এখানে উল্লেখনীয় যে, অথর্ববেদে পিতা-পুত্রী ও ভ্রাত-ভগিনীর মধ্যে যৌনমিলনের উল্লেখ আছে। পৌরাণিক এক কাহিনী থেকে আমরা জানি যে, নহুষ তার ‘পিতৃকন্যা’ বিরজাকে বিবাহ করেছিল ও তার গর্ভে ছয়টি সন্তান উৎপাদন করেছিল। বর্তমানকালে এরূপ যৌনাচারকে ইনসেস্ট’ (incest) বা অজাচার বলা হয়। তবে ষেসমাজের মধ্যে এরূপ সংসর্গ ঘটে, সেই সমাজের নীতিবিধানের ওপরেই নির্ভর করে—কোনটা অজাচার, আর কোনটা অজাচার নয়।
অজাচারের সামিল হচ্ছে ব্যভিচার। নারী যখন নিজ স্বামী ব্যতীত অপর পুরুষের সঙ্গে যৌনমিলনে প্রবৃত্ত হয়, তখন সেরূপ সংসৰ্গকে ব্যভিচার বলা হয়। স্মৃতিশাস্ত্রসমূহে বলা হয়েছে, যতরকম ব্যভিচার আছে, তার মধ্যে সর্বাপেক্ষ ঘৃণিত ও কদর্য হচ্ছে গুরুতল্প বা গুরুস্ত্রীগমন। অথচ প্রাচীন ভারতে এটা আকছার ঘটত। গুরুর অনুপস্থিতিতে গুরুপত্নীরা পুত্রস্তানীয় ও ব্রহ্মচর্যে রত শিষুদের প্রলুব্ধ করত তাদের সঙ্গে যৌনমিলনে রত হতে। এ-সম্বন্ধে মনস্তত্ত্ববিদরা কী বলবেন জানি না, তবে ষাট বৎসর পূর্বে বিলাতের এক পত্রিকায় একজন fossie of oilo asso co-footix: ‘I can think nothing more horrible than a woman proposing to a man’. কিন্তু বাস্তব জীবনে এরূপ horrible জিনিসই ঘটে। শিষ্যদের কাছে গুরুপত্নীদের যৌনমিলনের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করা তারই উদাহরণ। ঋগ্বেদেও আমরা পড়ি, যমী তার সহোদর ভ্রাতা যমকে প্রলুব্ধ করছে তার সঙ্গে যৌনমিলনে রত হবার জন্য।
***
নারী ব্যভিচারে লিপ্ত হয় তখনই—যখন সে নিজ স্বামীকে ভজনা করতে চায় না, বা তার নিজ স্বামী স্থানান্তরে থাকে। শেষোক্ত পারস্থিতিটাই গুরুতল্পের ক্ষেত্রে খাটত। আদিম যৌনক্ষুধার প্রক্রিয়াতেই এটা ঘটে। এটা বিশেষভাবে প্রকাশ পেয়েছিল মধ্যযুগে, আমাদের দেশের কৌলীন্ত-শাসিত সমাজে। সে-সমাজের মেয়ের বিবাহের পর বাপের বাড়িতেই থেকে যেত। স্বামী কচিৎ-কদাচিৎ শ্বশুরবাড়ি আসত। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি এলে কি হবে? বিনা দক্ষিণায় তারা কখনও স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হ’ত না। ভারতচন্দ্র তার ‘অন্নদামঙ্গল’-এ এর এক সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন। সেখানে এক কুলীনের মেয়ের মুখ দিয়ে তিনি বলিয়েছেন :
‘আর রামা বলে আমি কুলীনের মেয়ে।
যৌবন বহিয়া গেল বর চেয়ে চেয়ে॥
যদি বা হইল বিয়া কতদিন বই।
বয়স বুঝলে তার বড়দিদি হই॥
বিয়াকালে পণ্ডিতে পণ্ডিতে বাদ লাগে।
পুনর্বিয়া হবে কিনা বিয়া হবে আগে॥
বিবাহ করেছে সেটা কিছু ষাটি ঘাটি।
জাতির যেমন হৌক কুলে বড় আঁটি॥
দু-চারি বৎসরে যদি আসে একবার।
শয়ন করিয়া বলে কি দিবি ব্যাভার ॥
সূতাবেচা কড়ি যদি দিতে পারি তায়।
তবে মিষ্ট মুখ, নহে রুষ্ট হয়ে যায়॥’
