিন্তু এখানে বলছো কেন এসব?’
-‘জানো নিপুনদা, আমি সেই চিঠিটা বিপাশা দি কে দেবার আগে খুলে একবার পড়ে নিয়েছিলাম। হা হা হা হা। কি রোমান্টিক প্রেমপত্র ছিল সেটা। হা হা হা।’
নিপুন দা হাসছে, লজ্জাও পাচ্ছে। আমরাও হাসছি। সাজিদ বলল, -‘জানো সৌরভ, সেই চিঠির শুরুতে বিপাশা দি’র রূপের বর্ণনা দিতে গিয়ে নিপুন দা লিখেছে, ‘তোমার ওই চাঁদ মুখখানা না দেখলে আমার দিনটাই পানসে লাগে।’
আমরা সবাই হো হো করে হাসছি। সাজিদ আবার বলল, -‘আচ্ছা সৌরভ, নিপুন দা যে বিপাশার দি’র মুখকে চাঁদমুখ বলেছে, এখানে নিপুন দা কি বুঝিয়েছে যে, বিপাশা দি’র মুখ দেখতে চাঁদের আকৃতি মতো? আই মিন গোলাকার?’
সৌরভ বললো, -‘না, উনি বিপাশা দি’র রূপ বুঝিয়েছেন এটা দিয়ে।’
-‘এক্সাক্টলি। নিপুন দা সেদিন ‘চাঁদমুখ’ দিয়ে আসলে বিপাশা দি’র রূপ বুঝিয়েছেন, বিপাশা দি’র মুখের আকৃতি না। এটাকে বলে উপমা। ঠিক সেরকম আল্লাহ পৃথিবীকে বিছানার উপমা দিয়ে বুঝিয়েছেন, তিনি আমাদের জন্য কত উপযোগী করেই না এটা তৈরি করেছেন। এটা দিয়ে তিনি পৃথিবীর আকৃতি বা আমার বা তোমার বেডরুমের বিছানা বুঝান নি, বুঝেছো?’
সৌরভ একদম চুপ মেরে গেল। সে নিশ্চয়ই বুঝেছে। বিপূলও চুপচাপ।
সাজিদ নিপুন দা’র কাছে গিয়ে বললো, -‘স্যরি দা ভাই, ওই চিঠিটা তোমার পারমিশন ছাড়াই পড়েছিলাম বলে। কি করব বল? তোমাদের মত সিনিয়ারদের থেকেই তো এক্সপেরিয়েন্স নিতে হবে। তাই না? হা হা হা।’
নিপুন দা সাজিদকে ধরতে যাচ্ছিল আর সে অমনি দিল এক দৌড়………….
[তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া হয় যে, আল্লাহ সত্যি সত্যিই পৃথিবীকে কার্পেটের মতো করে তৈরি করেছেন, তা হলেও কোনো ভুল হবে না। কারণ, কার্পেট যে শুধু সমতল জিনিসে করা হয়, তা নয়। গোলাকার জিনিসও কার্পেট করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, একটি ফুটবলের কথা চিন্তা করুন। ফুটবল একটি গোলাকার জিনিস। এর উপরিভাগ কিরকম? কার্পেটের মতো করে আচ্ছাদিত। সো, আল্লাহ যদি বলেন, তিনি ভূমিকে কার্পেটের মতো করে বিছিয়েছেন, তাহলে ধরা যায় যে, ফুটবলের মত গোলাকার ভূমিকে কার্পেটের মত বিছিয়েছেন।
তাছাড়া, সূরা আল ইনশিক্কাকের ৩ নম্বর আয়াতে আছে, – ‘যেদিন পৃথিবীকে সমতল করা হবে…’
এখানে বলা হচ্ছে কিয়ামত দিবসের কথা। সেদিন পৃথিবীকে আল্লাহ সমতল করবেন। তাহলে, তিনি যদি এখনই পৃথিবীকে সমতল করে তৈরি করতেন, আবার কিয়ামত দিবসে এটাকে সমতল করার কথা আসে কিভাবে?]
কোরআন, আকাশ, ছাদ এবং একজন ব্যক্তির মিথ্যাচার
কোরআন, আকাশ, ছাদ এবং একজন ব্যক্তির মিথ্যাচার
মফিজুর রহমান স্যার সাজিদের দিকে এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তাকানোর ভঙ্গি এ রকম, -‘বাছা ! আজকে তোমায় পেয়েছি। আজ তোমার বারোটা যদি না বাজিয়েছি, আমার নাম মফিজ না।’
সাজিদ মাথা নিচু করে ক্লাসের বাইরে দাড়িয়ে আছে। ২০ মিনিট দেরি করে ফেলেছে ক্লাসে আসতে। বিশ্ববিদ্যালয় ২০ মিনিট দেরি করে ক্লাসে আসা এমন কোনো গুরুতর পাপ কাজ নয় যে, এর জন্য তার দিকে এভাবে তাকাতে হবে।
সাজিদ সবিনয়ে বলল, -‘স্যার আসবো?’
মফিজুর রহমান স্যার অত্যন্ত গম্ভীর গলায় বললেন, -‘হু’
এভাবে বললেন যেন সাজিদকে দু চার কথা শুনিয়ে দরজা থেকে খেদিয়ে পাঠিয়ে দিতে পারলেই ওনার গা জুড়োয়।
সাজিদ ক্লাস রুমে এসে বসল। লেকচারের বেশ অর্ধেকটা শেষ হয়ে গেছে। মফিজুর রহমান স্যার আর পাঁচ মিনিটের লেকচার দিয়ে ক্লাস সমাপ্ত করলেন।
সাজিদ কপালে যে আজ খুবই খারাপি আছে, সেটা সে প্রথম থেকেই বুঝতে পেরেছে।
মফিজুর রহমান সাজিদকে দাড় করালেন।
খুব স্বাভাবিক চেহারায় হাসি হাসি মুখ করে বললেন, -‘সাজিদ, কেমন আছো?’
সাজিদ প্রায় ভুত দেখার মত চমকে উঠলো। এই মুহূর্তে সে যদি সত্যি সত্যি ডুমুরের ফুল অথবা ঘোড়ার ডিম জাতীয় কিছু দেখতো, হয়তো এতটা চমকাতো না। মিরাকল জিনিসটায় তার বিশ্বাস আছে। তবে মফিজুর রহমান স্যারের এই আচরণ তার কাছে তার চেয়েও বেশি কিছু মনে হচ্ছে।
এই ভদ্রলোক এত সুন্দর করে এরকম হাসি মুখ নিয়ে কারো সাথে কথা বলতে পারে, এটাই এতদিন একটা রহস্য ছিল।
সাজিদ নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়ে বললো, -‘জ্বি স্যার, ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন?’
তিনি আবার একটি মুচকি হাসি দিলেন। সাজিদ পুনঃরায় অবাক হলো। মনে হচ্ছে সে কোন দিবাস্বপ্নে বিভোর আছে।
স্বপ্নের একটা ক্রাইটেরিয়া হচ্ছে, স্বপ্নে বেশিরভাগ সময় নেগেটিভ জিনিসকে পজিটিভ আর পজেটিভ জিনিসকে নেগেটিভ ভাবে দেখা যায়। মফিজুর রহমান স্যারকে নিয়ে তার মাত্রাতিরিক্ত নেগেটিভ চিন্তা থেকে হয়তো এরকম হচ্ছে। একটু পরে সে হয়তো দেখবে, এই ভদ্রলোক তার দিকে রাগী রাগী চেহারায় তাকিয়ে আছে এবং বলছে এই ছেলে এত দেরি করে ক্লাসে কেন এসেছ? তুমি জানো আমি তোমার নামে ডীন স্যারের কাছে কমপ্লেন করে দিতে পারি? আর কোনদিন যদি দেরি করেছো……..’
সাজিদের চিন্তায় ছেদ পড়ল। তার সামনে দাঁড়ানো হালকা-পাতলা গড়নের মফিজুর রহমান নামের ভদ্রলোকটি বললেন, -‘আমিও খুব ভালো আছি।’
ভদ্রলোকের মুখের হাসির রেখাটা তখনও স্পষ্ট।
মফিজুর রহমান সাজিদকে বললেন, ‘আচ্ছা বাবা আইনস্টাইন, তুমি কি বিশ্বাস কর আকাশ বলে কিছু আছে?’
সাজিদ এবার নিশ্চিত হলো যে এটা কোন স্বপ্নদৃশ্য নয়। মফিজুর রহমান স্যার তাচ্ছিল্যভরে সাজিদকে ‘আইনস্টাইন’ বলে ডাকে। সাজিদকে যখন ‘আইনস্টাইন’ বলে, তখন ক্লাসের অনেকে খলখল করে হেসে উঠে। এই মুহূর্তে সাজিদ একটি চাপা হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছে। তাহলে এটা কোন স্বপ্ন দৃশ্য নয়। বাস্তব।
সাজিদ বলল, -‘জ্বি স্যার। বিশ্বাস করি।’
ভদ্রলোক আরেকটি মুচকি হাসি দিলেন। উনি আজকে হাসতে হাসতে দিন পার করে দেবার পণ করেছেন কিনা, কে জানে।
তিনি বললেন, -‘বাবা আইন্সটাইন- আদতে আকাশ বলে কিছু নেই। আমরা যেটাকে আকাশ বলি, সেটা হচ্ছে আমাদের দৃষ্টির প্রান্তসীমা। মাথার উপরে নীল রঙের যে জিনিসটি দেখতে পাও সেটাকে মূলত বায়ুমণ্ডলের কারণেই নীল দেখায়। চাঁদের বায়ুমণ্ডল নেই বলে চাঁদে আকাশকে কালো দেখায়। বুঝতে পেরেছেন মহামতি আইনস্টাইন?’
স্যারের কথা শুনে ক্লাসে কিছু অংশ আবার হাসাহাসি শুরু করল।
স্যার আবার বললেন, -‘তাহলে বুঝলে তো, আকাশ বলে যে কিছুই নাই?’
সাজিদ কিছু বললো না। চুপ করে আছে।
স্যার বললেন, -‘গত রাতে হয়েছে কি জানো? নেট সার্চ দিয়ে একটি ব্লগ সাইটের ঠিকানা পেলাম। মুক্তমনা ব্লক নামে। অভিজিৎ নামে এক ব্লগার লেখা পেলাম সেখানে। খুব ভালো লিখে দেখলাম। যাহোক অভিজিৎ নামের এই লোকটা কোরআনের কিছু বাণী উদ্ধৃত করে দেখালো কত উদ্ভট এইসব জিনিস। সেখানে আকাশ নিয়ে কি বলা আছে শুনতে চাও?’
সাজিদ এবারো কিছু বলো না। চুপ করে আছে।
স্যার বললেন, -‘কুরআনে বলা আছে-
“আর আমরা আকাশকে সৃষ্টি করেছি সুরক্ষিত ছাদ। অথচ, তারা আমাদের নির্দেশনাবলী থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে।’
“And we made the sky a protected ceiling, but they, from its signs are turning away – Al Ambia 32”
দেখলে তো বাবা আইনস্টাইন, তোমাদের আল্লাহ বলেছে, আকাশ নাকি সুরক্ষিত ছাদ। তা বাবা, এই ছাদে যাবার কোন সিঁড়ির সন্ধান কোরআনে আছে কি? হা হা হা হা।’
চুপ করে থাকতে পারলে বেশ হতো। কিন্তু এই লোকটির মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়িতে সাজিদকে মুখ খুলতে বাধ্য হল।
সে বলল, -‘স্যার আপনার সে ব্লগার অভিজিৎ আর আপনার প্রথম ভুল হচ্ছে, আকাশ নিয়ে আপনাদের দুজনের ধারণা মোটেও ক্লিয়ার না।’
-‘ও, তাই নাকি? তা আকাশ নিয়ে কিলিয়ার ধারাটি কি বল শুনি?’ -অবজ্ঞাভরে লোকটির প্রশ্ন।
সাজিদ বলল, -‘স্যার, আকাশ নিয়ে ইংরেজি অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে বলা আছে, –
The region of the atposphere and outer space seen from the earth, অর্থাৎ, পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে বায়ুমণ্ডলের এবং তার বাইরে যা কিছু দেখা যায় সেটাই আকাশ। আকাশ নিয়ে আরও ক্লিয়ারলি বলা আছে উইকিপিডিয়াতে। আপনি নেট ঘেটে মুক্তমনা যেতে পেরেছেন, আরেকটু এগিয়ে উইকিপিডিয়া অবধি গেলেই পারতেন। আকাশ নিয়ে উইকিপিডিয়াতে বলা আছে, – The sky (or celestial dome) is everything that lies above the surface of the earth, including the atmosphere and outer space, অর্থাৎ, পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের উপরে যা কিছু আছে, তা সবই আকাশের অন্তর্গত। এর মধ্যে বায়ুমণ্ডল এবং তার বাইরে সবকিছু আকাশের মধ্যে পড়ে।’
-‘হু, তো?’
-‘এটা হচ্ছে আকাশের সাধারণ ধারণা। এখন আপনার সেই আয়াতে ফিরে আসি। আপনি কোরআন থেকে উল্লেখ করেছেন-
“আর আমরা আকাশকে করেছি সুরক্ষিত ছাদ। অথচ, তারা আমাদের নির্দেশনাবলী থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে। ”
আপনি বলেছেন মহাকাশকে কিভাবে ছাদ হয়, তাই না?
স্যার, বিংশ শতাব্দীতে বসে বিজ্ঞান জানা কিছু লোক যদি এরকম প্রশ্ন করে, তাহলে আমাদের উচিত বিজ্ঞান চর্চা বাদ দিয়ে গুহার জীবন যাপনে ফিরে যাওয়া।
-‘What do you mean?’
-‘বলছি স্যার। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর উপরিভাগে যে বায়ুমণ্ডল আছে, তাতে কিছু স্তরের সন্ধান পেয়েছেন। আমাদের পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের এসব পুরু স্তর দ্বারা গঠিত। এই স্তরগুলো হচ্ছে-
১। ট্রপোস্ফিয়ার
২। স্ট্রাটোস্ফিয়ার
৩। মেসোস্ফিয়ার
৪। থার্মস্ফিয়ার
৫। এক্সোস্ফিয়ার
এই প্রত্যেকটি স্তরের আলাদা আলাদা কাজ রয়েছে। আপনি কি জানেন, বিজ্ঞানী Sir venn Allen প্রমাণ করিয়ে দিয়েছিলেন, আমাদের পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের চারিদিকে একটি শক্তিশালী ম্যাগনেটিক ফিল্ড আছে। এই ম্যাগনেটিক ফিল্ড আমাদের পৃথিবীর চারদিকে একটি বেল্ট এর মত বলয় সৃষ্টি করে রেখেছে। বিজ্ঞানী Sir venn Allen এর নামে এই জিনিসটা নাম রাখা হয় Venn Allen Belt……..
এই বেল্ট চারপাশে ঘিরে রেখেছে আমাদের বায়ুমন্ডলকে। আমাদের বায়ুমণ্ডলের স্তরটির নাম হচ্ছে স্ট্রাটোস্ফিয়ার। এই স্তরের মধ্যে আছে এক জাদুকরি উপস্তর। এর নাম হলো ওজোন স্তর।
এই ওজোন স্তরের কাজের কথায় পরে আসছি। আগে একটু সূর্যের কথা বলি। সূর্যে প্রতি সেকেন্ডে যে বিস্ফোরণগুলো হয়, তা আমাদের চিন্তা কল্পনারও বাইরে। এই বিস্ফোরণগুলোর ক্ষুদ্র একটি বিস্ফোরণ তেজস্ক্রিয়তা এমন যে, তা জাপানের হিরোশিমায় যে অ্যাটমিক বোমা ফেলা হয়েছিল, সেরকম দশ হাজার বিলিয়ন অ্যাটমিক বোমার সমান। চিন্তা করুন স্যার, সেই বিস্ফোরণগুলোর একটু আঁচ যদি পৃথিবীতে লাগে, পৃথিবীর কি অবস্থা হতে পারে?
এখানেই শেষ নয়। মহাকাশে প্রতি সেকেন্ডে নিক্ষিপ্ত হয় মারাত্মক তেজস্ক্রিয় উল্কাপিণ্ড। এগুলোর একটি আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে যাবে পৃথিবী।
আপনি জানেন, আমাদের এই পৃথিবীকে এরকম বিপদের হাত থেকে কোন জিনিসটা রক্ষা করে? সেটা হচ্ছে আমাদের পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল। আরো স্পেসিফিকলি বলতে গেলে, বলতে হয়, ‘ওজোনস্তর’।
শুধু তাই নয়, সূর্য থেকে যে ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি আর গামা রশ্মি পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসে, সেগুলো যদি পৃথিবীতে প্রবেশ করতে পারতো, তাহলে পৃথিবীতে কোন প্রাণী বেঁচে থাকতে পারত না। এই অতি বেগুনি রশ্মির ফলে মানুষের শরীরে দেখা দিত চর্ম, ক্যান্সার, উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণ হতো না। আপনি জানেন, সূর্য থেকে পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসা এসব ক্ষতিকর জিনিসকে কোন জিনিসটা আটকে দেয়? পৃথিবীতে ঢুকতে দেয় না? সেটা হল বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর। এসব ক্ষতিকর উপাদানকে স্ক্যানিং করে পৃথিবীতে প্রবেশে বাধা দেয়।
মজার ব্যাপার কি জানেন? ওজোনস্তর সূর্য থেকে আসা কেবল সেসব উপাদান কেই পৃথিবীতে প্রবেশ করতে দেয়, যেগুলো পৃথিবীতে প্রাণের জন্য সহায়ক। যেমন বেতার তরঙ্গ আর সূর্যের উপকারী রশ্মি। এখানেই শেষ নয়। পৃথিবীর অভ্যন্তরে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় যে তাপমাত্রার সৃষ্টি হয়, তার সবটাই যদি মহাকাশে বিলীন হয়ে যেত, তাহলে রাতের বেলা পুরো পৃথিবী ঠান্ডা বরফে পরিণত হয়ে যেত। মানুষ আর উদ্ভিদ বাঁচতে পারত না। কিন্তু ওজন স্তর সব কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে মহাকাশে ফিরে যেতে দেয় না। কিছু কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে ধরে রাখে, যাতে পৃথিবি তাপ হারিয়ে একেবারে ঠান্ডা বরফ শীতল না হয়ে পড়ে। বিজ্ঞানীরা এটাকে ‘গ্রীন হাউস’ বলে।
স্যার, বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তরের এই ফর্মুলা, কাজ, এটা কি আমাদের পৃথিবীতে সূর্যের বিস্ফোরিত গ্যাস, সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি, উল্কাপিণ্ড থেকে ‘ছাদ’ এর মতো রক্ষা করছে না? আপনার বাসায় বৃষ্টি পানি প্রবেশ করতে পারে না আপনার বাসার ছাদের জন্য। বিভিন্ন দুর্যোগে আপনার বাসার ছাদ যেমন আপনাকে রক্ষা করছে, ঠিক সেভাবে বায়ুমণ্ডলের ওজোনস্তর কি আমাদের পৃথিবীকে রক্ষা করছে না?
আমরা আকাশের সংজ্ঞা থেকে জানলাম যে, পৃথিবীপৃষ্ঠ হতে উপরের সবকিছুই আকাশের মধ্য পড়ে। বায়ুমন্ডলও তো আকাশের মধ্যে পড়ে, এবং আকাশের সংজ্ঞায় বায়ুমন্ডলের কথা আলাদা করেই বলা আছে।
তাহলে বায়ুমণ্ডলের এই যে আশ্চর্যরকম ‘প্রটেক্টিং পাওয়ার’, এটার উল্লেখ করে যদি আল্লাহ বলেন- ‘আর আমরা আকাশকে করেছি সুরক্ষিত ছাদ। অথচ তারা আমাদের নির্দেশনাবলী দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে।’
তাহলে স্যার ভুলটা কোথায় বলছে? বিজ্ঞানতো নিজেই বলেছে, বায়ুমণ্ডল, স্পেশালি বায়ুমণ্ডলের ওজোনস্তর একটি ছাদের ন্যায় পৃথিবীকে রক্ষা করছে। তাহলে আল্লাহও যদি একই কথা বলে, তাহলে সেটা অবৈজ্ঞানিক হবে কেন?
আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, হয় আপনার সে অভিজিৎ রায় বিজ্ঞান বোঝেন না, নয়তো তিনি বিশেষ কোন গোষ্ঠীর পেইড এজেন্ট, যাদের কাজ সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও মনগড়া কথা লিখে কোরআনের ভুল ধরা।’
কথাগুলো বলে সাজিদ থামল। পুরো ক্লাসে এতক্ষণ একটা লেকচার দিয়ে গেল বলে মনে হচ্ছে। তাকে আইনস্টাইন বলায় যারা খলখল করে হাসতো, তাদের চেহারাগুলো ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। মফিজুর রহমান স্যার কিছুই বললেন না। See you Next বলে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন সেদিন।
কোরআনে বিজ্ঞান – কাকতালীয় না বাস্তবতা
কোরআনে বিজ্ঞান – কাকতালীয় না বাস্তবতা
দেবাশীষ বললো, -‘ধর্ম গ্রন্থগুলোর মধ্যে বিজ্ঞান খোজা আর আমাজন জঙ্গলের রেড ইন্ডিয়ানদের মধ্যে সভ্যতার খোঁজা একই ব্যাপার। দুটোই হাস্যকর। হা হা হা হা।’
ওর কথায় অন্যরা খুব ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। শাকিব বলল, -‘দেখ দেবাশীষ, অন্য ধর্ম গ্রন্থগুলোর ব্যাপারে জানিনা, তবে আল কোরআনে এমন অনেক বৈজ্ঞানিক ফ্যাক্ট নিয়ে বলা আছে, যা বিজ্ঞান অতি সম্প্রতি জানতে পেরেছে।’
দেবাশীষ বিদ্রূপ করে বলল, -‘এই জন্যই তো মুসলমানদের কেউই নোবেল পায় না বিজ্ঞানের। সব অই ইহুদি-খ্রিস্টানরাই মেরে দেয়। তখন আবার বলিস না যে, ইহুদি-খ্রিস্টান কোরআন পড়ে এসব বের করেছে। হা হা হা। পারিসও ভাই তোরা। হা হা হা।’
রাকিব বলল, -‘নোবেল লাভ করার উদ্দেশ্যে তো কোরআন নাজিল হয়নি, কোরআন এসেছে একটি গাইডবুক হিসেবে। মানুষকে মুত্তাকী বানাতে।’
-‘হুম, তো।’দেবাশীষের প্রশ্ন।
রাকিব কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। ঠিক সে সময় সাজিদ বলে উঠলো, -‘আমি দেবাশীষের সাথে একমত। আমাদের উচিত না ধর্ম গ্রন্থগুলোর মধ্যে বিজ্ঞান খোঁজা।’
সাজিদের কথা শুনে আমরা সবাই ‘থ’ হয়ে গেলাম। কোথায় সে দেবাশীষকে যুক্তি আর প্রমাণ দিয়ে এক হাত নেবে তা না, উল্টো সে দেবাশীষের পক্ষে সাফাই করছে।
সাজিদ আবার বলতে লাগল, -‘আরো ক্লিয়ারলি, বিজ্ঞান দিয়ে ধর্মগ্রন্থগুলোকে যাচাই করা ঠিক না। কারণ, ধর্মগ্রন্থগুলো ইউনিক। পাল্টানোর সুযোগ নেই। কিন্তু বিজ্ঞান প্রতিনিয়তই পাল্টায়। বিজ্ঞান এতই ছলনাময়ী যে, পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে সেরা বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনকেও তার দেওয়া মত তুলে নিয়ে ভুল স্বীকার করতে হয়েছে।
দেবাশীষ বললো, -‘মানে? তুই কি বলতে চাস?’
সাজিদ মুচকি হাসল। বলল। -‘দোস্ত, আমি তো তোকেই ডিফেন্ড করছি। বলছি যে, ধর্মগ্রন্থে বিজ্ঞান খোঁজা আর তা দিয়ে ধর্মগ্রন্থ জাজ করাটা বোকামি। আচ্ছা বাদ দে। দেবাশীষ, শেক্সপিয়ারের রচনা তোর কাছে কেমন লাগে রে?’
একটু অবাক হলাম। এ আলোচনায় আবার শেক্সপিয়ার আসে কোথা থেকে এসে পড়ল? যাহোক, কাহিনী কোন দিকে মোড় নেয় দেখার অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
-‘ভালো লাগে। কেন?’
-‘হেলমেট পড়েছিস?’
-‘হ্যাঁ।’
-‘পড়ে নিশ্চয়ই কান্না পেয়েছে?’
দেবাশীষ বাঁকা চোখে সাজিদের দিকে তাকালো। সাজিদ বলল, -‘আরে বাবা, এটা তো কোন রোমান্টিক রচনা না যে এটা পড়ে মজা পেয়েছিস কিনা জিজ্ঞেস করবো। এটা একটা করুন রসভিত্তিক রচনা। এটা পড়ে মন খারাপ হবে, কান্না পাবে এটাই স্বাভাবিক, তাই নয়।’
দেবাশীষ কিছু বললো না।
সাজিদ আবার বলল, -‘শেক্সপিয়ারের ‘A Mid Summer Night’s Dream’ পড়েছিস?কিংবা Comedy of Errors?’
-‘হ্যাঁ’
-‘Comedy of Errors পড়ে নিশ্চয়ই হেসে কুটিকুটি হয়েছিস। তাই না? হা হা হা হা।’
দেবাশীষ বললো, -‘হ্যাঁ, মজার রচনা।’
সাজিদ বললো, -‘তোকে শেক্সপিয়ারের আরকেটি নাটকের নাম বলি। হয়তো পড়ে থাকবি। নাটকের নাম হচ্ছে ‘Henry The Fourth’। ধারণা করা হয়, শেক্সপিয়ার এই নাটকটি লিখেছেন ১৫৯৭ সালের দিকে এবং সেটি প্রিন্ট হয় ১৬০৫ সালের দিকে।’
-‘তো?’
-‘আরে বাবা, বলতে দে। সেই নাটকের এক পর্যায়ে মৌমাছিদের নিয়ে দারুণ কিছু কথা আছে। শেক্সপিয়ার দেখিয়েছেন, পুরুষ মৌমাছিদের একজন রাজা থাকে। রাজাটা নির্ধারিত হয় পুরুষ মৌমাছিদের ভেতর থেকেই। রাজা ব্যতীত, অন্যান্য মৌমাছিদের হলো সৈনিক মোমাছি। এই সৈনিক মোমাছিদের কাজ হল, মৌচাক নির্মাণ, মধু সংগ্রহ থেকে শুরু করে সব। রাজার নির্দেশমতো সৈনিক মৌমাছিরা তাদের প্রত্যাহিক কাজ শেষ করে দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে রাজা রাজা মউমাছির কাছে জবাবদিহি করে। অনেকটা প্রাচীন যুগের রাজা বাদশাহের শাসনের মতো আর কি।’
আমরা সবাই শেক্সপিয়ারের গল্প শুনছি। কারো মুখে কোন কথা নেই।
সাজিদ আবার শুরু করলো, –
‘চিন্তা কর, শেক্সপিয়ারের আমলেও মানুষজনের বিশ্বাস ছিল যে, মৌমাছি দুই প্রকার। পুরুষ মৌমাছি আর স্ত্রী মৌমাছি। স্ত্রী মৌমাছি খালি সন্তান উৎপাদন করে, আর বাদ বাকি কাজকর্ম করে পুরুষ মৌমাছি।
সাকিব বলল, -‘তেমনটা তো আমরাও বিশ্বাস করি। এবং, এটাই তো স্বাভাবিক, তাই না?’
-‘হা হা হা। এরকমটাই হওয়া স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু মৌমাছির জীবন চক্র অন্যান্য কীট-প্রত্যঙ্গের তুলনায় একদম আলাদা।’
-‘কি রকম?’ -রাকিবের প্রশ্ন।
সাজিদ বলল, -‘১৯৭৩ সালে অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী Karl Von Frisch ‘Physiology of Medicine’ বিষয়ে সকল গবেষণার জন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল ‘মৌমাছির জীবন চক্র’। অর্থাৎ, মৌমাছিরা কিভাবে তাদের জীবন নির্বাহ করে।
এই গবেষণা চালাতে গিয়ে তিনি এমন সব আশ্চর্যজনক জিনিস সামনে নিয়ে এলেন, যা শেক্সপিয়ারের সময়কার পুরো বিশ্বাসকে পাল্টে দিলো। তিনি ফটোগ্রাফি এবং অন্যান্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করে দেখিয়েছিলেন যে, মৌমাছি দুই প্রকার নয়, মৌমাছি আসলে তিন প্রকার।
প্রথমটা হল, পুরুষ মৌমাছি।
দ্বিতীয়টা হল, স্ত্রী মৌমাছি। এই মৌমাছিদের বলা হয়, Queen Bee. এরা শুধু সন্তান উৎপাদন করা ছাড়া আর কোন কাজ করে না। এই দুই প্রকার ছাড়াও আরো এক প্রকার মৌমাছি আছে। লিঙ্গভেদে এরাও স্ত্রী মৌমাছি তবে একটু ভিন্ন।’
-‘কি রকম?’ দেবাশীষ প্রশ্ন করল।
-‘আমরা জানি পুরুষ মৌমাছিরাই মৌচাক নির্মাণ থেকে শুরু করে মধু সংগ্রহ সব করে থাকে কিন্তু এই ধারণা ভুল। পুরুষ মৌমাছি শুধু একটি কাজই করে, আর তা হলো কেবল রানী মৌমাছিদের প্রজনন প্রক্রিয়ায় সহায়তা করা। মানে, সন্তান উৎপাদনে সহায়তা করা। এই কাজ ছাড়া আর কোন কাজ নেই।’
-‘তাহলে মৌচাক নির্মাণ করে শুরু করে বাকি কাজ কারা করে?’ –রাকিব জিজ্ঞাসা করল।
-‘হ্যাঁ। তৃতীয় প্রকারের মৌমাছিরাই বাদ বাকি সব কাজ করে থাকে। লিঙ্গভেদে এরাও স্ত্রী মৌমাছি। কিন্তু প্রকৃতিগতভাবে এর সন্তান জন্মদানে অক্ষম। সোজা কথায়, এদের বন্ধ্যা বলা যায়।’
আমি বললাম, -‘ও আচ্ছা।’
সাজিদ আবার বলতে লাগল, -‘বিজ্ঞানী Karl Von Frisch এই বিশেষ শ্রেণীর স্ত্রী মৌমাছিদের নাম দিয়েছেন Worker Bee বা কর্মী মৌমাছি। এরা Queen Bee তথা রানি মৌমাছি থেকে আলাদা একটি দিকেই। সেটা হলো রানী মৌমাছির কাজ হলো সন্তান উৎপাদন, আর কর্মীদের কাজ সন্তান জন্ম দেওয়া ছাড়া অন্যসব।’
সাকিব বলল, -‘বাহ, দারুন তো। এরা কি প্রকৃতিগতভাবেই সন্তান জন্মদানে অক্ষম হয়ে থাকে?’
-‘হ্যাঁ’
-‘আরও, মজার ব্যাপার আছে। বিজ্ঞানী Karl Von Frisch প্রমাণ করেছেন যে, ওইসব কর্মীরা যখন ফুল থেকে রস সংগ্রহ করতে বের হয়, তখন তারা খুব অদ্ভুত একটি কাজ করে। সেটা হল, ধর, কোন কর্মী মৌমাছি কোন এক জায়গায় ফুলের উদ্যানের সন্ধান পেল যেখান থেকে রস সংগ্রহ করা যাবে। তখন ওই মৌমাছিটি তার অন্যান্য সঙ্গীদের এই ফুলের উদ্যান সম্পর্কে খবর দেয়।’
মৌমাছিটি ঠিক সেভাবেই বলে, যেভাবে যে পথ দিয়ে সে ওই উদ্যানে গিয়েছিল। মানে, এক্স্যাক্ট, যে পথে সে সন্ধান পায়, সে পথের কথাই অন্যদের বলে। আর, অন্য মৌমাছিরাও ঠিক তার বাতলে দেওয়া পথ অনুসরণ করেই সে উদ্যানে পৌঁছে। একটুও হেরফের করে না। Karl Von Frisch এই ভারী অদ্ভুত জিনিসটার নাম রেখেছেন ‘Waggle dance’..
আমি বললাম, -‘ভেরি ইন্টারেস্টিং…..’
সাজিদ বলল, -‘মোদ্দাকথা, Karl Von Frisch প্রমাণ করেছেন যে, স্ত্রী মৌমাছি দু প্রকারের। রানি মৌমাছি আর কর্মী মৌমাছি। দুই প্রকারের কাজ সম্পূর্ণ আলাদা। আর, পুরুষ মৌমাছি মৌচাক নির্মাণ, মধু সংগ্রহ এসব করে না। এসব করে কর্মী স্ত্রী মৌমাছিরাই।’
এই পুরো জিনিসটার ওপর Karl Von Frisch একটি বইও লিখেছেন। বইটির নাম ‘the Dancing Bees’। এই জিনিসগুলো প্রমাণ করে তিনি ১৯৭৩ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান।
এতটুকু বলে সাজিদ থামল। দেবাশীষ বলল, -‘এত কিছু বলার উদ্দেশ্য কি?’
