- বইয়ের নামঃ চোদ্দ শতকের বাঙালী
- লেখকের নামঃ অতুল সুর
- বিভাগসমূহঃ মুক্তিযুদ্ধের-বই
শতক বিহরণ
কালের অনন্ত প্রবাহে একশ’ বছর এক অতি সামান্য বিন্দুমাত্র। কিন্তু বঙ্গাব্দ চোদ্দ শতকের এই সামান্য সময়কালের মধ্যেই ঘটে গিয়েছে বৈপ্লবিক ঘটনাসমহ যথা, দই মহাযুদ্ধ, এক মন্বন্তর, স্বাধীনতা লাভ ও দেশ বিভাগ, গগনস্পর্শী মূল্যস্ফীতি, নৈতিক শৈথিল্য, মানবিক সত্তার অবনতি, নারী নির্যাতন-ধর্ষন ও বাঙালীর আত্মহনন। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় ঘটনা হচ্ছে ১৯৪৭ খ্রীস্টাব্দে ভারত থেকে ইংরেজের মহাপ্রস্থান ও ভারতের স্বাধীনতা লাভ । সেই ঘটনাই শতাব্দীর ইতিহাসকে বিভক্ত করে দভাগে । সেই ঘটনা ঘটবার আগে আমরা কিরকম ছিলাম ও পরে কি হয়েছি, সেটাই আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু ।
বঙ্গাব্দ ১৩০০-র আগের একশ’ বছরে বাঙলায় ঘটে গিয়েছিল নবজাগরণ বা রেনেসাঁ। যদিও রেনেসাঁর প্রধান হোতাদের মধ্যে মাইকেল মধুসূদন দত্তের মৃত্যু ঘটেছিল ১২৮০ বঙ্গাব্দে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ১২৯৮ বঙ্গাব্দে ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ১৩০০ বঙ্গাব্দে, তা হলেও তাঁদের তিরোধানের সঙ্গে রেনেসাঁর ধারা শুকিয়ে যায়নি। পূর্ণমাত্রায় চলেছিল সেই ধারা । দেশকে বড় ও মহৎ করাই ছিল রেনেসাঁর হোতাদের প্রধান লক্ষ্য । ১৩০০ বঙ্গাব্দেই আমরা স্বামী বিবেকানন্দকে দেখি আমেরিকার শিকাগো শহরে অনুষ্ঠিত ধর্ম মহাসভায় ভারতীয় সংস্কৃতির মহান আদশ সম্বন্ধে বক্তৃতা দিয়ে বিশ্বজনের মন জয় করতে। ভারত সেদিন গর্বিত হল, যখন পড়ল ‘নিউ ইয়র্ক হেরালড’-এর স্তম্ভে বিবেকানন্দ সম্বন্ধে লিখিত প্রশস্তি—’ভারতের বাত্যাসৃজনী ঋষি ধর্মমহাসভার বৃহত্তম মানুষ ।’
বস্তুত শতাব্দীর প্রথম পাদটা ছিল ভারতের এক অত্যাশ্চর্য ও আনন্দমুখের যােগ । মোহনবাগান জয় করল আই এফ এ শিল্ড । রবীন্দ্রনাথ পেলেন নোবেল পরিস্কার। শরৎচন্দ্র শুরু করলেন তাঁর আবিস্মরণীয় উপন্যাসসমূহ । আমেরিকায় গিয়ে ধনগোপাল মুখোপাধ্যায় পেলেন তাঁর ‘গ্ৰে নেক’ গ্রন্থের জন্য মার্কিন মুলুকের বিখ্যাত পুরস্কার ‘জন নিউবেরি পদক’। প্রথম মহাযদ্ধের সময় বাঙালী দূর করল। সাহেবদের দেওয়া অপবাদ যে বাঙালীর সামরিক শৌর্যবীর্য নেই। সামরিক বাহিনীতে যোগদান করে এক দল বাঙালী বীর সেদিন বিশ্বকে চমৎকৃত করল। পশ্চিম রণাঙ্গনে জার্মানদের গোলাবর্ষণের ব্যূহ ভেদ করে কেড়ে নিয়ে এল জার্মানদের কামানগুলো । বস্তুত, ধর্ম, ক্ৰীড়া, সাহিত্য, সামরিক শৌর্যবীর্য, সব ক্ষেত্রেই স্বীকৃত হল বাঙালীর শ্রেষ্ঠত্ব ।
।। দুই ।।
চিন্তাশীলতার ক্ষেত্রে বাঙালী সেদিন ছিল অদ্বিতীয়। গোপালকৃষ্ণ গোখলে উদাত্তকণ্ঠে ঘোষণা করলেন–‘হোয়াট বেঙ্গল থিংকস টুডে, ইণ্ডিয়া থিংকস টুমরো ।’ গোপালকৃষ্ণ গোখলের এই উক্তির মধ্যে কোন অতিরঞ্জন ছিল না। আগের শতকে বাঙলাই ছিল নবজাগতির প্রসূতিগার। সব বিষয়ে বাঙালী ছিল এগিয়ে । ১৮৮৫ খ্রীস্টাব্দে (১৩০০ বঙ্গাব্দ শুরু হয়েছিল ১৩ এপ্রিল ১৮৯৩ খ্রীস্টাব্দে ) বোম্বাইয়ে যখন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন হয়, তখন তার সভাপতিত্ব করলেন একজন বাঙালী–উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। আবার প্রথম বাঙালী সিভিলিয়ান নিযুক্ত হলেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর । সাহেবদের ইংরেজি লেখার ভুল ধরতে লাগলেন রেভারেণ্ড লালবিহারী দে ।
চিন্তাশীলতার ক্ষেত্রে শতাব্দীর প্রথমার্ধে আমরা যেসব অনন্যসাধারণ বাঙালীকে দেখি, তাঁদের মধ্যে জনাকয়েকের আমরা এখানে নাম করছি–বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, গিরীশচন্দ্র, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিপিন চন্দ্ৰ পাল, রামেন্দ্ৰসুন্দর ত্ৰিবেদী, শিশির কুমার ঘোষ, মতিলাল ঘোষ, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জগদীশচন্দ্র বসু, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, বিনয়কুমার সরকার, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রাসবিহারী ঘোষ, তারকচন্দ্র পালিত, ব্যোমকেশ চক্রবর্তী, যোগেশচন্দ্র রায়, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী, যদ্যনাথ সরকার, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, শিশির কুমার ভাদুড়ি, অরবিন্দ ঘোষ, বারীন্দ্রনাথ ঘোষ, ক্ষুদীরাম বসু, কানাইলাল দত্ত, সূর্য সেন, দীনেশচন্দ্র সেন, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, হেমেন্দ্ৰ প্ৰসাদ ঘোষ, সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার, সুরেশচন্দ্র মজুমদার, চিত্তরঞ্জন দাশ, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, সুভাষচন্দ্র বসু, বিধানচন্দ্র রায়, নীলরতন সরকার, নলিনীরঞ্জন সরকার, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে এদের সমতুল্য কোন ব্যক্তিকে আর দেখি না। শতাব্দীর প্রথমার্ধের মানুষেরা ছিলেন চিন্তাশীল ও প্রতিভাবান। চিন্তাশীলতাই ছিল তাঁদের মূলধন। দ্বিতীয়ার্ধের মানুষদের মূলধন হচ্ছে চালাকি । চালাকির দ্বারাই তাঁরা সবকিছ, সমাধা করতে চান ৷ প্ৰতিভার আজ আর কোন কদর নেই। যারা চালাকিতে ওস্তাদ, পাঁচজনের বই থেকে বিনা স্বীকৃতিতে উপাদান চুরি করে বই ছাপাতে জানে, তারাই আজকের চিন্তাশীল ও প্রতিভাবান পুরুষ। তারাই আজকের পণ্ডিতপ্রবর ও তারাই পায় সাম্মানিক ডি. লিট। সব দেখে শুনে বলতে ইচ্ছে করে—‘ডক্টরেটস আর অ্যাওয়াডেড বাই দ্য ফুলস ফর দ্য বেনিফিট অফ দ্য ফুলস।’
।। তিন ।।
শতাব্দীর প্রথমার্ধটা ছিল অত্যন্ত সুখস্বাচ্ছন্দ্যের যােগ । জিনিসপত্তরের দাম ছিল খুবই সস্তা । শতাব্দীর সূচনায় চালের দাম ছিল এক টাকা মন । তবে বঙ্গাব্দ প্রথম দশকের গোড়ার দিকে বুয়ার যুদ্ধের জন্য দাম বেড়ে দেড় টাকা থেকে দু’টাকা হয়েছিল । চল্লিশের দশকে (দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের গোড়ার দিকে গুণাগুণ অনুযায়ী) চালের দাম ছিল আড়াই টাকা থেকে সাড়ে তিন টাকা মন । অধিকাংশ ডালের দাম ছিল ছ’ পয়সা সের। আটা দু’ পয়সা সের, ময়দা চার পয়সা সের, সর্ষের তেল দশ পয়সা সের, চিনি দু’ আনা সের, আর ভাল ভয়সা ঘি দশ আনা সের । মাখন আট আনা সের, মাংস ছ’ আনা সের । বাগদা, ট্যাংরা, পারসে ইত্যাদি মাছ চার আনা সের। কাটা রুই মাছ ছ’ আনা সের। দশ হাতি লাট্টূ মার্কা ভাল বিলিতি কাপড় দেড় টাকা থেকে সাত সিকা জোড়া। এখনকার এক টাকা দামের রসগোল্লার নাম ছিল ‘রসমুণ্ডি’। এক পয়সায় চারটে রসমুণ্ডি পাওয়া যেত। ফাউ চাইলে দোকানদার আরও একটা ফাউ দিত । আর বাকি সব রকম খাবার ছিল ছ’ আনা সের। এসব দাম ১৯৪২ খ্রীস্টােব্দ পর্যন্ত ( বঙ্গাব্দ শতকের প্রথমার্ধ পযন্ত) চাল ছিল । তখনও কলকাতা শহরে ‘পাইস হোটেল’- এর অস্তিত্ব ছিল । এসব হোটেলে এক পয়সার বিনিময়ে ভাত, ডাল, তারকারী, চাটনি পাওয়া যেত। কাপড়চোপড়ও ১৯৪২ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত আগেকার মতই ছিল । তবে তখন বিলিতি কাপড়ের পরিবর্তে এখানকার মিলের কাপড় পরার রীতি হয়েছিল । ১২০-কাউণ্ট সুতোর মিহি ধুতির দাম ছিল সাত সিকে ও শাড়ীর দাম দু’টাকা চার আনা জোড়া। আর ধনেখালির উৎকৃষ্ট শাড়ী তিন টাকা থেকে সাড়ে তিন টাকায় পাওয়া যেত ।
ছেলেদের লেখাপড়ার খরচও ছিল খুব কম। স্কুলের মাইনে ছিল। মাসিক এক আনা থেকে শুরু করে ম্যাট্রিকুলেশন (সকল ফাইনাল ) ক্লাসে দু’টাকা । কলেজের মাইনে এক টাকা (ক্ষুদিরাম বাবুর সেনট্রাল কলেজে ) থেকে শুরু করে পাঁচ টাকা ( স্কটিশ চার্চ কলেজে ) । বিশ্ববিদ্যালয়ের এম. এ ক্লাসের মাইনে ছিল আট টাকা। পরীক্ষার ফি ছিল পনের থেকে পঁচিশ টাকা । আমার প্রথম বছরে লেখাপড়া করতে মোট খরচ হয়েছিল চোদ্দ আনা পয়সা–মাসিক এক আনা হিসাবে এক বৎসরের মাইনে বারো আনা, একখানা বর্ণপরিচয় দু’পয়সা, একখানা ধারাপাত দু’ পয়সা, একখানা শ্লেট তিন পয়সা ও শ্লেট-পেনসিল এক পয়সা । আজকালকার মত বছরে বছরে পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তিত হত না । একবার পাটিগণিত, বীজগণিত ও জ্যামিতির বই কিনলে দু-চার পুরুষ তা পড়ত।
