- বইয়ের নামঃ চোদ্দ শতকের বাঙালী
- লেখকের নামঃ অতুল সুর
- বিভাগসমূহঃ মুক্তিযুদ্ধের-বই
শতক বিহরণ
কালের অনন্ত প্রবাহে একশ’ বছর এক অতি সামান্য বিন্দুমাত্র। কিন্তু বঙ্গাব্দ চোদ্দ শতকের এই সামান্য সময়কালের মধ্যেই ঘটে গিয়েছে বৈপ্লবিক ঘটনাসমহ যথা, দই মহাযুদ্ধ, এক মন্বন্তর, স্বাধীনতা লাভ ও দেশ বিভাগ, গগনস্পর্শী মূল্যস্ফীতি, নৈতিক শৈথিল্য, মানবিক সত্তার অবনতি, নারী নির্যাতন-ধর্ষন ও বাঙালীর আত্মহনন। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় ঘটনা হচ্ছে ১৯৪৭ খ্রীস্টাব্দে ভারত থেকে ইংরেজের মহাপ্রস্থান ও ভারতের স্বাধীনতা লাভ । সেই ঘটনাই শতাব্দীর ইতিহাসকে বিভক্ত করে দভাগে । সেই ঘটনা ঘটবার আগে আমরা কিরকম ছিলাম ও পরে কি হয়েছি, সেটাই আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু ।
বঙ্গাব্দ ১৩০০-র আগের একশ’ বছরে বাঙলায় ঘটে গিয়েছিল নবজাগরণ বা রেনেসাঁ। যদিও রেনেসাঁর প্রধান হোতাদের মধ্যে মাইকেল মধুসূদন দত্তের মৃত্যু ঘটেছিল ১২৮০ বঙ্গাব্দে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ১২৯৮ বঙ্গাব্দে ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ১৩০০ বঙ্গাব্দে, তা হলেও তাঁদের তিরোধানের সঙ্গে রেনেসাঁর ধারা শুকিয়ে যায়নি। পূর্ণমাত্রায় চলেছিল সেই ধারা । দেশকে বড় ও মহৎ করাই ছিল রেনেসাঁর হোতাদের প্রধান লক্ষ্য । ১৩০০ বঙ্গাব্দেই আমরা স্বামী বিবেকানন্দকে দেখি আমেরিকার শিকাগো শহরে অনুষ্ঠিত ধর্ম মহাসভায় ভারতীয় সংস্কৃতির মহান আদশ সম্বন্ধে বক্তৃতা দিয়ে বিশ্বজনের মন জয় করতে। ভারত সেদিন গর্বিত হল, যখন পড়ল ‘নিউ ইয়র্ক হেরালড’-এর স্তম্ভে বিবেকানন্দ সম্বন্ধে লিখিত প্রশস্তি—’ভারতের বাত্যাসৃজনী ঋষি ধর্মমহাসভার বৃহত্তম মানুষ ।’
বস্তুত শতাব্দীর প্রথম পাদটা ছিল ভারতের এক অত্যাশ্চর্য ও আনন্দমুখের যােগ । মোহনবাগান জয় করল আই এফ এ শিল্ড । রবীন্দ্রনাথ পেলেন নোবেল পরিস্কার। শরৎচন্দ্র শুরু করলেন তাঁর আবিস্মরণীয় উপন্যাসসমূহ । আমেরিকায় গিয়ে ধনগোপাল মুখোপাধ্যায় পেলেন তাঁর ‘গ্ৰে নেক’ গ্রন্থের জন্য মার্কিন মুলুকের বিখ্যাত পুরস্কার ‘জন নিউবেরি পদক’। প্রথম মহাযদ্ধের সময় বাঙালী দূর করল। সাহেবদের দেওয়া অপবাদ যে বাঙালীর সামরিক শৌর্যবীর্য নেই। সামরিক বাহিনীতে যোগদান করে এক দল বাঙালী বীর সেদিন বিশ্বকে চমৎকৃত করল। পশ্চিম রণাঙ্গনে জার্মানদের গোলাবর্ষণের ব্যূহ ভেদ করে কেড়ে নিয়ে এল জার্মানদের কামানগুলো । বস্তুত, ধর্ম, ক্ৰীড়া, সাহিত্য, সামরিক শৌর্যবীর্য, সব ক্ষেত্রেই স্বীকৃত হল বাঙালীর শ্রেষ্ঠত্ব ।
।। দুই ।।