সাজিদ তার দিকে তাকাল। আর বলল, -‘যে জিনিসটা ১৯৭৩ সালে বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে, সেই জিনিসটা ১৫০০ বছর আগে কোরআন বলে রেখেছে।’
দেবাশীষ সাজিদের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালো।
সাজিদ বললো, -‘কোরআন যেহেতু আরবী ভাষায় নাজিল হয়েছে, আমাদের আরবী ব্যাকরণ অনুসারে তার অর্থ বুঝতে হবে। বাংলা থেকে ইংরেজি কোনটাতেই পুংলিঙ্গ এবং স্ত্রীলিঙ্গের জন্য আলাদা আলাদা ক্রিয়া ব্যবহৃত হয় না।
যেমন ইংলিশে পুংলিঙ্গের জন্য আমরা বলি, He does the work, আবার স্ত্রী লিঙ্গের জন্যও বলি, She does the work
খেয়াল করো, দুটো বাক্যে জেন্ডার পাল্টে গেলেও ক্রিয়া পাল্টেনি। পুংলিঙ্গের জন্য যেমন does, স্ত্রীলিঙ্গের জন্যও does। কিন্তু আরবিতে সেরকম নয়। আরবিতে জেন্ডারভেদে ক্রিয়ার রূপ পাল্টে যায়।’
আমরা মনোযোগী শ্রোতার মত শুনেছি।
সে বলে যাচ্ছে-
‘কুরআনে মৌমাছির নামেই একটি সূরা আছে। নাম সূরা আল নাহল। এই সুরার ৬৮ নাম্বার আয়াতে আছে, – ‘(হে মোহাম্মদ) আপনার রব মৌমাছিকে আদেশ দিয়েছেন যে, মৌচক বানিয়ে নাও পাহাড়ে, বৃক্ষে এবং মানুষ যে গৃহ নির্মাণ করে, তাতে।’
খেয়াল করো, এখানে সন্তান জন্মদানের কথা বলা হচ্ছে না কিন্তু। মৌচক নির্মাণের কথা বলা হচ্ছে।
Karl Von Frisch আমাদের জানিয়েছেন, মৌচাক নির্মাণের কাজ করে থাকে স্ত্রী মৌমাছি। এখন আমাদের দেখতে হবে কুরআন কোন মৌমাছিকে এই নির্দেশ দিচ্ছে। স্ত্রীর মৌমাছিকে? নাকি পুরুষ মৌমাছিকে?
যদি পুরুষ মৌমাছিকে এই নির্দেশ দেয়, তাহলে ধরে নিতে হবে, আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে কুরআন ভুল। আরবি ব্যাকারনে পুরুষ মৌমাছি কে মৌচাক নির্মাণ কাজের নির্দেশ দিতে যে ক্রিয়া ব্যবহৃত হয় তাহলো ‘ইত্তাখিজ’ আর কি স্ত্রী মৌমাছিদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় ‘ইত্তাখিজি’।
অত্যন্ত আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, কোরআন এই আয়াতে মৌমাছিকে নির্দেশ দিতে ‘ইত্তাখিজ’ ব্যবহার না করে, ‘ইত্তাখিজি’ ব্যবহার করেছে। মানে, এই নির্দেশটা নিঃসন্দেহে স্ত্রী মৌমাছিকেই দিচ্ছে, পুরুষ মৌমাছিকে নয়।
বলতো দেবাশীষ, এই সূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক ব্যাপারটি, মুহাম্মদ সা. কোন সম্পর্ক রাখে কোন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন? এমনকি, শেক্সপিয়ারের সময়কালেও যেখানে এটা নিয়ে ভুল ধারণা প্রচলিত ছিল?’
দেবাশীষ চুপ করে আছে। আর বলতে লাগল, -‘শুধু এই আয়াতে নয়, এরপরের আয়তে আছে ‘অতঃপর, শোষণ করে নাও প্রত্যেক ফুল থেকে, এবং চল স্বীয় রবের সহজ সরল পথে।’
চোষণ বা পান করার ক্ষেত্রে আরবিতে পুংলিঙ্গের জন্য ব্যবহৃত হয় ‘কুল’ শব্দ, এবং স্ত্রী লিঙ্গের জন্য ব্যবহৃত হয় ‘ক্কুলি’। কুরআন এখানে ‘ক্কুল’ ব্যবহার না করে ‘ক্কুলি’ ব্যবহার করেছে। ‘সহজ সরল পথে’ চলার নির্দেশ এসেছে পুলিঙ্গের জন্য ব্যবহৃত শব্দ ‘ঊসলুক’, এবং স্ত্রীলিঙ্গের জন্য ব্যবহৃত হয় ‘ঊসলুকি’। মজার ‘ঊসলুক’ ব্যবহার না করে ‘ঊসলুকি’ ক্রিয়া ব্যবহার করেছে। মানে, নির্দিষ্টটা পুরুষ মৌমাছিদের জন্য নয়, স্ত্রী মৌমাছির জন্য।
আরও মজার ব্যাপার, এই আয়াতে কুরআন মৌমাছিকে একটি সহজ সরল পথে চলার নির্দেশ দিচ্ছে। আচ্ছা, মৌমাছির কি পরকালের জবাবদিহিতার কোন দায় আছে? পাপ পুণ্যের? নেই। তাহলে তাদের কেন সহজ সরল পথে চলার নির্দেশ দেয়া হল?
খেয়াল কর, বিজ্ঞানী Karl Von Frisch মৌমাছিদের ব্যাপারে যে আশ্চর্যজনক ব্যাপারটি লক্ষ্য করেছেন, তা হল তারা ঠিক যে পথে কোন ফুলের উদ্যানের সন্ধান পায়, ঠিক একই পথে, একই রাস্তায় অন্যদের বাতলে দেয়। কোন হেরফের করে না। অন্যরাও ঠিক সে পথ অনুসরণ করে উদ্যানে পৌঁছে। এটাই তাদের জন্য সহজ সরল পথ। বিজ্ঞানী Karl Von Frisch এটার নাম দিয়েছেন Waggle Dance, কোরআনও ঠিক এ কথাই বলছে না?
দেবাশীষ, এখন তোকে যদি প্রশ্ন করি, কুরআন কি এই জিনিসগুলো বিজ্ঞানী Karl Von Frisch থেকে নকল করেছে?
তোর উত্তর হবে ‘না’। কারন, তিনি এসব প্রমাণ করেছেন মাত্র সেদিন। ১৯৭৩ সালে। কোরআন নাজিল হয়েছে আজ থেকে ১৫০০ বছর আগে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবিহীন নিরক্ষর মুহাম্মদ সা. এই বৈজ্ঞানিক ব্যাপারগুলো ঠিক কোথায় পেলেন? কোরআন কেন এই নির্দেশগুলো পুরুষ মৌমাছিকে দিল না? কেন স্ত্রী মৌমাছিকে দিল?
যদি এই কোরআন সুপার ন্যাচারাল কোন শক্তি, যিনি এই মৌমাছির সৃষ্টিকর্তা, যিনিই মৌমাছিদের জীবনচক্রের জন্য উপযুক্ত করে সৃষ্টি করেছেন, তার নিকট থেকে না আসে, তাহলে ১৫০০ বছর আগে আরবের মরুভূমিতে বসে কে এটা বলতে পারে?
যে জিনিসটার ১৯৭৩ সালে আবিষ্কার করে বিজ্ঞানী Karl Von Frisch নোবেল পেলেন, তা কুরআনে বহু শতাব্দী আগেই বলা আছে। কই মুসলিমরা কি দাবী করছে Karl Von Frisch কোরআন থেকে নকল করেছে? করে নি। মুসলিমরা কি তার নোবেল পুরষ্কারে ভাগ বসাতে গেছে? না, যায় নি। কারন, এর কোনটাই কোরআনের উদ্দেশ্য নয়।
আমরা কোরআনকে বিজ্ঞান দিয়ে বিচার করি না, বরং দিন শেষে বিজ্ঞানী কোরআনের সাথে এসে কাঁধে কাঁধ মিলায়।
এতোটুকু বলে সাজিদ থেমে গেল। দেবাশীষ কিছুই বলছে না। শাকিব আর রাকিবের চেহারাটা তখন দেখার মতো। তারা খুবই উৎফুল্ল এবং খোশমেজাজি একটা চেহারায় দেবাশীষের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন তারা বলতে চাইছে- ‘দে দে ব্যাটা। পারলে একবার কোন উত্তর দে………..
কোরবানির ঈদ এবং একজন আরজ আলী মাতুব্বরের অযাচিত মাতবরি
কোরবানির ঈদ এবং একজন আরজ আলী মাতুব্বরের অযাচিত মাতবরি
পদ্মার বুক চলে আমাদের লঞ্চ চলছে।
দুপাশ থেকে শুনতে পাচ্ছি পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। সাধারণত, লঞ্চগুলোর মাথার উপর বিশাল সাইজের একটি ছাউনি থাকে। কিন্তু আমাদের লঞ্চের উপরিভাগ খালি। কোন ছাউনি নেই।
আকাশটা একদম উদোম। তার ওপরে তারা-নক্ষত্র ভর্তি সুবিশাল আকাশ, নিচে আছে স্রোতস্বিনী পদ্মা।
চাঁদের প্রতিফলিত আলোতে নদীর পানি ঝিকমিক ঝিকমিক করছে। সে এক অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য !
আমরা যাচ্ছি রসুলপুর গ্রামে। বরিশাল জেলার মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত একটি গ্রাম।
সাজিদের অনুরোধ, এবারের কোরবানির ঈদটা তার সাথে তাদের বাড়িতে করতে হবে। তাই যাওয়া।
তাছাড়া যখন শুনলাম, পদ্মা-মেঘনা সঙ্গমস্থলের উপর দিয়ে যাওয়া হবে, তখন আর লোভ সামলানো গেল না। আমি এর আগে কখনো এই দুই নদীকে স্বচক্ষে দেখিনি। তাই বিনা অজুহাতে তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম।
লঞ্চে আমরা তিনজন মাত্র মানুষ। আমি, সাজিদ এবং একজন চালক। মধ্যবয়স্ক এই লোকটার নাম মহব্বত আলী। যারা নৌকা চালায় তাদের মাঝি বলা হয়, যারা জাহাজ চালায় তাদের বলে নাবিক। যারা লঞ্চ চালায় তাদের কি বলে? আমি জানিনা। মহব্বত আলীর নামের এই লোক লঞ্চের এক মাথায় জড়সড় হয়ে বসে বসে ঝিমুচ্ছে। মাঝিদের মতো তার বৈঠা চালানোর চিন্তা নেই। তেলের ইঞ্জিন।
আমি আর সাজিদ মঞ্চের একেবারে মাঝখানে বসে আছি। একটি চাদর পাতা হয়েছে। সাথে আছে পানির বোতল, চিনা বাদাম, ভাজা মুড়ি।
মাথার উপরে আকাশ।
হঠাৎ করে আমার তখন মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসটির কথা মনে পড়ে গেল। আমি সাজিদ কে প্রশ্ন করলাম, -‘তুই কি মানিক দার ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ পড়েছিস?’
সাজিদ বলল, -‘হু’
আমিও কতবার পড়েছি এই উপন্যাস। সব চরিত্র গুলোর নাম আমার ঠিক মনে নেই। তবে উপন্যাসের নায়কের বউটা লেংড়া ছিল এবং নায়কের সাথে তার শালিকার প্রেম ছিল। এই ঘটনা গুলো আবছা আবছা মনে করতে পারি।
সাজিদ আমাকে বলল, -‘হঠাৎ উপন্যাসে চলে গেলি কেন?’
-‘না, এমনি।’
এইটুকু বলে দুজনে খানিকক্ষণ চুপচাপ ছিলাম। এরপর আমি জিজ্ঞেস করলাম, – ‘আচ্ছা ঐ উপন্যাসের কোন চরিত্রটি তোর কাছে সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং লেগেছে?’
আমি ভাবলাম, সাজিদ হয় উপন্যাসের নায়ক কিংবা নায়কের শ্যালিকার কথাই বলবে। কিন্তু সাজিদ বলল, -‘ওই উপন্যাসে ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার আছে কেবল একটাই। সেটি হল হোসেন মিয়া।’
আমি খানিকটা অবাক হলাম। অবাক হলাম কারণ সাজিদ এই প্রশ্নের উত্তর দিতে এক সেকেন্ডও ভাবেনি। আগে পড়া একটি উপন্যাস থেকে সে এমন একটি ক্যারেক্টার নাম বলছে যেটি উপন্যাসটির কোন মূল চরিত্রের মধ্যেই পড়ে না। হোসেন মিয়া নামে এই উপন্যাসে কোন চরিত্র আছে, সেটি আমি ভুলেই গিয়েছিলাম।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, -‘হোসেন মিয়া? নায়কটা নয় কেন?’
সাজিদ বলল, -‘কুবের মাঝির মতো কত কত শত মাঝি পদ্মা পারে অহরহ দেখা যায়, যাদের ঘরে মালার মতো একটি খোঁড়া পা ওয়ালা কিংবা অন্ধ স্ত্রী আছে, আছে তিন-চারটে করে পেটুক সন্তান, আছে কপিলার মত সুন্দরী শালীকা। তাদের মাঝেও পরকীয়া আছে, দৈহিক সম্পর্ক আছে। কিন্তু হোসেন মিয়া হোসেন মিয়ার মতো কোন চরিত্রে আছে এই পদ্মা পারে? যে কিনা নিজের মত করে একটি দ্বীপ সাজিয়ে তুলে সেখানে মানুষকে বিনা পয়সায় থাকতে দেয়। আছে?কি বাস্তবে, কি সাহিত্যে………’
আমি আরো একবার সাজিদের সাহিত্য জ্ঞান দেখে মুগ্ধ হলাম। সে এমনভাবে চরিত্রগুলোর নাম বলে গেল যেন, সে এইমাত্র উপন্যাসটি পড়ে শেষ করেছে।
আমরা রসুলপুরে পৌঁছাযই সাড়ে চারটেতে তখন কিছু কিছু জায়গার ফজরের আজান পড়েছে। যেখানে নেমেছি সেখান থেকে বেশ কিছু পথ হাঁটতে হবে।
খানিকটা হেঁটে একটা মাটির ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। বুঝতে পারলাম এটা মসজিদ। ভেতরে একটি কুপিবাতি মিটমিট করে জ্বলছে।
ব্যগপত্র রেখে দু’জন ওজু করে নিলাম। মসজিদে মানুষও আমরা তিনজন। আজব ! তিন সংখ্যাটা দেখি একদম পিছু ছাড়ছে না। লঞ্চেও ছিলাম আমরা তিনজন মসজিদে এসেও দেখি আমরা তিনজন।
নামাজ শেষ হয়েছে একটু আগে। আমরা বসে আছি মসজিদের বারান্দায়। একটু আলো ফুটলে বেরিয়ে পড়বো। ইমাম সাহেব আমাদের পাশে বসে কোরআন তেলাওয়াত করছেন। মাঝারি বয়স। দাড়িতে মেহেদি লাগিয়েছেন বলে দাড়িগুলো লালচে দেখাচ্ছে। উনি সূরা আর-রহমান তিলাওয়াত করছেন। ‘ফাবি আইয়্যি আলা-য়্যি রাব্বিকুমা তুকাজ্জিবান’ অংশ টিতে এসে খুব সুন্দর করে টান দিচ্ছেন। পরান জুরানিয়া।
আর রহমান তেলাওয়াত করে উনি কোরআন শরীফ বন্ধ করলেন। বন্ধ করে কোরআন শরীফের দুটি চুমু খেলেন। এরপর সেটাকে একবার কপালে আর একবার মুখে লাগিয়ে কি কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে একটা কাঠের তাকে তুলে রাখলেন।
আমরা লোকটার দিকে তাকিয়ে আছি। লোকটা আমার দিকে ফিরে বললেন, -‘আমনেরা কি শহর হইতে আইছেন?’
সাজিদ বলল, ‘জি।’
-‘আমনেরা কি লেখাপড়া করেন?’
সার্জিল আবার বলল, -‘জি।’
-‘মাশাল্লাহ মাশাল্লাহ। আমনেরা শহরের পইড়্যাও বিগড়াইয়া যান নাই। শুকুর আলহামদুলিল্লাহ।’
লোকটার কথা আমি ঠিক বুঝিনি। সাজিদ বুঝেছে। সে জিজ্ঞেস করল, -‘চাচা, শহরে পড়াশোনা করলে বিগড়িয়ে যায়, আপনাকে কে বলল?’
লোকটা হঠাৎ গম্ভীর মুখ করে বলল, -‘হেইয়া আবার কেডায় কইবে বাপ ! মোর ঘরেই তো জন্মাইছে একখান সাক্ষাৎ ইবলিশ।’
-‘কি রকম?’ সাজিদের প্রশ্ন।
-‘মোর এক্কুয়াই পোলা। পড়ালেখা করতে পাডাইলাম ঢাকা শহরে। হেইনে যাইয়া কি যে পড়ালেহা করছে ! এহন কয়, আল্লা-বিল্লা কইয়া বোলে কিস্যু নাই। এই যে, এহন তো বাড়িতে আইছে। আইয়া কইতেছে কি বোঝঝেন, কয় বলে কোরবানি দিয়া মোরা পশু হত্যা করি। এইগুলা বোলে ধর্মের নাম ভাইঙ্গা খাওনেন ধান্দা হরি মোরা। কিরপ্যিকা যে এইডারে ঢাকায় পড়তে পাডাইলাম বাপ ! হালুডি হরাইলে আজ এই দিন দেহা লাগতে না। !’
লোকটা সব কথা আমি বুঝতে পারিনি। তবে এইটুকু বুঝেছি যে, লোকটার ছেলে ঢাকায় পড়ালেখা করতে এসে নাস্তিক হয়ে গেছে।
সাজিদ বলল, -‘আপনার ছেলে এখন বাড়িতে আছে?’
-‘হ’
সাজিদ আমার দিকে ফিরে বললো, -‘দেখছিস, মেঘনার এত বড় বুকেও কিন্তু নাস্তিকদের বসবাস আছে। হা হা হা।
সিদ্ধান্ত হলো ছেলেটার সাথে দেখা করে যাব।
সকাল ন’টায় ছেলেটার সাথে আমরা দেখা হল। বয়সে আমাদের চেয়ে ছোট হবে। জিজ্ঞেস করে জানলাম, ছেলেটা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিষয় নিয়ে পড়ছে। ফার্স্ট ইয়ারে। নাম মোঃ রফিক।
সাজিদ রফিক নামের ছেলেটির কাছে জিজ্ঞেস করল, -‘কোরবানি নিয়ে তোমার প্রশ্ন কি?’
ছেলেটা বলল, -‘এইটা একটা কুপ্রথা। এভাবে পশু হত্যা করে উৎসব করার কোন মানে হয়?’
সাজিদ বলল, -‘তুমি কি বিজ্ঞান সম্পর্কে কিছু জানো?’
ছেলেটি চোখ বড় বড় করে বলল, -‘আপনি কি আমাকে বিজ্ঞান শিখেচ্ছেন নাকি? ইন্টারমিডিয়েট লেবেল পর্যন্ত আমি বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম।’
-‘তা বেশ। খাদ্য শৃংখল সম্পর্কে নিশ্চয়ই জানো?’
-‘জানি। জানবো না কেন?’
-‘খাদ্য শৃংখল হলো, প্রকৃতিতে উদ্ভিদ ও প্রাণীর মধ্যকার একটি খাদ্য জাল। যেসব উদ্ভিদ সূর্যের আলো ব্যবহার করে নিজের খাদ্য নিজে তৈরি করে নেয় তাদের বলা হয় উৎপাদক। এই উৎপাদককে বা উদ্ভিদকে যারা খায়, তারা হচ্ছে প্রথম শ্রেণীর খাদক…..’
ছেলেটা বলল, -‘মশাই, এসব আমি জানি। আপনার আসল কথা বলুন।’
ছেলেটার কথার মধ্যে কোন রকম আঞ্চলিকতার টান নেই। তাই বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না।
পাশ থেকে ছেলেটার বাবা বলে উঠলেন, -‘এ, হেরা বয়সে কোলাং তোর চাইয়া বড় অইবে। মান ইজ্জত দিয়া কথা কইতে পারো না?’
ছেলেটা তার বাবার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। সে দৃষ্টিতে পড়াশোনা জানা ছেলেদের মূর্খ বাবার প্রতি অবজ্ঞার ছাপ স্পষ্ট।
সাজিদ বলল, -‘ বেশ ! তোমাদের গরু আছে?’
-‘আছে’
-‘কয়টা?’
ছেলেটার বাবা বললেন, -‘হ বাপ। মোগো গরু আছে পাচ খান। দুইডা গাই, এক্কুয়া ষাঁড় গরু। লগে আবার বাছুরও আছে দুইডা।
-‘আচ্ছা রফিক, ধরো-তোমাদের যে দুটি গাভী আছে, তাদের এই দুটি করে বাচ্চা দিল। তাহলে তোমাদের মোট গরুর সংখ্যা হবে নয়টি। ধরো, তোমরা পশু হত্যায় বিশ্বাসী নও। তাই তোমরা গরুগুলো বিক্রিও করো না। কারণ, তোমরা জানো বিক্রি হলে গরুগুলো কোথাও না কোথাও কুরবানী হবেই। ধরো, এরপরের বছর গরু গুলো আরো দুটি করে বাচ্চা দিল। মোট গুরু তখন ১৩ টি। এর পরের বছর দেখা গেল, বাছুরগুলোর মধ্যে থেকে দুটি গাভী হয়ে উঠল, যারা বাচ্চা দিবে। এখন মোট গাভীর সংখ্যা চারটি। ধরো, চারটি গাভী এর পরের বছর আরো দুটি করে বাচ্চা দিবে। তাহলে সে বছর তোমাদের মোট গরুর সংখ্যা কত দাড়ালো?’
ছেলেটির বাবা আঙুল হিসাব কষে বললেন, -‘হ, ১৯ টা অইবে।’
সাজিদ বলল, -‘বলতো রফিক, ১৯ টা গরু রাখার মত জায়গা তোমাদের আছে কিনা? ১৯ টা গরুকে খাওয়ানোর মতো সামর্থ্য, পর্যাপ্ত ভুসি, খই, ঘাস আছে কি না তোমাদের?’
-‘না’ -ছেলেটা বলল।
-‘তাহলে আলটিমেটলি তোমাদের কিছু গরু বিক্রি করে দিতে হবে। এদের যারা কিনবে, তারা তো গরু কিনে গুদামে ভরবে না। তাই না? তারা গরু গুলোকে জবাই করে মাংস বিক্রি করবে। গরুর মাংস আমিষের চাহিদা পূরণ করবে আর চামড়াগুলো শিল্পের জন্য কাজে লাগবে। তাই না?’
-‘হুম’
-‘এটা হল প্রকৃতির ব্যালেন্স। তাহলে, প্রকৃতির ব্যালেন্স ঠিক রাখার জন্য পশুগুলোকে জবাই করতেই হচ্ছে। সেটা এমনি হোক অথবা কোরবানে।’
ছেলেটা বলল, -‘সেটা নিয়ে তো আপত্তি নেই। আপত্তি হচ্ছে, এটাকে ঘিরে উৎসব হবে কেন?’
সাজিদ বলল, -‘বেশ ! উৎসব বলতে তুমি হয়তো মীন করছো, যেখানে নাচ গান হয়, ফুর্তি হয়, আড্ডা, ড্রিঙ্কস হয়। মিছিল হয়, শোভাযাত্রা হয়, তাই না? কিন্তু দেখো, মুসলমানদের এই উৎসব সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে নাচ গান নেই, আড্ডা মাস্তি নেই। ড্রিঙ্কস নেই, মিছিল শোভাযাত্রা নেই। আছে ত্যাগ আর তাকওয়ার পরীক্ষা। আছে, অসহায়ের মুখে হাসি ফোটানো প্রাণান্তকর চেষ্টা। শ্রেণি বৈষম্য দূর করে, সবার সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়া হয়। এরকম উৎসবে সম্ভবত কারো দ্বিমত থাকার কথা না। কার্ল মাক্সকে চেনো?’
ছেলেটা এরপর কিছুক্ষন চুপ করেছিল। তারপর বলল, -‘আরজ আলী মাতুব্বরকে চিনেনে আপনি?’
সাজিদ বলল, -‘হ্যাঁ, চিনি তো’
-‘কোরবানি নিয়ে উনার কিছু যৌক্তিক প্রশ্ন আছে।’
-‘কি প্রশ্ন বলো।’
ছেলেটা প্রথম প্রশ্নটি বলল। সেটি ছিল –
‘আল্লাহ ইব্রাহিম এর কাছে তার সব চাইতে প্রিয় বস্তুর উৎসর্গের আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু ইব্রাহিম এর কাছে সবচেয়ে প্রিয় বস্তু তার ছেলে ইসমাইল না হয়ে, তার নিজ প্রান কেন হল না?’
সাজিদ মুচকি হেসে বললো, -‘খুবই লজিক্যাল প্রশ্ন বটে।’
-‘আমি যদি আরজ আলী মাতব্বরের সাক্ষাৎ পেতাম, তাহলে জিজ্ঞেস করতাম বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছে, তাদের কাছে তাদের নিজের প্রানের চেয়ে দেশটা কেন বেশি প্রিয় হলো? কেন দেশরক্ষার জন্য নিজেদের প্রাণটাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিল?
দুটো জিনিসই সেইম ব্যাপার। ইব্রাহীমের কাছে নিজের চেয়েও প্রিয় ছিল পুত্রের প্রাণ, আর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে নিজের প্রানের চেয়ে প্রিয় ছিল নিজের মাতৃভূমি।
কিন্তু পরীক্ষার ধরন ছিল আলাদা। ইব্রাহিমকে বলা হলো, প্রিয় জিনিস কোরবানি করতে, আর মুক্তিযোদ্ধাদের বলা হলো প্রিয় জিনিস রক্ষা করতে। কিন্তু, আমরা দেখতে পেলাম দুজনের কারো কাছেই প্রিয় বস্তু নিজের প্রান নয়। সুতরাং আরজ আলী মাতব্বরের মাতব্বরিটা এখানে ভুল প্রমাণিত হলো।’
ছেলেটা কাচুমাচু করে দ্বিতীয় প্রশ্ন করল ।
আরজ আলী মাতব্বর বলেছেন, -‘আল্লাহ পরীক্ষাটা করেছেন ইব্রাহিমকে। ইব্রাহিম এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে সেই পরীক্ষাটা কেন তার অনুসারীদের দিতে হবে?’
সাজিদ বললো, -‘এইটা খুব ভালো প্রশ্ন। আমরা মুহাম্মদ সা. কে অনুসরন করি। তাহলে আমরা কি বলতে পারি যে, -কই আমাদের উপর তো জিবরাঈল আঃ ওহী নিয়ে কখনো আসে নাই। তাহলে মোহাম্মদের উপর আসা ওহী আমরা কেন মানতে যাবো? বলো প্রশ্নটা কি আমরা করতে পারি?’
ছেলেটা চুপ করে আছে। সাজিদ বলল, -‘আরজ আলী মাতুব্বরের Leader & Leadership আদতে কোন জ্ঞানই ছিল না। তাই তিনি এরকম প্রশ্ন করে নিজেকে সক্রেটিস বানাতে চেয়েছিলেন।
ছেলেটা তার তৃতীয় প্রশ্ন করল-
‘আরজ আলী মাতুব্বর বলেছেন, -নবী ইব্রাহিমকে তো কেবল ইসমাইলকে কুরবানী করা সংক্রান্ত পরীক্ষাই দিতে হয়নি, অগ্নিকুন্ডে নিক্ষিপ্ত হবার মতো কঠিন পরীক্ষাও তাকে দিতে হয়েছিল। তাহলে মুসলমানরা ইব্রাহিমের স্মৃতি ধরে রাখতে পশু কোরবানি করলেও ইব্রাহিমের আর একটি পরীক্ষা মতে -মুসলমানরা নিজেদের অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করে না কেন?’
আরজ আলী মাতুব্বরের আগের প্রশ্নগুলো আমার কাছে শিশুসুলভ মনে হলেও, এই প্রশ্নটিকে অনেক ম্যাচিউর মনে হল। আসলেই তো। দুটোই ইব্রাহিম আঃ এর জন্য পরীক্ষা ছিল। তাহলে, একটি পরীক্ষা স্মৃতি ধরে রাখতে আমরা যদি পশু কুরবানী করি, তাহলে নিজেদের অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করি না কেন?
পদ্মা থেকে সাঁ সাঁ শব্দে বাতাস আসতে শুরু করেছে।
সাজিদ বলল, -‘রফিক, তার আগে তুমি আমার একটি প্রশ্ন উত্তর দাও। তুমি কি শেখ মুজিবকে ভালোবাসো? তার আদর্শকে?’
ছেলেটা বলল, -‘অবশ্যই। তিনি না হলে তো বাংলাদেশের অস্তিত্বই থাকত না। তিনি আমাদের জাতির পিতা।’
-‘তুমি ঠিক বলেছ। শেখ মুজিব না হলে বাংলাদেশে হয়তো কোনদিনই স্বাধীন হত না । সে যাহোক, শেখ মুজিবকে জীবনের দুটি বড় ধরনের পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছিল।
প্রথমে, একটা দেশকে স্বাধীন করার লড়াইয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া।
দ্বিতীয়ত, সপরিবারে খুন হওয়া। আমি কি ঠিক বললাম না রফিক?’
-‘হু’
-‘এখন, তুমি শেখ মুজিবের আদর্শ বুকে ধারণ কর। তুমি একাত্তরের চেতনায় নিজেকে বুলিয়ান ভাবো। তুমি ৭ ই মার্চের বিশাল মিছিলে যোগদান করো। ১৬ ই ডিসেম্বর সভা-সমাবেশে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলে স্লোগান দাও। কিন্তু, ১৫ই আগস্টে রাস্তায় বেরিয়ে কোনদিন বলেছ, হে মেজর ডালিম এর বংশধর, হে খন্দকার মোশতাকের বংশধর, তোমরা কে কোথায় আছো, এসে আমাকেও মুজিবের মত সপরিবারে খুন করো। বলো কি?’
আমি সাজিদের কথা শুনে হো হো হো করে হাসা শুরু করলাম। ছেলেতার২ মুখ তখন একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। সাজিদ আবার বলতে শুরু করল, -‘তুমি এটা বলো না। শেখ মুজিবের আদর্শ বুকে ধারণ করে এরকম কেউই এটা বলবে না। যদি কেউ এরকম বলে, তাহলে তাকে মানুষ বলবে, -কি ব্যাপার? লোকটাকে কি ভাদ্র মাসের কুকুরে কামড়িয়েছে নাকি?’
সাজিদের কথা শুনে রফিকের বাবাও হা হা হা করে হাসতে লাগলো। ছেলেকে পরাজিত হতে দেখে পৃথিবীর কোন বাবা এত খুশি হতে পারে, এই দৃশ্য না দেখলে বুঝতামই না।
আমরা রসুলপুরের দিকে হাটা ধরলাম। পদ্মা পাড়ের জনবসতিগুলো দেখতে একেবারে ছবির মতো। নিজেকে তখন হোসেন মিয়ার ময়না দ্বীপের বাসিন্দা মনে হচ্ছিলো। আর সাজিদ? তাকে আপাতত হোসেন মিয়া রূপেই ভাবতে পারেন।
তাকদির বনাম স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি – স্রষ্টা কি এখানে বিতর্কিত?
সাজিদের ব্যাগে ইয়া মোটা ডায়েরি থাকে সবসময় ডায়েরিটা প্রাগঐতিহাসিক আমলের কোন নিদর্শনের মত । জায়গায় জায়গায় ছেড়া । ছেড়া জায়গার কোনটাতে সুতো দিয়ে সেলাই করা, কোন জায়গায় আটা দিয়ে প্রলেপ লাগান, কোন জায়গায় ট্যাপ করা ।
এই ডায়েরিতে সে তার জীবনের নানা উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো লিখে রাখে । এই ডায়েরির কোন এক মাঝামাঝি জায়গায় সাজিদ আমার সাথে প্রথম সাক্ষাতের ঘটনাটিও লিখে রেখেছে । তার সাথে আমার প্রথম দেখা হয় টি.এস.সি তে ।
সে আমার সম্পর্কে লিখে রেখেছে, –
‘ভ্যাবলা টাইপের একটা ছেলের সাথে সাক্ষাৎ হল আজ । দেখলেই মনে হবে, জগতের কঠিন বিষয়ের কোন কিছুই সে বুঝে না । কথা বলার পর বুঝলাম, এই ছেলে অত্যন্ত বুদ্ধিমান, কিন্তু বোকা । ছেলেটির নাম- আরিফ । ‘
নিচে তারিখ দেওয়া –’০৫/০৩/০৯
এই ডায়েরিতে নানান বিখ্যাত ব্যক্তিদের কথাও লেখা আছে ।
একবার কানাডার টরেন্টোতে সাজিদ তার বাবার সাথে একটি অফিসিয়াল ট্যুরে গিয়েছিল । সেখানে অনেক সেলেব্রিটির সাথে বিল গেটসও আমন্ত্রিত ছিলেন । বিল গেটস সেখানে দশ মিনিটের জন্য বক্তৃতা রেখেছিলেন । সে ঘটনাটি লেখা । জাফর ইকবালের সাথে সাজিদের একবার বইমেলায় দেখা হয়ে যায় । সেবারের বই মেলায় জাফর স্যারের বই’একটুখানি বিজ্ঞান’ এর দ্বিতীয় কিস্তি’আরো একটুখানি বিজ্ঞান’ প্রকাশিত হয় । সাজিদ জাফর স্যারের বই কিনে বের হওয়ার পথে জাফর স্যারের সাথে তার দেখা হয়ে যায় । সাজিদ স্যারের একটি অটোগ্রাফ নিয়ে, স্যারের কাছে হেসে জানতে চাইলো,’স্যার,’একটুখানি বিজ্ঞান’ পাইলাম । এরপর পাইলাম’আরো একটুখানি বিজ্ঞান’ । এটার পরে’আরো আরো একটুখানি বিজ্ঞান’ কবে পাচ্ছি ?’
সেদিন নাকি জাফর স্যার মিষ্টি হেসে বলেছিলেন, -‘পাবে’
নিজের সাথে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনাই ঠাই পেয়েছে সাজিদের ডাইরিতে ।
সাজিদের ডায়েরির আদ্যোপান্ত আমার পড়া ছিল । কিন্তু, সেমিস্টার ফাইনাল সামনে চলে গত বেশ কিছুদিন তার ডায়েরিটা আমার আর পড়া হয়নি । অবশ্য ডায়েরিটা আমি লুকিয়ে লুকিয়েই পড়ি ।
সেদিন থার্ড সেমিস্টারের শেষ পরিক্ষাটি দিয়ে রুমে আসলাম । এসে দেখি সাজিদ ঘরে নেই । তার টেবিলের উপর তার ডায়েরিটা পড়ে আছে খোলা অবস্থায় ।
ঘর্মাক্ত শরীর । কাঠ ফাটা রোদের মধ্যে ক্যাম্পাস থেকে হেঁটে বাসায় ফিরেছি । এই মুহূর্তে বসে ডায়েরিটা উলটবো, সে শক্তি বাঁ ইচ্ছা কোনটাই নেই । কিন্তু ডায়েরিটা বন্ধ করতে গিয়ে একটি শিরোনাম আমার চোখে আটকে যায় । আমি সাজিদের টেবিলেই বসে পড়ি । লেখাটির শিরোনাম ছিল –
‘ভাগ্য বনাম স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি –স্রষ্টা কি এখানে বিতর্কিত ?’