ডাক মাসুলের খরচও খুব কম ছিল । পোস্টকার্ড এক পয়সা, খাম দ’ পয়সা, রেজিস্ট্রেশন খরচ দু’ আনা ও বিলেতে চিঠি পাঠাতে খরচ হত দশ পয়সা । পোস্ট আপিসের কর্মকুশলতা ছিল অদ্ভূত। আজ সকালে আটটার মধ্যে কলকাতা থেকে ব্যারাকপরের ঠিকানায় চিঠি পোস্ট করলে, তা বেলা তিনটার সময় সেখানে বিলি হত, এবং সেখান থেকে তার জবাব পাঁচটার মধ্যে পোস্ট করলে কাল সকালে আটটার মধ্যে তা কলকাতায় বিলি হত । আর আজকের একটা নমুনা দিচ্ছি। একখানা চিঠি আমার নামে এবছর ২ ফেব্রুয়ারি তারিখে লেনিন সরণী থেকে পোস্ট করা হয়েছে। ষোল আনা শুদ্ধ ঠিকানা থাকা সত্ত্বেও চিঠিখানা পেলাম ১০ এপ্রিল তারিখে ।
।। চার ।।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় আবির্ভূত হল মহামন্বন্তর। যুদ্ধ দেশের দোরগোড়া পর্যন্ত প্রসারিত হওয়ার ফলে, সৈন্যবাহিনীকে খাওয়ানোর জন্য সরকার চাল ‘কর্ণার’ করল । দেশে চাল দুষ্প্রাপ্য হওয়ায় অন্নাভাবে গ্রাম থেকে ভূমিহীন কৃষকের দল ছুটে এল রাজধানী শহরের দিকে । এখানে অনাহারে কলকাতার রাজপথে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করল হাজার হাজার নরনারী ও শিশু। তারই পদাঙ্কে রেশনিং প্রথা চাল করা হল । সঙ্গে সঙ্গে চোরাবাজারীদের আবির্ভাব ঘটল । ফলে জিনিসপত্তরের দামের সামান্য কিছ হেরফের হতে লাগল। পণ্ডিত নেহরু, তখন গদি পাননি। জিনিসপত্তরের মূল্যের উর্দ্ধগতি দেখে তিনি তো চটে লাল। উত্তেজিত হয়ে তিনি বললেন–‘আমি যদি কোনদিন ক্ষমতায় আসি, তাহলে চোরাবাজারীদের ল্যাম্প-পোস্টে ঝুলিয়ে তাদের গলা কেটে দেব ।’ ১৯৪৭ খ্রীস্টাব্দের পনের আগস্ট ভারত স্বাধীনতা পেল । পণ্ডিত নেহেরুই প্রধানমন্ত্রী হলেন । পনেরো আগস্টের মধ্যরাত্রে তিনি জাতির প্রতি ভাষণে বললেন, ‘আমাদের দীর্ঘদিনের অধীনতা, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ও তার অনবতী ঘটনাসমূহের ফলে, আমরা জীবনের অনেক পঞ্জীভূত গুরুতর সমস্যার উত্তরাধিকারী হয়েছি । আজ আমাদের দেশের লোকের খাদ্য, বসন, ও নিত্য আবশ্যকীয় দ্রব্যসামগ্রীর অভাব রয়েছে । আমরা মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যবৃদ্ধির নাগপাশে বদ্ধ হয়েছি। আমরা বিচক্ষণতার সঙ্গে এসব সমস্যার সমাধান করতে চাই, যাতে সাধারণ লোকের ক্লেশের বোঝা হ্রাস পায় ও তাদের জীবনযাত্রার মানবৃদ্ধি পায় ।’
নেহরুর এই প্রতিশ্রুতি সাফল্যমণ্ডিত করবার জন্য ১৯৫১ সাল থেকে শুরু করে আমরা সাতটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ও তিনটি বার্ষিক যোজনা ইতিমধ্যে রচিত ও রূপায়িত করেছি। বর্তমানে অষ্টম পরিকল্পনা রূপায়িত হচ্ছে। সপ্তম পরিকল্পনার শেষ পযন্ত আমরা খরচ করেছি ৫৪৪,২৭৬ কোটি টাকা । অষ্টম পরিকল্পনার জন্য বরাদ্দ হয়েছে ৮,৭২,১০০ কোটি টাকা । কিন্তু এই বিপুল অর্থব্যয় করেও আমরা দরিদ্র দেশবাসীর অদৃষ্ট ফেরাতে পারিনি। বরং পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে আমরা আরও দরিদ্র হয়ে পড়েছি । মূল্যস্ফীতি সাধারণ লোকের জীবনকে অতিষ্ট করে তুলেছে। সরকার অবশ্য বলবেন যে আমরা অনেক বিষয়ে এগিয়ে গেছি। কিন্তু সাধারণ লোকের জীবন যে আগেকার তুলনায় সুখময় হয়নি, সে সম্বন্ধে কোন বিতর্কই নেই। দেশের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত একই রব অনুরাণিত হচ্ছে–‘ম্যায়। ভুখা হুঁ।’ ধনী আরও বেশি ধনী হয়েছে, দরিদ্র হয়েছে দরিদ্রতর। মধ্যবিত্ত সমাজের অবলুপ্তি ঘটেছে ।
।। পাঁচ ।।
সবচেয়ে বড় দুর্গতি যা আজ মানুষেকে অভিভূত করেছে তা হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। যারা মূল্যস্ফীতি ঘটাচ্ছে, নেহেরু তাদের ল্যাম্প-পোস্টে ঝলিয়ে মারতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষমতায় আসবার পর দেখা গিয়েছিল যে তাদের সঙ্গেই তিনি হাত মিলিয়ে ফেলেছেন । তাঁর উত্তরাধিকারীরা সেই একই নীতি অনসরণ করে এসেছেন, কেননা সেই ব্যবসায়ীদের বদন্যতার ওপরেই দলের পুষ্টি ও নির্বাচনের সাফল্য নির্ভর করে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের দোষ দিলে হবে না। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সরকার নিজেও মূল্যস্ফীতি ঘটাচ্ছেন। প্রত্যক্ষভাবে সরকার মূল্যস্ফীতি ঘটাচ্ছেন পণ্যদ্রব্যের ওপর কর বসিয়ে, রেলের মাসুল বাড়িয়ে ও পণ্যদ্রব্যের ঊর্ধ্বমূল্য নির্ধারণ করে দিয়ে । আর পরোক্ষভাবে মূল্যস্ফীতি ঘটাচ্ছেন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা সমূহের রূপায়নের জন্য ঘাটতি ব্যয়নীতি অনসরণ করে। এ সবের ফলে বর্তমানে পণ্যদ্রব্যমূল্য এমন স্তরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে তুলনা করলে শতাব্দীর প্রথমার্ধের পণ্যদ্রব্যের মূল্যসমূহ রূপকথার কাহিনী বলে মনে হবে। নেহেরু পণ্যমূল্যের উর্দ্ধগতি দমন করে সাধারণ লোকের জীবন সুখময় করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে পণ্যমূল্য গগনস্পর্শী হয়ে সাধারণ লোকের জীবন কিরকম ক্লেশকর করেছে তা নীচে শতকের দুই অংশের পণ্যমূল্যের তালিকা থেকে প্রতীয়মান হবে ।
পণ্যদ্রব্য | শতকের প্রথমার্ধের মূল্য | শতকের শেষের মূল্য |
চাল (প্রতি মন) | দু’ টাকা ৫০ পয়সা | ৩২০ টাকা |
ডাল (প্রতি সের) | ছ’ পয়সা | ২০ টাকা |
সরষের তেল (প্ৰতি সের) | দশ পয়সা | ৩০ টাকা |
চিনি (প্ৰতি সের) | আট পয়সা | ১৫ টাকা |
ঘি (প্ৰতি সের) | দশ আনা | ২০০ টাকা |
মাংস (প্রতি সের) | ছ’ অনা | ৭২ টাকা |
মাছ (কাটা রই প্রতি সের) | ছ’ আনা | ৭০ টাকা |
ধুতি (মিহি কাপড়) | দু’ টাকা | ৮০ টাকা |
ধনেখালির শাড়ি | তিন টাকা | ২৫০ টাকা |
গত দশ বছরেই দ্রব্যমূল্য দ্বিগুন হয়ে গিয়েছে। এটা সরকারী ‘কনস্যুমার প্রাইস ইনডেকস’ থেকে বুঝতে পারা যাবে । ১৯৮২ সালে সূচকসংখ্যা ছিল ১০০, আর ১৯৯২-তে ২১৯ । মূল্যস্ফীতি দেশের মধ্যে ধনবৈষম্য ঘটিয়েছে । ষাটের দশকে মহলানবীশ কমিটি এই প্রবণতা লক্ষ্য করেছিলেন এবং এ সম্বন্ধে আমাদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন । সে সতর্ক বাণীতে আমরা কর্ণপাত করিনি। ফলে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সঙ্গে ধনবৈষম্য বিরাট আকারে প্রকট হয়েছে ।
।। ছয় ।।
শতাব্দীর পূর্বার্ধের রাজনৈতিক পরিস্হিতি পরবর্তী প্রবন্ধে আলোচিত হয়েছে। এবার শতাব্দীর শেষাধের রাজনৈতিক পরিস্থিতিটার দিকে তােকানো যাক । ১৯৪৭ খ্রীস্টাব্দের স্বাধীনতা লাভের শোচনীয় শর্ত হিসাবে বঙ্গদেশ দ্বিখণ্ডিত হয়–পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্বপাকিস্তান। পশ্চিমবঙ্গ জন্মগ্রহণ করেছিল অনেক সমস্যা নিয়ে । যুক্তবাঙলার অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে ছিল একটা ভারসাম্য। পূর্ববাঙলা ছিল কৃষিপ্রধান, সেজন্য পূর্ববাঙলা ছিল খাদ্যশস্য ও কাঁচামালের আড়ত। আর পশ্চিমবঙ্গ ছিল শিল্প প্রধান । পশ্চিমবঙ্গকে খাদ্যশস্য ও কাঁচামালের জন্য পূর্ববাঙলার ওপর নির্ভর করতে হত । দ্বিখন্ডিত হবার পর এই আৰ্থিক ভারসাম্য ভেঙে পড়ে । তারপর পশ্চিমবঙ্গ ছিল ঘনবসতিবহুল অংশ । তার মানে, আগে থেকেই এখানে ছিল বাসস্থানের অভাব । সে অভাবকে ক্রমশই তীব্রতর করে তুলেছিল অন্য প্রদেশ থেকে আগত জনসমুদ্র । এই সমস্যাকে আরও উৎকট করে তুলল যখন নিরাপত্তার কারণে লক্ষ লক্ষ হিন্দু পূর্ববাঙলা থেকে পশ্চিমবাঙলায় এল।
যখন পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টি হল, তখন প্ৰফুল্ল চন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে এক ‘ছায়া মন্ত্রি পরিষদ’ রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করল। কিন্তু চার-পাঁচ মাসের মধ্যেই সেই মন্ত্রিসভা ভেঙে পড়ল। ১৯৪৮ খ্রীস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করলেন। স্বাভাবিক ভাবে পশ্চিমবঙ্গ যেসব উৎকট সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল, সেগুলির সমাধান এই নতুন মন্ত্রিসভার ঘাড়ে চেপে বসল। নিরবিচ্ছিন্নভাবে তাঁর মৃত্যুকাল পর্যন্ত আঠারো বছর মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন বিধানচন্দ্র পশ্চিমবঙ্গের সমস্যাগুলি একে একে সমাধান করে ফেললেন।