চিন্তাশীলতার ক্ষেত্রে বাঙালী সেদিন ছিল অদ্বিতীয়। গোপালকৃষ্ণ গোখলে উদাত্তকণ্ঠে ঘোষণা করলেন–‘হোয়াট বেঙ্গল থিংকস টুডে, ইণ্ডিয়া থিংকস টুমরো ।’ গোপালকৃষ্ণ গোখলের এই উক্তির মধ্যে কোন অতিরঞ্জন ছিল না। আগের শতকে বাঙলাই ছিল নবজাগতির প্রসূতিগার। সব বিষয়ে বাঙালী ছিল এগিয়ে । ১৮৮৫ খ্রীস্টাব্দে (১৩০০ বঙ্গাব্দ শুরু হয়েছিল ১৩ এপ্রিল ১৮৯৩ খ্রীস্টাব্দে ) বোম্বাইয়ে যখন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন হয়, তখন তার সভাপতিত্ব করলেন একজন বাঙালী–উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। আবার প্রথম বাঙালী সিভিলিয়ান নিযুক্ত হলেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর । সাহেবদের ইংরেজি লেখার ভুল ধরতে লাগলেন রেভারেণ্ড লালবিহারী দে ।
চিন্তাশীলতার ক্ষেত্রে শতাব্দীর প্রথমার্ধে আমরা যেসব অনন্যসাধারণ বাঙালীকে দেখি, তাঁদের মধ্যে জনাকয়েকের আমরা এখানে নাম করছি–বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, গিরীশচন্দ্র, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিপিন চন্দ্ৰ পাল, রামেন্দ্ৰসুন্দর ত্ৰিবেদী, শিশির কুমার ঘোষ, মতিলাল ঘোষ, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জগদীশচন্দ্র বসু, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, বিনয়কুমার সরকার, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রাসবিহারী ঘোষ, তারকচন্দ্র পালিত, ব্যোমকেশ চক্রবর্তী, যোগেশচন্দ্র রায়, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী, যদ্যনাথ সরকার, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, শিশির কুমার ভাদুড়ি, অরবিন্দ ঘোষ, বারীন্দ্রনাথ ঘোষ, ক্ষুদীরাম বসু, কানাইলাল দত্ত, সূর্য সেন, দীনেশচন্দ্র সেন, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, হেমেন্দ্ৰ প্ৰসাদ ঘোষ, সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার, সুরেশচন্দ্র মজুমদার, চিত্তরঞ্জন দাশ, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, সুভাষচন্দ্র বসু, বিধানচন্দ্র রায়, নীলরতন সরকার, নলিনীরঞ্জন সরকার, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে এদের সমতুল্য কোন ব্যক্তিকে আর দেখি না। শতাব্দীর প্রথমার্ধের মানুষেরা ছিলেন চিন্তাশীল ও প্রতিভাবান। চিন্তাশীলতাই ছিল তাঁদের মূলধন। দ্বিতীয়ার্ধের মানুষদের মূলধন হচ্ছে চালাকি । চালাকির দ্বারাই তাঁরা সবকিছ, সমাধা করতে চান ৷ প্ৰতিভার আজ আর কোন কদর নেই। যারা চালাকিতে ওস্তাদ, পাঁচজনের বই থেকে বিনা স্বীকৃতিতে উপাদান চুরি করে বই ছাপাতে জানে, তারাই আজকের চিন্তাশীল ও প্রতিভাবান পুরুষ। তারাই আজকের পণ্ডিতপ্রবর ও তারাই পায় সাম্মানিক ডি. লিট। সব দেখে শুনে বলতে ইচ্ছে করে—‘ডক্টরেটস আর অ্যাওয়াডেড বাই দ্য ফুলস ফর দ্য বেনিফিট অফ দ্য ফুলস।’