বেশ লোভনীয় শিরোনাম । শারিরিক ক্লান্ত ভুলেই আমি ঘটনাটির প্রথম থেকে পড়া শুরু করলাম । ঘটনাটি সাজিদের ডায়েরিতে যেভাবে লেখা, ঠিক সেভাবেই আমি পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি, –
‘কয়েকদিন আগে ক্লাসের থার্ড পিরিয়ডের মফিজুর রহমান স্যার এসে আমাকে দাড় করালেন । বললেন, -‘তুমি ভাগ্যে, আই মিন তাকদিরে বিশ্বাস কর ?’
আমি আচমকা অবাক হলাম । আসলে এই আলাপগুলো হল ধর্মীয় আলাপ । মাইক্রোবায়োলজির একজন শিক্ষক যখন ক্লাসে এসে এসব জিজ্ঞস করে, তখন খানিকটা বিব্রতবোধ করাটাই স্বাভাবিক । স্যার আমার উত্তরের আশায় আমার মুখের দিকে চেয়ে আছেন । আমি বললাম,’জি স্যার । এজ এ মুসলিম আমি তকদিরে বিশ্বাস করি । এটি আমার ইমানের মূল সাতটি বিষয়ের মধ্যে একটি । ‘
স্যার বললেন,’তুমি কি বিশ্বাস করো যে, মানুষ জিবনে যা যা করবে তার সবকিছুই তার জম্মের অনেক অনেক বছর আগে তার তাকদিরে লিখে দেওয়া হয়েছে ?’
-‘জি, স্যার’ আমি উত্তর দিলাম ।
–’বলা হয়, স্রষ্টার ইচ্ছা শক্তি ছাড়া গাছের একটি ক্ষুদ্র পাতাও নড়ে না, তাই না ?’
-‘জি, স্যার’
-‘ধরো, আজ সকালে আমি একজন লোককে খুন করলাম । এটা কি আমার তকদিরে পূর্বে নির্ধারিত ছিল না ?’
-‘জি, ছিল’
-‘আমার তাকদির যখন লেখা হচ্ছিলো, তখন কি আমি জীবিত ছিলাম ?’
-‘না, ছিলেন না । ‘
-‘আমার তাকদির কে লিখেছে ? বাঁ কার নির্দেশে লিখিত হয়েছে ?’
-‘স্রষ্টার । ‘
-‘তাহলে, সোজা এবং সরল লজিক এটাই বলে –’আজ সকালে যে খুনটি আমি করেছি, সেটি মূলত আমি করি নি । আমি এখানে একটি রোবটমাত্র । আমার ভেতরে একটা প্রোগ্রাম সেট করে দিয়েছেন স্রষ্টা । সেই প্রোগ্রামে লেখা ছিল যে, আজ সকালে আমি একজন লোককে খুন করবো । সুতরাং, আমি ঠিক তাই করেছি, যা আমার স্রষ্টা পূর্বে ঠিক করে রেখেছেন । এতে আমার কোন হাত নেই । ডু ইউ এগ্রি, সাজিদ ?’
-‘কিছুটা’ -আমি উত্তর দিলাম ।
স্যার এবার হাসলেন । হেসে বললেন, -‘আমি জানতাম তুমি কিছুটাই একমত হবে, পুরোটা নয় । এখন তুমি আমাকে নিশ্চয়ই যুক্তি দেখিয়ে বলবে, -স্যার, স্রষ্টা আমাদের একটি স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন । আমরা এটা দিয়ে ভাল মন্দ বিচার করে চলি, রাইট ?’
-‘জি, স্যার’
-‘কিন্তু, সাজিদ, এটা খুব লেইম লজিক, ইউ নো ? ধরো, আমি তোমার হাতে একটি বাজারের লিস্ট দিলাম । লিস্টে যা যা কিনতে হবে, তার সব কিছু লেখা আছে । এখন তুমি বাজার করে ফিরলে । তুমি ঠিক তাই কিনলে যা আমি লিস্টে লিখে দিয়েছে । এবং এটা করতে বাধ্য । ‘
এতটুকু বলে স্যার আমার কাছে জানতে চাইলেন,’বুঝতে পারছ ?’
আমি বললাম,’জি, স্যার’
-‘ভেরি গুড । ধরো, তুমি বাজার করে আসার পর, একজন জিজ্ঞেস করলো, সাজিদ কি কি বাজার করেছ ? তখন আমি উত্তর দিলাম, -‘ওর যা যা খেতে মন চেয়েছে, তা-ই তা-ই কিনেছে’, তাহলে এটা একটা ডাহা মিথ্যা কথা, না ?’
-‘জি, স্যার’
-‘ঠিক স্রষ্টাও এভাবে মিথ্যা বলেছেন । দুই নাম্বারি করেছেন । তিনি অনেক আগে আমাদের তাকদির লিখে তা আমাদের গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছেন । এখন আমরা সেটাই করি, যা স্রষ্টা সেখানে লিখে রেখেছেন । আবার, এট দ্যা এন্ড অফ দ্যা ডে, এই কাজের জন্য কেউ জান্নাতে যাচ্ছে, কেউ জাহান্নামে । কিন্তু কেন ? এখানে মানুষের তো কোন হাত নেই । ম্যানুয়ালটা স্রষ্টার তৈরি । আমরা তো জাস্ট পারফর্মার । স্ক্রিপ্ট রাইটার তো স্রষ্টা । স্রষ্টা এর জন্য আমাদের কাউকে জান্নাত, কাউকে জাহান্নাম দিতে পারেন না । যুক্তি তাই বলে, ঠিক ?’
আমি চুপ রইলাম । পুরো ক্লাসে পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছে তখন । স্যার বললেন,’হ্যাভ ইউ এনি প্রপার লজিক অন দ্যাট ক্রিটিক্যাল কোয়েশ্চান, ডিয়ার ?’
আমি কিছুক্ষন চুপ করে থাকলাম ।
স্যার মুচকি হাসলেন । মনে হল – উনি ধরেই নিয়েছেন যে, উনি সত্যি সত্যিই আমাকে কুপকাত করে দিয়েছেন । বিজয়ের হাসি।
আমাকে যারা চিনে তারা জানে, আমি কখন কারো প্রশ্নের উত্তর দিতে সময় নিই না। আজকে যেহেতু তার ব্যাতিক্রম ঘটলো, আমার বন্ধুরা আমার দিকে ড্যাব ড্যাব চোখ করে তাকালো । তাদের চাহনি দেখে মনে হচ্ছিলো, এই সাজিদকে তারা চিনেই না । কোন দিন দেখেই নি ।
আর, ক্লাসে আমার বিরুদ্ধ মতের যারা আছে, তাদের চেহারা তখন মুহূর্তেই উজ্জ্বল বর্ণ ধারন করলো । তারা হয়তো মনে মনে বলতে লাগলো, -‘মৌল্লার দৌড় ওই মসজিদ পর্যন্তই । হা – হা –হা’
আমি মুখ তুলে স্যারের দিকে তাকালাম । মুচকি হাসি স্যারের মুখে তখনও বিরাজমান ।
আমি বললাম,’স্যার, এই ক্লাসে কার সম্পর্কে আপনার কি অভিমত ?’
স্যার ভ্যাবাচ্যাকা খেলেন । স্যার জিজ্ঞেস করেছেন কি আর আমি বলছি কি ।
স্যার বললেন,’বুঝলাম না । ‘
-‘মানে আমাদের ক্লাসে কার মেধা কি রকম, সে বিষয়ে আপনার কি ধারণা ?’
-‘ভাল ধারণা । ছাত্রদের সম্পর্কে একজন শিক্ষকের তো সবচেয়ে ভাল জ্ঞান থাকে’
আমি বললাম, -‘স্যার আপনি বলুন তো, এই ক্লাশের কারা কারা ফার্স্ট ক্লাস আর কারা কারা সেকেন্ড ক্লাস পাবে ?’
স্যার কিছুটা বিস্মিত হলেন । বললেন ,’আমি তোমাকে অন্য বিষয়ে প্রশ্ন করেছি । তুমি আউট অফ কনট্যাক্সট এ গিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করছ, সাজিদ ?’
-‘না, স্যার । আমি কন্টেক্সটেই আছি । আপনি উত্তর দেন । ‘
স্যার বললেন,’এই ক্লাশ থেকে রায়হান, মমতাজ, ফারহানা, সজিব, ওয়ারেশ, ইফতি, সুমন, জাবেদ এবং তুমিও ফার্স্ট ক্লাশ পাবে । আর বাকিরা সেকেন্ড ক্লাশ । ‘
স্যার যাদের নাম বলেছেন তারা সবাই ক্লাশের ব্রিলিয়েন্ট স্টুডেন্ট । সুতরাং, স্যারের অনুমান খুব একটা ভুল না ।
আমি বললাম,’স্যার, আপনি এটা লিখে দিতে পারেন ?’
-‘Why not?’ স্যার বললেন ।
এই বলে তিনি খচখচ করে একটা কাগজের একপাশে যারা ফার্স্ট ক্লাশ পাবে তাদের নাম, অন্য পাশে যারা সেকেন্ড ক্লাশ পাবে, তাদের নাম লিখে আমার হাতে দিলেন ।
আমি বললাম,’স্যার, ধরে নিলাম যে আপনার ভবিষৎবাণী সম্পূর্ণ সত্য হয়েছে । মানে, আপনি ফার্স্ট ক্লাশ পাবে বলে যাদের নাম লিখেছেন, তারা সবাই ফার্স্ট ক্লাশ পেয়েছে, আর যারা সেকেন্ড ক্লাশ পাবে লিখেছেন, তাদের সবাই সেকেন্ড ক্লাশ পেয়েছে । ‘
-‘হুম, তো’
-‘এখন স্যার বলন তো, যারা ফার্স্ট ক্লাশ পেয়েছে, আপনি এই কাগজে তাদের নাম লিখেছেন বলেই কি তারা ফাস্ট ক্লাশ পেয়েছে ?’
-‘নাহ তো’
-‘যারা সেকেন্ড ক্লাশ পেয়েছে, তারা সেকেন্ড ক্লাশ পাবে বলে আপনি এই কাগজে লিখেছেন বলেই কি তারা সেকেন্ড ক্লাশ পেয়েছে ?’
স্যার বললেন,’একদম না । ‘
-‘তাহলে মূল ব্যাপারটি কি স্যার ?’
স্যার বললেন, -‘মূল ব্যাপার হল, আমি তোমাদের শিক্ষক । আমি খুব ভাল জানি পড়াশুনায় তোমাদের কে কেমন । আমি খুব ভাল করেই জানি, কার মেধা কেমন । সুতরাং, আমি চোখ বন্ধ করেই বলে দিতে পারি কে কেমন রেজাল্ট করবে । ‘
আমি হাসলাম । বললাম,’ স্যার যারা সেকেন্ড ক্লাশ পেয়েছে, তারা যদি আপনাকে দোষ দেয় ? যদি বলে, আপনি’সেকেন্ড ক্লাশ’ ক্যাটাগরিতে তাদের নাম লিখেছেন বলেই তারা সেকেন্ড ক্লাশ পেয়েছে ?’
স্যার কপালের ভাঁজ লম্বা করে বললেন,’ইট উড বি টোট্যালি বুলশিট ! আমি কেন এর জন্য দায়ী হব ? এটাতো সম্পূর্ণ তাদের দায় । আমি শুধু তাদের মেধা, যোগ্যতা সম্পর্কে ধারণা রাখি বলেই অগ্রিম বলে দিতে পেরেছি যে কে কেমন রেজাল্ট করবে । ‘
আমি আবার জোরে জোরে হাসতে লাগলাম । পুরো ক্লাশ আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে ।
আমি থামলাম । বললাম,’ তকদির তথা ভাগ্যটাও ঠিক এরকম । আপনি যেমন আমাদের মেধা, যোগ্যতা, ক্ষমতা সম্পর্কে ভাল ধারণা রাখেন, স্রষ্টাও তেমনি তার সৃষ্টি সম্পর্কে ধারণা রাখেন । আপনার ধারণা মাঝে মাঝে ভুল হতে পারে, কিন্তু স্রষ্টার ধারনায় কোন ভুল নেই । স্রষ্টা হলেন আলিমুল গায়েব । তিনি ভুত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সব জানেন । ‘
আপনি যেরকম পূর্বানুমান করে লিখে দিয়েছেন যে, আমাদের মধ্যে কারা ফাস্ট ক্লাস পাবে, আর কারা সেকেন্ড ক্লাশ । এর মানে কিন্তু এই না যে, আপনি বলেছেন বলে আমাদের কেউ ফাস্ট ক্লাশ পাচ্ছি, কেউ সেকেন্ড ক্লাশ ।
স্রষ্টাও সেরকম পূর্বানুমান করে আমাদের তাকদির লিখে রেখেছেন । তাতে লেখা আছে আমরা দুনিয়ায় কে কি করবো । এর মানে কিন্তু এই নে যে, তিনি লিখে দিয়েছেন বলেই আমরা কাজগুলো করছি । বরং, এর মানে হল এই – তিনি জানেন যে, আমরা দুনিয়ায় এই এই কাজগুলো করবো । তাই তিনি অগ্রিম লিখে রেখেছেন তাকদির হিসেবে ।
আমাদের মধ্যে কেউ ফাস্ট ক্লাশ আর কেউ সেকেন্ড ক্লাশ পাবার জন্য যেমন কোনভাবেই আপনি দায়ী নন, ঠিক সেভাবে, মানুষের মধ্যেও কেউ ভাল কাজ করে জান্নাতে, আর কেউ খারাপ কাজ করে জাহান্নামে যাবার জন্যও স্রষ্টা দায়ী নন । স্রষ্টা জানেন যে, আপনি আজ সকালে একজনকে খুন করবেন । তাই তিনি সেটা আগেই আপনার তকদিরে লিখে রেখেছেন । এটার মানে এই না যে – স্রষ্টা লিখে রেখেছেন বলেই আপনি খুনটি করেছেন । এর মানে হল – স্রষ্টা জানেন যে, আপনি আজ খুনটি করবেন । তাই সেটা অগ্রিম লিখে রেখেছেন আপনার তাকদির হিসেবে ।
স্যার ব্যাপারটা কি এখন পরিষ্কার ?
স্যারের চেহারাটা কিছুটা ফ্যাকাশে মনে হল । তিনি বললেন ,’হুম’
এরপর স্যার কিছুক্ষন চুপ থাকলেন । তারপর বললেন,’আমি শুনেছিলাম তুমি ক’দিন আগেও নাস্তিক ছিলে । তুমি আবার আস্তিক হলে কবে ?’
আমি হা হা হা করে হাসলাম । বললাম,’এই প্রশ্নটা কিন্তু আউট অফ কনট্যাক্সট । ‘
এটা শুনে পুরো ক্লাশ হাসিতে ফেটে পড়লো ।
পিরিয়ডের একদম শেষ দিকে, স্যার আবার আমাকে দাড় করালেন । বললেন,’বুঝলাম স্রষ্টা আগে থেকে জানেন বলেই লিখে রেখেছেন । তিনি যেহেতু আগে থেকেই জানেন কে ভাল কাজ করবে আর কে খারাপ কাজ করবে, তাহলে পরিক্ষা নেওয়ার কি দরকার ? যারা জান্নাতে যাওয়ার তাদের জান্নাতে, যারা জাহান্নামে যাওয়ার দরকার তাদের জাহান্নামে পাঠিয়ে দিলেই তো হতো, তাই না ?’
আমি আবার হাসলাম । আমার হাতে স্যারের লিখে দেওয়া কাগজটি তখনো ধরা ছিল । আমি সেটা স্যারকে দেখিয়ে বললাম,’স্যার, এই কাগজে কারা কারা ফাস্ট ক্লাশ পাবে, আর কারা কারা সেকেন্ড ক্লাশ পাবে, তাদের নাম লেখা আছে । তাহলে এই কাগজের ভিত্তিতেই রেজাল্ট দিয়ে দিন । বাড়তি করে পরিক্ষা নিচ্ছেন কেন ?’
স্যার বললেন,’পরিক্ষা না নিলে হয়তো এই বলে অভিযোগ করতে পারে যে, – স্যার আমাকে ইচ্ছা করেই সেকেন্ড ক্লাশ দিয়েছে । পরিক্ষা দিলে হয়তো আমি ঠিকই ফাস্ট ক্লাশ পেতাম । ‘
আমি বললাম,’একদম তাই স্যার । স্রষ্টাও এজন্যই পরিক্ষা নিচ্ছেন, যাতে কেউ বলতে না পারে – দুনিয়ায় পরিক্ষার ব্যাবস্থা থাকলে আমি অবশ্যই আজকে জান্নাতে থাকতাম । স্রষ্টা ইচ্ছা করেই আমাকে জাহান্নামে পাঠিয়েছে । ‘
ক্লাশের সবাই হাত তালি দিতে শুরু করলো । স্যার বললেন,’সাজিদ, আই হ্যাভ এ লাস্ট কোয়েশ্চান । ‘
-‘ডেফিনেইটলি, স্যার । ‘ আমি বললাম ।
-‘আচ্ছা, যে মানুষ পুরো জীবনে খারাপ কাজ বেশি করে, সে অন্তত কিছু না কিছু ভালো কাজ তো করে, তাই না ?’
-‘জি স্যার’
-‘তাহলে, এই ভালো কাজগুলোর জন্য হলেও তো তার জান্নাতে যাওয়া দরকার, তাই না ?’
আমি বললাম,’স্যার, পানি কিভাবে তৈরি হয় ?’
স্যার আবার অবাক হলেন । হয়তো বলতে যাচ্ছিলেন যে, এই প্রশ্নটাও আউট অফ কনট্যাক্সট, কিন্তু কি ভেবে যেন চুপসে গেলেন । বললেন,’দুই ভাগ হাইড্রোজেন আর এক ভাগ অক্সিজেনের সংমিশ্রণে । ‘
আমি বললাম,’আপনি এক ভাগ হাইড্রোজেন আর এক ভাগ অক্সিজেন দিয়ে পানি তৈরি করতে পারবেন ?’
-‘কখনোই না । ‘
-‘ঠিক সেভাবে, এক ভাগ ভালো কাজ আর এক ভাগ মন্দ কাজে জান্নাত পাওয়া যায় না । জান্নাত পেতে হলে হয় তিন ভাগই ভালো কাজ হতে হবে, নতুবা দুই ভাগ ভালো কাজ, এক ভাগ মন্দ কাজ হতে হবে । অর্থাৎ, ভালো কাজের পাল্লা ভারী হওয়া আবশ্যক । ‘
সেদিন আর কোন প্রশ্ন স্যার আমাকে করেন নি ।
-এক নিঃশ্বাসে পুরোটা পড়ে ফেললাম । কোথাও একটু থমিনি । পড়া শেষে যেই মাত্র সাজিদের ডায়েরিটা বন্ধ করতে যাবো, অমনি দেখলাম, পেছন থেকে সাজিদ এসে আমার কান মলে ধরেছে । সে বলল,’তুই তো সাংঘাতিক লেভেলের চোর । ‘
আমি হেসে বললাম, -‘হা হা হা । স্যারকে তো ভালো জব্দ করেছিস ব্যাটা । ‘
কথাটা সে কানে নিলো বলে মনে হল না । নিজের সম্পর্কে কোন কমপ্লিমেন্টই সে আমলে নেয় না । গামছায় মুখ মুছতে মুছতে সে খাটের উপর শুয়ে পড়লো ।
আমি তার কাঁধে হাত রাখলাম । বললাম,’সাজিদ,………..’
-‘হু’
-‘একটা কথা বলব ?’
-‘বল’
-‘জানিস, এক সময় যুবকেরা হিমু হতে চাইতো । হলুদ পাঞ্জাবী গায়ে দিয়ে, মরুভূমির গর্ত খুড়ে জ্যোৎস্না দেখার স্বপ্ন দেখত । দেখিস, এমন একদিন আসবে, যেদিন যুবকেরা সাজিদ হতে চাইবে । ঠিক তোর মতো । …’
এই বলে আমি সাজিদের দিকে তাকালাম । দেখলাম, ততক্ষনে সে ঘুমিয়ে পড়েছে । অঘোর ঘুম …………..
তাদের অন্তরে আল্লাহ মোহর মেরে দেন; সত্যিই কি তাই?
বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীতে বসে বই পড়ছিলাম।
সজিদ পড়ছিল এন্থনি মাসকারেনহাস এর বই, -‘The legacy of blood’।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ওপর বিদেশী সাংবাদিকদের লেখা বই। সাজিদের অনেক দিনের ইচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপর একটা ডকুমেন্টারি তৈরি করবে। তাই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যত বই আছে সব খুটিয়ে খুটিয়ে পড়ছে সে।
আমি অবশ্য সাজিদকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য রয়ে গেছি। এসব বই পড়ার ব্যাপারে আমার যথেষ্ট অনিহা আছে। থার্ড পিরিয়ডে সাজিদ ফোন করে বলল ক্লাশ শেষে যেন ওর সাথে দেখা করি। দেখা করতে এসে আটকে গেছি। সোজা নিয়ে এলো লাইব্রেরীতে। মোটা মোটা বই গুলো নিয়ে সে বসে পড়েছে। খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছে আর গুরুত্বপূর্ণ লাইন গুলো ডায়েরিতে ঠুকে নিচ্ছে।
আমি আর কি করবো? সাজিদকে মুখের উপর ‘তুই বসে থাক’ বলে চলে আসা যাবেনা। তাহলেই হয়েছে।
আমি ঘুরে ঘুরে শেলফে সাজিয়ে রাখা বইগুলো দেখছি। হুমায়ূন আহাম্মেদের একটি বই হাতে নিলাম। বইটির নাম ‘দীঘির জলে কার ছায়া গো’।
হুমায়ূন আহমেদ নামের এই ভদ্রলোক বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয় লেখক। যদিও উনার তেমন বই আমি পড়ি নি, কিন্তু সাজিদের মুখে উনার বেশ প্রশংসা শুনি। উনার বেশ কিছু কাল জয়ী চরিত্র আছে। একবার নাকি উনার নাটকের একটি প্লট পাল্টানোর জন্য মানুষ মিছিল নিয়েও বেরিয়েছিল। বাব্বা কি সাংঘাতিক।
‘দীঘির জলে কার ছায়া গো’ নামের বইটি উল্টাতে লাগলাম। উল্টাতে উল্টাতে একটি জায়গায় আমার চোখ আটকে গেল। বিবর্তনবাদের জনক চার্লস ডারউইন এর ব্যাপারে কিছু একটা লেখা। পড়তে শুরু করলাম –
‘আহসানকে পেয়ে শওকত সাহেব আনন্দিত। তিনি নতুন একটা বই পড়ছেন।
বইয়ে বিবর্তনবাদের জনক ডারউইন সাহেবকে ধরাশায়ী করা হয়েছে। তার পূর্বপুরুষ বানর -এটা তিনি মেনে নিতেই পারতেন না। এখন সমস্যার সমাধান হয়েছে। তিনি আহসানের দিকে ঝুকে এসে বললেন, ‘তুমি ডারউইনবাদে বিশ্বাস করো?’
আহসান বলল, – ‘জ্বি চাচা, করি।’
-‘তোমার বিশ্বাস তুমি এখন যে কোন একটা ভালো ডাস্টবিন দেখে ফেলে আসতে পারো’
আহসান বলল, – ‘জি, আচ্ছা করি।’
-‘পুরো বিষয়টা না শুনেই জি আচ্ছা বলবে না। আগে পুরো বিষয়টা শোনো।’
আহসান হতাশ ভঙ্গিতে পুরো বিষয়টা শোনার জন্য প্রস্তুত হল। এই বিরক্তিকর মানুষটার কাছ থেকে ছাড়া পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না।
শওকত সাহেব বললেন, ‘তোমাদের ডারউইনের থিউরি বলে, পাখি এসেছে সরীসৃপ থেকে।
তুমি এখন একটা সাপ ও ময়ূর পাশাপাশি রাখো। চিন্তা কর যে, ময়ূরের পূর্বপুরুষ সাপ, যে সাপ এখন ময়ূরের প্রিয় খাদ্য। বলো, তোমার কিছু বলার আছে?’
-‘এই মুহূর্তে কিছু বলার নেই চাচা।’
-‘মনে মনে ১০ এর উপরে ৯৫০ টা শুন্য বসাও।
এই বিশাল প্রায় অসীম সংখ্যা দিয়ে ১ কে ভাগ কর। কি পাবে জানো? শূন্য। এটা হল এটমে এটমে ধাক্কাধাক্কি করে ডিএনএ অণু তৈরীর সম্ভাবনা। মিলার নামে কোন সায়েন্টিস্ট এর নাম শুনেছো? ছাগল টাইপ সায়েন্টিস্ট।
-‘চাচা শুনিনি।’
-‘ঐ ছাগলটা ১৯৫০ সনে একটা এক্সপেরিমেন্ট করে অন্য ছাগল সাইন্টিস্টদের মধ্যে হইচই ফেলে দিয়েছিল। ছাগলটা করেছে কি, ল্যাবরেটরীতে আদি পৃথিবীর আবহাওয়ার তৈরি করে ঘনঘন ইলেকট্রিক কারেন্ট পাস করেছে। কিছু প্রোটিন অনু তৈরি করে বলেছে- এভাবেই পৃথিবীতে প্রাণের শুরু। প্রান সৃষ্টিতে সৃষ্টিকর্তার কোন প্রয়োজন নেই। এখন সেই ছাগল মিলারকে নিয়ে বৈজ্ঞানিক মহলে হাসাহাসি। Life ম্যাগাজিনে কি লেখা হয়েছিল পড়ে শোনাই।’
-‘চাচা, আরেকদিন শুনি? জটিল কিছু শোনার জন্য আমি এ মুহূর্তে মানসিক ভাবে তৈরি না।’
-‘জটিল কিছু বলছিনা। জলবত তরলং। মন দিয়ে শোনো।’
শওকত সাহেব পড়তে শুরু করলেন। আহসান হতাশ চোখে জানালার দিকে তাকিয়ে রইল…
–এইটুকু পড়ে আমি বেশ আনন্দ পেলাম। লেখক হুমায়ুন আহাম্মেদ এখানে ব্যাটা ডারউইনকে একহাত নিলেন। শওকত সাহেবের মত আমিও কোনোভাবেই মানতে পারিনি যে, আমাদের পূর্বপুরুষ বানর। ভাবতেই ঘেন্না লাগে !
–বইটি নিয়ে আমি সাজিদের কাছে গেলাম। এসে দেখি সে ব্যাগপত্র গোছানো শুরু করেছে। সে বলল, ‘চল, বাসায় যাব।’
আমি তাকে হাতের বইটি দেখিয়ে বললাম, -‘এই বইটা পড়েছিস? মজার একটি কাহিনী আছে। হয়েছে কি জানিস……..’
আমার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে সাজিদ বললো, – ‘শওকত সাহেব নামের এক ভদ্রলোক আহসান নামের একটি ছেলের সামনে ডারউইনের গুষ্টি উদ্ধার করছে, তাই তো?’
আমি অবাক হলাম। বললাম, – ‘হ্যাঁ। কিন্তু আমি এ ব্যাপারে বলবো কি করে বুঝলি?’
সাজিদ ব্যাগ কাঁধে নিতে নিতে বলল, -‘এইটা ছাড়া এই বইটা আর তেমন বিশেষ কিছু নাই যেটা দেখাতে তুই এভাবে আমার কাছে ছুটে আসবি। তাই অনুমান করলাম।’
আমি আর কিছুই বললাম না। বইটি সেল্ফে রেখে দিয়েই হাঁটা ধরলাম।
সিঁড়ির কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ বিপ্লবদার সাথে দেখা।
উনার সাথে শেষবার দেখা হয়েছিল উনার বাসায়। সেবার সাজেদার বিপ্লবদার মধ্যে কোয়ান্টাম ফিজিক্স নিয়ে যা বিতর্ক হয়েছিল দেখার মত। বিতর্কে বিপ্লব দা সাজিদের কাছে গো-হারা হেরে ছিল। সেটা ভাবতেই এখনো আমার পৈশাচিক আনন্দ হয়।
আমাদের দেখেই বিপ্লবদা হেসে দিলেন। কিছু কথাবার্তা বললেন।
এর মধ্যে হঠাৎ করে বৃষ্টি চলে এলো। আকাশে সূর্যি মামা তখনো বহাল তবিয়তে জ্বলজ্বল করছে। আর ওদিকে বৃষ্টি বিশাল বিশাল ফোঁটা। গ্রাম্য লোকজনের কাছে এই বৃষ্টির একটি মজার ব্যাখ্যা আছে। তারা বলে, শিয়ালের বিয়ে হলে এরকম বৃষ্টি হয়। রোদের মধ্যেই বৃষ্টি। শিয়াল প্রজাতির মধ্যে বিয়ের প্রচলন আছে কিনা কে জানে।
-বিপ্লব দা সহ আমরা ক্যান্টিনে ঢুকলাম। বৃষ্টি কমলে বেরুতে হবে।
সাজিদ তিন কাপ চা অর্ডার করল। এরপর বিপ্লব দা’র দিকে তাকিয়ে বলল, -‘দাদা ভাই চা খেতে অসুবিধা নেই তো?’
-‘না না, ইটস ওকে।’ বিপ্লব দা উত্তরে বললো।
এরপর আবার বিপ্লব দা বলল, ‘সাজিদ, তোমার সাথে একটি ব্যাপারে আলাপ করার ছিল।’
ততক্ষণে চা চলে এসেছে। বৃষ্টির মধ্যে গরম গরম ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দেবার ফ্লেভারটাই অন্যরকম। সাজিদ তার কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, ‘হ্যাঁ দাদা, বলুন। কোন টপিক?’
বিপ্লব দা বলল, -‘ওই যে, তোমরা যে বইটাকে স্রষ্টার বানী বলো, সেটা নিয়ে। কোরআন’
সাজিদ বলল, -‘সমস্যা নেই, বলুন কি বলবেন?’
বিপ্লব দা বললেন, -‘কুরআনে একটা সূরা আছে। সূরাটার নাম বাকরা।’
সাজিদ বলল, -‘সূরাটার নাম বাকরা নয়, বাকারা। বাকারা অর্থ ‘গাভী’ ইংরেজিতে ‘The cow’…..
-‘ওই আর কি। এই সূরার ৬-৭ নাম্বার লাইনগুলো তুমি কি পড়েছ?’
-‘ পুরো কোরআনই আমরা মাসে কয়েকবার পড়ি। এটা মার্কস কিংবা প্লেটো’র রচনা নয় যে একবার পড়া হয়ে গেলেই শেলফে আজীবনের জন্য সাজিয়ে রাখব।’
বিপ্লবদা বললেন, ‘এই লাইনগুলোতে বলা হয়েছে-
“ Verily, those who disbelieve, it is the same to them whether you warn them or do not warn them, they will not believe .
Allah has set a seal on their hearts and on their hearings, and on their eyes there is a covering. Theirs will be a great torment” –Baqara 6-7..
এরপর বিপ্লব দা সেটার বাংলা অর্থ করে বললেন, –
“নিশ্চয়ই যারা অস্বীকার করে, তাদের আপনি সাবধান করুন আর না-ই করুন, তারা স্বীকার করবে না। আল্লাহ তাদের হৃদয়ে এবং তাদের কর্ণকুহরে মোহর মেরে দিয়েছেন; তাদের দৃষ্টির উপর আবরণ টেনে দিয়েছেন। তাদের জন্য আছে ভয়াবহ শাস্তি। ”
এতোটুকু বলে বিপ্লব দা থামলেন। সাজিদ বলল’ ‘ what’s wrong with this verses?’
বিপ্লব দা বললেন, -‘দেখো, এখানে বলছে কাফিরদের হৃদয়ে আর কানে তোমাদের আল্লাহ মোহর আই মিন দিল মেরে দেয়। সিল মারা মানে, তালাবদ্ধ করে দেওয়া। তাই না?’
-‘হু’
-‘এখন কাফিরদের হৃদয় আর কানে যদি সিল মারা থাকে, তারা তো সত্যের বাণী আই মিন তোমরা যেটাকে ধর্মের বাণী বলো আর কি সেটা বুঝতে পারবে না। উপলব্ধি করতে পারবে না। আল্লাহ যেহেতু তাদের হৃদয় আর কানে সিল মেরে দিচ্ছে, তাই তারা ধর্মের বাণীগুলো বুঝতে পারছে না। তাই তারা কাফির থেকে যাচ্ছে, নাস্তিক হচ্ছে। তাদের কি দোষ বল? আল্লাহ চান না তারা আস্তিক হোক। চাইলে নিশ্চয়ই তিনি হৃদয় আর কানে সীল মেরে দিত না। আবার, শেষে এসে বলছে, তাদের জন্য আজাব অপেক্ষা করছে। এটা কেমন কথা? এদিকে সিল মেরে দিয়ে সত্য বোঝার থেকে দূরে রাখছেন, আবার ঐদিকে আজাব প্রস্তুত করে রাখছেন। ব্যাপারটা কি ঠিক, বল?’
বিপ্লবদার কথাগুলো আমার কাছে খুব যৌক্তিক মনে হল। আসলেই তো। এই আয়াত গুলো নিয়ে তো এভাবে কোনোদিন ভাবি নি। আল্লাহ একদিকে বলছেন কাফিরদের অন্তরে মোহর মেরে দেন, আবার তাদের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন। ব্যাপারটা কী?