১৯৬২ খ্রীস্টাব্দের ১ জলাই বিধান রায়ের মাতুত্যুর পর কংগ্রেস নেতা প্রফুল্লচন্দ্র সেন নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করেন। কিন্তু তাঁর অনুসৃত খাদ্যনীতি জনমতের বিরুদ্ধে যাওয়ায়, ১৯৬৭ খ্রীস্টাব্দের নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন ও অজয় মুখার্জির নেতৃত্বে এক যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়। কিন্তু তা ক্ষণস্থায়ী হওয়ায় ড. প্রফাল্ল চন্দ্র ঘোষ এক নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করেন । তা-ও স্বল্পকালস্থায়ী হওয়ায় ১৯৬৮ খ্রীস্টাব্দের ২০ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতির শাসন জারি হয়। ১৯৬৯ খ্রীস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে অজয় মুখার্জির নেতৃত্বে বামফ্ৰণ্ট সরকার গঠিত হয়। মাত্র এক বছরের বেশি এ-সরকার স্থায়ী হয় না । ১৯৭০ খ্রীস্টাব্দের ১৯ মার্চ আবার রাষ্ট্রপতির শাসন প্রবর্তিত হয় । ১৯৭১ খ্রীস্টাব্দের এপ্রিল মাসে অজয় মুখার্জির নেতৃত্বে এক ডেমোক্ৰেটিক কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয় । কিন্ত দু’মাস পরে ( জুন ১৯৭১) তা ভেঙে পড়ে। তখন ( ৩০ জুন ১৯৭১) আবার রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করা হয় । ১৯৭২-এর মার্চ মাসে সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ে্র নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকার গঠিত হয়। ১৯৭৭ খ্রীস্টাব্দের নিবাচনে ‘বামফ্রন্ট’ দল সাফল্য অর্জন করাতে জ্যোতি বসু, ‘বামফ্রন্ট সরকার’ গঠন করেন । এই বামফ্রন্ট সরকারই এখনও পর্যন্ত ক্ষমতাসীন আছে ।
বৈষয়িক সম্পদ বৃদ্ধির অন্তরালে বামফ্ৰণ্ট সরকারের আমলে ঘটেছে শান্তিশৃঙ্খলার অবনতি, রাজনৈতিক দলাদলি, দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ, পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা ও নির্যাতন, মধ্যবিত্ত সমাজের অবলুপ্তি, শিক্ষার সংকট, বাঙলায় অবাঙালীর অবারিত আগমন ও কর্রসংস্থানের ওপর তার প্রতিঘাত, বেকারের সংখ্যাবৃদ্ধি ও জীবনের সর্বক্ষেত্রে বিশঙ্খলতা ও নৈতিক শৈথিল্যে । তাছাড়া বাঙালীর মানবিক সত্তা ক্রমশই হ্রাস পাচ্ছে। নারীনিগ্রহ ও বাধা-নির্যাতনের ক্রমবৃদ্ধিতার দৃষ্টান্ত ।
বস্তুত, সমকালীন সামাজিক বিশৃঙ্খলতা, মানবিক সত্তার হ্রাস ও নৈতিক শৈথিল্যের প্রতি দুটি রেখে মনে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে যে বাঙালীর জীবনচর্যা ও সংস্কৃতির স্বকীয়তা অবক্ষয়ের পথে চলেছে কিনা ? অশন-বসনে, আচার-ব্যবহারে বাঙালী আজ যেমন নিজেকে বহুরূপী করে তুলেছে, তেমনই বর্ণচোরা করেছে তার সংস্কৃতিকে । অতীতের গৌরবময় সংস্কৃতির পরিবর্তে এক জারজ সংস্কৃতির প্রাবল্যই লক্ষিত হচ্ছে ।
।। সাত ।।
এরই মধ্যে ঘটে গিয়েছে বিজ্ঞানের অত্যাশ্চর্য অগ্রগতি । আগের শতকে আমরা পেয়েছিলাম টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, বৈদ্যুতিক আলো, পাখা ইত্যাদি । বিংশ শতাব্দীতে আমরা পেয়েছি বেতার, বিমান, খনিজতৈল, মোটরগাড়ি, পরমাণুর ব্যবহার, ইলেকট্রনিকস্, টেলিভিসন, প্লাস্টিকস্ ইত্যাদি। বস্তুত বিজ্ঞান ও প্রযক্তি বিদ্যার সাহায্যে আমরা এমনভাবে এগিয়ে গেছি যে মনে হবে বিজ্ঞানই বঝি বা স্বয়ং ভগবান। ভগবানের দুই সত্ত্বা আছে–তিনি যােগপৎ স্রষ্টা ও সংহারকর্তা। বিজ্ঞােনও তাই। বিজ্ঞান যেমন একদিকে মানুষের কল্যাণ সাধন করছে, অপরদিকে মানুষেকে ধবংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে। জানিনা আগামীকালে মানুষের কপালে কি আছে। কেননা এখন চলেছে প্রকৃতির ওপর আধিপত্যের জন্য বিজ্ঞানের লড়াই। এই বিজ্ঞান বনাম প্রকৃতির লড়াইয়ের ফলাফলের ওপর নির্ভর করছে, হয় মানবসভ্যতার আরও অগ্রগতি, আর তা নয়তো মানুষের সম্পূর্ণ বিলুপ্তি। ( অতুল সুর, ‘মানব সভ্যতার নৃতাত্ত্বিক ভাষ্য’ দ্রঃ)
বিপ্লববাদী সমাজের অভ্যুত্থান
বিগত শতকের সবচেয়ে বড় ঘটনা হচ্ছে ১৯৪৭ খ্রীস্টাব্দে ভারত থেকে ইংরেজের মহাপ্রস্থান ও ভারতের স্বাধীনতা লাভ। সেটা কি করে ঘটেছিল, সেটাই এখানে বলছি।
যদিও স্বাধীনতা লাভের উদ্দেশ্যে জনমত গঠনের জন্য ১৮৮৫ খ্রীস্টাব্দেই ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’ স্থাপিত হয়ে গিয়েছিল, তা হলেও ওটা বিপ্লববাদী সংস্থা ছিল না। জাতীয় কংগ্রেস সহাপনের পাবে। সংঘটিত যে সব ঘটনাকে আমরা স্বাধীনতা লাভের পদক্ষেপ বলে চিহ্নিত করি সেগলো বিপ্লব নয়, বিদ্রোহ মাত্র। প্রকৃত বিপ্লববাদের আগুন জ্বলে ওঠে। বঙ্গভঙ্গকে উপলক্ষ করে। বঙ্গদেশের আয়তন এককালে অনেক বড় ছিল। কিন্তু তাকে ছোট করে আনা হয়েছিল বঙ্গ, আসাম, বিহার, ওড়িষা ও ছোটনাগপুরে। তারপর আসাম প্রদেশকে পথিক করে একজন চীফ কমিশনারের শাসনাধীনে ন্যস্ত করা হয়। মোট কথা নানারকম রাজনৈতিক কারণে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গদেশকে খর্ব করবার অপচেষ্টায় ব্যস্ত ছিল। ১৯০৩ খ্রীস্টাব্দে মধ্যপ্রদেশের চীফ কমিশনার স্যার অ্যানড্রু ফ্লেজার প্রস্তাব করেন যে বঙ্গদেশকে দু’খণ্ডে বিভক্ত করা হউক। প্রস্তাবটা বঙ্গদেশের সবার গভীর অসন্তোষ সৃষ্টি করে। এমন কি ইংরেজ মালিকানাবিশিষ্ট ও ইংরেজ কর্তৃক সম্পাদিত ‘ইংলিশম্যান’ পত্রিকাতেও বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে লেখা হয়। কিন্তু এসব সত্বেও ১৯o৫ খ্রীস্টাব্দের ১৭ অক্টোবর তারিখে বঙ্গদেশকে দ্বিখণ্ডিত করে দেওয়া হয়। পূর্বদিকে সৃষ্টি হল আসাম ও পূর্ব বঙ্গ প্রদেশ ও পশ্চিমে বাকি অংশ। চতুর্দিকে বিদ্বেষের বহ্নি জ্বলে উঠল। বিলাতী পণ্য বর্জন করা হল। যারা বিলাতী জিনিষের দোকানে পিকেটিং করল, তাদের ওপর পুলিশ নিষ্ঠুর অত্যাচার করল। এর প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষিত সমাজের মধ্যে ভীষণ অসন্তোষ প্রকাশ পেল।
আন্দোলন থেকে উদ্ভূত হল জাতীয়তাবাদ, আর জাতীয়তাবাদ এক শ্রেণীর মধ্যে বীজ বপন করল বিপ্লববাদের। বিপ্লববাদ প্রসারের জন্য প্রথম যে সমিতি গঠিত হল, তা হচ্ছে অনুশীলন সমিতি। এর শাখা প্রশাখা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল। এদিকে শ্রীঅরবিন্দের ছোট ভাই বারীন্দ্রের নেতৃত্বে গঠিত হল এক সশস্ত্র বিপ্লবীদল। তারা তাদের গোপন কেন্দ্র করল মানিকতলার খালের ওপারে মুরারীপুকুরে এক নিভৃত বাগানবাড়িতে। বারীন্দ্রের নেতৃত্বে যে দল গঠিত হল, তারা দ’জন সদস্যকে বিদেশে পাঠাল বোমা তৈরী করবার প্রণালী শিখে আসবার জন্য। তারপর মুরারীপুকুরের বাগানবাড়িতে বোমা তৈরির আয়োজন চলতে লাগল। বারীন্দ্রের দলের দজন প্রফাল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম বসু মজাফরপরের দিকে রওনা হল কলকাতার প্রাক্তন প্রেসিডেন্সী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যা করবার জন্য। ভুল করে তারা কিংসফোর্ডের গাড়ির মত দেখতে অন্য একখানা গাড়ির ওপর বোমা নিক্ষেপ করে। নিহত হয় মিস্টার কেনেডি নামে এক আইনবিদের স্ত্রী ও কন্যা। প্রফুল্ল ঘৃত হয় বটে কিন্তু সে আত্মঘাতী হয়। ক্ষুদিরামের বিচার হয় এবং তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
এরপর আসে বিশ্বাসঘাতকের পালা। নরেন্দ্ৰ গোস্বামী নামে দলের একজন সদস্য পুলিসের কাছে গোপন তথ্য সরবরাহ করে বারীন্দ্রের দলকে ধরিয়ে দিয়েছিল। কানাইলাল দত্ত ও সত্যেন বসু নামে দলের দু’জন বন্দী জেলখানার মধ্যেই নরেন্দ্রকে হত্যা করে। বিচারে বারীন্দ্র সমেত ১৪ জন অপরাধী সাব্যস্ত হয়। তাদের যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়। কিন্তু এই সঙ্গে বিপ্লববাদের পরিসমাপ্তি ঘটে না। ১৯০৭ থেকে ১৯১৭ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে ন্যুনাধিক ৬৩ জন নিহত হয়। সংগ্রামের জন্য অর্থসংগ্রহের প্রয়াসে বিপ্লবীদল রাজনৈতিক ডাকাতি শুরু করে। ১৯০৭ থেকে ১৯১৭ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে ১১২টা ডাকাতি হয় এবং ডাকাতরা এভাবে সাত লক্ষ টাকা সংগ্রহ করে।
