সেকালের আরববাসীরা ছিল নানা দলে বিভক্ত এবং তাহাদের চরিত্র ছিল নেহায়েত মন্দ। সেকালের আরব জাহানে যদিও ইহুদি ও খ্রীস্টান ধর্মের প্রাধান্য ছিল, তবুও ঐখানে মূর্তিপূজার প্রচলন ছিল যথেষ্ট। মারামারি, কাটাকাটি, হিংসা, দ্বেষ, পরনিন্দা ইত্যাদি দুনিয়ার সমস্ত অন্যায়– অবিচারগুলি যেন জড়ো হইয়াছিল তখন আরবে। স্বদেশবাসীদের এহেন অধোগতি দেখিয়া ব্যথিত হইলেন হজরত মোহাম্মদ (সা.)। তিনি কেবলই চিন্তা করিতেন যে, কি করিয়া ইহাদের এই অধোগতি রোধ করা যায়, কি করিয়া ইহাদের অজ্ঞানান্ধকার দূর করিয়া জ্ঞানালোক দান ও একতাবদ্ধ করা যায়; কি রকমে দেখানো যায় ইহকাল ও পরকালের সরল পথ?
হজরতের বয়স যতই বৃদ্ধি পাইতে লাগিল, ততই বৃদ্ধি পাইতে থাকিল তাহার চিন্তাক্ষেত্রের পরিসর। সেই চিন্তা শুধু আরব জাহানেই সীমাবদ্ধ থাকিল না, তাহা পর্যবসিত হইল বিশ্বমানবের কল্যাণের চিন্তায়। তিনি ডুবিলেন চিন্তাসমুদ্রের গভীর তলদেশে মক্কার অদূরবর্তী হেরা পর্বতের গহ্বরে।
হজরতের বয়স তখন প্রায় ৪০ বৎসর। ৬১০ খ্রীস্টাব্দের আগস্ট মাসের ৬ তারিখ। হজরত হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যানমগ্নাবস্থায় বসিয়া আছেন। এমন সময় তিনি শুনিতে পাইলেন যে, আল্লাহর ফেরেশতা জেব্রাইল আসিয়া তাহাকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন, “আল্লাহর বাণী আপনার উপর নাজেল হইল, আপনি আল্লাহর রসূল।” এই দিন হইতে হজরত মোহাম্মদ (সা.) হইলেন পয়গম্বর, অর্থাৎ আল্লাহর প্রেরিত মহান বাণীবাহক।
ঐদিন হইতে হজরত তাহার সমস্যাসমূহের সমাধানে প্রাপ্ত হইতে থাকেন জেব্রাইল ফেরেশতার মারফত আল্লাহর বাণী এবং তাহা সাধারণ্যে প্রকাশ করিতে থাকেন ‘ভাববাণী’ রূপে। ইহকাল ও পরকাল বিষয়ে মানুষের কর্তব্য সম্বন্ধে আল্লাহর বাণীরূপে জেব্রাইল ফেরেশতার মারফত হজরত মোহাম্মদ (সা.) আমরণ যে সমস্ত আদেশ-উপদেশাদি প্রাপ্ত হইয়াছেন, তাহারই সঙ্কলন পবিত্র কোরান মহাগ্রন্থখানা।
পবিত্র কোরানের বিধান ব্যতীত হজরত স্বয়ং ধর্মজগতের আবশ্যকীয় অনেক বিধান প্রদান করিয়াছেন। সেই সমস্ত বিধানের সকলনকে বলা হয় পবিত্র হাদিস গ্রন্থ। ইসলাম ধর্ম প্রধানত পবিত্র কোরান ও হাদিস গ্রন্থের বিধানের উপর প্রতিষ্ঠিত।
————
৩৯. প্রাচীন মিশর, শচীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, পৃ. ১২১, ১২২।
৪০, পৃথিবীর আশ্চর্য, উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, পৃ. ২৭।
১৬. প্লাবন ও পুনঃ সৃষ্টি
প্লাবন ও পুনঃ সৃষ্টি
মানুষ, পশু, পাখি, তরুলতা ইত্যাদি যাহা আমরা বর্তমানে দেখিতে পাইতেছি, ইহারা প্রাথমিক সৃষ্টির বংশধর নহে। জগদ্ব্যাপী এক মহাপ্লাবনের ফলে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত জীব ও উদ্ভিদাদি ধংসপ্রাপ্ত হইয়াছিল এবং গুটিকতক যাহারা জীবিত ছিল, তাহাদের বংশাবলীতে বর্তমান জগত ভরপুর।
উক্তরূপ একটি প্লাবনের কাহিনীকে কেন্দ্র করিয়া নানা দেশে নানা রকম প্রবাদ সৃষ্টি হইয়া, ঐগুলি জাতিবিশেষের মধ্যে বেশ প্রসিদ্ধি লাভ করিয়া আছে। এইখানে আমরা উহার কয়েকটি কাহিনীর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিতেছি।
# হিন্দুদের কাহিনী
পৌরাণিক শাস্ত্রাদিতে জলপ্লাবনের বিস্তৃত বিবরণ দেখিতে পাওয়া যায়। ঐ প্লাবনে মহর্ষি মনু যাবতীয় জীবজন্তু ও উদ্ভিদাদির বীজ রক্ষা করিয়াছিলেন এবং তাহা হইতেই আধুনিক জীবাদির সৃষ্টি হইয়াছে।[৪১] (শতপথ ব্রাহ্মণ– প্রথম খণ্ড, অষ্টম ব্রাহ্মণ, দশম অধ্যায়; মৎস্য পুরাণ– প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায়; মহাভারত– বনপর্ব, সপ্তাশীত্যধিক শততমাধ্যায় দ্রষ্টব্য)।
.