সাজিদ মুচকি হাসলো। চায়ের কাপে শেষ চুমুকটুকু দিয়ে বলল, – ‘দাদা ইসলামের ইতিহাস পড়লে আপনি একশ্রেণীর মীরজাফরদের কথা জানতে পারবেন। এরা করতো কী জানেন? রাসূল সাঃ এর কাছে আসতো। হাতের মুঠির মধ্যে নিয়ে বলতো, ‘মুহাম্মদ, আমার হাতে কি আছে বলতে পারলে আমি এক্ষুনি ইসলাম কবুল করব। দেখি তুমি কেমন নবী?’
রাসুল সাঃ হাসতেন। হেসে বলতেন, ‘তোমার হাতের জিনিসই বলুক সেগুলো কি।’ তখন পাথরগুলো কথা বলতে শুরু করত। এটা দেখে সেই লোক গুলো খুব অবাক হতো। অবাক হয়ে বলতো, এ সাক্ষাৎ জাদুকর। এই বলে পালাতো। অথচ, তারা বলেছিল হাতে কি আছে বলতে পারলে ইসলাম কবুল করবে। কিন্তু রাসূল সাঃ তাদের পরীক্ষায় পাশ করে গেলে তারা তাকে জাদুকর, জ্যোতিষী ইত্যাদি বলে চলে যেতো। মুনাফিকি করত। এসব আয়াতে মূলত এই শ্রেণীর কাফিরদের কথাই বলা হয়েছে। যাদের সামনে সত্য উদঘাটিত হওয়ার পরও তারা তা অস্বীকার করে।’
বিপ্লব দা বললেন, -‘কিন্তু অন্তরে মোহর মেরে দিয়ে তাদের সত্য জানা থেকে বঞ্চিত করে, আবার তাদের শাস্তি দেওয়া টা কি ঠিক?’
-‘মোহর আল্লাহ ইচ্ছা করে মেরে দেন না। এটা সিস্টেমেটিক্যালি হয়ে যায়।’
বিপ্লব দা হাসা শুরু করলেন। বললেন, ‘ভেরি ইন্টারেস্টিং’ সিস্টেমেটিক্যালি পড়ে যায়? হা হা হা।
সাজিদ এই কথাটা আমার কাছেও শিশুসুলভ মনে হলো। সিস্টেমেটিক্যালি সিল পড়ে যায়? আল্লাহ মারেন না। এটা কেমন কথা? আয়াতে তো স্পষ্টই আছে, -‘আল্লাহ তাদের হৃদয় মোহর মেরে দেন।’
সাজিদ বলল, -‘দাদা ধরুন, আমি বললাম যারা খাবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে, আপনি তাদের খেতে বলুন আর না বলুন, তারা কোনোভাবেই খাবে না। আল্লাহ তাদের দেহ শুকিয়ে দেন। তাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেন। তাদের জন্য রয়েছে কঠিন অসুখ।
খেয়াল করুন, -এখানে তারা অসুস্থ হচ্ছে, তাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, তারা কঠিন অসুখে পড়তে যাচ্ছে। কেনো এসব হচ্ছে? আল্লাহ ইচ্ছা করেই তাদের সাথে এগুলো করছে না। এগুলো তাদের কর্মফল। তাদের যতই জোর করা হোক, তারা যখন কোনোভাবেই খাবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, তখন সে সিস্টেম্যাকালি না খাওয়ার ফলে তাদের শরীর শুকিয়ে যাবে, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবে। তারা কঠিন রোগে পতিত হবে। এসব কিছুর জন্য তারাই দায়ী। এখানে আল্লাহর ইচ্ছে অনিচ্ছে কিছুই নেই। কিন্তু সিস্টেমটা আল্লাহু চালাচ্ছেন। আল্লাহ একটি সিস্টেম রেডি করে দিয়েছেন। আপনি না খেলে আপনার শরীর আল্লাহ শুকিয়ে দেবেন। আপনার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেবেন। দিন শেষে আপনার একটি কঠিন রোগ হবে। এটা একটা সিস্টেম। এই সিস্টেমে আপনি তখনই পরবেন- যখন আপনি নিজ থেকে খাবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন।
ঠিক সেভাবেই- যারা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে যে, তাদের সামনে যত প্রমাণ, যত দলিলই আসুক, তারা সত্যকে মেনে নিবে না, অস্বীকার করবেই করবে, তাদের অন্তরে আর কানে সিস্টেমেটিক্যালি একটি সীল পড়ে যাচ্ছে। না খাওয়ার ফলে আপনি যেভাবে শুকিয়ে যান, আপনার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, আপনার কঠিন অসুখ হয়, ঠিক সেভাবে, বিশ্বাস করবেন না বলে সিদ্ধান্ত যখন নিয়েই ফেলেছেন- তখন আপনার অন্তরে, কানে সেই পরে যাচ্ছে, আর দিনশেষে, আপনার জন্য অপেক্ষা করছে কঠিন অসুখ আই মিন আজাব। এর জন্য আল্লাহকে ব্লেইম করা হবে কেন?’
সাজিদ একনাগাড়ে কথাগুলো বলে গেল। বিপ্লবদার মুখ খানিকটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। তিনি সম্ভবত বুঝে গেছেন ব্যাপারটা।
আমি বললাম, -‘বাব্বা, কি দিয়ে কি বুঝিয়ে দিলি রে ভাই। আমি হলে তো হ-য-ব-র-ল’ করে ফেলতাম।’
সাজিদ মুচকি হাসলো।
অনেকক্ষণ আগেই বৃষ্টি থেমে গেছে। আমরা বিপ্লব দা’র কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলাম সেদিন।
তোমরা মুশরিকদের যেখানেই পাও, হত্যা করো
‘তোমরা মুশরিকদের যেখানেই পাও, হত্যা করো’
নীলাঞ্জন দা মনে-প্রাণে একজন খাঁটি বাংলাদেশী।
বাংলাদেশ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা মুক্তিসংগ্রামকে তিনি কোন কিছুর সাথে কম্প্রোমাইজ করতে রাজি নন।
সাজিদের সাথে নীলাঞ্জন দার খুবই ভালো সম্পর্ক। নীলাঞ্জন দা’কে আমরা ভালোবেসে নীলুদা বলেই ডাকি। ঊনি একাধারে কবি, রাজনীতিবিদ এবং সাংবাদিক।
আজকে সাজিদের সাথে নিলু দা’র একটি বিষয়ে আলাপ হবে। কয়েকদিন আগে নীলুদা ব্লগে আল কোরআনের একটি আয়াতকে ‘সন্ত্রাসবাদি আয়াত’ বলে কটাক্ষ করে একটি পোস্ট করেছে। এ ব্যাপারে সুরাহা করতে নিজ থেকেই নিলু দার বাসায় যাচ্ছি আমরা। আমরা বিকেলে চারটায় নীলু দা’র বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। উনার বাসায় এর আগে কখনো আসিনি। উনার সাথে দেখা হতো প্রেসক্লাব আর বিভিন্ন প্রোগ্রামে। তবে, উনি যে নীলক্ষেতে থাকেন সেটা জানি।
নীলক্ষেতে এসে হাজির নীলু দা’কে ফোন দিলো।
নিলু দা’কে ফোন দিতেই ওপাশ থেকে সুন্দর একটি রিংটোন বেজে উঠল।
রিংটনে সেট করা ছিলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ ই মার্চের বিখ্যাত ভাষণ। সাজিদ ফোনের লাউড স্পিকার অন করে দিলো। আমরা আবার শুনলাম বঙ্গবন্ধুর সেই চিরচেনা ভাষণটি।
বঙ্গবন্ধু বলছে, -‘আমরা তাদের ভাতে মারবো, আমরা তাদের পানিতে মারব। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
পরপর দুইবার রিং হওয়ার পর তৃতীয়বারের নীলু দা ফোন রিসিভ করলেন।
সাজিদকে নীলুদা ভালোমতো বাসার ঠিকানা বুঝিয়ে দিলেন।
বাইরে থেকে কলিংবেল বাজতেই বুড়ো মত এক ভদ্রলোক দরজা খুলে দিল।
আমরা ভিতরে গেলাম।
বলে নিই, আমরা যে উদ্দেশ্যে এখানে এসেছি, সেটা নীলুদা কে জানানো হয়নি।
নীলু দা’র একটি গুণের কথা বলা হয়নি। কবিতা লেখা, সাংবাদিকতার পাশাপাশি নীলুদা খুব ভালো ছবি আঁকে।
আমরা ঘরে প্রবেশ করা মাত্রই বুড়ো লোকটি আমাদের সোজা নীলু দা’র রুমে নিয়ে গেল। মনে হয়, উনার উপর এই নির্দেশটাই ছিল।
আমরা নীলুদার রুমে এসে দেখি উনি ছবি আঁকছেন। মুক্তিযুদ্ধের ছবি। প্রায়ই আঁকা হয়ে গেছে।
জলপাইরঙা পোশাকের একজন মিলিটারি। মিলিটারির বাম হাতে একটি রাইফেল। একজন অর্ধনগ্ন মহিলা। মহিলার চুল খোলা। মহিলা বেঁচে নেই। মিলিটারিটা মহিলাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। মনে হয় ভাগাড়ে নিক্ষেপ করবে-এরকম কিছু। পাশে একটি ডাস্টবিন টাইপ কিছু। চারটে কাক বসে আছে সেটার উপর। জয়নুলের ‘দুর্ভিক্ষ’ ছবিটার মতোই।
আমাদের দিকে না ফিরেই নীলু দা বললেন, -‘কিরে এত ঘটা করে দেখা করতে এসছিস যে?’
সাজিদ বলল, -‘ওমা তোমার সাথে দেখা হয়না কদ্দিন, দেখতে মন চাইলে বলে চলে এলাম। ডিস্টার্ব করেছি বুঝি?’
-‘আরে না না, তা বলিনি।’ এইটুকু বলে নীলুদা ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল। আমাকে দেখে নিল দা বলে উঠলো, ‘আরিফ না?’
-‘হু’ সাজিদ বলল।
-‘আরেব্বাস! আজ দেখি আমার বাসা চাঁদের হাট। তুমিতো জম্পেশ কবিতা লিখ ভাই আরিফ। বিচিত্রায় তোমার কবিতা আমি প্রায়ই পড়ি।’
নীলু দা’র মুখে এরকম কথা শুনে আমি লজ্জায় মরে যাচ্ছিলাম। সাজিদ বললো, -‘জানো দাদা, তাকে কত করে বলি, কবিতার একটা পাণ্ডুলিপি রেডি কর বইমেলার জন্যে। কিন্তু সে বলে, ওর নাকি ভয় করে। দেখো তো দাদা।’
নীলু দা বলল, -‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। পান্ডুলিপি তৈরি করো। একবার বই বের হয়ে গেলে দেখবে ভয়-টয় তো সব দৌড়ে পালাবে। তোমার লেখার তার হাত দারুন। আমি পড়ি তো। বেশ ভালো লিখো।’
সাজিদ বললো, -‘দাদা, ওটা কী মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক ছবি? যেটা আকছো?’
-‘হু’ নিলু দা’র উত্তর।
-‘আচ্ছা দাদা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার বিশেষ পড়াশোনা নেই। তুমি তো আবার এই লাইনের। আজ তোমার কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনবো।’
নীলুদা মুচকি হাসলেন। তুলির শেষ আঁচড় খানা দিয়ে খাটের উপর উঠে বসলেন । আমরা দুজন ততক্ষণে দুটি চেয়ারে বসে পড়েছি।
বুড়ো ভদ্রলোকটা ট্রেতে করে কফি নিয়ে এসেছেন।
নীলুদা কফিতে চুমুক দিতে দিতে মুক্তিযুদ্ধ গল্প বলতে শুরু করলেন, -‘১৯৭১ সাল। পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে নির্যাতিত, নিষ্পেষিত বাঙালিরা। যখনই তারা নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য সোচ্চার হয়েছে, তখনই পাকিস্তানীরা বাঙ্গালীদের উপর চালিয়েছে অত্যাচার-নির্যাতন।’
নিলুদা’র কন্ঠ ভারি হয়ে এলো। মুক্তিযুদ্ধের আলাপ উঠলেই উনি এরকম আবেগকেন্দ্রিক হয়ে যান।
তিনি বলে যাচ্ছেন, -‘এই অত্যাচার নির্যাতনের মাত্রা এতই ভয়াবহ হয়ে উঠল যে, বাঙালিরা শেষ পর্যন্ত নিজেদের এবং নিজেদের মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বাধ্য হল।
তখন চলছে উত্তপ্ত মার্চ মাস। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলা ও বাঙালি জাতির কর্ণধার, ইতিহাসের বরপুত্র, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে সশস্ত্র যুদ্ধের ডাক দিলেন।’
সাজিদ বলল, -‘দাদা তোমার ফোনের রিংটোনে শুনি তো। আমরা তাদের ভাতে মারবো, আমরা তাদের পানিতে মারবো।
বাবারে ! কি সাংঘাতিক কথা।’
নীলুদা কপালের ভাঁজ দীর্ঘ করে বললেন, -‘সাংঘাতিক বলছিস কেন? বরং বল, এটিই হলো বাঙালির মহাকাব্য। সেদিন এরকম ভাবে বাঙ্গালীদের অনুপ্রাণিত না করলে আমরা কি স্বাধীনতার স্বাদ পেতাম?’
-‘তাই বলে মেরে ফেলার কথা? এটা তো আইন হাতে তুলে নেবার মতো’- সজিদ বলল।
নিলু দা বলল, -‘যেখানে নিজেদের অস্তিত্বই বিলুপ্ত হবার পথে, সেখানে তুই আইন বানাচ্ছিস? যুদ্ধের ময়দানে কোন আইন চলে না।’
-‘তারপর?’
-‘শেখ মুজিবরের সেই ঐতিহাসিক ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঙ্গালীরা ঝাঁপিয়ে পড়লো যুদ্ধে।’
আমি বললাম, -‘তারা পাকিস্তানিদের মারল, এবং মরলো তাই না?’
-‘হ্যাঁ’
-‘যুদ্ধের পরে ‘আমরা তাদের ভাতে মারবো, পানিতে মারবো।’ অথবা, ‘যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ো’ এরকম কথার জন্য কি শেখ মুজিবরকে কি জেল-টেল খাটতে হয়েছে? বাঁ কেউ তাকে সন্ত্রাসে উস্কানিদাতা কিংবা খুন মদদদাতা বলে ব্লেইম করেছে?’ – সাজিদ জিজ্ঞেস করলো।
-‘তোর মাথায় কি গোবর নাকি রে সাজিদ? এটা কোন কথা বললি? শেখ মুজিবকে এটার জন্য ব্লেইম করবে কেন? যুদ্ধের ময়দানে এটা ছিল একজন কমান্ডারের কমান্ড। এটা অপরাধ নয়। বরং, এটার জন্য তিনি ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। নির্যাতিত বাঙ্গালিদের মুক্তির দিশারি, মহান এ নেতা। এভাবে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আমরা পেলাম একটি স্বাধীন ভূখণ্ড। একটা স্বাধীন পতাকা।’
-‘আচ্ছা দাদা, ঠিক একই কাজ যদি পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে অন্য কেউ করে, ধরুন, নির্যাতিত, নিষ্পেষিত, দলিত মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য পৃথিবীর অন্য কোথাও যদি অন্যকোন নেতা এরকম কথা বলে, -যদি বলে শত্রুদের যেখানেই পাও, হত্যা করো। আর, এই কমান্ড পেয়ে যদি নির্যাতিত মানুষগুলো যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে- আপনি সেটাকে কোন চোখে দেখবেন?’
-‘অবশ্যই আমি ওই নেতার পক্ষে থাকবো এবং তার এই কথার, এই কাজের প্রশংসা করবো।’ – নিলু দা বললেন।
-‘যেমন?’
-‘যেমন আমি চে গুয়েভারার সংগ্রামকে স্বাগত জানাই। আমি জোসেফ ষ্ট্যালিন, মাও সে তুং এর সংগ্রামকে স্বাগত জানাই। এরা সবাই নির্যাতিতদের অধিকারের জন্য লড়েছেন।’
এবার সাজিদ বলল, -‘দাদা, আপনি আরবদের ইতিহাস জানেন?’
-‘কি রকম?’
-‘চোদ্দশত বছর আগের কথা। আরবদের প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাসের বিপরিতে একটি নতুন ধর্মবিশ্বাস সেখানে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে।’
-‘হু’
-‘কিছু মানুষ স্বেচ্ছায়, কোন রকম জোর-জবরদস্তি ছাড়াই এই ধর্মের প্রতি অনুরাগী হয়ে পড়ে। তারা দলে দলে এই ধর্মবিশ্বাস মেনে নিতে শুরু করে। কিন্তু সমাজপতিদের এটা সহ্য হয়নি। যারা যারা এই ধর্মটিকে মেনে নিচ্ছিলো – তাদের উপরই নেমে আসছিলো অকথ্য নির্যাতন। বুকের উপর পাথর তুলে দেওয়া, উঠের পেছনে রশি দিয়ে বেঁধে মরুভূমিতে ঘুরানো, গর্দান নিয়ে নেওয়া কতো কি। একপর্যায়ে, এই ধর্মের প্রচারক, এবং তার সঙ্গী-সাথীদের দেশ ছাড়া করা হল। এমন কোন নির্যাতন নেই, যা তাদের উপর নেমে আসে নি।
স্বদেশ হারা, স্বজন হারা হয়ে তারা তখন বিধ্বস্ত।
৭১ এ আমাদের শত্রু যেমন ছিল পাকিস্তান, ১৪০০ বছর আগের সে সময়টায় মুসলমানদের শত্রু ছিল মুশরিকরা। তাহলে, এই অত্যাচার, নির্যাতনের বিরুদ্ধে দাড়িয়ে, তাদের নেতা যদি ঘোষণা দেয়, -‘তোমারা মুশরিকদের যেখানেই পাও, হত্যা কর’, তাহলে দাদা এতে কি কোন অপরাধ, কোন সন্ত্রাসবাদ প্রকাশ পায়?’
নিলু দা চুপ করে আছে।
সাজিদ বলে যেতে লাগলো, -‘শেখ মুজিবের, ‘আমরা তাদের ভাতে মারবো, পানিতে মারবো’ যদি বাঙ্গালির মহাকাব্য হয়, এটা যদি সন্ত্রাসবাদে উস্কানি না হয়, তাহলে আরেকটি যুদ্ধের ঘোষণা স্বরূপ বলা- ‘তোমরা মুশরিকদের যেখানেই পাও, হত্যা করো’ এই কথাটা কেন সন্ত্রাসবাদি কথা হবে? এটি কেন জঙ্গিবাদে উস্কানি হবে?’
কিন্তু, হত্যার নির্দেশ দেবার পরের আয়াতে আছে, ‘মুশরিকদের কেউ যদি তোমাদের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে, তাদের নিরাপদ স্থানে আশ্রয় দেও’
শেখ মুজিব কি বলেছিলেন, ‘আমরা তাদের ভাতে মারবো, পানিতে মারবো। কিন্তু তাদের কেউ এসে আমাদের আছে আশ্রয় চাইলে, আমরা তাদের নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় দেবো, বলেছিলেন? বলেন নি। পৃথিবীর কোন কমান্ডার শত্রুদের এরকম নিরাপদ দেবার কথা বলে নি। বরং, নির্দেশ দেয় দেখা মাত্রই গুলি করার।’
আমি বললাম, -‘হু’
সাজিদ বলল, -‘দাদা, কোরআনে আরো আছে, – ‘কেউ যদি বিনা অপরাধে কোন ব্যক্তিকে খুন করলো, সে যেন পুরো মানবজাতিকেই খুন করলো’ এরকম একটি কথা, পৃথিবীর কোন মানুষ, কোন নেতা, কোন গ্রন্থে কি আছে? নেই।
৭১ এর পাকিস্তানিদের মারার ঘোষণা দিয়েও শেখ মুজিব যদি আপনার কাছে মহানায়ক হন, তাহলে ১৪০০ বছর আগে, এরকম ঘোষণা আরেকজন দিয়ে থাকলে, তিনি কেন আপনার চোখে খলনায়ক হবেন? অপরাধী হবেন? একই কথা, একই নির্দেশের জন্য আপনি একজনকে মহামানব মনে করেন, অন্য জনকে মনে করেন সন্ত্রাসী কেন দাদা? স্রেফ কি ধর্মবিরোধীতার জন্য?
একজন এরকম ঘোষণাকে ফোনের রিংটোন করে রেখেছেন, অন্য জনের এরকম ঘোষণাকে সন্ত্রাসবাদি কথাবার্তা, জঙ্গিবাদী কথাবার্তা বলে কটাক্ষ করে লেখা লেখেন, কেন? এটা কি ফেয়ার, দাদা?’
-‘হুম’ -নীলুদা কিছুটা একমত।
সাজিদ বলল, -‘দাদা, অনেক নাস্তিককে কোরআনের একটি আয়াতকে অন্য আয়াতের সাথে কন্ট্রাডিক্টরী বলতে দেখেছি। অথচ তারা কোনদিনও সূরা তওবার ‘তোমরা মুশরিকদের যেখানে পাও, হত্যা কর’ এটাকে সূরা মায়েদার ‘কেউ যদি নিরাপরাধ কোন ব্যক্তিকে হত্যা করল, সে যেন পুরো মানবজাতিকে হত্যা করল’ এটার সাথে কন্ট্রাডিক্টরী বলতে দেখি না।
অথচ, সে ভাবে ভাবলে, নেই দুই আয়াত এরকম কথা বলা হচ্ছে। একবার মেরে ফেলতে বলছে, একবার বলছে, মারলে পুরো মানবজাতিকে হত্যা করার মত চরম পাপ হবে। কিন্তু নাস্তিকরা এই দুটোকে এক পাল্লায় এনে কথা বলেনা। কেন বলেনা, কারন তারাও জানে দুটো আয়াত নাজিলের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই দুটোকে এক করে বলতে গেলেই নাস্তিকরা ধরা পড়বে তাই বলে না। নিলু দা সব শুনে বললেন, -‘এর জন্যই বুঝি মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে এসেছিলি?’
-না দাদা, শুধু ডাবল স্ট্যান্ডবাজিটা উপলব্ধি করতে এসেছি। হা হা হা।’
নেহাত ভালো সম্পর্ক বলেই নীলুদা সেদিন রাগ করেন নি হয়তো।
ভেলকিবাজির সাতকাহন
আমাদের আড্ডাটির কথাটা তো আগেই বলেছি। সাপ্তাহিক আড্ডা। শিক্ষামূলক বটে। একেক সপ্তাহে একেক টপিকের উপর আলোচনা চলে।
আমি আর সাজিদ মাগরিবের নামাজ পড়ে এগুচ্ছিলাম। উদ্দেশ্য-আড্ডাস্থল। আজ আড্ডা হচ্ছে সেন্ট্রাল মসজিদের পেছনে। ওই দিকটা একটা মাঝারি সাইজের বটগাছ আছে। বটতলাতেই আজ আসর বসার কথা।
খানিকটা দূর থেকে দেখলাম আড্ডাস্থলে বেশ অনেক জনের উপস্থিতি। কেউ একজন যেন দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছে।
তাকে দেখে শামসুর রহমানের কবিতার দুটি লাইন মনে পড়ে গেল-
‘স্বাধীনতা তুমি-
বট ছায়ায় তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীর
শানিত কথার ঝলসানি-লাগা সতেজ ভাষণ ’
আড্ডাস্থলে পৌঁছে দেখি হুলস্থুল কান্ড। আলোচনা তখন আর আলোচনায় নেই, বাড়াবাড়িতে রূপ লাভ করেছে।
দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে যে কথা বলছিল, সে হলো রূপম। ঢাবির ফিলোসফির স্টুডেন্ট। অ্যাথেইজমে বিশ্বাসী। তাঁর মতে, ধর্ম কিছু রুপকথার গল্প বৈ কিছু নয়। সে তর্ক করছিলো হাসনাতের সাথে। হাসনাত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্থ্রোলজিতে পড়ে।
রুপমের দাবি- একমাত্র নাস্তিকতাই স্বচ্ছ, সৎ আর বিজ্ঞানভিত্তিক কথা বলে। কোন প্যাচ গোচ নেই, কোনো দুই নম্বরি নেই, কেন ফ্রডফিরি নেই। যা বাস্তব, যা বিজ্ঞান সমর্থন করে- তাই নাস্তিকতা।
মোদ্দাকথা, নাস্তিকতা মানে প্রমাণিত সত্য আর স্বচ্ছতার দিশা।
হাসনাতের দাবি- ধর্ম হলো বিশ্বাসের ব্যাপার। আর বিশ্বাসের ব্যাপার বলেই যে একে একেবারে রূপকথা বলে চালিয়ে দিতে হবে, তা কেন?
ধর্ম ধর্মের জায়গায়, বিজ্ঞান বিজ্ঞানের জায়গায়। ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের সামঞ্জস্যতা দেখাতে গিয়ে যে আলবার্ট আইনস্টাইন সহ বড় বড় কিছু বিজ্ঞানী আর দার্শনিকদের মন্তব্য কোট করতে লাগলো।
আমি গিয়ে সাকিবের পাশে বসলাম। তার হাতে বাদাম ছিল। একটি বাদাম ছিলে মুখে দিলাম।
সাজিদ বসলো না।
সে রুপমের পাশে গিয়ে তার কাঁধে হাত রাখল। বলল, -‘এতো উত্তেজনার কি আছে রে?’
-‘উত্তেজনা হবে কেন?’ -রুপম বলল।
-‘তোকে দেখেই মনে হচ্ছে, অনেক রেগে আসিস। এনিথিং রং?’
হাসনাত বলে উঠল, -‘উনি নাস্তিকতাকে ডিফেন্ড করতে এসেছেন। উনার নাস্তিকতা কত সাধু লেভেলের, তা প্রমাণ করার জন্যই ভাষণ দেওয়া শুরু করেছেন।’
সাজিদ হাসনাতকে ধমক দেওয়া সুরে বলল, -‘তুই চুপ কর ব্যাটা। তোর কাছে জানতে চেয়েছে আমি?’
হাসনাতকে সাজিদের এইভাবে ঝারি দিতে দেখে আমি পুরো হাঁ করে রইলাম। হাসমত সাজিদের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুদের একজন। আর এই রুপমের সাথে সাজিদের পরিচয় ক’দিনের? মনে হয় এক বছর হবে। রূপমের জন্যে তার এতো দরদ কিসের? মাঝে মাঝে সাজিদের এসব ব্যাপার আমার এত বিদঘুটে লাগে যে, ইচ্ছে করে তার কানের নিচে দু চারটা লাগিয়ে দিই।
সাজিদের ধমক খেয়ে বেচারা হাসনাতের মনটা খারাপ হয়ে গেল। হবারই তো কথা।
সাজিদ আবার রুপমকে বলল, -‘বল কি হয়েছে?’
-‘আমি বলতে চাইছি, ধর্ম হলো গোঁজামিলপূর্ণ একটা জিনিস। সেই তুলনায় নাস্তিকতাই স্বচ্ছ, সত্য আর বাস্তবতাপূর্ণ। কোন দুই নাম্বারি তাতে নেই।
সাজিদ বলল, ‘তাই?’
-‘হুম, Any Doubt?’
সাজিদ হাসলো। হাসতে হাসতে সে এসে মিজবাহ’র পাশে বসলো। রুপম বসলো আমার পাশে। বটগাছের নিচের এই জায়গাটা গোলাকার করে বানানো হয়েছে। সাজিদ আর রুপম এখন মুখোমুখি বসা।
সাজিদ বলল, -‘বন্ধু, তুই যতটা স্বচ্ছ, সত্য আর সততার সার্টিফিকেট তোর বিশ্বাসকে দিচ্ছিস, সেটা এতটা স্বচ্ছ, সত্য আর সৎ মোটেও নয়।
রুপম বলল, -‘মানে? কি বলতে চাস তুই? নাস্তিকরা ভুয়া ব্যাপারে বিশ্বাস করে? দুই নাম্বারি করে?’
-‘হুম। করে তো বটেই। এটাকে জোর করে বিশ্বাসও করায়।’
-‘মানে?’
সাজিদ নড়েচড়ে বসলো। বললো, -‘খুলে বলছি।’
এরপরে সাজিদ বলতে শুরু করল-
‘বিজ্ঞানীরা যখন DNA আবিষ্কার করল, তখন দেখা গেল আমাদের শরীরের প্রায় ৯৬-৯৮% DNA হল নন কোডিং। অর্থাৎ, এরা প্রোটিনে কোন প্রকার তথ্য সরবরাহ করে না। ২-৪% DNA ছাড়া বাকি সব DNA-ই নন কোডিং। এগুলোর তখন নাম দেয়া হলো- Junk DNA। Junk শব্দের মানে তো জানিস, তাই না? Junk শব্দের অর্থ হলো ‘আবর্জনা’। অর্থাৎ, এই 98% DNA-র কাজ কোন কাজ নেই বলে এগুলোকে ‘বাতুল DNA’ বা ‘Junk DNA’ বলা হল।
ব্যস, এটা আবিষ্কারের পরে বিবর্তনবাদী নাস্তিকরা তো খুশি তে লম্ফঝম্ফ শুরু করে দিলো। তারা ফলাও করে প্রচার করতে লাগল যে, আমাদের শরীরের যে ৯৮% DNA আছে সেগুলো হলো, Junk, অর্থাৎ, এদের কোন কাজ নেই। এই ৯৮% DNA ডারউইনের বিবর্তনবাদের পক্ষে অনেক বড় প্রমান। তারা বলতে লাগলো- মিউটেশনের মাধ্যমে এক প্রজাতি থেকে আরেক প্রজাতিতে রূপান্তরিত হবার সময় এই বিশাল সংখ্যক DNA আমাদের শরীরে রয়ে গেছে।
যদি কোন বুদ্ধিমান স্রষ্টা আমাদের সৃষ্টি করতো, তাহলে এই বিশাল পরিমাণ অকেজো অপ্রয়োজনীয় DNA তিনি আমাদের শরীরে রাখতেন না। কিন্তু কোন বুদ্ধিমান সত্ত্বার হাতছাড়া, প্রকৃতির অন্ধ প্রক্রিয়ায় আমরা অন্য একটি প্রাণী থেকে বিবর্তিত হয়েছে বলেই এ বিশাল অপ্রয়োজনীয় কিছু DNA আমাদের শরীরে এখনো বিদ্যমান।
বিবর্তনবাদীদের গুরু, বিখ্যাত বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স তো এই Junk DNA কে বিবর্তনবাদের পক্ষে বড়সড় প্রমান দাবি করে করে একটি বিশাল সাইজের বইও লিখে ফেলেন। বইটির নাম ‘The selfish Gene’।
কিন্তু বিজ্ঞান ওই Junk DNA তে আর বসে নেই।
বর্তমানে এপিজেনেটিক্সের গবেষণা থেকে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে, এতদিন যে DNA কে Junk বলে বিবর্তনের পক্ষে প্রমাণ করে চালিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তার কোন কিছুই Junk নয়। আমাদের শরীরে কোন রয়েছে নানা রকম বায়োকেমিক্যাল ফাংশন। যেগুলোকে নাস্তিক বিবর্তনবাদীরা এতদিন অকেজো, বাতিল, অপ্রয়োজনীয় বলে বিবর্তনের পক্ষে বড় প্রমাণ বলে লাফিয়েছে, সাম্প্রতিক গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে- এসব DNA মোটেও অপ্রয়োজনীয় কিছু নয়। মানবদেহে এদের রয়েছে নানান ফাংশন। তারা বলতো, প্রকৃতির অন্ধ প্রক্রিয়ায় মানুষ অন্য প্রাণী থেকে বিবর্তিত হয়েছে বলেই এরকম অকেজো নন ফাংশনাল DNA শরীরে রয়ে গেছে। যদি কোন সৃষ্টিকর্তা বিশেষভাবে মানুষকে সৃষ্টি করত, তাহলে এরকম অপ্রয়োজনীয় জিনিস আমাদের শরীরে থাকত না। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, এসব DNA মোটেও নন ফাংশনাল নয়। আমাদের শরীরে এদের অনেক কাজ রয়েছে। তাহলে বিবর্তনবাদীরা এখন কি বলবে, তারা তো বলেছিল ‘অপ্রয়োজনীয়’ বলেই এগুলো বিবর্তনের পক্ষে প্রমাণ। কিন্তু এগুলোর প্রয়োজন যখন জানা গেল, তখনো কি তারা একই কথা বলবে? ডকিন্স কি তার ‘The selfish Gene’ বইটা সংশোধন করবে? বিবর্তনবাদীরা কি তাদের ভুল শুধরে নিয়ে ভুলের জন্য ক্ষমা চাইবে? বল দোস্ত, এইটা কি দুই নাম্বারি না?
সাজিদ থামল। রুপম বলল, -‘বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে রকম দু-একটি ধারণা পাল্টাতে পারে। এটা কি চিটিং করা হয়?
সাজিদ বলল, -‘না। কিন্তু বিজ্ঞান কোনো ব্যাপারে ফাইনাল কিছু জানানোর আগে তাকে কোন নির্দিষ্ট কিছু এর পক্ষে প্রমাণ বলে চালিয়ে দেওয়া, প্রতিপক্ষকে এটা দিয়ে এক হাত নেওয়া এবং এটা পক্ষে কিতাবাদি লিখে ফেলাটা চিটিং এবং নাস্তিকরা তাই করে।’
সাজিদ বলল, -‘শুধু Junk DNA নয়। আমাদের শরীরে যে অ্যাপেন্ডিক্স আছে, সেটা নিয়েও কত কাহিনী তারা করেছে। তারা বলেছে, অ্যাপেন্ডিক্স আমাদের শরীরের অপ্রয়োজনীয় অঙ্গ। আমাদের শরীরের কোন কাজ নেই। যদি কোন বুদ্ধিমান সত্ত্বা আমাদের সৃষ্টি করত, তাহলে অ্যাপেন্ডিক্স এর মত অপ্রয়োজনীয় অঙ্গ আমাদের শরীরে রাখত না। আমরা শিম্পাঞ্জি জাতীয় এক প্রকার এপ থেকে প্রকৃতি অন্ধ প্রক্রিয়ায় বিবর্তিত বলেই এরকম অপ্রয়োজনীয় অঙ্গ আমাদের শরীরে রয়ে গেছে। এটার কোনো কাজ নেই।
এটাকে তারা বিবর্তনের পক্ষে প্রমাণ বলে চালিয়ে দিত।
কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা গেছে যে, অ্যাপেন্ডিক্স মোটেও কোনো অপ্রয়োজনীয় অঙ্গ নয়। আমাদের শরীরে যাতে রোগজীবাণু, ভাইরাস ইত্যাদি প্রবেশ করতে না পারে, তার জন্য যে টিস্যুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, সেটাত নাম লিম্ফ টিস্যু। এই টিস্যু আমাদের শরীরে অনেকটা সৈনিক তথা প্রহরীর মতো কাজ করে। আর, আমাদের বৃহদন্ত্রের মুখের প্রচুর লিম্ফ টিস্যু ধারনকারী যে অঙ্গটি আছে, তার নাম অ্যাপেনডিক্স।
যে অ্যাপেনডিক্সকে একসময় অকেজো ভাবা হতো, বিজ্ঞান এখন তার অনেক ফাংশনের কথা আমাদের জানাচ্ছে। বিবর্তনবাদীরা কি আমাদের এব্যাপারে কোনকিছু নসিহত করতে পারে? এখন কি বলবে অ্যাপেন্ডিক্স অকেজো? বিবর্তনের পক্ষে প্রমাণ?