।।দুই।।
বিপ্লবের জন্য বিদেশে হরদয়ালের নেতৃত্বে এক দল গঠিত হয়। এই দল বিদেশ থেকে ভারতে অস্ত্রশস্ত্ৰ পাঠাবার ব্যবস্থা করে। অস্ত্রশস্ত্র আসছে, এই খবর পেয়ে সেগলো কোন নিভৃত স্থানে নামাবার জন্য যাদুগোপাল মুখুজ্যে যান সুন্দরবনে ও যতীন মুখুজ্যে যান বালেশ্বরে। বালেশ্বরে যতীন মুখুজ্যের কাছে বাটাভিয়ায় অবস্থিত সহানুভূতিশীল জারমান সরকারের প্রতিভূরা বিপ্লবে সাহায্য করবার জন্য টাকা পাঠাতে থাকে। কিন্তু শেষ কিস্তির দশ হাজার টাকা ব্রিটিশ সরকারের হাতে গিয়ে পড়ে। সেই সূত্র ধরে পুলিস যতীন মুখুজ্যের তল্লাসে বেরিয়ে পড়ে। বুড়িবালামের তীরে যতীন মুখুজ্যে ও তার সহকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের এক ভীষণ যুদ্ধ হয়। পুলিশের সঙ্গে সর্ব শক্তি দিয়ে যতীন মুখুজ্যে লড়ে যান। তিনি আহত হন। আহত অবস্থায় হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়।
এদিকে রাসবিহারী বসু, ভারতীয় সৈন্যবাহিনীকে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে উদ্বুদ্ধ করে। বিদ্রোহের দিন নিদিষ্ট হয় ১৯১৫ খ্রীস্টাবেদার ১৯ ফেব্রুয়ারী তারিখে। কিন্তু রাসবিহারীর দলে কিরপাল সিং নামে পুলিশের একজন গুপ্তচর যোগদান করে। তার মারফত সরকার আগে থাকতেই খবর পেয়ে এ চেষ্টা বিফল করে দেয়।
।।তিন৷৷
রাউলাট আইন ও জালিওয়ানাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পদাঙ্কে ১৯২০ খ্রীস্টাব্দের পর থেকে গান্ধীজী হন ভারতীয় কংগ্রেসের অপ্রতিদ্বন্দী নেতা। গান্ধীজী অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভের পথ ঘোষণা করেন। কিন্তু বিধানসভার মাধ্যমে স্বরাজ লাভের আন্দোলন পরিচালনা করবার জন্য দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ গঠিত করলেন ‘স্বরাজ্য পার্টি’। তাঁরা বিধানসভার মধ্যে নানাভাবে সরকারকে বিপর্যস্ত করে তোলেন।
এর মধ্যে কংগ্রেসের মধ্যে বামপন্থী দলের প্রাদুর্ভাব ঘটল। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠিত হল। বিনয়, বাদল, দীনেশ রাইটাস বিলডিং-এর অভ্যন্তরে সিম্পসন সাহেবকে হত্যা করল। ঢাকায় পুলিশ সুপারিনটনডেণ্ট লোম্যান সাহেবও নিহত হল।
আইন অমান্য করে লবণ প্রস্তুতের উদ্দেশ্যে গান্ধীজী ১৯৩০ খ্রীস্টাব্দে ডাণ্ডি অভিমখে যাত্রা করলেন। ১৯৩২ খ্রীস্টাবেদের মধ্যে আইন অমান্য আন্দোলন দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। দলে দলে লোক কারারুদ্ধ হল।
।।চার।।
তারপর এল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। কংগ্রেস প্রথমে যুন্ধে সহযোগিতার প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু সরকার তাতে সাড়া না দেওয়ায় ১৯৪২ খ্রীস্টাব্দে আবার সত্যাগ্ৰহ আন্দোলন শহর হল। সেদিন সমস্ত দেশবাসী আত্মবলে বলীয়ান হয়ে উচ্চকণ্ঠে বলে উঠল-‘করেংগে ইয়া মরেংগে।’ সরকার নেতৃবন্দকে কারারদ্ধ করল। বিক্ষুব্ধ দেশবাসী সংগ্রাম শহর করল ইংরেজের বিরুদ্ধে। ‘আগস্ট বিপ্লব’ নামে আখ্যাত এই সংগ্রাম তীব্র আকার ধারণ করল মেদিনীপর জেলায়। সতীশচন্দ্র সামন্তের অধিনায়কত্বে বিপ্লবীরা সেখানে প্ৰতিষ্ঠিত করল এক স্বাধীন সরকার। প্রায় দেড় বৎসর ইংরেজ শাসন সেখানে বিলুপ্ত হল। ইংরেজ চালালো অমানুষিক অত্যাচার ও ব্যাপক নারীধর্ষণ, পুলিশের গুলি অগ্রাহ্য করে অপূর্ব দেশপ্রেম ও সাহস দেখাল মাতঙ্গিনী হাজরা। সত্তর বৎসর বয়স্কা এই বীরাঙ্গনা মহিলা ললাটে গলিবিদ্ধ অবস্থায় জাতীয় পতাকা দৃঢ়মুষ্টিতে ধরে মৃত্যুবরণ করল। বাঙলার সর্বত্রই চলল উত্তেজনা ও পুলিশের অকথ্য অত্যাচার।
ইতিমধ্যে লড়াইয়ের মধ্যেই ঘটে গেল এক চমকপ্রদ ঘটনা। ‘আগস্ট বিপ্লব’-এর সময় সুভাষ চন্দ্র বসকে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু অসুস্থতার কারণে তাঁকে জেলখানা থেকে এনে নিজগহে অন্তরীণ করা হল। কিন্ত ইংরেজের চোখে ধুলো দিয়ে তিনি অন্তর্হিত হলেন ১৯৪১ খ্রীস্টাব্দের ১৮ জানুয়ারী তারিখে। আফগানিস্তানের ভিতর দিয়ে তিনি গিয়ে পৌঁছালেন জারমানীতে। সেখান থেকে জাপানে গিয়ে তিনি গঠন করলেন আজাদ হিন্দ ফৌজ। জাপানী সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে আজাদ হিন্দ ফৌজ আক্ৰমণ হানল ব্ৰহ্মদেশের ওপর। তাসের বাড়ির মত টলমল করে পড়ে যেতে লাগল শহরের পর শহর ও গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিসমূহ। নেতাজী এসে উপনীত হলেন আসাম সীমান্তে। ধ্বনি তুললেন–‘দিল্লী চল’, ‘লালকেল্লায় গিয়ে স্বাধীন ভারতের পতাকা তোল।’ কিন্তু যুদ্ধের পর নেতাজী আবার হলেন অদৃশ্য।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অবসান ঘটে ১৯৪৫ খ্রীস্টাব্দের মে মাসে। যুদ্ধে জয়লাভ করলে ভারতকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেবে, এ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ইংরেজ। কিন্ত স্বাধীনতার ব্যাপার নিয়ে বিবাদ বাঁধল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগে। ১৯৪৬ সালের মাৰ্চ মাসে এল ক্যাবিনেট মিশন, হিন্দু মুসলমানের মধ্যে মীমাংসা করবার জন্য। কিন্ত মীমাংসার সব চেস্টাই ব্যর্থ হল। ওরই পদাঙ্কে লাগল হিন্দ-মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা। নোয়াখালি ও পূর্ব বঙ্গের অন্যত্র দাঙ্গা চরম আকার ধারণ করল। কলকাতাতে দাঙ্গার হাঙ্গামা তরঙ্গে উঠল। ওই দাঙ্গার পদাঙ্কেই দেশ-বিভাগ ও স্বাধীনতা লাভ ঘটল।
হিন্দু সভ্যতার শিকর আবিষ্কার
হিন্দু সভ্যতার ক্ষেত্রে বিগত শতাব্দী চিহ্নিত হয়ে আছে এক অত্যাশচর্য আবিষ্কারের জন্য। সেটা হচ্ছে ১৯২২ খ্রীস্টাব্দে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক সিন্ধু সভ্যতার আবিষ্কার। এই আবিষ্কারের পূর্বে পন্ডিতমহলের বিশ্ববাস ছিল যে আগন্তুক আর্যরাই ভারতীয় সভ্যতার স্রষ্টা। তাঁরা মনে করতেন যে খ্রীস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে আর্যরা পঞ্চনদের উপত্যকায় আসবার পূর্বে, ভারতের লোকরা ছিল অসভ্য ও বর্বর এবং আর্যরাই তাদের সভ্য করে তুলেছিল। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতার আবিষ্কার এক লহমায় প্রমাণ করে দিয়েছিল যে ওই ধারণা একেবারেই ভুল। আর্যরা এদেশে আসবার হাজার বৎসর পূর্বেই এদেশে প্রাদর্ভূত হয়েছিল এক শিক্ষিত নগর সভ্যতা, যার বাহকরা আর্যদের চেয়ে অনেক বেশি সভ্য ছিল। বরং বলা যেতে পারে যে সিন্ধু সভ্যতার বাহকদের তুলনায়, আর্যরাই ছিল এক বর্বর জাতি।
সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে আমার পরিচয় প্রত্যক্ষ। ১৯২৮ খ্রীস্টাব্দে ভারতের প্রত্নতত্ত্ব সমীক্ষা অধিকরণের সর্বময় কর্তা স্যার জন মারশাল আমাকে নিয়োজিত করেন ‘হিন্দু-সভ্যতার গঠনে সিন্ধু সভ্যতার অবদান’ সম্বন্ধে গবেষণা করবার জন্য। এই গবেষণার কাজটা দু পর্যায়ে সমাপ্ত হয়েছিল। প্রথম পর্যায়ে মহেঞ্জোদারোয় ও দ্বিতীয় পর্যায়ে কলকাতায়। প্রথম পর্যায়ে আমি যখন মহেঞ্জোদারোতে সরেজমিনে গবেষণা চালাচ্ছি, তখন এক বাঙালী-বিদ্বেষী অফিসারের হাতে নিপীড়িত হবার ভয়ে আমাকে কলকাতাতে পালিয়ে আসতে হয়েছিল। সে কথাটা যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট-গ্রাজুয়েট ডিপার্টমেন্টের প্রেসিডেন্ট ডঃ সর্ব পল্লী রাধাকৃষ্ণন ও সেনেটের সবচেয়ে প্রভাবশালী সদস্য শ্যামাপ্রসাদ মখোপাধ্যায়ের কানে গেল, তখন তাঁরা আমাকে বৈতনিক গবেষক নিযুক্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুশীলন চালিয়ে যেতে বললেন। দু’ বৎসর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুশীলন চালিয়ে এই তথ্য উত্থাপন করলাম যে হিন্দু সভ্যতার গঠনের মূলে বারো-আনা ভাগ আছে সিন্ধু উপত্যকার প্রাক-আর্য সভ্যতা; আর মাত্র চার-আনা ভাগ মণ্ডিত আর্য সভ্যতার আবরণে। আমার গবেষণা-লব্ধ তথ্যসমূহ আমি স্যার জন মারশালের কাছে পাঠাতাম। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে বিশদ প্রতিবেদন পেশ করতাম। আমার সতীৰ্থ ডঃ নীহাররঞ্জন রায় ১৯৩১ খ্রীস্টাব্দে যখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত ‘ক্যালকাটা রিভিউ’ পত্রিকার সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেন, তখন তিনি আমার গবেষণা সম্পর্কিত প্রতিবেদনের অংশবিশেষ ওই পত্রিকায় প্রকাশ করেন। কিছু অংশ ‘ইণ্ডিয়ান হিসটরিক্যাল কোয়াটারলি’ পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়েছিল। পরে এগুলি পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। ১৯৩৬ খ্রীস্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রধান ডঃ দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকার ইণ্ডিয়ান কালচারেল কনফারেনসে প্রদত্ত তাঁর সভাপতির ভাষণে বললেন—‘হিন্দু সভ্যতা যে আর্য ও অন্যান্য সভ্যতার মিশ্রণে উদ্ভুত এটা যে চারজন বিশিষ্ট প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ করেছেন তাঁরা হচ্ছেন স্যার জন মারশাল, রায়বাহাদুর রমাপ্রসাদ চন্দ, ডঃ স্টেলা ক্রামরিশ ও শ্ৰীঅতুলকৃষ্ণ সুর।’
তারপর অনেক বছর কেটে গেল; ভারতের ইতিহাসের ওপর প্রাকবৈদিক সভ্যতার প্রভাব যে কতখানি, তা আমাদের ঐতিহাসিকরা বুঝলেন না। গতানুগতিক ভাবে ভারতের ইতিহাস রচিত হতে লাগল, মাত্র বৈদিক যুগের আগে সিন্ধু সভ্যতা সম্বন্ধে একটা অধ্যায় যোগ করে দিয়ে।
আমি যখন মহেঞ্জোদারোয় যাই, তখন নগরীর যে অঞ্চলে খননকার্য চলছিল, তার নামকরণ করা হয়েছিল : DK Area-Intermediate III period। মহেঞ্জোদারোর প্রশস্ত রাজপথ ও সমান্তরাল রাস্তাগলি সে বৎসরই আবিস্কৃত হয়েছিল। প্রশস্ত রাজপথটি উত্তর-দক্ষিণমুখী। রাজপথটি তখন মাত্র এক কিলোমিটার পর্যন্ত খুড়ে বের করা হয়েছে। রাজপথটি ৩১ থেকে ৩৬ ফুট প্রশস্ত, আর সমান্তরাল পথগালি ২০ থেকে ২৫ ফুট। সে বৎসর আরও আবিস্কৃত হয়েছিল নগরীর পয়ঃপ্ৰণালী। পোড়া ইট দিয়ে তৈরী এই পয়ঃপ্রণালী অনেকটা পথ রাস্তার পশ্চিম ধার দিয়ে এসে, এক জায়গায় রাস্তা অতিক্রম করে, রাস্তার পূর্ব পাশ ধরে চলে গিয়েছিল। বাড়ির দূষিত জল এই পয়ঃপ্রণালীতে এসে পড়ত, তবে অনেক বাড়িতে ‘সোক্পিট’ও ছিল। প্রতি বাড়ির প্রবেশ পথ দিয়ে ঢুকলেই সামনে পড়ত বাড়ির প্রাঙ্গণ। প্রবেশ পথের নিকট প্রাঙ্গণের এক পাশে থাকত বাড়ির কূপ। স্নানের সময় আবরু রক্ষার জন্য কূপগুলিকে দেওয়াল দ্বারা বেষ্টিত করা হত। রাজপথের দিকে বাড়ির যে দোকানঘরগুলি ছিল, তার অনেকগলির সামনে আমরা আবিষ্কার করেছিলাম ইটের গাঁথা পাটাতন। বোধহয় এই পাটাতনগলির ওপর বিক্ৰেতারা দিনের বেলা তাদের পণ্যসম্ভার সাজিয়ে রাখত, এবং রাত্রিকালে সেগালিকে দোকান-ঘরে তুলে রাখত। ছোট ছোট যে সব দ্রব্যসামগ্ৰী আমরা সে বৎসর পেয়েছিলাম, তার মধ্যে ছিল মেয়েদের মাথার কাঁটা। তা থেকে আমরা সহজেই অনুমান করেছিলাম যে, মেয়েরা খোঁপা বাঁধত ও খোঁপায় কাঁটা গুঁজত। তবে মেয়েরা যে বেণী ঝুলিয়েও ঘুরে বেড়াত, তার প্রমাণও আমরা পেয়েছিলাম।
ব্যাপকভাবে খননকার্যের ফলে এখন হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো ছাড়া তামাশ্ম যুগের সভ্যতার আরও অনেক কেন্দ্র খুঁজে বের করা হয়েছে। এর ফলে আমরা জানতে পেরেছি যে এই সভ্যতার বিকাশ পনেরো লক্ষ বর্গ মাইল ব্যাপী এক বিস্তৃত এলাকায় ঘটেছিল। ১৯৪৭ খ্রীস্টাব্দে দেশ-বিভাগের পর এই সকল কেন্দ্রের কিছু পাকিস্তানে ও কিছু ভারতের মধ্যে পড়েছে। সিন্ধু সভ্যতার যেসব কেন্দ্র ভারতের মধ্যে পড়েছে সেগালি হচ্ছে–কালিবঙ্গান, লোথাল, রূপার, চণ্ডীগড়, সুরকোটড়া, দেশলপুর, নবিনাল, রঙপুর, ভগৎরাও, মাণ্ড, বরা, বরগাওন, বাহাদারাবাদ, শিশওয়াল, মিটাথাল, আলমগিরপুর, কায়াথা, গিলাণ্ড, টড়িও, দ্বারকা, কিনডারখেদ, প্রভাস, মাটিয়ালা, মোটা, রোজড়ি, আমরাফলা, জেকডা, সুজনপুর, কানাসুতারিয়া, মেহগাওন, কাপড়খেদা ও সবলদা। এছাড়া তামাশ্ম যুগের সভ্যতার নিদর্শন আমরা পেয়েছি–লালকিলা, নোয়া, মানোটি, দৈমাবাদ, মহিষদল, বানেশবরডাঙ্গা, পাণ্ডুরাজার ঢিবি প্রভৃতি স্থান থেকেও। ১৯২৯-৩১ খ্রীস্টাব্দে আমি যখন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈতনিক গবেষক হিসাবে সিন্ধু সভ্যতা সম্বন্ধে অনুশীলন করেছিলাম, তখন আমার প্রতিবেদনের প্রথম অনুচ্ছেদেই বলেছিলাম—‘এ সম্পকে ঝুঁকি নিয়ে একথা বলা যেতে পারে যে পরবর্তীকালে অনুরূপ সভ্যতার নিদর্শন গঙ্গা উপত্যকাতেও পাওয়া যেতে পারে, যার দ্বারা প্রমাণিত হবে যে এ সভ্যতা উত্তর ও প্রাচ্য ভারতেও বিস্তার লাভ করেছিল।’ আজ খননকার্যের ফলে আমার সেই অনুমান বাস্তবে পরিণত হয়েছে।
।। দুই।।
অনেকেই বলেন যে সিন্ধুসভ্যতা ও আর্যসভ্যতা অভিন্ন। কিন্তু এটা যে ভ্ৰান্ত মত সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। দুই সভ্যতার মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করলেই এটা বুঝতে পারা যাবে। দুই সভ্যতার মূলগত পার্থক্যগুলি আমি নীচে দিচ্ছি–
(১) সিন্ধু সভ্যতার বাহকরা শিশ্ন-উপাসক ছিল মাতৃকাদেবীর আরাধনা করত। আর্যরা শিশ্ন-উপাসক ছিল না ও শিশ্ন-উপাসকদের ঘৃণা ও নিন্দা করত। আর্যরা পুরুষ দেবতার উপাসক ছিল। মাতৃকাদেবীর পূজার কোন আভাসই আমরা ঋগ্বেদে পাই না!
(২) আর্যরাই প্রথম ঘোড়াকে পোষ মানিয়েছিল। ঘোড়াই ছিল তাদের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ জন্তু। এখানে বলা দরকার যে ঘোড়ার কোন অশ্মীভূত (f০ssilized) অস্থি আমরা সিন্ধুসভ্যতার কোন কেন্দ্রে পাইনি। সিন্ধুসভ্যতার বাহকদের কাছে বলীবর্দই প্রধান জন্তু ছিল। এটা শীলমোহরসমূহের ওপর পুনঃ পুনঃ বলীবর্দের প্রতিকৃতি খোদন থেকে বঝতে পারা যায়। পশুপতি শিব আরাধনার প্রমাণও মহেঞ্জোদারো থেকে পাওয়া গিয়েছে। বলীবর্দ শিবেরই বাহন। সুতরাং সিন্ধুসভ্যতার কেন্দ্রসমূহে বলীবর্দের প্রাধান্য সহজেই অনুমেয়।
(৩) সিন্ধুসভ্যতার বাহকরা নগরবাসী ছিল। আর্যরা নগর নির্মাণ করত না। তারা নগর ধবংস করত। সেজন্য তারা তাদের দেবতা ইন্দ্রর নাম পুরন্দর রেখেছিল।।
(৪) আর্যরা মৃত ব্যক্তিকে দাহ করত। সিন্ধু সভ্যতার ধারকরা মৃতকে সমাধিস্থ করত।
(৫) আর্যদের মধ্যে লিখন প্রণালীর প্রচলন ছিল না। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতার ধারকদের মধ্যে লিখন প্রণালী সুপ্রচলিত ছিল।
(৬) সিন্ধুসভ্যতা যে আর্যসভ্যতা নয়, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে মৃৎপাত্র। কুরু-পঞ্চাল দেশ, তার মানে যেখানে আর্যসভ্যতা বিস্তার লাভ করেছিল, সেখানকার বৈশিষ্ট্যমূলক মৃৎপাত্রের রঙ ছিল ধূসর বর্ণ। সিন্ধুসভ্যতার কেন্দ্র সমূহ থেকে যে সব মৃৎপাত্র পাওয়া গিয়েছে সেগুলির রঙ হচ্ছে ‘কালো-লাল’।
(৭) সিন্ধু সভ্যতা ছিল কৃষিভিত্তিক সভ্যতা। আর্যরা প্রথমে কৃষিকাষ জানত না। এটা আমরা শতপথব্রাহ্মণের এক উক্তি থেকে জানতে পারি। (এ সম্বন্ধে বিশদ বিবরণের জন্য আমার ‘হিন্দু সভ্যতার নৃতাত্ত্বিক ভাষ্য’ দ্রষ্টব্য।)
(৮) সিন্ধুসভ্যতার লোকেরা হাতির সঙ্গে বেশ সপরিচিত ছিল। আর্যদের কাছে হাতি এক নতুন জীববিশেষ ছিল। সেজন্য তারা হাতিকে ‘হস্তবিশিষ্ট মৃগ’ বলে অভিহিত করত। বস্তুতঃ হাতিকে প্রাচ্য ভারতের পালকপ্য নামে এক ঋষিই প্রথম পোষ মানিয়েছিল।
এসব প্রমাণ থেকে সহজেই বঝা যাবে যে আর্যসভ্যতা ও সিন্ধুসভ্যতা এক নয়।
গোড়ার দিকে আর্যরা সিন্ধুসভ্যতার বাহকদের সঙ্গে তুমুল, সংগ্রাম চালিয়েছিল। কিন্তু তাদের এই গোড়ার দিকের বৈরিতা পরবর্তীকালে আর স্থায়ী হয়নি। পঞ্চনদ থেকে তারা যতই পূর্বদিকে অগ্রসর হল, ততই তারা এদেশের লোকের সংস্পর্শে এল। তারা এদেশের মেয়েদেরও বিয়ে করল। যখন অনার্য রমণী গৃহিণী হল, তখন আর্যদের ধর্মকর্মের ওপর তার প্রতিঘাত পড়ল। ক্ৰমশঃ তারা বৈদিক যজ্ঞাদি ও বৈদিক দেবতাগণকে পশ্চাদভূমিতে অপসারণ করল। আর্য ও অন্যান্য সংস্কৃতির সংশ্লেষণে পৌরাণিক দেবতামণ্ডলীর সৃষ্টি হল।