# ইরানীয়দের কাহিনী
ইরানীয়দের জেল-আভেস্তা গ্রন্থের ভেন্দিদাদ অংশে এক প্রলয়ঙ্করী প্লাবনের বিষয় লিখিত আছে। তবে উহা জলপ্লাবন নহে, তুষারপাত। উক্ত বিবরণে অহুর মজদা (ঈশ্বর) জীবাদি ধ্বংসের জন্য যিম (যম)-কে বলিতেছেন, “বিবঘতের পুত্র যিম! এই জীবজন্তু সমাকুল পৃথিবীতে ভীষণ শৈত্য উপস্থিত হইবে। তাহা হইতে সর্ববিধ্বংসী তীব্র তুষার উৎপন্ন হইয়া পৃথিবীকে ধ্বংস করিয়া ফেলিবে। সেই তুষার পৃথিবীপৃষ্ঠে সর্বত্র বিতস্তি (১৪ অগুলি) পরিমাণ পুরু হইয়া বিদ্যমান থাকিবে। পর্বতের উচ্চ চূড়া হইতে আরম্ভ করিয়া সমুদ্রের তলদেশ পর্যন্ত সমভাবে তুষারাবৃত হইবে। যে সকল প্রাণী অরণ্যে বাস করে, যাহারা পর্বতের উপর অবস্থিত থাকে, অথবা যাহারা অধিত্যকা প্রদেশে বাস করে –এই সর্বব্যাপী তুষারসম্পাতে সেই ত্রিবিধ প্রাণীই মৃত্যুর ক্রোড়ে আশ্রয় লইবে। যে সকল চারণক্ষেত্র তৃণ-শল্পে পরিপূর্ণ রহিয়াছে, যেখানে স্বচ্ছসলিলা স্রোতস্বিনী প্রবাহিত হইতেছে এবং যেখানে আজিও ক্ষুদ্র-বৃহৎ পশ্বাদি বিচরণ করিতেছে –সেই সকল স্থান হইতে, সেই ভীষণ শৈত্যাধিক্যের পূর্বে মানুষের, কুকুরের, পক্ষীর, মেষের, বৃষের বীজ সংগ্রহ করিয়া আন এবং তৎসমুদয় রক্ষার জন্য ভর প্রস্তুত করিয়া রাখ।”[৪২]
উক্ত কাহিনীটির সহিত অন্যান্য কাহিনীগুলির তিনটি বিষয়ে আপাতপার্থক্য দেখা যায়। প্রথমত, অন্যান্য কাহিনীতে পাওয়া যায় জলপ্লাবন আর এইখানে তুষারপ্লাবন। তবে জল ও তুষার মূলত একই পদার্থ। দ্বিতীয়ত, অন্যান্য কাহিনীতে দেখা যায় যে, ঈশ্বর কোনো এক ব্যক্তিকে ভবিষ্যদ্ববাণী করিয়াছেন এবং অচিরেই তাহা ঘটিয়াছে; আর এইখানে উহা ঘটিয়াছে কি না, তাহার উল্লেখ নাই। বোধহয় যে, ঘটিয়া গিয়াছে। তৃতীয়ত, অন্যান্য কাহিনীতে ঈশ্বর বলিয়াছেন নৌকা তৈয়ার করিতে, আর এইখানে বলিয়াছেন ভর তৈয়ার করিতে। কিন্তু অনুবাদকগণ ‘ভর’ শব্দের অর্থ করিয়াছেন স্থান বা নৌকা। জেন্দ-আভেস্তার অনুবাদক অধ্যাপক ডারমেস্টাটর ভরকে বলিয়া গিয়াছেন নোয়ার আর্ক, অর্থাৎ নূহের নৌকা।