রুপম চুপ করে আছে। সাজিদ বলল, -‘এতো গেল মাত্র দুটি ঘটনা। তুই কি ‘মিসিং লিঙ্ক’ এর ব্যাপার জানিস রুপম?
আমার পাশ থেকে রাকিব বলে উঠল, -‘মিসিং লিঙ্ক আবার কি জিনিস?’
সাজিদ রাকিবের দিকে তাকাল। বলল, -‘বিবর্তনবাদীরা বলে থাকে একটা প্রাণী থেকে ধীরে ধীরে অন্য একটা প্রাণী বিবর্তিত হয়। তারা বলে থাকে, -শিম্পাঞ্জি থেকে আমরা, মানে মানুষ এসেছে বিবর্তন প্রক্রিয়ায়। যদি এরকম হয়, তাহলে শিম্পাঞ্জি থেকে কিন্তু এক লাফে মানুষ চলে আসে নি।
অনেক অনেক ধাপে শিম্পাঞ্জি থেকে মানুষ এসেছে। ধর, ১ সংখ্যাটা বিবর্তিত হয়ে ১০ এ যাবে। এখন ১ সংখ্যাটা কিন্তু এক লাফে ১০ হয়ে যাবে না। তাকে অনেক গুলো মধ্যবর্তী পর্যায় (২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯) অতিক্রম করে ১০ হতে হবে। এই যে ১০ এ আসতে সে অনেকগুলো ধাপ (২, ৪, ৭, ৮, ৯) অতিক্রম করল, এ ধাপগুলি হল ১ এবং ১০ এর মিসিং লিঙ্ক।’
রাকিব বলল, -‘ও আচ্ছা, বুঝলাম। শিম্পাঞ্জি যখন মানুষের বিবর্তিত হবে, প্রাথমিক পর্যায়ে তার মধ্যে কিছু মানুষের কিছু শিম্পাঞ্জির বৈশিষ্ট্য আসবে। এই বৈশিষ্ট্য সম্বলিত পর্যায়টাই মিসিং লিঙ্ক, তাই না?’
-‘হুম। ধর, মৎসকন্যা। তার অর্ধেক শরীর মাছ, অর্ধেক শরীর মানুষ। তাহলে তাকে মানুষের একটি মধ্যবর্তী পর্যায়ে হিসেবে ধরা যায়। এখন কেউ যদি দাবী করে যে, মাছ থেকে মানুষ এসেছে, তাহলে তাকে ঠিক মৎস্য কন্যার মত কিছু একটা প্রমাণ করতে হবে। এটাই হল মিসিং লিঙ্ক।
রুপম বলল, -‘তো এইটা নিয়ে কি সমস্যা?’
সাজিদ আবার বলতে লাগলো, -‘বিবর্তনবাদ তখনই সত্যি হবে, যখন এরকম সত্যিকারের মিসিং লিঙ্ক পাওয়া যাবে। পৃথিবীতে কোটি কোটি প্রাণী রয়েছে। সেই হিসাবে বিবর্তনবাদ সত্য হলে, কোটি কোটি প্রাণের বিলিয়ন বিলিয়ন এরকম মিসিং লিঙ্ক পাওয়া যাওয়ার কথা। কিন্তু মজার ব্যাপার, এরকম কোন মিসিং লিঙ্ক আজ অবধি পাওয়া যায়নি। গত দেড়শ বছর ধরে অনেক অনেক ফসিল পাওয়া গেছে কিন্তু সেগুলোর কোনটির মিসিং লিঙ্ক নয়। বিবর্তনবাদীরা তর্কের সময় এই মিসিং লিঙ্কের ব্যাপারটা খুব কৌশলে এড়িয়ে যায়। কেউ কেউ বলে, আরো সময় লাগবে। বিজ্ঞান একদিন ঠিক পেয়ে যাবে, ইত্যাদি।
কিন্তু ২০০৯ সালে বিবর্তনবাদীরা একটা মিসিং লিঙ্ক পেয়ে গেল যা প্রমাণ করে যে, মানুষ শিম্পাঞ্জী গোত্রের কাছাকাছি কোন প্রাণী থেকেই বিবর্তিত। এটার নাম দেওয়া হল-Ida।
বিবর্তনবাদ দুনিয়ায় রাতারাতি তো ঈদের আমেজ নেমে আসলো। তারা এটাকে বলল, -‘The eighth wonder of the world’
কেউ কেউ তো বলছিল, -‘আজ থেকে কেউ যদি বলে বিবর্তনবাদের পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই, তারা যেন Ida কে প্রমাণ হিসেবে হাজির করে। বিবর্তনবাদীদের অনেকেই এটাকে ‘Our Monalisa’ বলেও আখ্যায়িত করেছিল। হিস্ট্রি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, ডিসকভারি চ্যানেলে এটাকে ফলাও করে প্রচার করা হলো। সারা বিবর্তনবাদ দুনিয়ায় তখন সাজ সাজ রব।
কিন্তু, বিবর্তনবাদীদের কান্নায় ভাসিয়ে ২০১০ সালের মার্চে টেক্সাস ইউনিভার্সিটি, ডিউক ইউনিভার্সিটি আর ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো’র গবেষক বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করে দেখালেন যে, Ida কোন মিসিং লিঙ্ক নয়। এটা Lomour নামক একটি প্রাণীর ফসিল। তাদের এই রিসার্চ পেপার যখন বিভিন্ন নামিদামি সায়েন্স জার্নালে প্রকাশ করা হলো, রাতারাতি বিবর্তনবাদ জগতে শোক নেমে আসে। বল রুপম, এইটা কি জালিয়াতি নয়? একটা আলাদা প্রাণীর ফসিলকে মিসিং লিঙ্ক বলে সাধারণ মানুষকে ধোকা দেওয়া কি চিটিং নয়?’
এরচেয়েও জঘন্য কাহিনী আছে এই বিবর্তনবাদীদের। ১৯১২ সালে Piltdown Man নামে ইংল্যান্ডে সাসেক্সে একটি জীবাশ্ম পাওয়া যায় মাটি খুঁড়ে। এটিকেও রাতারাতি ‘বানর এবং মানুষের’ মিসিং লিঙ্ক বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। এটাকে তো ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল জাদুঘরে প্রদর্শনীর জন্য রেখে দেওয়া হয়। বানর এবং মানুষের এই মিসিং লিঙ্ক দেখতে হাজার হাজার দর্শনার্থী আসতো।
কিন্তু ১৯৫৩ সালে কার্বন টেস্ট করে প্রমান করা হয় যে, এটি মোটেও কোনো মিসিং লিঙ্ক নয়। এটাকে কয়েকশো বিলিয়ন বছর আগের বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। গবেষণায় দেখা যায়, এই খুলিটি মাত্র ৬০০ বছর আগের আর এর মাড়ির দাতগুলো ওরাং ওটাং নামের অন্য প্রাণীর। রাতারাতি বিবরতন মহলে শোক নেমে আসে।
বুঝতে পারছিস রুপম, বিবর্তনবাদকে জোর করে প্রমান করার জন্য কত রকম জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে এবং হচ্ছে?
একটা ভুয়া জিনিষকে কিভাবে বছরের পর বছর ধরে প্রমাণ হিসেবে গিলানো হয়েছে। নেট ঘাটলে এরকম জোড়াতালি দেওয়া অনেক মিসিং লিঙ্ক এর খবর তুই এখনো পাবি। মোদ্দাকথা, এ নাস্তিকতা, এই বিবর্তনবাদ টিকে আছে কেবল পশ্চিমা বস্তুবাদীদের ক্ষমতা আর টাকার জোরে।
এ বিবর্তনবাদই তাদের সর্বশেষ সম্বল ধর্মকে বাতিল করে দেওয়ার। তাই এটাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য, দাঁড় করানোর জন্য, মানুষকে গিলানোর জন্য, তাদের যা যা করতে হয় তারা করবে। যত জালিয়াতির আশ্রয় নিতে হয় তারা নিবে।
এরপরও কি বলবি তোর নাস্তিকতা সাধু? সৎ? প্রতারনাবিহীন নির্ভেজাল জিনিস?
রুপম কিছু না বলে চুপ করে আছে। হাসনাত বলে উঠলো, -‘ইশ ! এতক্ষণ তো নাস্তিকতাকে নির্ভেজাল, সৎ, সাধু, কোন দুই নাম্বারি নেই, কোন ফ্রডবাজি নেই বলে লেকচার দিচ্ছিলি। এখন কিছু বল?’
এশার আযান পড়লো। আমরা নামাযে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালাম। আমাদের সাথে রাকিব আর হাসনাতও আছে অল্প। অল্প একটু পথ হাটার পরে আমি হঠাৎ থেমে গেলাম। সাজিদ বলল, -‘তোর আবার কি হলো রে?’
আমি রাগি চেহারায় বড় বড় চোখ করে বললাম, -‘তুই ব্যাটা হাসনাতকে তখন ওইভাবে ঝাড়ি দিয়েছিলি কেন?’
সাজিদ হাসনাতের দিকে তাকালো। মুচকি হেসে বলল, ‘শেক্সপিয়র বলেছেন, Sometimes I have to be cruel just to be kind’………
আমরা সবাই হা হা হা করে হেসে ফেললাম।
রাসূল (সা.) আর আয়েশা (রা.) এর বিয়ে নিয়ে কথিত নাস্তিকদের কানাঘুষা
আমরা চারজন বসে টিএসসিতে আড্ডা দিচ্ছিলাম। রাকিব, শাহরিয়ার, সাজিদ আর আমি। আমাদের মধ্যে শাহরিয়ার হল খেলাপ্রেমিক। ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনার চরম ভক্ত। কেউ পুরো সপ্তাহের কোন ম্যাচ না দেখে শাহরিয়ার কাছে আধঘন্টা বসলেই হবে। শাহরিয়ার পুরো সপ্তাহের খেলার আদ্যোপান্ত তাকে কাগজে-কলমে বুঝিয়ে দেবে। ইপিএলে কোন দলে আছে, ম্যানচেস্টার সিটির দায়িত্ব নিয়ে পেপ গার্দিওলা কিরকম দলটাকে পাল্টে দিল,
সিরিএ-তে জুভের অবস্থান কোথায়, ইব্রাকে ছেড়ে দিয়ে ফ্রেঞ্চ লীগে পিএসজির অবস্থান কেমন, বুন্দেসলীগাতে বায়ার্ন আর ডর্টমুন্ড কি করছে, লা-লিগাতে বার্সা-রিয়ালের দৌড়ে কে এগিয়ে, রোনাল্ডোর ফ্রম নাই কেন, মেসিকে ছাড়া বার্সা সামনের ম্যাচ গুলোর উতরে যেতে পারবে কিনা, নেইমার সেরা না বেল সুয়ারেজ নাকি বেনজেমা ইত্যাদি ইত্যাদি বিশ্লেষণের জন্য শাহরিয়ারের জুড়ি নেই। এত কঠিন কঠিন স্প্যানিশ, জার্মেইন, ফ্রেঞ্চ আর ইতালির নামগুলো সে কিভাবে যে মনে রাখে আল্লাহ মালুম। খেলার খবর বলতে শুরু করলে তার কোন থামাথামি নেই। ননস্টপ বলে যেতে পারে। এজন্য আমরা বন্ধু মহলে শাহরিয়ার ‘স্পোর্টস চ্যানেল’ নামে পরিচিত।
রাকিব হলো আগাগোড়া ‘পলিটিক্স স্পেশালিস্ট’।
দুনিয়ার রাজনীতি কখন কোথায় কিভাবে মোড় নিচ্ছে, তার সমস্ত রকম আপডেট থাকে রাকিব এর কাছে। গলির মুখ থেকে ট্রাম্পের বেঁচে আসা থেকে শুরু করে হিলারির ম্যালেরিয়া পর্যন্ত সব খবর তার নখ দর্পনে। তবে ইদানিং সে ব্যস্ত পাক-ভারতের যুদ্ধ নিয়ে। কাশ্মীরের উরিতে হামলা নিয়ে পাক-ভারতের মধ্যে যে যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব বিরাজ করছে, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করেই যাচ্ছে সে। রাকিবের মনে হচ্ছে, ঊরি’র হামলাটা আসলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির একটি ‘ব্লাইন্ড গেম’। তার মতে ঊরিতে যারা হামলা করছে, তারা যদি সত্যি পাকিস্তানি হবে, তাহলে নিহত হামলাকারীদের মিডিয়ার সামনে না এনে রাতারাতি কবরস্থ করে ফেলা হলো কেন? সেই হামলাকারীদের ছবি আর পরিচয় মিডিয়ার সামনে এনে পাকিস্তানকে এক ঘরে করে দেবার একটি দারুন চান্স ছিল ভারতের হাতে। কিন্তু ভারত তা করল না কেন? কেন তারা রাতারাতি লাশগুলো সেনাক্যাম্পে দাফন করে ফেললো কেন? কেন পাকিস্তানের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হলো না ইত্যাদি পয়েন্ট ধরে রাকিবের মনে সন্দেহ আছে।
যুদ্ধ যদি সত্যিই লেগেই যায়, কোন পক্ষ বেনিফিট হবে, কার কত সামরিক শক্তি, কে কোন দিক থেকে আক্রমণ-প্রতি আক্রমণ চালাবে সেগুলোর পয়েন্ট বাই পয়েন্ট ব্যাখ্যা দিচ্ছে সে।
আলোচনার মাঝখানে হঠাত নিলয় দা’র আগমন। আমাদের চেয়ে সিনিয়র মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্র ছিলো।
আমাদের চেয়ে ঢের সিনিয়র হওয়া সত্ত্বেও আমাদের সাথে তার বন্ধুত্ব সুলভ আচরণ দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এত সিনিয়র লেভেলের কেউ।
তার হাতে একটি পত্রিকা। পত্রিকা হাতে নিলয় দা আমাদের পাশে এসে বেঞ্চিতে বসলো।
নিলায় দাকে দেখে সাজিদ আরেক কাপ রঙ চা’র অর্ডার করলো।
চা চলে এলে নিলয় দা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, -‘বাকস্বাধীনতার মূল্য পৃথিবীর কোথাও নেই, বুঝলি? কোথাও নেই।’
কথাগুলো এমনভাবে বলল যে নিলয় দাকে খুব মর্মাহত দেখালো। নিলয়দা কোন পয়েন্টে থেকে কথাগুলো বলল তা আমাদের কারো মাথাতে আসে নি তখনও। রাকিব বলে উঠল, -‘নিলয়দা কি পশ্চিমবঙ্গের ধর্মীয় কটূক্তির দায়ে গ্রেপ্তার হওয়া তারক বিশ্বাসের কথা বললে?’
নিলয়দা রাকিবের কথার প্রত্যুত্তরে কোন কিছু বলল না। তার মানে রাকিব এর ধারণা ঠিক। অন্য সময় হলে রাকিবের এরকম উপস্থিত বুদ্ধির বহর দেখে নিলয়দা তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলতো ‘সাবাস’। কিন্তু আজ খুব ফ্রাস্ট্রেটেড থাকায় নিলয়দা খুব অফ মুডে আছে বলে মনে হচ্ছে।
ব্যাপারটা খুব শরটলি ব্যাখ্যা করলো রাকিব। পশ্চিমবঙ্গের একজন নাস্তিক তরুণ মহানবী সা. কে নিয়ে কটুক্তি করার ফলে সাইবার আইনে গ্রেফতার হয়েছে পরশুদিন। এটাকে নিলয়দা বলছে বাকস্বাধীনতার ওপর আঘাত।
সাজিদ তার চায়ের শেষ চুমুকটি দিয়ে বলল, -‘এতে দোষের তো কিছু দেখছি না দাদা। ছেলেটা দোষ করেছে, সে তার শাস্তি পাচ্ছে। What’s wrong?’
নিলয় দা মুখের রং পরিবর্তন করে বড় বড় চোখে সাজিদের দিকে তাঁকালো। বললো, -‘একজন পঞ্চাশোর্ধ বুড়ো লোক ৯ বছর বয়সী একটা মেয়েকে বিয়ে করলে দোষ নেই, তা নিয়ে কথা বললেই দোষ হয়ে যায়।
সাজিদ বললো, -‘কথা বললে তো দোষ নেই দাদা। কিন্তু অশ্লীল ভাষায় কটুক্তি করাটা দোষের। একটি ধর্মের পবিত্র নবীকে নিয়ে এরকম খিস্তি করাটা মূল্যবোধ বিরোধী তো বটেই, এটা সংবিধান বিরোধীও।’
-‘গুষ্টি কিলাই তোমার এরকম মূল্যবোধ আর সংবিধানের।’
সাজিদ বুঝলো নিলয়দা খুব ক্ষেপে আছে। তাকে সহজে বোঝানো যাবে বলে মনে হচ্ছে না।
সাজিদ বলল, -‘দাদা মনে আছে তোমার, আমি তখন সবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। তোমার সাথে প্রথম পরিচয় হয় তখন। এক সন্ধ্যায় হুমায়ূন আহমেদের মেয়ের বয়সি শাওনকে বিয়ে করার ব্যাপারটা নিয়ে যখন আমি আপত্তি তুলে ছিলাম, তুমি কি বলেছিলে? তুমি বলেছিলে, বিয়ে হল একটি বৈধ সমাজিক বন্ধন। যখন তাতে দুটি পক্ষের সম্মতি থাকে, তখন সে তার বয়স, সামাজিক স্ট্যাটাস কোন কিছুই ম্যাটার করে না। হুমায়ূন আহমেদের বেলায় যে কথাগুলো প্রযোজ্য, সে কথাগুলো মুহাম্মদ সা. এর বেলায় কেন প্রযোজ্য হবে না?’
নিলয়দা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। এরপর বলল, -‘তাই বলে বলতে চাচ্ছিস, ৯ বছরের অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েকে বিয়ে করা বৈধ হয়ে যাবে?’
সাজিদ হাসলো। বললো, -‘দাদা আমি মোটেও তা বলছি না। আমি প্রথমে বোঝাতে চাইলাম যে, বিয়ে একটা সামাজিক বন্ধন।’
-‘তো? সামাজিক বন্ধন ধরে রাখতে ৯ বছরের কিশোরী বিয়ে করতে হবে নাকি?’
সাজিদ উঠে দাঁড়ালো। আমি জানি এখন সে লেকচার শুরু করবে। রাসূল সাঃ এবং আয়েশা রা. এর বিয়ে নিয়ে একি নাতিদীর্ঘ লেকচার দেওয়ার জন্য সে মেন্টালি প্রস্তুতি নিচ্ছে।
যা ভাবলাম তাই। সাজিদ বলতে শুরু করল-
‘দাদা প্রথমে বলে রাখি, যারাই রাসূল সা. আর আয়েশা রা. এর বিয়ে নিয়ে আপত্তি তুলে, তাদের প্রথম দাবি মোহাম্মদ সা. নাকি যৌন লালসা কাতর ছিলেন। সে জন্য তিনি নাকি কিশোরী আয়েশা রা. কে বিয়ে করেছিলেন।
তাদের এই দাবি যে কতটা বাতুলতা আর ভিত্তিহীন, তা ইতিহাস থেকে আমরা দেখব। আমরা জানি, মুহাম্মদ সা. বিয়ে করেছিলেন ২৫ বছর বয়সে। হযরত খাদিজা রাঃ কে।
বলাবাহুল্য, যখন মুহাম্মদ সা. ২৫ বছরের একজন টগবগে তরুণ, ঠিক সেই সময়ে তিনি বিয়ে করলেন চল্লিশোর্ধ একজন মহিলাকে, যিনি কিনা আবার একজন বিধবা ছিলেন। যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন মুহাম্মদ সা. আর কোন বিয়ে করেননি। তুমি হয়তো বলবে, খাদিজার রা. এর প্রচুর ধন সম্পত্তি ছিল। পাছে এগুলো হারানোর ভয়ে হয়তো তিনি আর বিয়ে করেননি। তোমার জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি, এটা ইতিহাস সম্মত যে সম্পদশালী খাদিজার রা. নিজে মুহাম্মদ সা. কে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, মুহাম্মদ সা. নিজে দেন নি। তারউপর খাদিজা রা. নিজেই যেখানে একজন বিধবা ছিলেন, সেখানে মোহাম্মদ সা.ও যদি সেই অবস্থায় আরেকটি বিয়ে করতে চাইতেন, তাতে বাধা দেওয়ার অধিকার খাদিজা রা. এর থাকার কথা না।
তাহলে এখান থেকে আমরা কি বুঝলাম? আমরা বুঝলাম যে, মুহাম্মদ সা. যৌনকাতরতা থেকে কিশোরী আয়েশা রা. বিয়ে করেননি।
নিলয় দা প্রশ্ন করলো, -‘তাহলে কিশোরী আয়েশাকে বিয়ে করার হেতু কি?’
সাজিদ বলল, -‘Let me finish …… আয়েশা রা. কে বিয়ে করার একটা হুকুম রাসূল সা. আল্লাহর কাছ থেকে পেয়েছিলেন। কারণ জ্ঞানে-গুনে আয়েশা রা. ছিলেন তৎকালীন আরব কন্যাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তার সেই প্রজ্ঞা, সেই জ্ঞান, সে বিচক্ষণতা যাতে পুরোপুরিভাবে ইসলামের কল্যাণার্থে ব্যবহার হতে পারে, তারজন্যই হয়তো এই হুকুম।’
স্পোর্টস চ্যানেল শাহরিয়ার এতক্ষণ চুপ করেছিল। এবার সে বলল, -‘সাজিদ, রাসূল সা. বিয়ে করার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে হুকুম প্রাপ্ত, এই কথার ভিত্তি কি?’
সাজিদ শাহরিয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল, -‘নবীদের স্বপ্নও একপ্রকার ওহি। এটা জানিস তো?’
-‘বুখারির হাদিসে আছে, রাসূল সা. হযরত আয়েশা রা. কে একবার বললেন, (হে আয়েশা) আমি তোমাকে দুই বার স্বপ্নে দেখেছিলাম। একটি রেশমের উপরে একটি কারো একজনের মুখচিহ্ন। আমি যখন রেশনের উপর থেকে আবরণ সরালাম, আমি দেখলাম সেটা তোমার মুখাবয়ব। তখন কেউ একজন আমাকে বলল, -(হে মুহাম্মদ) এটা তোমার স্ত্রী। আমি বললাম, যদি এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত হয়, তাহলে এটাই হবে।’
বুখারি এই হাদিস থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, আয়েশা রা. যে নবী মুহাম্মদ স. এর স্ত্রী হবে সেটা আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি সম্মতি।’
শাহরিয়ার আবার বলল, -‘কিন্তু তুই যে বললি, তার জ্ঞান-প্রজ্ঞা ইসলামের কল্যাণার্থে ব্যবহারের জন্যই এই হুকুম, তার দলিল কি?’
সাজিদ বলল, -‘এটাতো সর্বজনবিদিত সত্য কথা। সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা রা. এর পর সবচেয়ে বেশি হাদীস মুখস্ত করে রেখেছিলেন, তিনি হযরত আয়েশা রা.। শুধু তাই নয়, কোরআনের অগাধ পাণ্ডিত্য। এমনকি বড় বড় সাহাবীরা পর্যন্ত তার কাছে ফতোয়ার জন্য আসতো। তার ফিক্বহী জ্ঞান ছিল অসামান্য।
আবু মুসা আল-আনসারী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন –‘এমন কখনো হয়নি (ফিক্বহী বিষয়ে) আমরা কোন কিছু সমাধানের জন্য আয়েশা রা. এর কাছে গেলাম কিন্তু সন্তোষজনক উত্তর পাইনি।’
অর্থাৎ, আয়েশা রা. এর এই যে জ্ঞান-প্রজ্ঞা, এর জন্য তিনি আল্লাহ কর্তৃক উম্মুল মুমিনীন হিসেবে সিলেক্টেড হয়ে যান।
এছাড়াও, তৎকালীন আরবে খুব ছোট বয়সে মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেত। তখন তার প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। এটা ঠিক যুগের সাথে সাথে সেটা পাল্টেছে। এখন মেয়েদের অনেক চিন্তা। ক্যারিয়ার গড়ো, পড়াশোনা কর, বিদেশ যাও, উচ্চ ডিগ্রির সার্টিফিকেট নাও।
তখন আরবের মেয়েদের চাকরি করার দরকার হয়নি, বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পড়ার রীতি তখনও ছিল না। ঘরোয়া পরিবেশে তারা ধর্মীয় জ্ঞানার্জন করতো। এর জন্য খুব ছোট বয়সে তাদের বিয়ের রীতি ছিল।
তবে মেয়েদের ছোট বয়সে যে বিয়ের রীতি ছিল, তা আয়েশা রা. এর জীবনের আরেকটি ঘটনা থেকেই বোঝা যায়। মুহাম্মদ সা. এর সাথে বিয়ের আগে, আয়েশা রাঃ এর আরেক জনের সাথে বিয়ে ঠিক হয়। তার নাম ছিল জুবায়ের। কিন্তু, আবু বকর রা. ইসলাম গ্রহন করায় বিয়েটা ভেঙে যায়। এর থেকে কি প্রমান হয় না, তখন মেয়েদের ছোট বয়সেই বিয়ের প্রচলন ছিল ? তাছাড়া, তখনকার মক্কার কোন বিধর্মীরা এই বিয়ে নিয়ে আপত্তি তোলেনি। তারাও জানত, এটা খুব স্বাভাবিক একটি ব্যাপার।
নিলয় দা বলল, -‘মোহাম্মদ তো এসেছিলেন রীতি ভেঙে রীতি গড়ার জন্য। তিনি এই অদ্ভুত রীতি ভাঙলেন না কেন?’
সাজিদ বলল, -‘দাদা, ঠিক বলেছ। মুহাম্মদ সা. এসেছিলেন রীতি ভেঙে রীতি গড়ার জন্য। কিন্তু তিনি সেসব রীতি ভাঙার জন্য এসেছিলেন, যা অনৈতিক। যেমন, কোন শিশুকে জীবন্ত দাফন। তিনি আরবের সেসব কালচার পাল্টে দিয়েছেন, যা জাহেলিয়াতের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু, ছোট বয়সে বিয়ে সেরকম কোনো ব্যাপার নয়। বিজ্ঞান আমাদের বলে, মেয়েরা পুরুষের চেয়ে দশগুণ তাড়াতাড়ি ম্যাচিওর হয়। সেটা ফিজিক্যালি এবং মেন্টালি দুইভাবেই। তাছাড়া, তখনকার আরবের ছোট বয়সে বিয়ে হবার পরও মেয়েরা খুব নরমালে সন্তান জন্ম দিতো। এটা কোন সমস্যা ছিল না। সেটা চেঞ্জ করার দরকার ছিল না। যা দরকার ছিল তা তিনি করেছেন। তুমি কি আশা কর যে, মুহাম্মদ সা. কেন তৎকালীন আরবদের উটের ব্যবসা তুলে দিয়ে, তাদের শেয়ার ব্যবসা শেখালেন না, কেন তিনি খেজুরের ব্যবসা তুলে দিয়ে সেখানে চকলেট আর রসমালাইয়ের ব্যবসার প্রচলন করলেন না? তুমি হয়তো ভাবছো, তৎকালীন আরবের বালকদের উট চরানো থেকে মুক্তি দিয়ে কেন তাদের হাতে একটি কম্পিউটার এবং একটি করে ফেসবুক একাউন্ট খুলে দিলেন না?’
শাকিব আর শাহরিয়ার হা হা হা হা করে হাসতে লাগলো। সাজিদ বলল, -‘মানুষ মাত্রই তার সমাজের সুস্থ নিয়মগুলোর সাথে মিলিয়ে চলতে বাধ্য। মুহাম্মদ সা.ও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। তাছাড়া এত অল্প বয়সে বিয়ে কেবল ১৫০০ বছর আগে ছিল তা নয়, শিল্প বিপ্লবের পরেও অনেক উন্নত দেশে বিয়ের ক্ষেত্রে মেয়েদের সর্বনিম্ন বয়স সীমা ১০ এর নিচে ছিল। তাছাড়া, ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি, মুহাম্মদ সা. এর আরো ৫০০ বছর পরে ইংল্যান্ডের রাজা জন ৪৪ বছর বয়সে ১২ বছর বয়সী রানী ইসাবেলাকে বিয়ে করেছিলেন। এ ব্যাপারগুলো তখনকার সমাজে, যুগে খুব স্বাভাবিক ছিল, যেমন স্বাভাবিক সঙ্গম করে সন্তান উতপাদন করা। তাছাড়া, উপমহাদেশেও যে খুব ছোট বয়সে বিয়ে রীতি ছিল, তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প ‘হৈমন্তী’ থেকেই আমরা দেখতে পাই। লেখক সেখানে দেখিয়েছেন, তখনকার সময় ৮-১১ বছরের মধ্যে মেয়েদের বিয়ে হত। হৈমন্তীর বিয়ের স্বাভাবিক বয়স পেরিয়ে যাওয়ায়, অর্থাৎ, ১৭ হয়ে যাওয়ায় তার শাশুড়ি সেটা সবার কাছ থেকে লুকোতে চাইছিলেন। হৈমন্তীকেও মিথ্যে বলার জন্য শিখিয়ে দিয়েছিলেন। এখান থেকে বোঝা যায়, রবীন্দ্রনাথের সময়েও ৮ থেকে ১১ বছর বয়সে মেয়েদের বিয়ে ছিল একটি স্বাভাবিক ঘটনা।
সেই গল্পে আমরা ‘পণ’ প্রথার কুফল সম্পর্কে একটি আভাস পেলেও, কোথাও কিন্তু বিয়ের বয়স নিয়ে উচ্চবাক্য দেখেনি। বরং, হৈমন্তীর বয়স বেশি হয়ে যাওয়াতেই কিছুটা আপত্তি দেখা গেছে। এখান থেকে বুঝতে পারি, রবীন্দ্র আমলেও ছোট বয়সে বিয়ের প্রচলন ভারতবর্ষেই মজুদ ছিল।
সাজিদের এই লেকচারে নিলয় দা সন্তুষ্ট না। বললো। -‘দেখো ভাই, যতই ত্যানা পেচাও, একজন বৃদ্ধ লোক ৯ বছর বয়সি কিশোরীকে বিয়ে করেছে, এটাকে তুমি কোন ভাবেই ডিফেন্ড করতে পারোনা। সে প্রফেট হোক আর যাই-ই হোক।’
আমি ভাবলাম, এইবার সাজিদ পরাজিত হবে। হাল ছেড়ে দিয়ে হতাশ গলায় বলবে, -নাহ ! আর পারলাম না দাদা।’
কিন্তু না। সাজিদের মধ্যে আমি তেমন কিছুই দেখলাম না। সে খুব স্বাভাবিক মুচকি একটি হাসির রেখা তার ঠোঁটে। সে আর এক কাপ চায়ের অর্ডার করলো।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, -‘দাদা, ছাত্রলীগের নতুন কমিটিতে পদ পেয়েছে শুনলাম।’
নিলয় দা বললো, -‘হুম, সাহিত্য সম্পাদক।’
সাজিদ বলল, -‘নতুন একটি আইন হল শুনলাম। বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবার নিয়ে কেউ কটুক্তি করলে ধরা হবে নাকি?’
-‘হ্যাঁ, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটুক্তি করলেই তো সেটা সহ্য করা হবে না।’
-‘তা ঠিক। বঙ্গবন্ধু তো তোমাদের আইডল।’
নিলয় দা বলল, -‘আমাদের আইডল কিরে? বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির আইডল।’
-‘আচ্ছা দাদা, তুমি জানো বঙ্গবন্ধুর স্ত্রীর নাম কি ছিল?’
নিলয় দা অবাক হবার ভঙ্গি করে বলল, -‘কি সব বলছিস তুই? জানবো না কেন? বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা বেগম।’
সাজিদ বলল, -‘দাদা, তুমি জানো, বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা’র জন্ম কোন সালে ?’
নিলয় দা কিছুক্ষণ ভাবলেন। বললেন, -‘ভুলে গেছি রে ! বিসিএস এর জন্য যখন প্রিপারেশন নিচ্ছিলাম, তখন পড়েছিলাম।’
সাজিদ তার ফোন বের করে সেখান থেকে উইকিপিডিয়ার ‘বেগম ফজিলাতুন্নেসা’ লিখে সার্চ দিল। উইকিপিডিয়া রেজাল্ট দেখাল, বেগম ফজিলাতুন্নেসার ১৯৩০ সালে। সাজিদ সেটা নিলয় দা’কে দেখালো।
নিলয় দা বলল, -‘হুম, মনে পড়েছে। কিন্তু তাতে কি হয়েছে? হঠাৎ এই ব্যাপারে চলে গেলি কেন?’
সাজিদ বলল, -‘দাদা, তুমি জানো, বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা’র সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কত সালে বিয়ে হয়?
নিলয়দা ‘না’ সুচক মাথা নাড়ল। সাজিদ আবার উইকি থেকে দেখলো। বঙ্গবন্ধুর সাথে বেগম ফজিলাতুন্নেছা’র বিয়ে হয় ১৯৩৮ সালে।
সাজিদ বলল। -‘দাদা, ১৯৩৮ থেকে ১৯৩০ বাদ দিলে কত থাকে?’