আর্য ও অনার্য সভ্যতার সংশ্লেষ ঘটেছিল সেখানে, যেটাকে আগে আমরা ‘কুরু-পাঞ্চাল’ দেশ বলতাম বা গঙ্গা ও যমুনার অন্তবর্তী অঞ্চল। সেখানে আর্যদের আপোষ করতে হয়েছিল অনার্যদের ভাষা, সভ্যতা ও লোকযাত্রার সঙ্গে। এটা বিবর্তনের ক্ৰমিক ধারাবাহিকতার ভিতর দিয়ে সম্পূর্ণতা লাভ করেছিল পৌরাণিক যুগে। এই সংশ্লেষণের পর আমরা ভারতীয় সভ্যতার সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ দেখি, যেটা বৈদিক সভ্যতা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। লোকে আর ইন্দ্র, বরুণ প্রভৃতি বৈদিক দেবতার স্তুতিগান করে না। বৈদিক যজ্ঞ সম্পাদন করে না। নতুন দেবতামণ্ডলীর পত্তন ঘটে। যজ্ঞের পরিবর্তে আসে পূজা ও উপাসনা। বৈদিক আত্মকেন্দ্রিক স্তুতিগানের পরিবর্তে আসে ভক্তি। এর ওপর প্রাগার্য, তান্ত্ৰিক ধর্মেরও প্রভাব পড়ে। বৈদিক যুগের আর্যরা যাদের ঘৃণার চক্ষে দেখতেন ও যাদের সঙ্গে অবিরাম সংগ্রাম করতেন, শেষ পর্যন্ত সেই অনার্য নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীসমূহেরই জয় হল। বেদ সংকলন ও মহাভারত পুরাণ ইত্যাদি রচনার ভার ন্যস্ত হল এক অনার্য রমণীর জারজ সন্তানের ওপর। এ সবই আমরা বঙ্গাব্দ চতুর্দশ শতকের আবিষ্কার ও অনুশীলনের ফলে জানতে পেরেছি।
কুলীনের মেয়ের মুক্তি
বঙ্গাব্দ চতুর্দশ শতাব্দী স্মরণীয় হয়ে আছে কুলীন ব্রাহ্মণ সমাজে বহুবিবাহ নিরোধের জন্য। মধ্যযুগের বাঙালী সমাজ কলঙ্কিত হয়েছিল এই অপপ্রথার জন্য।
আগের শতাব্দীতে কৌলীন্য প্রথা নিরোধের জন্য নিরলস প্রয়াস চালিয়েছিলেন রামনারায়ণ তর্করত্ন ও পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। যদিও বিধবা বিবাহ বৈধ করবার জন্য বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রচেষ্টা সফল হয়েছিল (১৮৫৬ সালের ১৫ নম্বর আইন দ্বারা), কিন্তু কৌলীন্য প্রথা নিরোধের জন্য তাঁর নিরলস প্রচেষ্টা ফলবতীর্ণ হয়নি। সরকার এ সম্বন্ধে কোন আইন প্রণয়ন করেন নি। সরকার কর্তৃক প্রণীত না হলেও বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রচেস্টার ফলে যে জনমত গড়ে ওঠে তারই প্রভাবে বঙ্গাবাদ চতুর্দশ শতাব্দীতে কৌলীন্য প্রথার অবলুপ্তি ঘটে।
কুলীনের মেয়ের ছিল অভিশপ্ত ও কলঙ্কিত জীবন। ‘কুলীনের মেয়ে’ বলতে বোঝাত কুলীন ব্রাহ্মণকন্যা। যে সকল ব্রাহ্মণ ‘কুলীন’ নামে আখ্যাত হতেন, তাঁদের পদবী ছিল বন্দ্যোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায়, গঙ্গোপাধ্যায় ও মখোপাধ্যায়। সামাজিক মর্যাদায় তাঁরা ছিলেন অন্যান্য ব্ৰাহ্মণের তলনায় উচ্চ ও শ্রেষ্ঠ। বিবাহ সম্বন্ধে তাঁদের মধ্যে যে বিধান প্রচলিত ছিল সেই বিধান অনযায়ী কুলীন ব্রাহ্মণসন্তান কুলীন বা অকুলীন ব্রাহ্মণ বংশে বিবাহ করতে পারত, কিন্তু কুলীন ব্রাহ্মণকন্যারা তা পারত না। যদি সেরূপ মেয়ের বিবাহ অকুলীনের সঙ্গে হতো, তাহলে তার বাবার কৌলীন্য ভঙ্গ হতো। সামাজিক মর্যাদায় সেরূপ বংশ হীন বলে পরিগণিত হতো। সেজন্য কুলীন ব্রাহ্মণরা কন্যাদান কুলীন পাত্রেই করত। এছাড়া আরও বিধিনিষেধ ছিল। ফলে কুলীন কন্যার বিবাহ সম্বন্ধে সমাজে এক জটিল অবস্হার সৃষ্টি হয়েছিল।
বস্তুত মধ্যযুগের বাঙালী ব্রাহ্মণ সমাজে কৌলীন্য প্রথা যে জটিল অবস্হার সৃষ্টি করেছিল, তাতে কুলীন কন্যাদের বিবাহ যে মাত্ৰ দণ্ডকর হয়ে উঠেছিল তা নয়; বিভ্রাটে ও সামাজিক অশুচিতায় পরিণত হয়েছিল। অর্থগৃধ্নতা একশ্রেণীর কুলীন ব্রাহ্মণকে প্রলুব্ধ করেছিল বিবাহকে একটা বাণিজ্যিক পেশায় পরিণত করতে। রামনারায়ণ তর্করত্ন তাঁর ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ নাটকে তাদের ‘বিবাহ বণিক’ বলে বর্ণনা করেছেন। গ্রামে গ্রামে ঘরে অর্থের বিনিময়ে তারা কুলীন কন্যার পিতাদের কন্যাদায় হতে মুক্ত করত। তারপর বিবাহান্তে ওই সকল বিবাহবণিক নিজেদের খাতায় কন্যার ও তার পিতার নামধাম লিখে নিয়ে অন্তর্হিত হতো। ফলে সেরূপ ‘বিবাহিতা’ কুলীন কন্যাকে পিতৃগহেই থাকতে হতো। অনেক সময় কুলীন পিতা কুলরক্ষার জন্য শ্মশানঘাটে ‘গঙ্গাজলী’র জন্য আনীত কুলীন ব্রাহ্মণের সঙ্গেই কন্যার বিবাহ দিতেন। অচিরেই সেই কন্যা বিধবা হতো। এরূপ বিধবা কুলীন কন্যারাও পিতৃগহেই থেকে যেত। আবার গরীব কুলীন কন্যাদের অনেক সময় বিবাহই হতো না। সারা জীবন তাদের অনূঢ়া হয়েই পিতৃগহে থেকে যেতে হতো।
যারা কুলীন কন্যাদের বিবাহ করা পেশা রূপে গ্রহণ করেছিল, সে-সব কুলীন ব্রাহ্মণ খাতা দেখে নামধাম সংগ্রহ করে মাঝে মাঝে শ্বশুরবাড়িতে পদার্পণ করত এবং এক রাত্রি জামাই আদরে থেকে সালিয়ানা দক্ষিণা আদায় করে, কুলীন কন্যার পিতার বংশকে কৃতাৰ্থ করে, সত্বর অপর গ্রামে অপর শ্বশুরবাড়িতে পদার্পণ করবার জন্য যাত্রা করত। অনেকে আবার রাত্রিকালে নিদ্রিতা স্ত্রীর অলঙ্কার অপহরণ করে ও সরে পড়ত।
অনেক সময়ই এরূপ বিবাহ-পেশাদারী কুলীন ব্রাহ্মণরা শ্বশুরবাড়ির পথঘাটের সঙ্গে সম্যক পরিচিত থাকত না। কথিত আছে এরূপ এক কুলীন ব্রাহ্মণ এক গ্রামে গিয়ে শ্বশুরবাড়ি চিনতে না পেরে, পথে পুঙ্করিণী থেকে স্নানান্তে প্রত্যাগতা এক যুবতীকে দেখে তাকে সম্বোধন করে জিজ্ঞাসা করে–মা, অমকের বাড়ি এ গ্রামের কোথায় বলতে পার? তিনি কেন সন্ধান করছেন জানতে চাইলে ব্রাহ্মণ বলে-‘আমি তাঁর জামাই।’ সে কথা শুনে সেই কন্যা বুক পর্যন্ত অবগুণ্ঠিত হয়ে, তাকে নিজ গৃহে নিয়ে যায়।
আগেই বলেছি যে এ-সমাজের মেয়েরা বিয়ের পর বাপের বাড়িতেই থেকে যেত। স্বামী ক্বচিৎ কদাচিৎ শ্বশুরবাড়ি আসত। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি এলে কি হবে! বিনা দক্ষিণায় তারা কখনও স্ত্রীর সহিত মিলিত হতো না। ভারতচন্দ্র তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে এর এক সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন। সেখানে এক কুলীনের মেয়ের মুখ দিয়ে তিনি বলিয়েছেন–
আর রামা বলে আমি কুলীনের মেয়ে
যৌবন বহিয়া গেল বর চেয়ে চেয়ে।।
যদি বা হইল বিয়া কত দিন বই।
বয়স বুঝিলে তার বড় দিদি হই।।
বিয়াকালে পণ্ডিতে পণ্ডিতে বাদ লাগে।
পুনর্বিয়া হবে কিনা বিয়া হবে আগে।।
দু-চারি বৎসরে যদি আসে একবার।
শয়ন করিয়া বলে কি দিবি ব্যাভার।।
সুতা বেচা কড়ি যদি দিতে পারি তায়।
তবে মিষ্টি মুখ নতুবা রুষ্ট হয়ে যায়।।
সুতরাং এরূপ সমাজে যে-সব মেয়ের যৌনক্ষুধা প্রবল, তাদের ক্ষেত্রে যা ঘটত তা সহজেই অনুমেয়। গোপন অভিসার কুলীন কন্যাদের সবভাবে দাঁড়িয়েছিল। আদিম যৌনক্ষুধাকে তারা অস্বীকার করতে পারত না। অবৈধ সহবাসে তারা লিপ্ত হতো। বস্তুতঃ খ্রীস্টীয় উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে রামনারায়ণ তর্করত্ন ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সেটা খোলাখুলিই বলেছিলেন। রামনারায়ণ তাঁর ‘কুলীনকলসর্বস্ব’ নাটকের চতুথ অঙ্কে পিতা-পুত্রের সংলাপের ভিতর দিয়ে সেটা বলেছেন। পুত্র তিন বৎসর শ্বশুরবাড়ি যায়নি। হঠাৎ খবর এল তার একটি কন্যাসন্তান হয়েছে। পুত্র আশ্চর্য হয়ে পিতাকে যখন এ কথা বলছে, তখন পিতা বলছেন–বাপু হে, তাতে ক্ষতি কি? আমি বিবাহ করবার পর একবারও শ্বশুর বাড়ি যাইনি। শুভদৃষ্টির পর একেবারে তোমার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়।’
কুলীন কন্যাদের যখন স্বামী ব্যতীতই গর্ভ হতো, তখন মেয়ের মায়েরা কি কৌশল অবলম্বন করে সেই সন্তানের বৈধতা পাড়াপাড়শীদের কাছে জানাতো, তা বিদ্যাসাগর মশাই তাঁর ‘বহুবিবাহ নিবন্ধে বিবৃত করেছেন। বিদ্যাসাগর মশাই লিখেছেন–