এরূপ সমাজে যে-সব মেয়ের যৌনক্ষুধা প্রবল, তাদের ক্ষেত্রে যা ঘটত তা সহজেই অনুমেয়। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে রামনারায়ণ তর্করত্ব ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সেটা খোলাখুলিই বলেছিলেন। রামনারায়ণ তাঁর ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ নাটকের চতুর্থ অঙ্কে পিতা-পুত্রের সংলাপের ভেতর দিয়ে সেটা বলেছেন। পুত্র তিন বৎসর শ্বশুরবাড়ি যায়নি। হঠাৎ খবর এল তার একটি কন্যাসন্তান হয়েছে। পুত্র আশ্চর্য হয়ে পিতাকে যখন এ-কথা বলছে, তখন পিতা বলছেন, ‘বাপু হে! তাতে ক্ষতি কি? আমি তোমার জননীকে বিবাহ করে তথায় একবারও যাই নাই, একেবারে তোমার সাক্ষাৎ হয়। কুলীনকস্তাদের যখন স্বামী ব্যতীতই গর্ভ হ’ত, তখন মেয়ের মায়েরা কী কৌশল অবলম্বন করে সেই সন্তানের বৈধতা পাড়াপাড়শীর কাছে জানাত তা বিদ্যাসাগরমশাই তার “বহুবিবাহ’ নিবন্ধে বিবৃত করেছেন।
***
আপস্তম্ব-ধৰ্মসূত্রে কুমারী মেয়ের সঙ্গে ব্যভিচার করাটা একটা গৰ্হিত অপরাধ বলে গণ্য করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, যদি কোনো পুরুষ অনুঢ়া মেয়ের সঙ্গে ব্যভিচার করে, তবে তার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে এবং তাকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। আরও বলা হয়েছে যে, রাজা সংশ্লিষ্টা কুমারীকে সমস্ত কলঙ্ক থেকে মুক্ত করবেন এবং তাকে তার অভিভাবকদের হাতে সমর্পণ করবেন, যদি অভিভাবক যথোচিত প্রায়শ্চিত্ত নিম্পাদনের ব্যবস্থা করে।
কিন্তু দেখা যায়, মহাভারতীয় যুগে কুমারী মেয়েদের যৌনসংসর্গ অনুমোদিত হত। বোধহয় তার আগের যুগেও হ’ত। কেননা, ছান্দোগ্য উপনিষদে আমরা দেখতে পাই, মহৰ্ষি সত্যকামের মাতা জবালা যৌবনে বহুচারিণী ছিলেন। মহাভারতে এরূপ সংসর্গের একাধিক দৃষ্টান্ত আছে। পরাশর-সত্যবতীর কাহিনী সুবিদিত। সত্যবর্তী যৌবনে যমুনায় খেয়া-পারাপারের কাজে নিযুক্ত থাকত। একদিন পরাশরমুনি তার নৌকোয় উঠে, তার অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তার সঙ্গে যৌনমিলন প্রার্থনা করে। সত্যবতী তখন পরাশরকে বলে—নৌকোর মধ্যে আমি কী ভাবে যৌনকর্মে রত হব, কেননা তীর হতে লোকের আমাদের দেখতে পাবে। পরাশর তখন কুজ্যাটিকার স্মৃষ্টি করেন ও তারই অন্তরালে তার সঙ্গে যৌনমিলনে রত হন। এর ফলে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের জন্ম হয়। কুন্তীও কুমারী অবস্থায় সূর্যের সঙ্গে মিলনের ফলে কৰ্ণকৈ প্রসব করেন। মাধবী-গালব উপাখ্যানেও আমরা দেখি যে, প্রতিবার সন্তান-প্রসবের পরও মাধবী কুমারী ছিল। ওই যুগের সমাজে বিবাহের পূর্বে যে মেয়েদের যৌনসংসর্গ অনুমোদিত হ’ত এবং এরূপ যৌনসংসর্গের জন্য মেয়ের তাদের কুমারীত্ব হারাত না, ত৷ কুমারী মেয়েদের সন্তানদের বিশিষ্ট আখ্যা থেকে বুঝতে পারা যায়। এ-সম্বন্ধে কৃষ্ণ কর্ণকে বলেছেন, ‘কুমারী মেয়ের দু’রকম সন্তান হতে পারে—(১) কানীন ও (২) সহোঢ়। যে সন্তানকে কন্যা বিবাহের পূর্বেই প্রসব করে, তাকে বলা হয় ‘কানন। আর যে মেয়ে বিবাহের পূর্বে গর্ভধারণ করে বিবাহের পরে সন্তান প্রসব করে, সে-সন্তানকে বলা হয় সহোঢ়’। মহাভারতের অপর একজায়গায় ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলছেন, ‘কুমারী মেয়ের দু’রকমের সন্তান হতে পারে। যে সন্তানকে সে বিবাহের পূর্বে প্রসব করে, তাকে বলা হয় কানীন, আর যে সন্তানকে সে বিবাহের পরে প্রসব করে, তাকে বলা হয় অরোঢ়। এসব থেকে বুঝতে পারা যায় যে, মহাভারতীয় যুগে কুমারী কন্যার পক্ষে গর্ভধারণ করা বিশেষ নিন্দনীয় ব্যাপার ছিল না।