নিলয় দা বলল, -‘জি দাদা, একদম ঠিক বলেছ। ১৯৩৮ থেকে ১৯৩০ বাদ দিলে থাকে ৮ বছর। ঠিক ৮ বছর বয়সের বেগম ফজিলাতুন্নেসার সাথে বঙ্গবন্ধুর বিয়ে হয়। আচ্ছা দাদা, আমি কি এটাকে বাল্যবিবাহ বলতে পারব? বলতে পারব, শেখ মুজিব একজন যৌনকাতর পুরুষ ছিলেন যার ফলে তিনি মাত্র ৮ বছর বয়সের ফজিলাতুন্নেসাকে বিয়ে করেছেন? আমি এরকম বললে আমার বিরুদ্ধে কি মামলা হওয়া উচিত দাদা?
বলতো, একবিংশ শতাব্দীর শেখ মুজিবুর রহমান যেটা পেরেছেন, মাত্র ৮ বছর বয়সী একজন কিশোরীকে বিয়ে করে এতগুলো সন্তান জন্ম দিতে পারলে ১৫০০ বছর আগের মোহাম্মদ সা. কেন পারবে না? কেন তাকে ধর্ষক, যৌন কাতর, যৌন লিপ্সু ডাকা হবে? তাকে এবং আয়েশা রা. কে নিয়ে অশ্লীল কথা লিখে কেউ আইনের জালে ফাঁসলে তার জন্য কেন তোমার মন কাঁদবে যেখানে তুমি শেখ মুজিবের জন্য তৈরি করে রেখেছে সাইবার আইন।’
আকাশ থেকে পড়লে যা হয়, নিলয় দা’র অবস্থাও তখন তেমন। নিলয় দা এরকম একটা জবাব পাবেন তা হয়তো কল্পনাও করেননি।
-চায়ের বিল দেওয়ার জন্য সাজিদ এগিয়ে গেল। গম্ভীর, রাজনীতিপ্রিয় রাকিব এসে বলল, -‘দোস্ত, পরানটা ঠান্ডা করে দিয়েছিস একদম। বিলটা আমাকে দিতে দে, প্লিজ?’
সাজিদ মুচকি হাসলো।
রেফারেন্সঃ
1/ Jala-Ul Afhaam by Imam Ibnul Qaiyum
2/ Sahih Al bukhari, Volume 5, book 58, hadith 234
3/ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ –শেখ মুজিবুর রহমান
4/ Wikipedia
বিঃদ্রঃ (শেখ মুজিব বা উনার স্ত্রীকে প্রশ্নবিদ্ধ করা আমার মোটিভ নয়। একটি যুক্তির খাতিরে উনাকে উদাহরণ হিসেবে তানা হয়েছে। কেউ এটাকে পলিটিক্যালি বা পারসোনাল এ্যাটাক মনে করে ভুল করবেন না। )
শূন্যস্থান থেকে স্রষ্টার দূরত্ব
সাজিদের কাছে একটি মেইল এসেছে সকালবেলা। মেইলটি পাঠিয়েছে তার নাস্তিক বিপ্লব ধর। বিপ্লব দা’কে আমিও চিনি। সদা হাস্য এই লোকটার মাঝে মাঝেই টি.এস.সিতে দেখা হতো। দেখা হলেই উনি একটি হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করতেন, ‘তুই কি এখন রাতের বেলা ভুত দেখিস?’
বিপ্লব দা মনে হয় হাসিটি প্রস্তুত করেই রাখতো। দেখা হওয়া মাত্রই প্রদর্শন। বিপ্লব দা’কে চিনতাম সাজিদের মাধ্যমে। সাজিদ আর বিপ্লব দা একই ডিপার্টমেন্টের। বিপ্লব দা সাজিদের চেয়ে দু ব্যাচ সিনিয়র।
সাজিদ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে যে প্রথম নাস্তিক হয়ে গিয়েছিলো, তার পুরো ক্রেডিটটাই বিপ্লব দা’র। বিপ্লব দা তাকে বিভিন্ন নাস্তিক, এগনোষ্টিকদের বই-টই পড়িয়ে নাস্তিক বানিয়ে ফেলেছিল। সাজিদ এখন আর নাস্তিক নেই।
আমি ক্লাশ শেষ করে রুমে ডুকে দেখলাম সাজিদ বরাবরের মতোই কম্পিউটার গুতাচ্ছে।
আমাকে দেখা মাত্রই বলল, ‘তোর দাওয়াত আছে।’
-‘কোথায়?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
সাজিদ বলল, -‘বিপ্লব দা দেখা করতে বলেছেন।’
আমার সাথে উনার কোন লেনদেন নেই। আমাকে এভাবে দেখা করার হেতু কি বুঝলাম না। সাজিদ বলল, ‘ঘাবড়ে গেলি নাকি? তোকে একা না আমাকেও।’
এই বলে সাজিদ দা’র মেইলটি ওপেনকরে দেখাল। মেইলটি হুবহু এরকম, –
‘সাজিদ
আমি তোমাকে একজন প্রগতিশীল, উদারমন সম্পন্ন, মুক্তমনা ভাবতাম। পড়াশুনা করে তুমি কথিত ধর্মীয় গোঁড়ামি আর অন্ধ বিশ্বাস থেকে বেরিয়ে এসেছিলে। কিন্তু তুমি যে আবার সি অন্ধ বিশ্বাসের জগতে ফিরে যাবে – সেটা কল্পনাও করি নি আমি। আজ বিকেলে বাসায় এসো। তোমার সাথে আলাপ আছে।’
আমরা খাওয়া দাওয়া করে, দুপুরের নামাজ পড়ে বিপ্লব দা’র সাথে করার জন্য বের হলাম। বিপ্লব দা আগে থাকতেন বনানী, এখন থাকেন কাঁটাবন। জ্যাম ট্যাম কাটিয়ে আমরা যখন বিপ্লব দা’র বাসায় পৌছাই, তখন আসরের ওয়াক্ত হয়ে গেছে। বিপ্লব দা’র সাথে হ্যান্ডসেক করে আমরা বসলাম না। সাজিদ বলল, ‘দাদা আলাপ একটু পরে হবে। আসরের নামাজটা পড়ে আসি আগে।’
বিপ্লব দা না করলেন না। আমরা বেরিয়ে গেলাম। পার্শ্ববর্তী মসজিদে আসরের নামাজ পড়ে ব্যাক করলাম উনার বাসায়।
বিপ্লব দা ইতিমধ্যেই কফি তৈরি করে রেখেছেন। খুবই উন্নতমানের কফি। কফির গন্ধটা পুরো ঘরময় ছড়িয়ে পড়ল মুহূর্তেই। সাজিদ কফি হাতে নিতে নিতে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘বিপ্লব দা’র এর কফি বিশ্ববিখ্যাত। ভূ-মধ্য সাগরীয় অঞ্চলের কফি। এইটা কানাডা ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না। বিপ্লব দা কানাডা থেকে অর্ডার করিয়ে আনেন।’
কফির কাপে চুমুক দিয়ে মনে হল আসলেই সত্যি। এত ভালো কফি হতে পারে ভাবাই যায় না।
সাজিদ এবার বিপ্লব দা’র দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আলাপ শুরু হোক।’
বিপ্লব দা’র মুখে সদা হাসি ভাবটা আজকে নেই। উনার পরম শিষ্যের এরকম অধঃপতনে সম্ভবত উনার মন কিছুটা বিষণ্ণ। তিনি বললেন, ‘তোমার সিদ্ধান্তের প্রতি আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধা আছে। তবে, তোমাকে একটি বিষয়ে বলার জন্যই আসতে বলেছি। হয়তো তুমি ব্যাপারটি জেনে থাকবে -তবুও।’
সাজিদ কফির কাজে চুমুক দিয়ে বলল, ‘জানা বিষয়টাও আপনার মুখ থেকে শুনলে মনে হয় নতুন জানছি। আমি আপনাকে কতটা পছন্দ করি তা তো আপনি জানেনই।’
বিপ্লব দা কোন ভুমিকায় গেলেন না। সরাসরি বললেন, ‘ওই যে, তোমার সৃষ্টিকর্তা, উনার ব্যাপারে বলতে চাই। তুমি বিজ্ঞানের ছাত্র, তুমি হয়তো এ ব্যাপারে জানো। সম্প্রতি বিজ্ঞান প্রমান করেছে, এই মহাবিশ্ব সৃষ্টিকর্তার কোন দরকার নেই। মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে শূন্য থেকেই। আগে তোমরা, মানে বিশ্বাসীর বলতে, একটা সামান্য সূচও যখন কোন কারিগর ছাড়া এমনি এমনি তৈরি হতে পারে না, তাহলে এই গোটা মহাবিশ্ব কিভাবে তৈরি হবে আপনা আপনি? কিন্তু বিজ্ঞান এখন বলছে, এই মহাবিশ্ব শূন্য থেকে আপনা আপনিই তৈরি হয়েছে। কারো সাহায্য ছাড়াই।’
এই কথাগুলো বিপ্লব দা এক নাগাড়ে বলে গেলেন। মনে হয় তিনি কোন নিঃশ্বাসই নেন নি এতক্ষন।
সাজিদ বলল, ‘অদ্ভুত তো। তাহলে তো আমাকে নাস্তিক হয়ে যেতে হবে দেখছি। হা হা হা হা।’
সাজিদ চমৎকার একটা হাসি দিল। সাজিদ এইভাবে হাসতে পারে, তা আমি আজই প্রথম দেখলাম। বিপ্লব দা সেদিকে মনোযোগ দিয়েছেন বলে মনে হল না। উনি মোটামুটি একটা লেকচার শুরু করেছেন। আমি আর সাজিদ খুব মনযোগী ছাত্রের মতো উনার বৈজ্ঞানিক কথাবার্তা শুনছিলাম। তিনি যা বুঝালেন, বাঁ বললেন, তার সার সংক্ষেপ এরকম।
‘পদার্থ বিজ্ঞানে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স। এই কোয়ান্টাম মেকানিক্সে একটি থিউরি আছে, সেটি হল, কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন। এই কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের মুল কথা হল, মহাবিশ্বে পরম শূন্য স্থান বলে আদতে কিছু নেই। মানে, আমরা যেটাকে Nothing বলে জেনে এসেছি, বিজ্ঞান বলছে, আদতে Nothing বলতে কিছুই নেই। প্রকৃতি শূন্য স্থান পছন্দ করে না। তাই যখন কোন শূন্যস্থান (Nothing) তৈরি হয়, সেখানে এক সেকেন্ডের বিলিয়ন ভাগের এক ভাগ সময়ের মধ্যে কনা এবং প্রতিকনা (Matter & anti-matter) তৈরি হচ্ছে, এবং একটির সাথে অন্যটির ঘর্ষণে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
তোমরা জান কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের ধারনা কোথা হতে এসেছে?’
আমি বললাম, ‘না।’
বিপ্লব দা আবার বলতে শুরু করলেন, ‘এই ধারণা এসেছে হাইজেনবার্গের বিখ্যাত ‘অনিশ্চয়তা নীতি’ থেকে। হাইজেনবার্গের সেই বিখ্যাত সূত্রটা তোমরা জানো নিশ্চয়ই?’ সাজিদ বলল, ‘হ্যাঁ, হাইজেনবার্গ বলেছেন, আমরা কখনও একটি কনার অবস্থান এবং এর ভরবেগের সঠিক পরিমান একসাথে একুরেইটলি জানতে পারব না। যদি অবস্থান সঠিকভাবে জানতে পারি, তাহলে এর ভরবেগের মধ্যে গলদ থাকবে। আবার যদি ভরবেগ সঠিকভাবে জানতে পারি, তাহলে এর অবস্থানের মধ্যে গলদ থাকবে। দুটো একসাথেই সঠিকভাবে জানা কখনই সম্ভব না। এইটা যে সম্ভব না, এটা বিজ্ঞানের অসারতা না, আসলে এটা হল কনার ধর্ম বাঁ বৈশিষ্ট্য।’
বিপ্লব দা বললেন, ‘এক্সাক্টলি। একদম তাই। হাইজেনবার্গের এই নীতিকে শক্তি আর সময়ের ক্ষেত্রে ব্যাবহার করা যায়। হাইজেনবার্গের এই নীতি যদি সত্যি হয়, তাহলে মহাবিশ্বে ‘শূন্যস্থান’ বলে কিছু থাকতে পারেনা। যদি থাকে, তাহলে তার অবস্থান ও ভরবেগ দুটোই শূন্য চলে আসে, যা হাইজেনবার্গের নীতি বিরুদ্ধ।’
এইটুকু বলে বিপ্লব দা একটু থামল। কফির পট থেকে কফি ঢালতে ঢালতে বললেন, ‘বুঝতেছ তোমরা?’
সাজিদ বুঝেছে কিনা জানিনা, তবে আমার কাছে ব্যাপারটি দুর্বোধ্য মনে হলেও, বিপ্লব দা’র উপস্থাপন ভঙ্গিমা সেটাকে অনেকটাই প্রাঞ্জল করে তুলেছে। ভালো লাগছে।
বিপ্লব দা কফিতে চুমুক দিলেন। এরপর আবার বলতে শুরু করলেন, ‘তাহলে তোমারা বলো না, যে বিগ ব্যাং এর আগে তো কিছুই ছিল না। না সময়, না শক্তি, না অন্যকিছু। তাহলে বিগ ব্যাং এর বিস্ফোরণটি হল কিভাবে? এর জন্য নিশ্চয়ই কোন শক্তি দরকার? কোন বাহ্যিক বল দরকার, তাই না? এটাই বলে তোমরা স্রষ্টার ধারণাকে জায়েজ করতে। তোমরা বলতে, এই বাহ্যিক বলটি এসেছে স্রষ্টার কাছ থেকে। কিন্তু দেখ, বিজ্ঞান বলছে, এইখানে স্রষ্টার কোন হাত নেই। বিগ ব্যাং হবার জন্য যে শক্তি দরকার ছিল, সেটা এসেছে এই কোয়ান্টাম ফ্লায়েকচুয়েশন থেকে। সুতরাং, মহাবিশ্ব তৈরিতে স্রষ্টার অস্তিত্বকে বিজ্ঞান ডাইরেক্ট না বলে দিয়েছে। আর, তোমরা এখন স্রষ্টা স্রষ্টা করে কোথায় যে পরে আছ।’
এতটুকু বলে বিপ্লব দা’র চোখ মুখ ঝলমলিয়ে উঠলো। মনে হচ্ছে, উনি যে উদ্দেশ্যে আমাদেরকে এখানে ডেকেছেন তা সফল হয়ে গেছে। আমরা হয়তো উনার বিজ্ঞানের উপর এই জ্ঞান গর্ভ লেকচার শুনে এক্ষুনি নাস্তিকতার উপর ঈমান নিয়ে আসব।
যাহোক, ইতিমধ্যে সাজিদ দু কাপ কফি গিলে ফেলেছে। নতুন এক কাপ ঢালতে ঢালতে বলল, ‘এই ব্যাপারে স্টিফেন হকিংয়ের বই আছে। নাম -‘The grand design’। এটা আমি পরেছি।’
সাজিদের কথা শুনে বিপ্লব দা’কে খুব খুশি মনে হল। তিনি বললেন, ‘বাহ, তুমি তাহলে পড়াশুনা স্টপ করনি? বেশ বেশ। পড়াশুনা করবে। বেশি বেশি পড়বে।’
সাজিদ হাসল। হেসে সে বলল, ‘কিন্তু দাদা, এই ব্যাপারে আমার কনফিউশান আছে।’
-‘কোন ব্যাপারে?’
-‘ষ্টিফেন হকিং আর লিওনার্ড ম্লোদিনোর বই The grand design এর ব্যাপারে।’
বিপ্লব দা একটু থতমত খেলো বলে মনে হল। মনে হয় উনি মনে মনে বলছে – এই ছেলে দেখি খোদার উপর খোদাগিরি করছে।
তিনি বলল, -‘ক্লিয়ার করো।’
সাজিদ বলল, -‘আমি দুইটা দিক থেকেই এটার ব্যাখ্যা করবো। বিজ্ঞান এবং ধর্ম।
যদি অনুমতি দেন।’
-‘অবশ্যই।’ বিপ্লব দা বললেন।
আমি মুগ্ধ শ্রোতা। গুরু এবং এক্স-শিষ্যের তর্ক জমে উঠেছে।
সাজিদ বলল, ‘প্রথমে কথা হচ্ছে, ষ্টিফেন হকিং এর এই থিওরিটা এখনো ‘থিওরি’, সেটা ফ্যাক্ট নয়। এই ব্যাপারে প্রথম কথা বলেন বিজ্ঞানী লরেন্স ক্রাউস। তিনি এইটা নিয়ে বিশাল সাইজের বই লিখেছেন। বইটার নাম ছিল ‘A universe from nothing’
অনেক পরে, এখন ষ্টিফেন এটা নিয়ে উনার The grand design এ কথা বলেছেন। উনার এই বইটি প্রকাশ হবার পর সি এন এনের এক সাংবাদিক হকিংকে জিজ্ঞেস করেছিলো, -‘আপনি কি ইসসরে বিশ্বাস করেন?’
হকিং বলেছিল, -‘ঈশ্বর থাকলেও থাকতে পারে, তবে, মহাবিশ্ব তৈরিতে তার প্রয়োজন নেই।’
বিপ্লব দা বলল, ‘সেটাই, উনি বুঝালেন যে, ঈশ্বর মূলত ধার্মিকদের একটি অকার্যকর বিশ্বাস।’
-‘হকিং কি বুঝিয়েছেন জানি না, কিন্তু হকিংয়ের ওই বইটি অসম্পূর্ণ। কিছু গলদ আছে।’
বিপ্লব দা কফির কাপটি রাখতে রাখতে বললেন, ‘গলদ? মানে?’
– ‘দাঁড়ান, বলছি। গলদ মানে, উনি কিছু বিষয় বইতে ক্লিয়ার করেন নি। যেহেতু এটা বিজ্ঞান মহলে প্রমানিত সত্য নয়, তাই এটা বিজ্ঞান মহলে প্রচুর বিতর্কিত হয়েছে।
উনার বইতে যে গলদগুলো আছে তা সিরিয়ালি বলছি।
গলদ নাম্বার ১ –
হকিং বলছেন, শূন্য থেকেই কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের মাধ্যমে বস্তু কনা তৈরি হয়েছে, এবং সেটা মহাকর্ষ বলের মাধ্যমে নিউট্রালাইজ হয়েছে।
এখানে প্রশ্ন হল, শূন্য বলতে হকিং কি একদম Nothing (কোন কিছুই নেই) বুঝিয়েছেন, নাকি Quantum vaccum (বস্তুর অনুপস্থিতি) বুঝিয়েছেন সেটা ক্লিয়ার করেন নি। হকিং বলেছেন, শূন্যস্থানের বস্তু কনার মাঝে কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন হতে হলে সেখানে মহাকর্ষ বল প্রয়োজন। কিন্তু ওই শূন্যস্থানে (যখন সময় আর স্থানও তৈরি হয় নি) ঠিক কোথা থেকে এবং কিভাবে মহাকর্ষ বল এলো, তার কোন ব্যাখ্যা হকিং দেয় নি।
গলদ নাম্বার – ২
হকিং তার বইতে বলেছেন, মহাবিশ্ব তৈরি হয়েছে একদম শূন্য থেকে, কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের মাধ্যমে। তখন ‘সময়’ (Time) এর আচরন আজকের সময়ের মতো ছিল না। তখন সময়ের আচরন ছিল ‘স্থান’ (Space) এর মতো। কারন, এই ফ্ল্যাকচুয়েশন হবার জন্য প্রাথমিকভাবে সময়ের দরকার ছিল না, স্থানের দরকার ছিল। কিন্তু হকিং তার বইতে এই কথা বলেন নি যে, যে সময় মহাবিশ্বের একদম শুরুতে ‘স্থান’ এর মতো আচরন করেছে, সেই ‘সময়’ পরবর্তীতে ঠিক কবে আর কখন থেকে আবার Time এর মতো আচরন শুরু করলো এবং কেন?’
আমি বিপ্লব দা’র মুখের দিকে তাকালাম। তার চেহারার উৎফুল্ল ভাবটা চলে গেছে।
সাজিদ বলে যাচ্ছে,
‘গলদ নাম্বার – ৩
পদার্থ বিদ্যার যে সুত্র মেনে কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন হয়ে মহাবিশ্ব তৈরি হল, তখন শূন্যবস্থায় পদার্থবিদ্যার এই সুত্রগুলো বলবত থাকে কি করে? এটার ব্যাখ্যা হকিং দেয় নি।
গলদ নাম্বার – ৪
আপনি বলেছেন, প্রকৃতি শূন্যস্থান পছন্দ করে না। তাই, শূন্যস্থান পুরন করতে আপনা আপনি কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন হয়ে মহাবিশ্ব তৈরি হয়েছে। আমার প্রশ্ন হল – যেখানে আপনি শূন্যস্থান নিয়ে কথা বলছেন, যখন সময় ছিল না, স্থান ছিল না, তখন আপনি প্রকৃতি কোথায় পেলেন?’
সাজিদ হকিংয়ের বইয়ের পাচ নাম্বার গলদের কথা বলতে যাচ্ছিলো। তাকে থামিয়ে দিয়ে বিপ্লব দা বললেন, ‘ওকে ওকে। বুঝলাম। আমি বলছি না যে এই জিনিসটা একেবারে সত্যি। এটা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হবে। আলোচনা-সমালোচনা হবে। আরো পরিক্ষা নিরিক্ষা হবে। তারপর ডিসাইড হবে যে এটা ঠিক না ভুল।’
সাজিদের কাছে বিপ্লব দা’র এরকম মৌন পরাজয় আমাকে খুব তৃপ্তি দিল। মনে মনে বললাম, ‘ইয়েস সাজিদ, ইউ ক্যান।’
সাজিদ বলল, -‘হ্যাঁ, সে পরিক্ষা চলতে থাকুক। যদি কোন দিন এই থিওরি সত্যিও হয়ে যায়, তাহলে আমাকে ডাক দিয়েন না দাদা। কারন, আমি কোরআন দিয়েই প্রমান করে দিতে পারব।’
সাজিদের এ কথা শুনে আমার হেঁচকি উঠে গেল। কি বলে রে? এতক্ষন যেটাকে গলদপূর্ণ বলেছে, সেটাকে আবার কোরআন দিয়ে প্রমান করবে বলছে? ক্যামনে কি?
বিপ্লব দা’ও বুঝলোনা। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি রকম?’
সাজিদ হাসল। বলল, -‘শূন্য থেকেই মহাবিশ্ব সৃষ্টির কথা আল কোরআনে বলা আছে দাদা।’
আমি আরো অবাক। কি বলে এই ছেলে?
সে বলল, ‘আমি বলছি না যে কোরআন কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের কথাই বলছে। কোরআন যার কাছ থেকে এসেছে, তিনি তার সৃষ্টি জগতের সৃষ্টির ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এখন সেটা বিগ ব্যাং আসলেও পাল্টাবে না, কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন থিওরি আসলেও পাল্টাবে না। একই থাকবে।’
বিপ্লব দা বলল, ‘কোরআনে কি আছে বললে যেন?’
-‘সূরা বাকারার ১১৭ নাম্বার আয়াতে আছে –
“যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে আনায়ন করেন (এখানে মূল শব্দ ‘বাদ্যিয়ূ’ Originator- সেখান থেকেই অস্তিত্ব-অনস্তিত্বের ধারণা) এবং যখন তিনি কিছু করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন তখন শুধু বলেন হও, আর তা হয়ে যায়। ”
‘Creator of heavens and earth from nothingness, He has only to say when he is wills a thing, “Be” and it is’…
দেখুন আমি আবার বলছি, আমি এটা বলছি না যে, আল্লাহ তায়ালা এখানে কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের কথাই বলছেন। তিনি তার সৃষ্টির কথা বলেছেন। তিনি ‘অনস্তিত্ব’ (Nothing) থেকে ‘অস্তিত্বে’ (something) এ এনেছেন। এমন না যে, আল্লাহ তার হাত দিয়ে প্রথম মহাবিশ্বের ছাদ বানালেন। তারপর তাতে সূর্য, চাঁদ, গ্যালাক্সি এগুলো একটা একটা বসিয়ে দিয়েছেন। তিনি কেবল নির্দেশ দিয়েছেন।
হকিংও একই কথা বলেছে। কিন্তু তারা বলছে বলছে, এটা এমনি এমনি হয়ে গেছে, শূন্য থেকেই। আল্লাহ বলছেন, নাহ এমনি হয় নি। আমি যখন নির্দেশ করেছি ‘হও’ (কুন), তখন তা হয়ে গেল।
হকিং ব্যাখ্যা দিতে পারছে না এই কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের জন্য মহাকর্ষ বল কোথা থেকে এল, ‘সময়’ কেন, কিভাবে ‘স্থান’ হল, পরে আবার সেটা ‘সময়’ হল।
কিন্তু আমাদের স্রষ্টা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন ‘হতে’ আর তা হয়ে গেল।
ধরুন, একটা ম্যাজিশিয়ান ম্যাজিক দেখাচ্ছে। ম্যাজিশিয়ান বসে আছে স্টেজের এক কোনায়। কিন্তু সে তার চোখের ইশারায় ম্যাজিক দেখাচ্ছে। দর্শক দেখছে, খালি টেবিলের উপর হঠাত একটা কবতর তৈরি হয়ে গেল, এবং সেটা উড়েও গেল।
দর্শক কি বলবে এটা কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের মাধ্যমে হয়ে গেছে? না, বলবে না। এর পিছনে ম্যাজিশিয়ানের কারসাজি আছে। সে স্টেজের এক কোনা থেকে চোখ দিয়ে ইশারা করেছে বলেই এটা হয়েছে।
স্রষ্টাও সেরকম। তিনি শুধু বলেছেন, ‘হও’, আর মহাবিশ্ব আপনা আপনি হয়ে গেলো। ….
আপনাদের সেই শূন্যস্থান থেকে স্রষ্টার দূরত্ব কেবল ওই ‘হও’ পর্যন্তই।’
মাগরিবের আজান পড়তে শুরু করেছে। বিপ্লব দা’কে অনেকটাই হতাশ দেখলাম।
আমরা বললাম, ‘আজ তাহলে উঠি।’
উনি একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘এসো।’
আমরা বেরিয়ে পরলাম। আমি অবাক হয়ে সাজিদের দিকে তাকিয়ে আছি। কে বলবে এই ছেলেটা গত ছ’মাস আগেও নাস্তিক ছিল। নিজের গুরুকেই কিরকম কুপোকাত করে দিয়ে আসলো। কোরআনের সূরা বাকারার ১১৭ নাম্বার আয়াতটি কত হাজার বার পড়েছি, কিন্তু এভাবে কোনদিন ভাবিনি। আজকে এটা সাজিদ যখন বিপ্লব দা কে বুঝাচ্ছে, মনে হচ্ছে আজকেই নতুন শুনছি এই আয়াতের কথা। গর্ব হতে লাগলো আমার।
স্রষ্টা কি এমন কিছু বানাতে পারবে যেটা স্রষ্টা নিজে তুলতে পারবে না
স্রষ্টা কি এমন কিছু বানাতে পারবে যেটা স্রষ্টা নিজে তুলতে পারবে না
ছুটির দিনে সারা দিন রুমে বসে থাকা ছাড়া আমার আর কোন কাজ থাকেনা। সপ্তাহের এই দিনটি অন্য সবার কাছে ঈদের মতো মনে হলেও আমার কাছে এই দিনটি খুবই বিরক্তিকর। ক্লাশ, ক্যাম্পাস, আড্ডা এসব স্তিমিত হয়ে যায়।
এই দিনটি আমি রুমে শুয়ে-বসে, ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলেও, সাজিদ এই দিনের পুরোটা সময় লাইব্রেরীতে কাটিয়ে দেয়। লাইব্রেরীতে ঘুরে ঘুরে নানান বিষয়ের উপর বই নিয়ে আসে।
আজ সকালেও সে বেরিয়ে গেছে লাইব্রেরির উদ্দেশ্যে। ফিরবে জুমার আগে। হাতে থাকবে একগাদা মোটা মোটা বই।
বাসায় আমি একা ভাবলাম একটু ঘুমাব। অনেক রাত পর্যন্ত বসে বসে অ্যাসাইনমেন্ট রেডি করেছি। চোখদুটো জবা ফুলের মতো টকটকে লাল হয়ে আছে। আমি হাই তুলতে তুলতে যেই ঘুমোতে যাবো, অমনি দরজার দিকে থেকে কেউ একজনের কাশির শব্দ কানে এলো।
ঘাড় ঘুরিয়ে সে দিকে তাকাতেই দেখলাম, একজন বড় বড় চোখ চশমার ভেতর দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আগাগোড়া চোখ বুলিয়ে নিলাম। পরনে শার্ট-প্যান্ট, চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। লোকটার চেহারায় সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত ‘ফেলুদা’ চরিত্রের কিছুটা ভাব আছে। লোকটা আমার চোখাচোখি হতেই পিক করে হেসে দিল। এরপর বললো, -‘এটা কি সাজিদের বাসা?’
প্রশ্নটা আমার গায়ে লাগলো। সাজিদ কি বাইরের সবাইকে এটাকে নিজের একার বাসা বলে বেড়ায় নাকি? এই বাসার যা ভাড়া, তা সাজিদ আর আমি সমান ভাগ করে পরিশোধ করি। তাহলে চুক্তি মতে বাসাটা তো আমারও।
লোকটা যতটা উৎসাহ নিয়ে প্রশ্ন করেছে, তার দ্বিগুন উৎসাহ নিয়ে আমি বললাম, -‘এটা সাজিদ আর আমার দু জনেরই বাসা।’
লোকটা আমার উত্তর শুনে আবারো পিক করে হেসে দিল। ততক্ষনে লোকটা ভিতরে চলে এসেছে।
সাজিদকে খুঁজতে এরকম প্র্যায়ই অনেকেই আসে। সাজিদ রাজনীতি না করলেও, নানারকম স্বেচ্ছাসেবী মূলক সংগঠনের সাথে যুক্ত আছে।
লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, -‘সাজিদ মনে হয় ঘরে নেই, না?’
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, -‘জি না। বই আনতে গেছে। অপেক্ষা করুন, চলে আসবে।’
লোকটাকে সাজিদের চেয়ারটা টেনে বসতে দিলাম। তিনি বললেন, -‘তোমার নাম?’
-‘আরিফ।’
-‘কোথায় পড়ো?’
-‘ঢাবি তে।’
-‘কোন ডিপার্টমেন্ট?’
-‘জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং’
লোকটা খুব করে আমার প্রশংসা করলো। এরপর বলল, -‘আমি প্রথম ভেবেছিলাম তুমিই সাজিদ।’
লোকটার কথা শুনে আমার ছ নম্বার হাঁইটা মুহূর্তেই মুখ থেকে গায়েব হয়ে গেল। ব্যাপারটা কি? এই লোক কি সাজিদ কে চিনে না?
আমি বললাম, -‘আপনি সাজিদের পরিচিত নন?’
-‘না।’
-‘তাহলে?’
লোকটা একটু ইতঃস্তত বোধ করলো মনে হচ্ছে। এরপর বলল, -‘আসলে আমি একটি প্রশ্ন নিয়ে এসেছি সাজিদের কাছে। প্রশ্নটি আমাকে করেছিল একজন নাস্তিক। আমি আসলে কারো কাছে এটার কোনো সন্তোষজনক উত্তর পাইনি, তাই।’
আমি মনে মনে বললাম, -‘বাবা সাজিদ, তুমি তো দেখি এখন সক্রেটিস বনে গেছো।
পাবলিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে তোমার দ্বারস্থ হয়।’
লোকটার চেহারায় একটি গম্ভীর ভাব আছে। দেখলেই মনে হয় এই লোক অনেক কিছু জানে, বোঝে। কিন্তু কি এমন প্রশ্ন, যেটার জন্য কোন ফেয়ার এন্সার উনি পাচ্ছেন না?
কৌতুহল বাড়লো।
আমি মুখে এমন একটি ভাব আনলাম, যেন আমিও সাজিদের চেয়ে কোনো অংশে কম নযই। বরং তার চেয়ে কয়েক কাঠি সরেশ। এরপর বললাম, -‘আচ্ছা, কি সেই প্রশ্ন?’
লোকটা আমার অভিনয়ে বিভ্রান্ত হলো। হয়তো ভাবলো, আমি সত্যিই ভালো কোন উত্তর দিতে পারবো।
বললো, -‘খুবই ক্রিটিক্যাল প্রশ্ন। স্রষ্টা সম্পর্কিত।’
আমি মনে মনে তখনি প্রায় লেজেগোবরে অবস্থা। কিন্তু মুখে বললাম, -‘প্রশ্ন যে খুবই ক্রিটিক্যাল, সেটা তো বুঝেছি। নইলে ঢাকা শহরে এই জ্যাম-ট্যাম মাড়িয়ে কেউ এত কষ্ট করে এখানে আসে?’
আমার কথায় লোকটা আবারো বিভ্রান্ত হল এবং আমাকে ভরসা করলো। এরপর আমাকে বলল, -‘আগেই বলে নিই, প্রশ্নের উত্তর ‘হ্যাঁ/না’ হতে হবে।’
-‘আপনি আগে প্রশ্ন করুন, তারপর উত্তর কি হবে দেখা যাবে’ -আমি বললাম।
-‘প্রশ্নটা হচ্ছে- স্রষ্টা কী এমন কোন কিছু বানাতে পারবে, যেটা স্রষ্টা উঠাতে পারবে না?’
আমি বললাম, -‘আরে, এ তো খুবই সহজ প্রশ্ন। হ্যাঁ বলে দিলেই তো হয়। ল্যাটা চুকে যায়।’
লোকটা হাসল। মনে হল, আমার সম্পর্কে ওনার ধারনা পাল্টে গেছে। এই মুহূর্তে উনি আমাকে গবেট, মাথামোটা টাইপ কিছু ভাবছেন হয়তো।
আমি বললাম, -‘হাসলেন কেন? ভুল বলেছি?’