‘কোনও কারণে কুলীন মহিলার গর্ভসঞ্চার হইলে, তাহার পরিপাকাথে কন্যাপক্ষীয়দিগকে বিবিধ উপায় অবলম্বন করিতে হয়। প্রথম সবিশেষ চেষ্টা ও যত্ন করিয়া জামাতাকে আনয়ন। তিনি আসিয়া শ্বশুরালয়ে দু-একদিন অবস্থিতি করিয়া, প্রস্থান করেন। ঐ গর্ভ তৎ সহযোগে সম্ভুত বলিয়া পরিগণিত হয়। দ্বিতীয়, জামাতার আনয়নে কৃতকার্য হইতে না পারিলে, ব্যভিচার সহচরী ভ্রূণহত্যাদেবীর আরাধনা। এ অবস্হায় এতদ্ব্যাতিরিক্ত নিস্তারের আর পথ নাই। তৃতীয় উপায় অতি সহজ, অতি নির্দোষ ও সাতিশয় কৌতুকজনক। তাহাতে অর্থব্যয়ও নাই এবং ভ্রূণহত্যাদেবীর উপাসনাও করিতে হয় না। কন্যার জননী বা বাটির অপর কোন গৃহিণী একটি ছেলে কোলে করিয়া, পাড়ায় বেড়াইতে যান, এবং একে একে প্রতিবেশীদিগের বাটি গিয়া, দেখ মা, দেখ বোন অথবা দেখ বাছা, এইরূপ সম্ভাষণ করিয়া, কথা প্রসঙ্গে বলিতে আরম্ভ করেন, অনেক দিনের পর কাল রাত্ৰিতে জামাই আসিয়াছিলেন, হঠাৎ আসিলেন, রাত্রিকাল কোথায় কি পাব, ভাল করিয়া খাওয়াতে পারি নাই। অনেক বলিলাম একবেলা থাকিয়া, খাওয়া দাওয়া করিয়া যাও। তিনি কিছুতেই রহিলেন না, বলিলেন, আজ কোন মতে থাকিতে পারিব না; সন্ধ্যার পরই অমুক গ্রামের জমিদারের বাটিতে একটা বিবাহ করিতে হইবেক; পরে অমুক দিন, অমুক গ্রামের হালদারের বাটীতেও বিবাহের কথা আছে; সেখানেও যাইতে হইবেক। যদি সুবিধা হয়, আসিবার সময় এই দিক দিয়া যাইব। এই বলিয়া ভোর ভোর চলিয়া গেলেন। স্বর্ণকে বলিয়াছিলাম, ত্রিপুরা ও কামিনীকে ডাকিয়া আন, তারা জামাইয়ের সঙ্গে খানিক আমোদ আহ্লাদ করিবে। একলা যেতে পারব না, বলিয়া ছুঁড়ী কোন মতেই এল না। এই বলিয়া সে ঐ দুই কন্যার দিকে চাহিয়া বলিলেন, এবার জামাই এলে মা তোরা যাস ইত্যাদি। এইরূপে পাড়ায় বাড়ি বাড়ি বেড়াইয়া জামাতার আগমনবার্তা কীর্তন করেন। পরে স্বর্ণমঞ্জরীর গর্রসঞ্চার প্রচার হইলে, ঐ গর্ভ জামাতাকৃত বলিয়া পরিপাক পায়।’
এবার শুনুন শরৎচন্দ্র তাঁর ‘বামনের মেয়ে’ উপন্যাসে কি বলেছেন। ‘পরম কুলীনের পরমা কুলীন কন্যা হিসাবে সন্ধ্যা বলল-আমি বামুনের মেয়ে নই।…আমার মা আমাকে সম্প্রদান করতে বসেছিলেন। এমন সময় মৃত্যুঞ্জয় ঘটক দু’জন লোক সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হল। বলল, তোমরা শোন, এই যাকে তোমরা পরম কুলীন প্রিয় মুখুজ্যে বলে জান সে বামন নয়, মিহির নাপিতের ছেলে। তারপর মৃত্যুঞ্জয় ঘটক গঙ্গাজলের ঘটটা ঠাকুরমার সামনে বসিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, বলুন সত্যি কিনা? বলুন ও কার ছেলে? মকুন্দ মুখুজ্যের না হীরা নাপিতের? আমার সন্ন্যাসিনী ঠাকুরমা মাথা হেঁট করে রইলেন। কিছুতেই মিথ্যা কথা বলতে পারলেন না। একজন তখন সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। সে তাদের গ্রামের লোক। বলল, আট বছর বয়সে ঠাকুরমার বিয়ে হয়, তারপর দশ-পনের বছর পরে একজন এসে জামাই মুকুন্দ মুখুজ্যে বলে পরিচয় দিয়ে বাড়ি ঢোকে। পাঁচ টাকা আর একখানা কাপড় নিয়ে সে দুদিন বাস করে চলে যায়। তারপর থেকে লোকটা প্রায়ই আসত। ঠাকুরমা খুব সুন্দরী ছিলেন–আর সে টাকা নিত না। তারপর যখন সে একদিন হঠাৎ ধরা পড়ে গেল, তখন বাবা জন্মেছেন। তারপর লোকটা বলল, ও কুকাজ সে নিজের ইচ্ছায় করেনি, তার মনিব মুকুন্দ মুখুজ্যের আদেশেই করেছে। একে বুড়ো মানুষ, তারপর পাঁচ-সাত বছর বাতে পঙ্গু, তাই অপরিচিত স্ত্রীদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের ভার তার ওপর দিয়েছিল। হিরু নাপিত ঐ বামনের পরিচয় মুখস্থ করে, একটা উপায় তৈরি করে রাখে। তখন থেকে যা কিছ রোজগার করে অর্ধেক ভাগ পায়। আরো দশ-বারো জায়গা থেকে সে এমনি করে প্রভুর জন্য রোজগার করে নিয়ে যেত।’
রামনারায়ণ তর্করত্ন, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখদের রচনা থেকে আমরা বাঙলার কুলীন ব্রাহ্মণদের পরিচয় পাই। তারাই কুলীনের মেয়েদের পিতা, এবং তাদের মেয়েরাই কুলীন ব্রাহ্মণ ছাড়া বিবাহ করতে পারত না। এই প্রথা নিবর্তনের জন্য বিদ্যাসাগর মশাই যথেষ্ট আন্দোলন করেছিলেন, কিন্তু সরকারী সমৰ্থন পাননি। তবে তা সত্ত্বেও তাঁর আন্দোলনের ফলেই এই কুপ্রথা বাঙালী সমাজ থেকে গত শতাব্দীতে বিলপ্ত হয়। তার ফলে কুলীনের মেয়েরা বিবাহিত জীবনে আজ সম্মান ও শুচিতা লাভ করেছে।
হিন্দু বিবাহ-বিধান
গত শতাব্দীতে হিন্দু মেয়েরা পেয়েছে বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার। আর পুরুষ বঞ্চিত হয়েছে তার একাধিক বিবাহ করবার অধিকার। এছাড়া বিবাহের ন্যূনতম বয়স এখন বর্ধিত করা হয়েছে। এ সবই বিবাহের ওপর গণতান্ত্ৰিক চিন্তাধারার ফসল। এ সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে দেখা যাক বিবাহ সম্বন্ধে আমাদের আগে কি প্রথা ও নিয়মকানুন ছিল।
আর্যরা এদেশে আসবার আগে যে সব বর্গের বিবাহপ্রথা প্রচলিত ছিল তা হল যথাক্রমে রাক্ষস, গন্ধব ও অসুর বিবাহ। কেননা এই সব বর্গের বিবাহের কোন উল্লেখ ঋগ্বেদে নেই, অথচ এগুলি বর্তমানের আদিবাসী সমাজে প্রচলিত আছে। বৈদিক যুগে মাত্ৰ এক রকম বর্গের বিবাহই (ব্রাহ্ম বিবাহ) প্রচলিত ছিল, এবং তারপ্রাপ্তবয়স্ক যুবক যুবতীদের মধ্যেই হত। এছাড়া তাদের অধিকাংশই নিজের পতি নিজেই নিবাচন করতে পারত। এটা আমরা জানতে পারি ঋগ্বেদের সপ্তম মণ্ডলে বর্ণিতে ‘সমন’ উৎসব থেকে। এই উৎসবে যুবতীরা মনোমত পতি লাভের আশায় সুসজ্জিত হয়ে যোগদান করত। পরে দিদিষুর (মধ্যগ বা ঘটকের) আবির্ভাব ঘটে। তখন থেকেই ‘সমন’ উৎসবে পতিনির্বাচনের প্রচলন কমে যায়।
বৈদিক যুগে বিবাহ কোন বিশেষ ব্যক্তির সঙ্গে হত না, হত তার সমস্ত ভ্ৰাতাদের সঙ্গে। অন্তত আপস্তম্ভধমসূত্রে পরিষ্কার বলা হয়েছে যে, কন্যাকে দান করা হয় কোন এক বিশেষ ভ্রাতাকে নয়, বংশের সমস্ত ভ্ৰাতাকে। এজন্য পরবর্তীকালে মনু বিধান দিয়েছিলেন যে, কলিযুগে কন্যার বিবাহ যেন সমগ্র পরিবারের সঙ্গে যৌথভাবে দেওয়া না হয়। ঋগ্বেদ এবং অথবা বেদে কয়েকটি স্তোত্ৰ আছে যা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, যদিও বধুকে জ্যেষ্ঠভ্ৰাতাই বিবাহ করত, তা হলেও তার কনিষ্ঠ সহোদরদের তার ওপর যৌনমিলন বা রমণের অধিকার থাকত। এই দুই গ্রন্থেই স্বামীর কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে ‘দেবৃ’ বা দেবর বলা হয়েছে। কেননা, ‘দেবর’ মানে ‘দ্বিবর’ বা দ্বিতীয় বর। ঋগ্বেদের এক সাহানে বর্ণিত হয়েছে যে বিধবা বৌদি দেবৃকে তার দাম্পপত্য শয্যায় নিয়ে যাচ্ছে।
ঋগ্বেদে যম-যমীর কথোপকথনে দেখা যায় যে যমের যমজ-ভগনী যমী। যমের সঙ্গে যৌনমিলন প্ৰার্থনা করছে। বৌদ্ধ জাতক গ্রন্থেও সহোদরসহোদরা বিবাহের বহু দৃষ্টান্ত আছে। পরবর্তী কালে যখন গোত্র-প্রবর-সপিণ্ড বিধানের উদ্ভব হয়, তখন এটা বন্ধ হয়ে যায়। তবে দক্ষিণ ভারতে পিসততো বোন ও মামাতো বোনের সঙ্গে বিবাহ এখনও বাঞ্ছনীয়। বর্তমানে উত্তর ভারতে নিকট আত্মীয়ের সঙ্গে বিবাহ নিষিদ্ধ, যদিও আদিবাসী সমাজে এটার প্রচলন আছে। যেমন উত্তর-পূর্ব সীমান্তের আদিবাসী সমাজভুক্ত লাখের, বাগনী ও ডাফলা জাতির লোকরা বিধবা বিমাতাকে বিবাহ করে। আসামের গারো জাতির লোকেরা বিধবা শাশুড়িকে বিবাহ করে। ওড়িশার আদিবাসী সমাজে শবর জাতির লোকেরা বিধবা খুড়িকে বিবাহ করে।
মহাভারতীয় যুগে আমরা চার রকমের বিবাহের উল্লেখ পাই, যথা ব্রাহ্ম, গান্ধব, অসুর ও রাক্ষস। কিন্তু সূত্ৰগ্রন্থসমূহে আট রকম বিবাহের উল্লেখ আছে। উপরোক্ত চার রকম ছাড়া, আর্য, প্রাজাপত্য, দৈব ও পিশাচ। এই সকল বিবাহের বর্ণনা আমার ‘ভারতের বিবাহের ইতিহাস’ বইয়ে দেওয়া আছে। তবে এখানে মাত্র একথাই বলতে চাই যে মহাভারতীয় ও রামায়ণী যুগের স্বয়ম্বরা বিবাহ রাক্ষস বিবাহেরই একটা সুষ্ঠ সংস্করণ।
বেদোত্তর যুগে নিষ্ঠাবান হিন্দুসমাজে বিবাহ নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল স্মৃতিশাস্ত্রসমূহ দ্বারা। তাদের মধ্যে প্রাধান্য লাভ করে মনুর মানবধর্মশাস্ত্র। মনুর বিধানসমূহের ভিত্তিতে যে আদর্শ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল, সে আদর্শ গঠিত হয়েছিল নিম্নলিখিত বিধানসমহ নিয়ে।
(১) বিবাহ নিম্পন্ন হবে মন্ত্রপাঠ, যজ্ঞ সম্পাদন ও সপ্তপদীগমন দ্বারা।
(২) জাতি নির্বিশেষে সকলকেই পুত্র উৎপাদনের জন্য বিবাহ অবশ্যই করতে হবে।
(৩) কন্যার বিবাহ দিতে হবে সে ঋতুমতী হবার পূর্বে।
(৪) বিবাহ সংঘটিত হবে জাতির মধ্যে।
(৫) বিবাহ সগোত্রে, সপ্রবরে ও সপিণ্ডদের মধ্যে হতে পারবে না।
(৬) বিবাহিতা নারীকে সতীত্বের সমস্ত বিধান অনসরণ করে পতিব্ৰতা হয়ে থাকতে হবে।