লোকটা কিছু না বলে আবার হাসল। এবার লোকটা হাসি দেখে আমি নিজেই বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম। প্রশ্নটা আবার মনে করতে লাগলাম।
স্রষ্টা কি এমন কোনো কিছু বানাতে পারবে, যেটা স্রষ্টা উঠাতে পারবে না।
আবার চিন্তা করতে লাগলাম। উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয়, তাহলে ধরে নিচ্ছি যে, জিনিসটা বানাতে পারলেও সেটা তুলতে পারবে না। আরে এটা কিভাবে সম্ভব? স্রষ্টা পারেনা এমন কোন কাজ আছে নাকি আবার? আর, একটা জিনিস উঠানো কি এমন কঠিন কাজ যে স্রষ্টা সেটা পারবে না?
আবার চিন্তা করতে লাগলাম। উত্তর যদি ‘না’ হয়, তাহলে ধরে নিচ্ছি যে- স্রষ্টা জিনিসটা উঠাতে পারলেও বানাতে পারবে না।
ও আল্লাহ ! কি বিপদ ! স্রষ্টা বানাতে পারবে না এটা কিভাবে সম্ভব? হ্যাঁ বললেও আটকে যাচ্ছি, না বললেও আটকে যাচ্ছি।
লোকটা আমার চেহারার অস্থিরতা ধরে ফেলেছে। মুচকি মুচকি হাসতে শুরু করলো। আমি ভাবছি তো, ভাবছিই।
এর একটু পরে সাজিদ এলো। সে আসার পরে লোকটার সাথে তার প্রাথমিক আলাপ শেষ হলো। এর মাঝে লোকটা সাজিদকে বলে দিয়েছে যে, আমি প্রশ্নটার প্যাঁচে কিরকম নাকানী-চুবানী খেলাম, সেটা। সাজিদ আমার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ হেসে নিল।
এরপর সাজিদ তার খাটে বসলো। হাতে কি কাগজের ঠোঙার মধ্যে বুট ভাজা। বাইরে থেকে কিনে এনেছে। সে বুটের ঠোঙ্গাটা লোকটার দিকে ধরে বলল, -‘নিন, এখনও গরম আছে।’
লোকটা প্রত্যাখ্যান করতে চেয়েও করল না। কেন করলো না কে জানে।
লোকটি সাজিদকে এবার তার প্রশ্ন সম্পর্কে বলল। প্রশ্নটি হল-
‘স্রষ্টা কি এমন কিছু বানাতে পারবে, যেটা স্রষ্টা নিজেই তুলতে পারবে না?’
এই বলে লোকটা এবার প্রশ্নটিকে ভেঙ্গে বুঝিয়ে দিল। বলল, -‘দেখ, এই প্রশ্নের উত্তরে যদি ‘হ্যাঁ’ বলো, তাহলে তুমি ধরে নিচ্ছ যে, স্রষ্টা জিনিসটি বানাতে পারলেও তুলতে পারবে না। কিন্তু আমরা জানি স্রষ্টা সর্বশক্তিমান। কিন্তু, যদি স্রষ্টা জিনিসটি তুলতে না পারে, তিনি কি আর সর্বশক্তিমান থাকেন? থাকেন না।
যদি এই প্রশ্নের উত্তরে তুমি ‘না’ বলো, তাহলে তুমি স্বীকার করছ যে, সেরকম কোন জিনিস স্রষ্টা বানাতে পারবেন না যেটা তিনি তুলতে পারবেন। এখানেও স্রষ্টার ‘সর্বশক্তিমান’ গুণটি প্রশ্নবিদ্ধ। এই অবস্থায় তোমার উত্তর কি হবে?’
সাজিদ লোকটির প্রশ্নটি মন দিয়ে শুনল। প্রশ্ন শুনে তার মধ্যে তেমন কোন ভাব লক্ষ্য করিনি। নর্মাল।
সে বলল, -‘দেখুন সজীব ভাই, আমরা কথা বলবো লজিক দিয়ে, বুঝতে পেরেছেন?’
এরমধ্যে সাজিদ লোকটির নামও জেনে গেছে। কিন্তু এই বৃদ্ধ লোকটিকে সে ‘আঙ্কেল’ কিংবা ঢাকা শহরের নতুন রীতি অনুযায়ী ‘মামা’ না ডেকে ‘ভাই’ কেন ডাকলো? বুঝলাম না।
লোকটি মাথা নাড়ালো। সাজিদ বলল, -‘যে মুহূর্তে আমার যুক্তির শর্ত ভাঙবো, ঠিক সেই মুহূর্তে যুক্তি আর যুক্তি থাকবে না। যেটা তখন হবে কু যুক্তি। ইংরেজিতে বলে Logical Fallacy সেটা তখন আত্মবিরোধের জন্ম দিবে, বুঝেছেন?’
-‘হ্যাঁ’-লোকটা বলল।
-‘আপনি প্রশ্ন করেছেন স্রষ্টার শক্তি নিয়ে। তার মানে, প্রাথমিকভাবে আপনি ধরে নিলেন যে, একজন স্রষ্টা আছেন, রাইট?’
-‘হ্যাঁ’
-‘এখন স্রষ্টার একটি অন্যতম গুন হলো- তিনি অসীম, ঠিক না?’
-‘হ্যাঁ, ঠিক।’
-‘এখন আপনি বলছেন, স্রষ্টা এমন কিছু বানাতে পারবে কিনা, যেটা স্রষ্টা তুলতে পারবে না। দেখুন, আপনি নিজেই বলেছেন, এমনকিছু আই মিন Something, রাইট?’
-‘হ্যাঁ’
-‘আপনি ‘এমনকিছু’ বলে আসলে জিনিসটার একটা আকৃতি, শেইপ, আকার বুঝিয়েছেন, তাই না? যখনই Something ব্যবহার করেছেন, তখন মনে মনে সেটার একটা শেইপ আমরা চিন্তা করি, করি না?’
-‘হ্যাঁ, করি।’
-‘আমরা তো এমন কিছুকেই শেইপ বা আকার দিতে পারি, যেটা আসলে সসীম, ঠিক?’
-‘হ্যাঁ, ঠিক।’
-‘তাহলে এবার আপনার প্রশ্নে ফিরে যান। আপনি ধরে নিলেন যে স্রষ্টা আছে। স্রষ্টা থাকলে তিনি অবশ্যই অসীম। এরপর আপনি তাকে এমন কিছু বানাতে বলছেন, যেটা সসীম। যেটার নির্দিষ্ট একটা মাত্রা আছে, আকার আছে, আয়তন আছে। ঠিক না?’
-‘হ্যাঁ’
-‘পরে শর্ত দিলেন, তিনি সেটা তুলতে পারবে না। দেখুন, আপনার প্রশ্নের লজিকটাই ঠিক নেই। একজন অসীম সত্ত্বা একটি সসীম জিনিস তুলতে পারবে না, এটা তো পুরোটাই লজিকের বাইরে প্রশ্ন। খুবই হাস্যকর না? আমি যদি বলি, উইসান বোল্ট কোনদিনও দৌড়ে ৩ মিটার অতিক্রম করতে পারবেনা। সেটা কি হাস্যকর ধরনের যুক্তি নয়?’
সজিব নামের লোকটা এবার কিছু বললেন না। চুপ করে আছেন।
সাজিদ উঠে দাঁড়ালো। এরমধ্যেই বুট ভাঁজা শেষ হয়ে গেছে। সে বইয়ের তাকে কিছু বই রেখে আবার এসে নিজের জায়গায় বসল। এরপর আবার বলতে শুরু করল-
‘এর প্রশ্নটি করে মূলত আপনি স্রষ্টার ‘সর্বশক্তিমান’ গুণটাকে ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ করে প্রমাণ করতে চাইছেন যে, আসলে স্রষ্টা নেই।
আপনি ‘সর্বশক্তিমান’ টার্মটি দিয়ে বুঝাচ্ছেন, যে স্রষ্টা মানে এমন এক সত্ত্বা, যিনি যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন, রাইট?’
লোকটি বলল, -‘হ্যাঁ, স্রষ্টা মানেই তো এমন কেউ, কেউ যিনি যখন ইচ্ছা, তাই করতে পারেন।’
সাজিদ মুচকি হাসলো। বললো, -‘আসলে সর্বশক্তিমান মানে এই না যে, তিনি যখন যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। সর্বশক্তিমান মানে হল- তিনি নিয়মের মধ্যে থেকেই সবকিছু করতে পারেন। নিয়মের বাইরে গিয়ে তিনি কিছু করতে পারেন না। করতে পারেন না বলাটা ঠিক নয়, বলা উচিত তিনি করেন না। এর মানে এই না যে, তিনি সর্বশক্তিমান নন বা তিনি স্রষ্টা নন। এর মানে হল এই -কিছু জিনিস তিনি করেন না, এটাও কিন্তু তার স্রষ্টা হবার গুণাবলী। স্রষ্টা হচ্ছেন সকল নিয়মের নিয়ন্ত্রক। এখন তিনি নিজেই যদি নিয়মের বাইরের হন -ব্যাপারটি তখন ডাবলস্ট্যান্ড হয়ে যায়। স্রষ্টা এরকম নন। তার কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। তিনি সেই বৈশিষ্ট্যগুলো অতিক্রম করেন না। সেগুলো হলো তার মোরালিটি। এগুলো আছে বলেই তিনি স্রষ্টা, নাহলে তিনি স্রষ্টা থাকতেন না।
সাজিদের কথায় এবার আমি কিছুটা অবাক হলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম। -‘স্রষ্টা পারে না, এমন কি কাজ থাকতে পারে?’
সাজিদ আমার দিকে ফিরল। ফিরে বলল, -‘স্রষ্টা কি মিথ্যা কথা বলতে পারে? ওয়াদা ভঙ্গ করতে পারে? ঘুমাতে পারে? খেতে পারে?’
আমি বললাম, -‘আসলেই তো।’
সাজিদ বলল, -‘এগুলো স্রষ্টা পারে না বা করেন না। কারণ এগুলো স্রষ্টার গুণ এর সাথে কন্ট্রাডিক্টরি। কিন্তু এগুলো করে না বলে কি তিনি সর্বশক্তিমান নন? না। তিনি এগুলো করেন না কারন, এগুলো তার মোরালিটি সাথে যায় না।’
এবার লোকটি প্রশ্ন করল, -‘কিন্তু, এমন জিনিস তিনি বানাতে পারবেন না কেন, যেটাতে তিনি তুলতে পারবেন না?’
সাজিদ বলল, -‘কারন, স্রষ্টা যদি এমন জিনিস বানান, যেটা স্রষ্টা তিনি তুলতে পারবেন না- তবে জিনিসটাকে অবশ্যই তার চেয়েও বেশি শক্তিশালী হতে হবে। স্রষ্টা যে মুহূর্তে এরকম জিনিস বানাবেন, সে মুহূর্তেই তিনি স্রষ্টা হবার অধিকার হারাবেন। তখন স্রষ্টা হয়ে যাবে তার চেয়ে বেশি শক্তিশালী ঐ জিনিসটি। কিন্তু এটাতো স্রষ্টার নীতিবিরুদ্ধ। তিনি এটা কিভাবে করবেন?’
লোকটা বলল, -‘তাহলে এমন জিনিস কি থাকা উচিত নয়, যেটা স্রষ্টা বানাতে পারলেও, তুলতে পারবে না?’
-‘এমন জিনিস অবশ্যই থাকতে পারে, তবে যেটা থাকা উচিত নয়, তা হলো এমন প্রশ্ন।’
-‘কেন?’
এবার সাজিদ বলল, -‘যদি আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করি, নীল রঙের স্বাদ কেমন? কি বলবেন? বা, ৯ সংখ্যাটির ওজন কত মিলিগ্রাম, কি বলবেন?’
লোকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেলো মনে হল। বলল, -‘নীল রঙের আবার স্বাদ কি? ৯ সংখ্যাটির ওজনই হবে কি করে?’
সাজিদ হাসলো। বললো, -‘নীল রঙের স্বাদ কিংবা ৯ সংখ্যাটির ওজন আছে কি নেই তা পরের ব্যাপার। থকেতেও পারে, নাও থাকতে পারে। তবে যেটা থাকা উচিত নয় সেটা হল, নিল রং এবং নয় সংখ্যাকে নিয়ে এই ধরনের প্রশ্ন।’
সাজিদ বলল, -‘ফাইনালি আপনাকে একটি প্রশ্ন করি। আপনার কাছে দুটি অপশন। হয় ‘হ্যাঁ’ বলবেন, নয়তো ‘না’। আমি আবার বলছি, হয় ‘হ্যাঁ’ বলবেন নয়তো ‘না’।’
লোকটা বলল, -‘আচ্ছা।’
-‘আপনি কি আপনার বউকে পেটানো বন্ধ করেছেন?’
লোকটি কিছুক্ষণ চুপ মেরে চিল। এরপর বলল, -‘হ্যাঁ’
এরপর সাজিদ বলল, -‘তার মানে আপনি একসময় বউ পেটাতেন?’
লোকটা চোখ বড় বড় করে বলল, -‘আরে, না, না।’
এবার সাজিদ বলল, -‘হ্যাঁ না হলে কি? ‘না’?’
লোকটা এবার ‘না’ বলল।
সাজিদ হাসতে লাগলো। বলল, -‘তার মানে আপনি এখনো বউ পেটান?’
লোকটা এবার রেগে গেলো। বলল, -‘আপনি ফাউল প্রশ্ন করছেন। আমি কোনদিনও বউ পেটায় নি। এটা আমার নীতিবিরুদ্ধ।’
সাজিদ বলল, -‘আপনিও স্রষ্টাকে নিয়ে একি ফাউল প্রশ্ন করেছেন। এটা স্রষ্টার নীতিবিরুদ্ধ।
আমার প্রশ্নের উত্তরে আপনি যদি ‘হ্যাঁ’ বলেন, তাহলে স্বীকার করে নিচ্ছেন যে- আপনি একসময় বউ পেটাতেন। যদি ‘না’ বলেন, তাহলে স্বীকার করে নিচ্ছেন আপনি এখনো বউ পেটান। আপনি না ‘হ্যাঁ’ বলতে পারছেন, না পারছেন ‘না’ বলতে। কিন্তু, আদতে আপনি বউ পেটান না। এটা আপনার নীতিবিরুদ্ধ। সুতরাং, এমতাবস্তায় আপনাকে এরকম প্রশ্ন করাই উচিত না। এটা লজিকাল ফ্যালাসির মধ্যে পড়ে যায়। ঠিক সেরকম স্রষ্টাকে ঘিরেও এরকম প্রশ্ন থাকা উচিত নয়। কারণ, এই প্রশ্নটি নিজেই নিজের আত্মবিরোধী।
নীল রঙের স্বাদ কেমন, বা ৯ সংখ্যাটির ওজন কত মিলিগ্রাম, এরকম প্রশ্ন যেমন লজিকাল ফ্যালাসি এবং এই ধরনের প্রশ্ন যেমন থাকা উচিত নয়, তেমনি ‘স্রষ্টা’ এমনকিছু বানাতে পারবে কিনা যেটা স্রষ্টা উঠাতে পারবে না। এটাও একটা লজিকাল ফ্যালাসি। কু-যুক্তি। এরকম প্রশ্ন থাকা উচিত নয়।
সেদিন লোকটি খুব শকড হলেন। ভেবেছিলেন হয়তো এই প্রশ্নটি শুনেই ডিগবাজি খাবে। কিন্তু বেচারাকে এরকম ধোলাই করবে বুঝতে পারেনি। সেদিন উনার চেহারাটা হয়েছিল দেখার মত। বউ পেটানোর লজিকটা মনে হয় উনার খুব গায়ে লেগেছে।
স্রষ্টা কেন মন্দ কাজের দায় নেন না?
ক্লাশে নতুন একজন স্যার এসেছেন। নাম- মফিজুর রহমান।
হ্যাংলা-পাতলা গড়ন। বাতাস আসলেই যেনো ঢলে পড়বে মতন অবস্থা শরীরের। ভদ্রলোকের চেহারার চেয়ে চোখ দুটি অস্বাভাবিক রকম বড়। দেখলেই মনে হয় যেন বড় বড় সাইজের দুটি জলপাই, কেউ খোদাই করে বসিয়ে দিয়েছে।
ভদ্রলোক খুবই ভালো মানুষ। উনার সমস্যা একটিই- ক্লাসে উনি যতোটা না বায়োলজি পড়ান, তারচেয়ে বেশি দর্শন চর্চা করেন। ধর্ম কোথা থেকে আসলো, ঠিক কবে থেকে মানুষ ধার্মিক হওয়া শুরু করলো, ‘ধর্ম আদতে কি’ আর, ‘কি নয়’ তার গল্প করেন।
.
আজকে উনার চতুর্থ ক্লাশ। পড়াবেন Analytical techniques & bio-informatics। চতুর্থ সেমিষ্টারে এটা পড়ানো হয়।
স্যার এসে প্রথমে বললেন, -’Good morning, guys….’
সবাই সমস্বরে বললো, -’Good morning, sir…’
এরপর স্যার জিজ্ঞেস করলেন, -’সবাই কেমন আছো?’
স্যারের আরো একটি ভালো দিক হলো- উনি ক্লাশে এলে এভাবেই সবার কুশলাদি জিজ্ঞেস করেন। সাধারণত হায়ার লেভেলে যেটা সব শিক্ষক করেন না। তারা রোবটের মতো ক্লাশে আসেন, যন্ত্রের মতো করে লেকচারটা পড়িয়ে বেরিয়ে যান। সেদিক থেকে মফিজুর রহমান নামের এই ভদ্রলোক অনেকটা অন্যরকম।
আবারো সবাই সমস্বরে উত্তর দিলো। কিন্তু গোলমাল বাঁধলো এক জায়গায়। শিক্ষার্থীদের মধ্যে কয়েকজন উত্তর দিয়েছে এভাবে-’আলহামমমমদুলিল্লাহ ভালো।’
স্যার কপালের ভাঁজ একটু দীর্ঘ করে বললেন, -’আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো বলেছো কে কে?’
অদ্ভুত প্রশ্ন। সবাই থতমত খেলো।
একটু আগেই বলেছি স্যার একটু অন্যরকম। প্রাইমারি লেভেলের টিচারদের মতো ক্লাশে এসে বিকট চিৎকার করে Good Morning বলেন, সবাই কেমন আছে জানতে চান। এখন’আলহামদুলিল্লাহ্’ বলার জন্য কি প্রাইমারি লেভেলের শিক্ষকদের মতো বেত দিয়ে পিটাবেন নাকি?
সাজিদের তখন তার প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক বাবুল চন্দ্র দাশের কথা মনে পড়ে গেলো। এই লোকটা ক্লাশে কেউ দুটোর বেশি হাঁচি দিলেই বেত দিয়ে আচ্ছামতন পিটাতেন। উনার কথা হলো-’হাঁচির সর্বোচ্চ পরিমাণ হবে দু’টি। দু’টির বেশি হাঁচি দেওয়া মানে ইচ্ছে করেই বেয়াদবি করা।’
যাহোক, বাবুল চন্দ্রের পাঠ তো কবেই চুকেছে, এবার মফিজ চন্দ্রের হাতেই না গণ পিটুনি খাওয়া লাগে।
ক্লাশের সর্বমোট সাতজন দাঁড়ালো। এরা সবাই’আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো’ বলেছে। এরা হচ্ছে- রাকিব, আদনান, জুনায়েদ, সাকিব, মরিয়ম, রিতা এবং সাজিদ।
স্যার সবার চেহারাটা একটু ভালোমতো পরখ করে নিলেন। এরপর পিক করে হেসে দিয়ে বললেন, -’বসো।’
সবাই বসলো। আজকে আর মনে হয় এ্যাকাডেমিক পড়াশুনা হবেনা। দর্শনের তাত্বিক আলাপ হবে।
ঠিক তাই হলো। মফিজুর রহমান স্যার আদনানকে দাঁড় করালো। বললেন, -’তুমিও বলেছিলে সেটা, না?’
-’জ্বি স্যার।’- আদনান উত্তর দিলো।
স্যার বললেন, -’আলহামদুলিল্লাহ্’র অর্থ কি জানো?’
আদনান মনে হয় একটু ভয় পাচ্ছে। সে ঢোঁক গিলতে গিলতে বললো, -’জ্বি স্যার, আলহামদুলিল্লাহ্ অর্থ হলো- সকল প্রশংসা কেবলি আল্লাহর।’
স্যার বললেন, -’ সকল প্রশংসা কেবলি আল্লাহর।’
স্যার এই বাক্যটি দু’বার উচ্চারণ করলেন। এরপর আদনানের দিকে তাকিয়ে বললেন, -’বসো।’
আদনান বসলো। এবার স্যার রিতাকে দাঁড় করালেন। স্যার রিতার কাছে জিজ্ঞেস করলেন, -’আচ্ছা, পৃথিবীতে চুরি-ডাকাতি আছে?’
রিতা বললো, -’আছে।’
-’খুন-খারাবি, রাহাজানি, ধর্ষণ?’
–’জ্বি, আছে।’
-’কথা দিয়ে কথা না রাখা, মানুষকে ঠকানো, লোভ-লালসা এসব?’
-’জ্বি, আছে।’
-’এগুলো কি প্রশংসাযোগ্য?’
-’না।’
‘তাহলে মানুষ একটি ভালো কাজ করার পর তার সব প্রশংসা যদি আল্লাহর হয়, মানুষ যখন চুরি-ডাকাতি করে, লোক ঠকায়, খুন-খারাবি করে, ধর্ষণ করে, তখন সব মন্দের ক্রেডিট আল্লাহকে দেওয়া হয়না কেনো? উনি প্রশংসার ভাগ পাবেন, কিন্তু দূর্নামের ভাগ নিবেন না, তা কেমন হয়ে গেলো না?’
রিতা মাথা নিঁচু করে চুপ করে আছে। স্যার বললেন, -’এখানেই ধর্মের ভেল্কিবাজি। ইশ্বর সব ভালোটা বুঝেন, কিন্তু মন্দটা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। আদতে, ইশ্বর বলে কেউ নেই। যদি থাকতো, তাহলে তিনি এরকম একচোখা হতেন না। বান্দার ভালো কাজের ক্রেডিটটা নিজে নিয়ে নিবেন, কিন্তু বান্দার মন্দ কাজের বেলায় বলবেন-’উহু, অইটা থেকে আমি পবিত্র। অইটা তোমার ভাগ।’
স্যারের কথা শুনে ক্লাশে যে ক’জন নাস্তিক আছে, তারা হাত তালি দেওয়া শুরু করলো। সাজিদের পাশে যে নাস্তিকটা বসেছে, সে তো বলেই বসলো, -’মফিজ স্যার হলেন আমাদের বাঙলার প্লেটো।’
স্যার বলেই যাচ্ছেন ধর্ম আর স্রষ্টার অসারতা নিয়ে।
–
এবার সাজিদ দাঁড়ালো। স্যারের কথার মাঝে সে বললো, -’স্যার, সৃষ্টিকর্তা একচোখা নন। তিনি মানুষের ভালো কাজের ক্রেডিট নেন না। তিনি ততোটুকুই নেন, যতোটুকু তিনি পাবেন। ইশ্বর আছেন।’
স্যার সাজিদের দিকে একটু ভালোমতো তাকালেন। বললেন, -’শিওর?’
-’জ্বি।’
-’তাহলে মানুষের মন্দ কাজের জন্য কে দায়ী?’
-’মানুষই দায়ী। – সাজিদ বললো।
-’ভালো কাজের জন্য?’
-’তাও মানুষ।’
স্যার এবার চিৎকার করে বললেন, -’এক্সাক্টলি, এটাই বলতে চাচ্ছি। ভালো/মন্দ এসব মানুষেরই কাজ। সো, এর সব ক্রেডিটই মানুষের। এখানে স্রষ্টার কোন হাত নেই। সো, তিনি এখান থেকে না প্রশংসা পেতে পারেন, না তিরস্কার। সোজা কথায়, স্রষ্টা বলতে কেউই নেই।’
ক্লাশে পিনপতন নিরবতা। সাজিদ বললো, -’মানুষের ভালো কাজের জন্য স্রষ্টা অবশ্যই প্রশংসা পাবেন, কারন, মানুষকে স্রষ্টা ভালো কাজ করার জন্য দুটি হাত দিয়েছেন, ভালো জিনিস দেখার জন্য দুটি চোখ দিয়েছেন, চিন্তা করার জন্য মস্তিষ্ক দিয়েছেন, দুটি পা দিয়েছেন। এসবকিছুই স্রষ্টার দান। তাই ভালো কাজের জন্য তিনি অবশ্যই প্রশংসা পাবেন।’
স্যার বললেন, -’এই গুলো দিয়ে তো মানুষ খারাপ কাজও করে, তখন?’
-’এর দায় স্রষ্টার নয়।’
-’হা হা হা হা। তুমি খুব মজার মানুষ দেখছি। হা হা হা হা।’
সাজিদ বললো, -’স্যার, স্রষ্টা মানুষকে একটি স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন। এটা দিয়ে সে নিজেই নিজের কাজ ঠিক করে নেয়। সে কি ভালো করবে, না মন্দ।’
স্যার তিরস্কারের সুরে বললেন, -’ধর্মীয় কিতাবাদির কথা বাদ দাও, ম্যান। কাম টু দ্য পয়েণ্ট এন্ড বি লজিক্যাল।’
সাজিদ বললো, -’স্যার, আমি কি উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে পারি ব্যাপারটা?’
-’অবশ্যই।’- স্যার বললেন।
সাজিদ বলতে শুরু করলো-
‘ধরুন, খুব গভীর সাগরে একটি জাহাজ ডুবে গেলো। ধরুন, সেটা বার্মুডা ট্রায়াঙ্গাল। এখন কোন ডুবুরিই সেখানে ডুব দিয়ে জাহাজের মানুষগুলোকে উদ্ধার করতে পারছে না। বার্মুডা ট্রায়াঙ্গালে তো নয়ই। এই মূহুর্তে ধরুন সেখানে আপনার আবির্ভাব ঘটলো। আপনি সবাইকে বললেন, -’আমি এমন একটি যন্ত্র বানিয়ে দিতে পারি, যেটা গায়ে লাগিয়ে যেকোন মানুষ খুব সহজেই ডুবে যাওয়া জাহাজের মানুষগুলোকে উদ্ধার করতে পারবে। ডুবুরির কোনরকম ক্ষতি হবে না।’
স্যার বললেন, -’হুম, তো?’
-’ধরুন, আপনি যন্ত্রটি তৎক্ষণাৎ বানালেন, এবং একজন ডুবুরি সেই যন্ত্র গায়ে লাগিয়ে সাগরে নেমে পড়লো ডুবে যাওয়া মানুষগুলোকে উদ্ধার করতে।’
ক্লাশে তখন একদম পিনপতন নিরবতা। সবাই মুগ্ধ শ্রোতা। কারো চোখের পলকই যেনো পড়ছেনা।
সাজিদ বলে যেতে লাগলো-
‘ধরুন, ডুবুরিটা ডুব দিয়ে ডুবে যাওয়া জাহাজে চলে গেলো। সেখানে গিয়ে সে দেখলো, মানুষগুলো হাঁসপাশ করছে। সে একে একে সবাইকে একটি করে অক্সিজেনের সিলিন্ডার দিয়ে দিলো। এবং তাদের একজন একজন করে উদ্ধার করতে লাগলো।’
স্যার বললেন, -’হুম।’
-’ধরুন, সব যাত্রীকে উদ্ধার করা শেষ। বাকি আছে মাত্র একজন। ডুবুরিটা যখন শেষ লোকটাকে উদ্ধার করতে গেলো, তখন ডুবুরিটা দেখলো- এই লোকটাকে সে আগে থেকেই চিনে।’
এতটুকু বলে সাজিদ স্যারের কাছে প্রশ্ন করলো, -’স্যার, এরকম কি হতে পারেনা?’
স্যার বললেন, -’অবশ্যই হতে পারে। লোকটা ডুবুরির আত্মীয় বা পরিচিত হয়ে যেতেই পারে। অস্বাভাবিক কিছু নয়।’
সাজিদ বললো, -’জ্বি। ডুবুরিটা লোকটাকে চিনতে পারলো। সে দেখলো, – এটা হচ্ছে তার চরম শত্রু। এই লোকের সাথে তার দীর্ঘ দিনের বিরোধ চলছে। এরকম হতে পারেনা, স্যার?
-’হ্যাঁ, হতে পারে।’
সাজিদ বললো, -’ধরুন, ডুবুরির মধ্যে ব্যক্তিগত হিংসাবোধ জেগে উঠলো। সে শত্রুতাবশঃত ঠিক করলো যে, এই লোকটাকে সে বাঁচাবেনা। কারন, লোকটা তার দীর্ঘদিনের শত্রু। সে একটা চরম সুযোগ পেলো এবং প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে উঠলো। ধরুন, ডুবুরি অই লোকটাকে অক্সিজেনের সিলিন্ডার তো দিলোই না, উল্টো উঠে আসার সময় লোকটাকে পেটে একটা জোরে লাথি দিয়ে আসলো।’
ক্লাশে তখনও পিনপতন নিরবতা। সবাই সাজিদের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।
স্যার বললেন, -’তো, তাতে কি প্রমান হয়, সাজিদ?’
সাজিদ স্যারের দিকে ফিরলো। ফিরে বললো, -’Let me finish my beloved sir….’
-’Okey, you are permitted. carry on’- স্যার বললেন।
সাজিদ এবার স্যারকে প্রশ্ন করলো, -’স্যার, বলুন তো, এই যে, এতগুলো ডুবে যাওয়া লোককে ডুবুরিটা উদ্ধার করে আনলো, এর জন্য আপনি কি কোন ক্রেডিট পাবেন?’
স্যার বললেন, -’অবশ্যই আমি ক্রেডিট পাবো। কারন, আমি যদি অই বিশেষ যন্ত্রটি না বানিয়ে দিতাম, তাহলে তো এই লোকগুলোর কেউই বাঁচতো না।’
সাজিদ বললো, -’একদম ঠিক স্যার। আপনি অবশ্যই এরজন্য ক্রেডিট পাবেন। কিন্তু, আমার পরবর্তী প্রশ্ন হচ্ছে-’ডুবুরিটা সবাইকে উদ্ধার করলেও, একজন লোককে সে শত্রুতা বশঃত উদ্ধার না করে মৃত্যুকূপে ফেলে রেখে এসেছে। আসার সময় তার পেটে একটি জোরে লাথিও দিয়ে এসেছে। ঠিক?’
-’হুম।’
-’এখন স্যার, ডুবুরির এহেন অন্যায়ের জন্য কি আপনি দায়ী হবেন? ডুবুরির এই অন্যায়ের ভাগটা কি সমানভাবে আপনিও ভাগ করে নেবেন?’
স্যার বললেন, -’অবশ্যই না। ওর দোষের ভাগ আমি কেনো নেবো? আমি তো তাকে এরকম অন্যায় কাজ করতে বলিনি। সেটা সে নিজে করেছে। সুতরাং, এর পুরো দায় তার।’
সাজিদ এবার হাসলো। হেসে সে বললো, -’স্যার, ঠিক একইভাবে, আল্লাহ তা’য়ালা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন ভালো কাজ করার জন্য। আপনি যেরকম ডুবুরিকে একটা বিশেষ যন্ত্র বানিয়ে দিয়েছেন, সেরকম সৃষ্টিকর্তাও মানুষকে অনুগ্রহ করে হাত, পা, চোখ, নাক, কান, মুখ, মস্তিষ্ক এসব দিয়ে দিয়েছেন। সাথে দিয়েছেন একটি স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি। এখন এসব ব্যবহার করে সে যদি কোন ভালো কাজ করে, তার ক্রেডিট স্রষ্টাও পাবেন, যেরকম বিশেষ যন্ত্রটি বানিয়ে আপনি ক্রেডিট পাচ্ছেন। আবার, সে যদি এগুলো ব্যবহার করে কোন খারাপ কাজ করে, গর্হিত কাজ করে, তাহলে এর দায়ভার স্রষ্টা নেবেন না। যেরকম, ডুবুরির অই অন্যায়ের দায় আপনার উপর বর্তায় না। আমি কি বোঝাতে পেরেছি, স্যার?’
ক্লাশে এতক্ষণ ধরে পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছিলো। এবার ক্লাশের সকল আস্তিকেরা মিলে একসাথে জোরে জোরে হাত তালি দেওয়া শুরু করলো।
স্যারের জবাবের আশায় সাজিদ স্যারের দিকে তাকিয়ে আছে। স্যার বললেন, -’হুম। আই গট দ্য পয়েণ্ট।’- এই বলে স্যার সেদিনের মতো ক্লাশ শেষ করে চলে যান।
স্রষ্টা যদি দয়ালুই হবেন তবে জাহান্নাম কেন?
-‘আচ্ছা সাজিদ, সৃষ্টিকর্তা কি দয়ালু নাকি পাষাণ? দেবজিৎ দা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সাজিদকে জিজ্ঞেস করল।
আমার পাশে বসা ছিল মিজবাহ। সে বলল, -‘অদ্ভুত তো ! সৃষ্টিকর্তা পাষান হবে কেন? উনি হলেন রাহমানুর রাহিম। পরম দয়ালু।
দেবজিৎ দা মিজবাহর দিকে তাকালেন। এরপরে বললেন, ‘মিজবাহ, সৃষ্টিকর্তা যদি পরম দয়ালুই হবেন, তাহলে তিনি তার সৃষ্টিকে শাস্তি দেওয়ার জন্য কেন নরক, আই মিন জাহান্নামের মত জিনিস বানিয়ে রেখেছেন?’
মেজবাহর চটপটে উত্তর, ‘এটা কোন প্রশ্ন হল দাদা? কেউ যদি সৃষ্টিকর্তার কমান্ড ফলো না করে, তাহলে তাকে যদি শাস্তি দেওয়া হয়, সেটা কোনোভাবে সৃষ্টিকর্তাকে পাষাণ প্রমাণ করে না।’
মিসবাহর এই উত্তর দেবজিৎ দা’কে সন্তুষ্ট করেছে বলে মনে হচ্ছে না। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করতে যাবেন, ঠিক এই সময় সাজিদ বলে উঠল, -‘দাদা আজকের পত্রিকা পড়েছ?’