(৭) স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবাকে সধবার ভূষণ পরিহার করে ব্রহ্মচর্য পালন করতে হবে (পরে সহমরণ অনুসৃত হত)।
(৮) পরাস্ত্রীগমন ব্যাভিচার বলে গণ্য হবে এবং তার জন্য ব্যভিচারীকে গুরুদন্ড পেতে হবে।
।।দুই।।
সাম্প্রতিককালে, গণতন্ত্রের প্রভাবে হিন্দুরর বিবাহ জীবনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে। এর সূচনা করেছিলেন রাজা রামমোহন রায়। সনাতনী হিন্দু সমাজের ঘোর বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি সক্ষম হয়েছিলেন সতীদাহ প্রথা নিবারণ করতে। তিনি বড়লাট লর্ড উইলিয়াম বেনটিঙ্ককে সম্মত করেন ১৮২৯ সালে ২৭ নং আইন বিধিবদ্ধ করতে। এই আইন দ্বারা সতীদাহ চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। তারপর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আন্দোলনের ফলে ১৮৫৬ সালে ১৫ নং আইন বিধিবদ্ধ হয়। এই আইন দ্বারা বিধবার বিবাহ বৈধ করা হয়। তারপর ১৮৭২ সালের ৩ নং আইন দ্বারা অসবৰ্ণ বিবাহের বাধাও দূর করা হয়। তবে এই আইন অনযায়ী বিবাহ করতে হলে বিবাহ ইচ্ছুক উভয় পক্ষকেই শপথ করতে হত যে তারা হিন্দু নন। কিন্তু ১৯২৩ সালের ৩০ নং আইন দ্বারা বিধান দেওয়া হয় যে অহিন্দু বলে ঘোষণা না করেও অসবৰ্ণ বিবাহ করা যাবে। ১৮৯১ সালের ‘এজ অফ কনসেন্ট অ্যাক্ট’ দ্বারা বিবাহে সঙ্গমের ন্যুনতম বয়স নিদর্ধারিত হয়। এরপর বর্তমান শতাব্দীর বিশের দশকে রায় বাহাদুর হরবিলাস সরদা বদ্ধপরিকর হন হিন্দু সমাজে বাল্যবিবাহ রোধ করবার জন্য। ১৯২৯ সালের ১৯ নং আইনে নিদেশ দেওয়া হয় যে হিন্দু বিবাহে ছেলের উপযুক্ত বয়স ন্যূনপক্ষে ১৮ ও মেয়ের বয়স ১৫ হওয়া চাই। (বর্তমানে ইহা বৃদ্ধি করে ২১ ও ১৮ করা হয়েছে)।
হিন্দ বিবাহ সংস্কারের জন্য দুটি বড় রকমের আইন বিধিবদ্ধ হয় ১৯৪৬ সালে। ওই বৎসর ১৯ নং আইন দ্বারা, স্ত্রীকে অধিকার দেওয়া হয় অবস্থাবিশেষে স্বামী ত্যাগের জন্য। স্বামী যদি কুৎসিত ব্যাধিতে ভোগেন, বা স্বামী স্ত্রীর প্রতি এমন নিষ্ঠুর ব্যবহার করেন যাতে স্ত্রীর নিরাপত্তার অভাব ঘটে, বা স্ত্রীকে পরিত্যাগ করেন অথবা আবার বিবাহ করেন বা নিজ বাসগহে রক্ষিতা এনে রাখেন, বা ব্যভিচারে লিপ্ত হন কিংবা ধর্মান্তর গ্রহণ করেন, তাহলে ওই আইনের বলে স্ত্রী স্বচ্ছন্দে স্বামী ত্যাগ করে স্বতন্ত্র বসবাস করতে পারে। আর ২৮ নং আইনে নির্দেশ দেওয়া হয় যে সগোত্রে ও সমপ্রবারে বিবাহ বৈধ। স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৪৯ সালের ২১ নং আইন দ্বারা বিবাহ ক্ষেত্রে জাতিগত বর্ণগত, শ্রেণীগত ও সম্প্রদায়গত যত রকম বাধা-বৈষম্য ছিল, তা দূরীভূত করা হয়।
বিবাহ সম্পর্কে শেষ আইন বিধিবদ্ধ হয়েছে ১৯৫৫ সালে। এটাই হচ্ছে বিবাহ সম্বন্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপণ আইন। এই আইনটিকে হিন্দু বিবাহ বিধি বা ১৯৫৫ সালের ২৫ নং আইন বলা হয়। বৈধ বিবাহের যে সকল শর্ত এতে নির্দিষ্ট হয়েছে সেগুলি হচ্ছে—
(১) বিবাহকালে স্বামীর স্ত্রী বা স্ত্রীর অন্য স্বামী জীবিত থাকবে না।
(২) উভয়পক্ষের কেহই পাগল বা জড়বুদ্ধিসম্পন্ন হবে না।
(৩) ন্যূনপক্ষে বরের ১৮, (এখন ২১) ও কনের ১৫ (এখন ১৮) বৎসর বয়স হওয়া চাই।
(৪) উভয়পক্ষের কেহই নিষিদ্ধ নিকট আত্মীয়ের মধ্যে হবে না।
(৫) উভয়ের কেহই সপিণ্ড হবে না।
(৬) যেখানে কনের বয়স ১৫ (এখন ১৮) বছরের কম, সেখানে অভিভাবকের সন্মতির প্রয়োজন হবে।
এই আইনে আরও বলা হয়েছে যে সিদ্ধ বিবাহ অসিদ্ধ বলে সাব্যস্ত হবে–
(১) যদি স্বামী পুরুষত্বহীন হয়।
(২) যদি বিবাহের সময় কোন পক্ষ পাগল বা জড়বুদ্ধিসম্পন্ন হয়।
(৩) যদি প্রতারণা দ্বারা বা বলপূর্বক অভিভাবক দ্বারা দরখাস্তকারীর সম্মতি নেওয়া হয়ে থাকে।
(৪) যদি বিবাহের পূর্বে স্ত্রী স্বামী ব্যতীত অন্য কারোর দ্বারা গর্ভবতী হয়ে থাকে।
(৫) যদি অন্য স্ত্রী বা স্বামী বিদ্যমান থাকায় বিবাহ হয়ে থাকে।
(৬) যদি নিষিদ্ধ নিকট আত্মীয়ের মধ্যে বিবাহ হয়ে থাকে।
এছাড়া নিম্নলিখিত কারণগুলির মধ্যে যে কোন একটি কারণ দেখাতে পারলে আদালত বিবাহ বিচ্ছেদের আদেশ দিতে পারে–
(১) স্বামী বা স্ত্রী কেউ ব্যভিচারে লিপ্ত হয়।
(২) ধর্মান্তর গ্রহণের ফলে যদি আর হিন্দু না থাকে।
(৩) আদালতের কাছে বিবাহ ভঙ্গের জন্য দরখাস্ত করবার পূর্বে ক্ৰমান্বয়ে তিন বৎসর স্বামী বা স্ত্রী কেউ যদি বিকৃত মস্তিষ্ক হয়।
(৪) ওই রকম তিন বৎসর কাল যদি স্বামী বা স্ত্রী অনারোগ্য কুষ্ঠব্যাধিতে আক্ৰান্ত হয়ে থাকে।
(৫) ওই রকম তিন বৎসর কাল স্বামী বা স্ত্রী কেউ যদি কোন সংক্ৰামক যৌন ব্যাধিতে আক্ৰান্ত হয়।
(৬) স্বামী বা স্ত্রীর কেউ যদি অন্য কোন ধর্ম সম্প্রদায়ে যোগদান করে সংসার ত্যাগ করে।র
(৭) স্বামী বা সস্ত্রীর মধ্যে কেউ যদি ক্ৰমান্বয়ে সাত বৎসর নিরুদিষ্ট থাকে।
(৮) যেখানে জুডিশিয়াল সেপারেশনের ডিক্রির পর উভয়পক্ষ আর স্বামী-স্ত্রীরূপে সহবাস করেনি
(৯) যদি রেস্টিটিটিউশন অভ কনজুগাল রাইটস-এর ডিক্রি হবার পর কোন একপক্ষ সেই ডিক্রি অমান্য করে অপর পক্ষ থেকে ক্ৰমান্বয়ে দু’বৎসর পৃথক বসবাস করে।
এছাড়া আরও দু’টি কারণে স্ত্রী আদালতের কাছে বিবাহ-বিচ্ছেদের জন্য প্রার্থনা করতে পারে। এ দলটি কারণের প্রথমটি হচ্ছে—যদি এক স্ত্রী বিদ্যমান থাকতে স্বামী অন্য স্ত্রী গ্রহণ করে থাকে এবং আদালতে প্রার্থনা করবার সময় সেই স্ত্রী জীবিত থাকে। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে–স্বামী যদি বলাৎকরণ, পুংমৈথুন বা কোনরূপে অস্বাভাবিক যৌনকর্মে লিপ্ত হয়ে থাকে।
১৯৫৫ সালের বিবাহ আইন সম্পর্কে তিনটি কথা বলা প্রয়োজন। প্রথম, বিবাহ সিদ্ধ হবার সময় থেকে তিন বৎসরের পূর্বে কোন পক্ষ আদালতে বিবাহ-বিচ্ছেদের কোন দরখাস্ত করতে পারবে না, দ্বিতীয়, আদালত কর্তৃক বিবাহ-বিচ্ছেদের নির্দেশ দেবার পর যদি তার বিপক্ষে কোন আপীল না করা হয়ে থাকে তাহলে এক বছর অপেক্ষা করে উভয় পক্ষই পুনরায় বিবাহ করতে পারে। (যদি বিবাহ না করে তাহলে আদালত খোরপোষের দাবি গ্রাহ্য করতে পারে), এবং তৃতীয়, আদালত কর্তৃক বিবাহ-বিচ্ছেদের নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও ওই নিদেশের পাবে স্ত্রী যে সন্তান গর্ভে ধারণ করেছে সে সন্তান বৈধ বলে গণ্য হবে।
আশা করা হয়েছিল যে এই আইন প্রণয়নের ফলে হিন্দু-বিবাহ যে শুধু গণতান্ত্রিকতা লাভ করবে তা নয়, বিবাহিতা হিন্দু নারী সামাজিক ও পারিবারিক নিষ্ঠুরতা ও অন্যায়ের হাত থেকে নিষ্কৃতি লাভ করবে। কিন্তু আমাদের সে আশা আজ বিনষ্ট। নারী-মুক্তির পরিবর্তে এসেছে নারী নির্যাতন। প্রতিদিনই খবরের কাগজে একটি-দু’টি বধূ নিধনের খবর প্রকাশিত হয়। আদিম বর্বরতার বশীভূত হয়ে শ্বশুর শাশুড়ি, ননদ-দেবর, এমন কি স্বামী সকলেই হয় আগুনে পুড়িয়ে নয়তো গলায় ফাঁস লাগিয়ে বা বিষ খাইয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। শিক্ষিত, অশিক্ষিত সব ধরনের মেয়েই এর শিকার। তাই আজ অধিকাংশ মেয়ের কাছে পবিত্র বিবাহবন্ধন একটা বিভীষিকা হয়ে উঠেছে।
অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গেই বধূ হত্যার সংখ্যা ভয়াবহভাবে বেড়ে যাচ্ছে। বধূনিধন যেন একটা খেলাধূলার সামিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিশ্রুত বা প্রত্যাশিত পণ দিতে না পারাই বধ হত্যার প্রধান কারণ। তবে সমাজ থেকে পণপ্রথা উঠছে না! আইন হয়েছে, কিন্তু সে আইন কেউ মানছে না। পণ দেওয়ানেওয়া পুর্ণোদ্যমেই চলেছে। কেবল তার জন্য কিছ নিরীহ মেয়ের জীবনাবসান ঘটছে।
বধূহত্যা না করে, বনিবনা না হলে অনায়াসেই বিবাহ-বিচ্ছেদের পথ বেছে নেওয়া যায়। তার জন্য আইনও রয়েছে। কিন্তু সে রাস্তায় কেউ পা বাড়বে না। কারণ সেটা ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার। তার চেয়ে অনেক সুবিধাজনক ও সস্তা হচ্ছে মেয়েটিকে মেরে ফেলা। আজ স্ত্রী শিক্ষার প্রসার যতটা ঘটেছে, তার চেয়ে বেশি প্রবল হয়েছে বধূ নিধনের মত অমানুষিক নৃশংসতা।