দেবজিৎ দা বললেন, -‘না। কেন?’
-‘একটা নিউজ আছে’
-‘কি নিউজ?’
সাজিদ দেবজিৎ দা’র দিকে পত্রিকাটা এগিয়ে দিল। পত্রিকার একদম প্রথম পাতায় বড় বড় অক্ষরে শিরোনাম –‘সোনাগাজীতে ৯ বছরের বালিকাকে ৫ জন মিলে গ্যাং রেপ।’ বিস্তারিত অংশে যা লিখা আছে তার সারমর্ম এরকম-
‘নোয়াখালীর সোনাগাজীতে ৯ বছরের এক বালিকাকে স্কুল থেকে ফেরার পথে পাঁচজন যুবক মিলে ধর্ষণ করেছে। ধর্ষণের পর তারা মেয়েটিকে আহত অবস্থায় ধান ক্ষেতে ফেলে যায়। মেয়েটিকে খুব গুরুতর অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, মেয়েটির শরীরের বিভিন্ন অংশ ব্লেড দিয়ে কাটা হয়েছে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। মেয়েটি এখন পুরোটাই কোমার মধ্যে আছে। ধর্ষণকারীদের গ্রামের লোকজন আটক করে পুলিশের হাতে সোপর্দ করেছে। জানা গেছে, মেয়ের বাবা এলাকার মেম্বার। মেম্বারের উপর সালিশ বিষয়ক কোন ব্যাপার থেকেই উনার মেয়ের উপরে নির্যাতন চালায় ওরা।’
ঘটনাটা গতকালের। ছোট মেয়েটির একটি ছবিও দেওয়া আছে। কি ফুটফুটে চেহারা।
দেবজিৎ দা নরম মনের মানুষ। এরকম একটি খবর পড়ার পরে উনার মনটা মুহূর্তেই বিষন্নতায় ছেয়ে গেল। দাঁতে দাঁত খিঁচে অনেকক্ষণ ওই পাঁচজন ধর্ষণকারীকে গালাগাল দিলেন।
সাজিদ পত্রিকাটা ব্যাগে রাখতে রাখতে বলল, -‘দাদা, ধরো, এই পাঁচজনকে কোর্টে তোলা হলো আর তুমি হলে বিচারক। এই পাঁচজন যে আসল অপরাধী তার সমস্ত রকম তথ্য প্রমাণ তোমার কাছে পেশ করা হয়েছে। এখন একজন নাবালিকার উপর এরকম নির্মমভাবে নির্যাতন করার জন্য তুমি কি তাদের শাস্তি দিবে?’
দেবজিৎ দা দাঁত মুখ খিচে বললেন, -‘শাস্তি দিবো মানে? শুয়োরের বাচ্চাগুলোকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেব।’
সাজিদ মুচকি হাসল। বলল, -‘সত্যিই তাই?’
-‘হ্যাঁ, একদম। ফাসিতে ঝুলিয়ে এদের মাংস শেয়াল-কুকুর দিয়ে খাওয়াতে পারলেই আমার গা জুড়োবে।’
দেবজিৎ দা’র চোখ মুখ লাল বর্ণ ধারন করছে। উনাকে এরকম অবস্থায় আগে কখনো দেখি নি।
সাজিদ একগ্লাস পানি নিয়ে উনার দিকে বাড়িয়ে দিল। পানিটা ঢকঢক করে পান করে উনি শার্টের হাতাতে মুখ মুছলেন। উনি তখনও প্রচণ্ড রেগে আছেন বোঝা যাচ্ছে।
সাজিদ বলল, -‘আমি যে দেবজিৎ দাদাকে চিনি, সে কিন্তু এতটা হিংস্র না। আমি তাকে জানতাম দয়ালু, ক্ষমাশীল, মহানুভব হিসেবে। সে যে কাউকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেবার কথাও ভাবতে পারে, সেটাই বিরাট আশ্চর্য লাগছে।’
দেবজিৎ দা সাজিদের দিকে তাকালেন। তাকানোতে একটা তাচ্ছিল্যতা আছে।
বললেন, -শোন সাজীদ, আমি দয়ালু, মহানুভব ঠিক আছি। কিন্তু তার মানে এই না যে, আমি কোনো অন্যায় দেখে চুপ করে থাকব। আমার ক্যারেক্টারের ক্রাইটেরিয়াতে যেমন দয়ালু, মহান, উদার এসব আছে, ঠিক তেমনি আমি ন্যায়বিচারকও। অন্যায়ের কোন প্রশ্রয় আমার কাছে নেই।’
-‘বিচারক হিসেবে তুমি চাইলেই ওই পাঁচজন অপরাধীকে ক্ষমা করে দিতেই পারো।’ -সাজিদ বলল।
-‘হ্যাঁ, পারি। কিন্তু তাহলে যে ওই নিষ্পাপ মেয়েটার সাথে অন্যায় করা হবে। অবিচার করা হবে। আমি সেটা পারব না।’
-‘তাহলে কি ধরে নেব তুমি পাষাণ? কঠিন হৃদয়ের? তোমার মাঝে কোন ভালোবাসা নেই, মমতা নেই?’
দেবজিৎ দা উত্তেজিত হয়ে বললেন, -‘আশ্চর্য ! তোর বুদ্ধিশুদ্ধি কি সব লোপ পেয়েছে রে সাজিদ? ৫ জন লোক ঘোরতর অন্যায় করেছে। তাদের অন্যের জন্য আমি তাদের শাস্তি দিব। এটাই স্বাভাবিক। একজন বিচারক হিসেবে এখানে ন্যায়ের পক্ষ নেওয়াই আমার ধর্ম, আমার প্রেম, আমার ভালবাসা। এটা কি প্রমাণ করে যে আমি পাষাণ?’
সাজিদ আবার মুচকি হাসলো। বললো, -‘দাদা, তোমাকে উত্তেজিত করার জন্য দুঃখিত। না, তুমি আসলেই খুব ভালো। সৃষ্টিকর্তা যেমন পরম দয়ালু, ক্ষমাশীল, ঠিক তেমনি তিনি আবার একজন ন্যায়বিচারকও। তিনি কারো সাথে বিন্দু পরিমাণ অন্যায় হতে দেন না। সৃষ্টিকর্তা আমাদের সবাইকে সৃষ্টি করেছে। তিনি আমাদের জন্য কিছু নির্দিষ্ট রুলস তৈরি করে দিয়েছেন। এখন কিছু লোক এই রুলস ফলো করে যদি তার দেওয়া বিধান মতো জীবন যাপন করে, তাদের পুরস্কার হিসেবে জান্নাত দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। এখন একদল লোক নামায কালাম পড়ে, মিথ্যা কথা বলে না, লোক ঠকায় না, চুরি রাহাজানি করে না, সুদ-ঘুষ খায় না, মানুষ খুন করে না, মোদ্দাকথা সকল প্রকার অন্যায় থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখে এবং স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ এবং তার প্রতিশ্রুত জান্নাতের জন্য।
অপরদিকে আরেকদল লোক এসবের থোড়াই কেয়ার করে যদি ভোগবিলাসে মেতে ওঠে, সকল অন্যায় কাজ করে, স্রষ্টার অবাধ্য হয়, তাহলে স্রষ্টা যদি দয়া পরবশ হয়ে তাদেরকে আগের দলের সাথে জান্নাতে পাঠিয়ে দেয়, তাহলে এটা কি ন্যায্য হলো? প্রথম দলকে তো ঠকানোই হলো। সাথে কি পরের দলের সকল অন্যায়কে মেনে নেওয়া হলো না? প্রশ্রয় দেওয়া হলো না? তুমি যেভাবে বিচারকের আসনে বসে ক্ষমতা থাকার পরেও ওই পাঁচজনকে ক্ষমা করে দিতে পারো না কেবল ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য, স্রষ্টাও কি সেটা পারেন না?’
দেবজিৎ দা কিছু বললেন না। সাজিদ আবার বলল, -‘এটা হল স্রষ্টার ক্রাইটেরিয়া। তুমি যেমন পরম দয়ালু, ঠিক সেরকম ন্যায়বিচারকও।
আরেকটু ক্লিয়ার করি। একজন বাবার দুটি সন্তান। দুই সন্তানের, প্রথমজন দ্বিতীয়জনকে বিনা কারণে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিল। যাকে ধাক্কা দিল সে মাটিতে পড়ে খুব ব্যথা পেল এবং চিৎকার করে কেঁদে উঠলো ।
এখন বাবা এসে যদি প্রথমজনকে তার অন্যায়ের জন্য কোন শাস্তি না দেয়, তাহলে সেটা তার দ্বিতীয় সন্তান, যে নিষ্পাপ তার প্রতি অন্যায় করা হবে না?’
-‘হু’ – দেবজিৎ দা বললেন।
-‘স্রষ্টা এরকম নন। এ জন্যই তিনি জান্নাত আর জাহান্নাম দুটোই তৈরি করে রেখেছেন। আমাদের কর্ম নির্ধারণ করে দেবে আমাদের গন্তব্যস্থল। এতে কোন দুই নাম্বারি হবে না, কারো সাথে চুল পরিমানও অন্যায় হবে না।
দেবজিৎ দা বললেন, -‘তা বুঝলাম। কিন্তু যেহেতু তিনি স্রষ্টা, আমাদের চেয়ে হাজারগুণ দয়ালু হবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই তিনি আবার আমাদের কর্ম পরিচালনা করছেন। আবার তিনি আমাদের ধরে ধরে জাহান্নামে পাঠাচ্ছেন। ব্যাপারটা কেমন না সাজিদ?’
সাজিদ বলল, -‘দাদা, প্রথমত স্রষ্টা আমাদের কর্ম পরিচালনা করেন না। স্রষ্টা আমাদের একটা স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। সাথে পাঠিয়েছেন একটা গাইডবুক। এখন এই স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করেই আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে আমরা কি তার দেখানো পথে চলবো, কি চলব না। যদি চলি আমরা জান্নাতে যাব, যদি না চলি আমরা জাহান্নামে যাব। মোদ্দাকথা, আমরা কোথায় যাব তা আমরাই নির্ধারণ করি আমাদের কর্মের মাধ্যমে।’
দেবজিৎ দা হাসলেন। বললেন, -‘ও আচ্ছা। তার মানে কি বলতে চাচ্ছি যে কিছু লোক স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে জাহান্নাম চুস করে নিচ্ছে ?’
-‘হ্যাঁ’
-‘উদ্ভট না কথাটা?’
-‘একদম না।’
-‘লজিক্যালি বল।’
-‘আচ্ছা ধরো, তুমি গভীর সাগরে জাহাজ থেকে পানিতে পড়ে গেলে। পানিতে তুমি হাসপাস করছ। একটু পরে অতল তলে তলিয়ে যাবে। এখন ধরো, তোমাকে উদ্ধার করার জন্য আমি একটি লাইফ জ্যাকেট তোমার দিকে বাড়িয়ে দিলাম।’
-‘হু, তো?’
-‘সেই মুহুর্তে তোমার কাছে দুটি অপশন। হয় লাইফ জ্যাকেটটি নিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচাবে, নয়তো আমাকে ডিনাই করবে আর অতল সাগরে তলিয়ে যাবে এবং মৃত্যুবরণ করবে।
খেয়াল করো, আমি কিন্তু বাঁচার উপকরণ অর্থাৎ লাইফ জ্যাকেট তোমার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছি। এখন তুমি তোমার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে জ্যাকেটটি গ্রহণ করে প্রাণে বাঁচবে নাকি ডিনাই করে মৃত্যুকে বরণ করবে সম্পূর্ণ তোমার ব্যাপার। স্রষ্টাও জাহান্নাম থেকে বাঁচার উপকরণ আমাদের জন্য পাঠিয়েছেন। সাথে আমাদের ফ্রি উইল দিয়ে দিয়েছেন। এখানে আমরা তা আঁকড়ে ধরে বাঁচবো নাকি উপেক্ষা করে মরবো, তা আমাদের উপর নির্ভর করছে।’
দেবজিৎ দা কিছু বললেন না। স্রষ্টা দয়ালু হয়েও কেন জাহান্নাম তৈরি করেছেন তার উত্তর তিনি মনে হয় পেয়ে গেছেন। চায়ের বিদেশ বিল পরিশোধ করে এসে দেবজিৎ দা বললেন, -‘স্রষ্টা যেহেতু আমাদের চেয়ে অনেক বেশি দয়ালু, তিনি কিন্তু চাইলেই পারেন ক্ষমা করে দিতে।’
সাজিদ বলল, -‘স্রষ্টা শুধু তোমার চেয়ে অনেক বেশি দয়ালুই নয়, তোমার চেয়ে অনেক বেশি ন্যায়বিচারকও। সুতরাং…..’
সাজিদকে আর কিছুতেই বলতে দিল না দেবজিৎ দা। মনমরা করে বললেন, -‘বুঝেছি।’
সাজিদ হাসলো। দেবজিৎ দা’র এই চাহনি দেখে আমাদেরও হাসি পেলো। আমরাও হাসলাম। আমাদের হাসতে দেখে তিনিও আমাদের সাথে হাসা শুরু করলেন। হা হা হা।
স্রষ্টাকে কে সৃষ্টি করলো?
ল্যাম্পপোস্টের অস্পষ্ট আলোয় একজন বয়স্ক লোকের ছায়ামূর্তি আমাদের দৃষ্টিগোচর হলো। গায়ে মোটা একটি শাল জড়ানো। পৌষের শীত। লোকটা হালকা কাঁপছেও। আমরা খুলনা থেকে ফিরছিলাম। আমি আর সাজিদ।
স্টেশন মাস্টার রুমের পাশে একটি বেঞ্চিতে লোকটা আঁটোসাঁটো হয়ে বসে আছে। স্টেশনে এরকম কত লোকই তো বসে থাকে। তাই সেদিকে আমার বিশেষ কোন কৌতূহল ছিল না। কিন্তু সাজিদকে দেখলাম সে দিকে এগিয়ে গেল।
লোকটার কাছে গিয়ে সাজিয়ে ধপাস করে বসে পড়ল। আমি দূর থেকে খেয়াল করলাম লোকটার সাথে সাজিদ হেসে হেসে কথাও বলছে।
আশ্চর্য ! খুলনার স্টেশন। এখানে সাজিদের পরিচিত লোক কোথা থেকে এলো? তাছাড়া লোকটিকে দেখে বিশেষ কেউ বলেও মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে কোন বাদাম বিক্রেতা। বাদাম বিক্রি শেষে ফোটেনি ওই জায়গায় বসেই রাত কাটিয়ে দেয়। আমাদের রাতের ট্রেন। এখন বাজে রাত দু’টো। এই সময় সাজিদের সাথে কারো দেখা করার কথা থাকলে তা তো আমি জানতামই। অদ্ভুত !আমি আর একটু এগিয়ে গেলাম। একটু অগ্রসর হয়ে দেখলাম ভদ্রলোকের হাতে একটি বইও আছে। দূর থেকে আমি বুঝতে পারিনি।
সাজিদ আমাকে ইশারা দিয়ে ডাকলো। আমি গেলাম। লোকটার চেহারা টা বেশ চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু সঠিক মনে করতে পারছিনা। সাজিদ বলল, -‘এইখানে বোস। ইনি হচ্ছেন হুমায়ুন স্যার।’
হুমায়ুন স্যার? এই নামে কোন হুমায়ূন স্যারকে আমি তো চিনি না। সাজিদকে জিজ্ঞেস করতে যাব যে কোন হুমায়ুন স্যার, অমনি সাজিদ আবার বলল, -‘হুমায়ূন আজাদকে চিনিস না? ইন ইয়ার্কিইনি আর কি।’
এরপর সে লোকটার দিকে ফিরে বলল, -‘স্যার, এ হল আমার বন্ধু আরিফ।’
লোকটা আমার দিকে তাকালো না। সাজিদের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটে মৃদু হাসি। আমার তখনও ঘোর কাটছেই না। কি হচ্ছে এসব? আমিও ধপাস করে সাজিদের পাশে বসে পড়লাম।
সাজিদ আর হুমায়ুন আজাদ নামের লোকটার মধ্যে আলাপ হচ্ছে। এমন ভাবে কথা বলছে যেন, তারা পরস্পর পরস্পরকে অনেক আগে থেকেই চিনে।
লোকটা সাজিদকে বলছে, -‘তোকে কত করে বলেছি, আমার লেখা ‘আমার অবিস্বাস’ বইটা ভালো মতো পড়তে। পড়েছিলি?’
সাজিদ বলল, -‘হ্যাঁ স্যার। পড়েছি তো।’
-‘তাহলে আবার আস্তিক হয়ে গেলি কেন? নিশ্চয়ই কোন ত্যাদড়ের ফাঁদে পড়েছিস? কে সে? নাম বল? পেছনে যে আছে, কি জানি নাম?’
-‘ইডিয়েট আরিফ……..’
-‘হ্যাঁ, এই ত্যাদড়ের ফাঁদে পড়েছিস বুঝি? দাড়া, তাকে আমি মজা দেখাচ্ছি…….।
এই বলে লোকটা বসা থেকে উঠে গেল।
সাজিদ জোরে জোরে বলে উঠল, -‘না না স্যার। ও কিছু জানে না।’
-‘তাহলে?’
-‘আসলে স্যার, বলতে সংকোচবোধ করলেও সত্য এটাই যে নাস্তিকতার উপর আপনি যেসব লজিক দেখিয়েছে সেগুলো এতটাই দুর্বল যে, নাস্তিকতার উপর আমি বেশিদিন ঈমান রাখতে পারিনি।’
এইটুকু বলে সাজিদ মাথা নিচু করে ফেলল। লোকটার চেহারাটা মুহূর্তেই রুক্ষভাব ধারণ করলো। বললো, -‘তার মানে বলতে চাইছিস, তুই এখন আমার চেয়েও বড় পন্ডিত হয়ে গেছিস? আমার চেয়েও বেশি পড়ে ফেলেছিস? বেশি বুঝে ফেলেছিস?’
তখনও মাথা নিচু করে বসে আছে।
লোকটা বলল, -‘যাগ গে, একটা সিগারেট খাবো। ম্যাচ নাই। তোর কাছে আছে?’
-‘জি স্যার’- এই বলে সাজিদ ব্যাগ খুলে একটি ম্যাচ বের করে লোকটার হাতে দিল। সাজিদ সিগারেট খায় না, তবে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো তার ব্যাগে থাকে সব সময়।
লোকটা সিগারেট ধরালো। কয়েকটা জোরে জোরে টান টান দিয়ে ফুস করে একমুখ ধোঁয়া ছাড়লো। ধোয়াগুলো মুহূর্তেই কুণ্ডলী আকারে স্টেশন মাস্টারের ঘরের রেলিং বেয়ে উঠে যেতে লাগল উপরের দিকে। আমি সেদিকে তাকিয়ে আছি।
লোকটার কাশি উঠে গেল। কাশতে কাশতে লোকটা বসা থেকে উঠে পরল। এই মুহূর্তে উনার সিগারেট খাওয়ার আর সম্ভবত ইচ্ছে নেই। লোকটা সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরোটিকে নিচে ফেলে পা দিয়ে একটি ঘষা দিল। অমনি সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরোটি থেতলে গেল।
সাজিদের দিকে ফিরে লোকটা বলল, -‘তাহলে এখন বিশ্বাস করিস যে স্রষ্টা বলে কেউ আছে?’
সাজিদ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো।
-‘স্রষ্টা এই বিশ্বলোক, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছে বলে বিশ্বাস করিস তো?’
আবার সাজিদ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো।
এবার লোকটা এত অদ্ভুত ভয়ংকর রকম হাসি দিলো। এই হাসি এতটাই বিদঘুটে ছিল যে, আমার গা ছমছম করতে লাগল।
লোকটি বলল, -‘তাহলে বল দেখি স্রষ্টাকে কে সৃষ্টি করলো?’
এই প্রশ্নটি করে লোকটি আবার সেই বিদঘুটে হাসিটা হাসল। গা ছমছমে।
সাজিদ বলল, -‘স্যার বাই ডেফিনিশন, স্রষ্টার কোন সৃষ্টিকর্তা থাকতে পারে না। যদি বলি X-ই সৃষ্টিকর্তাকে সৃষ্টি করেছে, তৎক্ষণাৎ আবার প্রশ্ন উঠবে তাহলে X এর সৃষ্টিকর্তা কে? যদি বলি Y, তাহলে আবার প্রশ্ন উঠবে, Y এর সৃষ্টি কর্তা কে?এভাবেই চলতে থাকবে। কোন সমাধানে যাওয়া যাবেনা।’
লোকটি বলল, -‘সমাধান আছে।’
-‘কি সেটা?’
-‘মেনে নেওয়া যে -স্রষ্টা নাই, বাস !’ এইটুকু বলে লোকটি আবার হাসি দিল। হা হা হা হা।
সাজিদ আপত্তি জানালো। বলল, ‘আপনি ভুল স্যার।’
লোকটি চোখ কপালে তুলে বললো, -‘কী? আমি ভুল? আমি?
-‘জি স্যার।’
-‘তাহলে বল দেখি, স্রষ্টাকে কে সৃষ্টি করলো? উত্তর দে। দেখি কত বড় জ্ঞানের জাহাজ হয়েছিস তুই।’
আমি বুঝতে পারলাম এই লোক সাজিদকে যুক্তির গেরাকলে ফেলার চেষ্টা করছে।
সাজিদ বলল, -‘স্যার গত শতাব্দীতে বিজ্ঞানীরা ভাবতেন, এই মহাবিশ্ব অনন্তকাল ধরে আছে। মানে এটার কোনো শুরু নেই। তারা আরও ভাবতো, এটার কোন শেষ নেই। তাই তারা বলত যেতো এটার শুরু শেষ কিছুই নাই। সুতরাং এটার জন্য একটা সৃষ্টিকর্তারও দরকার নাই।
কিন্তু থার্মোডাইনামিক্স এর তাপ ও গতির সূত্র গুলো আবিষ্কার হওয়ার পর এই ধারণা তো পুরোপুরিভাবে ব্যানিশ হয়ই, সাথে পদার্থ বিজ্ঞানেও ঘটে যায় এক বিপ্লব। থার্মোডাইনামিক্স এর তাপ ও গতির দ্বিতীয় সূত্র বলছে, ‘এই মহাবিশ্ব ক্রমাগত ও নিরবিচ্ছন্ন উত্তাপ অস্তিত্ব থেকে পর্যায়ক্রমে উত্তাপহীন অস্তিত্বের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই সুত্রটাকে উল্টো থেকে প্রয়োগ কখনোই সম্ভব নয়। অর্থাৎ, কম উত্তাপ অস্তিত্ব থেকে এটাকে বেশি উত্তাপ অস্তিত্বের দিকে নিয়ে যাওয়া আদৌ সম্ভব নয়। এই ধারণা থেকে প্রমাণ হয় মহাবিশ্বও চিরন্তন নয়। এটা অনন্ত কাল ধরে এভাবে নেই। এটার একটা নির্দিষ্ট শুরু আছে। থার্মোডাইনামিক্স এর সূত্র আরো বলে, -এভাবে চলতে চলতে একসময় মহাবিশ্বের সকল শক্তির অবক্ষয় ঘটবে। আর মহাবিশ্ব ধ্বংস হবে।
লোকটি বলল, -‘উফফফ ! আসছেন বৈজ্ঞানিক লম্পু। সহজ করে বল ব্যাটা।’
সাজিদ বলল, -‘স্যার একটা গরম কফির কাপ টেবিলে রাখা হলে, সেটা সময়ের সাথে সাথে আস্তে আস্তে তাপ হারাতে হারাতে ঠান্ডা হতেই থাকবে। কিন্তু সেটা টেবিলে রাখার পর যে পরিমাণ গরম ছিল, সময়ের সাথে সাথে সেটা আরো বেশি গরম হয়ে উঠবে-এটাও অসম্ভব। এটা কেবল ঠান্ডাই হতে থাকবে। একটা পর্যায়ে গিয়ে দেখা যাবে কাপটা সমস্ত তাপ হারিয়ে একেবারে ঠান্ডা হয়ে গেছে। এটাই হচ্ছে থার্মোডাইনামিক্স এর সূত্র।’
-‘হুম, তো?’
-‘এর থেকে প্রমান হয়, মহাবিশ্বের একটা শুরু আছে। তারও প্রমাণ বিজ্ঞানীরা পেয়েছে। মহাবিশ্ব সৃষ্টি তত্ত্বের উপর এ যাবৎ যতগুলো থিওরি বিজ্ঞানী মহলে এসেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য, প্রমাণের দিক থেকে সবচেয়ে শক্তিশালী থিওরি হলো বিগ ব্যাং থিওরি। বিগ ব্যাং থিওরি বলছে, -মহাবিশ্বের জন্ম হয়েছে বিস্ফোরণের ফলে। তাহলে নিশ্চিত যে মহাবিশ্বের একটি শুরু আছে।’
লোকটা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো
সাজিদ আবার বলতে শুরু করল, -‘স্যার আমরা সহজ সমীকরণ পদ্ধতিতে দেখব স্রষ্টাকে সৃষ্টির প্রয়োজন আছে কিনা, মানে স্রষ্টার সৃষ্টিকর্তা থাকতে পারে কিনা।
সকল সৃষ্টির একটা নির্দিষ্ট শুরু আছে এবং শেষ আছে……….. ধরি এটা সমীকরণ (১)
মহাবিশ্ব একটি সৃষ্টি……… এটা সমীকরণ (২)
এখন সমীকরণ ১ আর ২ থেকে পাই-
সকল সৃষ্টির শুরু এবং শেষ আছে। মহাবিশ্ব একটি সৃষ্টি, তাই এটারও একটা শুরু এবং শেষ আছে।
তাহলে, আমরা দেখলাম উপরের দুটি শর্ত পরস্পর মিলে গেল এবং তাতে থার্মোডায়নামিক্সের তাপ ও গতিসূত্রের কোন ব্যাঘাত ঘটেনি।
-‘হু’
-‘আমার তৃতীয় সমীকরণ হচ্ছে -স্রষ্টা সবকিছু সৃষ্টি করেছেন।’
তাহলে খেয়াল করুন, আমার প্রথম সত্যের সাথে কিন্তু তৃতীয় শর্ত ম্যাচ হচ্ছে না। আর প্রথম শর্ত ছিল -সকল সৃষ্টির শুরু আর শেষ আছে। কিন্তু তৃতীয় শর্তে কথা বলছি স্রষ্টা নিয়ে। তিনি সৃষ্টি নন, তিনি স্রষ্টা। তাই এখানে প্রথম শর্ত খাটে না। তাপ গতি সূত্রটি এখানে আর খাটছে না। তার মানে, স্রষ্টার শুরুও নেই, শেষও নেই। অর্থাৎ, তাকে নতুন করে সৃষ্টির প্রয়োজন নাই। তার মানে স্রষ্টার আরেকজন স্রষ্টা থাকারও প্রয়োজন নাই। তিনি অনাদি, অনন্ত।
এইটুকু বলে সাজিদ থামল। হুমায়ুন আজাদ নামের লোকটি কপালের ভাঁজ দীর্ঘ করে বললেন, -‘কি ভং চং বুঝালি এগুলো? কিসব সমীকরণ টমিকরন? এসব কি? সোজা শাপ্টা বল। আমাকে অঙ্ক শিখাচ্ছিস? Law of Causality সম্পর্কে ধারণা আছে? Law of Causality মতে, সবকিছুর পেছনেও একটা কারন থাকতে হবে।’
সাজিদ বলল, -‘স্যার, উত্তেজিত হবেন না প্লিজ। আমি আপনাকে অঙ্ক শিখাতে যাব কোন সাহসে? আমি শুধু আমার মতো ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করেছি।’
-‘কচু করেছিস তুই। Law of Causality দিয়ে ব্যাখ্যা কর।’ –লোকটা উচ্চস্বরে বলল।
-‘স্যার, Law of Causality বলবত হয় তখনই, যখন থেকে Time, Space এবং Matter জন্ম লাভ করে, ঠিক না? কারণ আইনস্টাইনের থিওরী অফ রিলেটিভিটিও স্বীকার করে যে, Time জিনিসটা নিজেই Space আর Matter এর সাথে কানেক্টেড। Cause এর ধারণা তখনই আসবে যখন Time-Space-Matter এই ব্যাপার গুলো তৈরি হবে। তাহলে, যিনিই এই Time-Space-Matter এর স্রষ্টা তাকে কি করে আমরা Time-Space-Matter এর বাটখারা তে বসিয়ে Law of Causality দিয়ে বিচার করব? স্যার এটা তো লজিক বিরুদ্ধ, বিজ্ঞান বিরুদ্ধ।’
লোকটা চুপ করে আছে। কিছু হয়তো বলতে যাচ্ছিল। এর মধ্যেই আবার সাজিদ বলল, -‘স্যার আপনি Law of Causality’র যে সংজ্ঞা দিয়েছেন, সেটা ভুল।’
লোকটা আবার রেগে গেল। রেগেমেগে অগ্নিশর্মা হয়ে বলল, -‘এই ছোকরা ! আমি ভুল বলেছি মানে কি? তুই কি বলতে চাস আমি বিজ্ঞান বুঝিনা?’
সাজিব বলল, -‘না না স্যার, একদম তাই বলিনি। আমার ভুল হয়েছে। আসলে বলা উচিত ছিল যে- Law of Causality সংজ্ঞা বলতে গিয়ে আপনি ছোট্ট একটা জিনিস মিস করেছেন।’
লোকটির চেহারা এবার একটু স্বাভাবিক হল। বলল, -‘কি মিস করেছি?’
-‘আপনি বলেছেন Law of Causality মতে, সবকিছুরই একটি Cause থাকে। আসলে এটা স্যার সেরকম নয়। Law of Causality হচ্ছে Everything which has a beginning has a cause. অর্থাৎ, এমন সবকিছু, যেগুলোর একটা নির্দিষ্ট শুরু আছে কেবল তাদেরই cause থাকে। স্রষ্টার কোন শুরু নেই, তাই স্রষ্টাকে Law of Causality দিয়ে মাপা যুক্তি এবং বিজ্ঞান বিরুদ্ধ।’
লোকটার মুখটা কিছুটা গম্ভীর হয়ে গেল। বলল। -‘তুই কি ভেবেছিস, এরকম ভারি ভারি কিছু শব্দ ব্যবহার করে কথা বললে আমি তোর যুক্তি মেনে নিব? অসম্ভব।’
সাজিদ এবার মুচকি হাসলো। হেসে বলল, -‘স্যার, আপনার হাতে একটি বই দেখছি। ওইটা কি বই?’
-‘এটা আমার লেখা বই –‘আমার অবিশ্বাস’।’
-‘স্যার ঐটা আমাকে দিবেন একটু?’
-‘এই নে ধর।’
সাজিদ বইটা হাতে নিয়ে উল্টালো। উল্টাতে উল্টাতে বলল, -‘স্যার, এই বইয়ের কোন লাইনে আপনি আছেন?’
লোকটা ভুরু কুঁচকে বলল, -‘মানে?’
-‘বলছি এই বইয়ের কোন অধ্যা, য় কোন পৃষ্ঠায়, কোন লাইনে আপনি আছেন?’
-‘তুই অদ্ভুত কথা বলছিস। আমি বইয়ে থাকবো কেন?’
-‘কেন থাকবেন না? আপনি এর স্রষ্টা না?’
-‘হ্যাঁ।’
-‘এই বইটা কালি আর কাগজ দিয়ে তৈরি। আপনিও কি কালি আর কাগজ দিয়ে তৈরি, স্যার?’
-‘খুবই স্টুপিড টাইপ প্রশ্ন। আমি এই বই এর স্রষ্টা। এই বই তৈরি সংজ্ঞা দিয়ে কি আমাকে ব্যাখ্যা করা যাবে?’
সাজিদ আবার হেসে দিল। বলল, -‘না স্যার এই বই তৈরির যে সংজ্ঞা, সে সংজ্ঞা দিয়ে মোটেও আপনাকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। ঠিক সেভাবে এই মহাবিশ্ব যিনি তৈরি করেছেন, তাঁকেও তাঁর সৃষ্টির Time-Space-Matter- Cause এসব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না।
আপনি কালি কলম বা কাগজের তৈরি নন, তার উর্ধে। কিন্তু আপনি Time-Space-Matter- Cause এর উর্ধ্বে নন। আপনাকে এগুলো দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু, সৃষ্টিকর্তা হচ্ছেন এমন একজন, যিনি নিজেই Time-Space-Matter- Cause এর সৃষ্টিকর্তা। তাই তাকে Time-Space-Matter- Cause দিয়ে পরিমাপ করা যাবে না। তিনি এসব এর উর্দ্ধে। অর্থাৎ তার কোন Time-Space-Matter- Cause নাই। অর্থাৎ, তার কোন শুরু-শেষ নাই। অর্থাৎ, তার কোন সৃষ্টিকর্তা নাই।
লোকটি উঠে দাঁড়ালো। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো, -‘ভালো ব্রেইনওয়াশড ! ভালো ব্রেইনওয়াশড ! আমরা কি এমন তরুণ প্রজন্ম চেয়েছিলাম? হায় আমরা কি এমন তরুণ প্রজন্ম চেয়েছিলাম? এটা বলতে বলতে লোকটা হাটা ধরল। দেখতে দেখতেই উনি স্টেশনে মানুষের ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলেন।
ঠিক সেই মুহূর্তেই আমার ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙ্গার পর আমি কিছুক্ষণ ঝিম মেরে ছিলাম। ঘড়িতে সময় দেখলাম। রাত দেড়টা বাজে। সাজিদের বিছানার দিকে তাকালাম। দেখলাম, সে বিছানায় শুয়ে শুয়ে বই পড়ছে। আমি উঠে তার কাছে গেলাম। গিয়ে দেখলাম সে যে বইটা পরছে২, সেটার নাম ‘আমার অবিশ্বাস’। বইয়ের লেখক হুমায়ুন আজাদ।
সাজিদ বই থেকে মুখ তুলে আমার দিকে তাকালো। তার ঠোঁটের কোনায় একটি অদ্ভুত হাসি।
আমি বিরাট একটা শক খেলাম। নাহ ! এটা হতে পারে না স্বপ্নের উপর কারো হাত নেই-আমি বিড়বিড় করে বলতে লাগলাম।