বাঙলা ও বাঙালী
।।এক।।
একশো বছর আগে বঙ্কিমচন্দ্র আক্ষেপ করে বলেছিলেন যে, বাঙালীর ইতিহাস নেই। আজ আর সে-কথা ঘাটে না। নানা সুধীজনের প্রয়াসের ফলে আজ বাঙলার ও বাঙালীর এক গৌরবময় ইতিহাস রচিত হয়েছে। এ বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক প্রচেষ্টা ছিল রাজশাহীর বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটির। বর্তমান শতাব্দীর সূচনায় ওই সোসাইটির পক্ষ থেকে রমাপ্রসাদ চন্দ লেখেন “গৌড়রাজমালা” ও অক্ষয়কুমার মৈত্র প্রকাশ করেন “গৌড়-লেখমালা।” তারপর রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় রচনা করেন তাঁর “বাঙলার ইতিহাস।” কিন্তু বইখানা ছিল রাষ্ট্রীয় ইতিহাস, বাঙালীর জীবনচর্যার ইতিহাস নয়। তিনের দশকে বাঙলার ইতিহাসের একটা কঙ্কাল ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপিত করেন বর্তমান লেখক মহাবোধি সোসাইটির মুখপাত্র ‘মহাবোধি’-তে। চল্লিশের দশকের গোড়াতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বের করল তাদের “হিস্ট্রি অভ্ বেঙ্গল।” এই বইটাতে প্রথম প্রদত্ত হল বাঙালীর জীবনচর্যার বিভিন্ন বিভাগের ইতিহাস। এর ছ’বছর পরে ডঃ নীহাররঞ্জন রায় অসামান্য অর্জন করলেন বাঙলা সাহিত্যের অনবদ্য সৃজন তাঁর “বাঙালীর ইতিহাস—আদিপর্ব” লিখে। কিন্তু বাঙলার ইতিহাসের প্রাগৈতিহাসিক যুগটা শূন্যই থেকে গেল। ষাটের দশকে বর্তমান লেখক তাঁর “হিস্ট্রি অ্যাণ্ড কালচার অভ্ বেঙ্গল” ও “প্রি-হিস্ট্রি অ্যাণ্ড বিগিনিংস অভ্ সিভিলিজেন ইন বেঙ্গল” বই দুটি লিখে বাঙলার প্রাগৈতিহাসিক যুগের একটা ইতিহাস দেবার চেষ্টা করলেন। শুধু তাই নয়, তিনি বাঙলার ইতিহাসকে টেনে আনলেন ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের মুখ্যমন্ত্রিত্বের সময় পর্যন্ত। ওই দশকেই রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধিকর্তা পরেশচন্দ্র দাশগুপ্ত বের করলেন তাঁর “একস্ক্যাভেসনস্ অ্যাট পাণ্ডুরাজার ঢিবি।” এর পর ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখলেন চারখণ্ডে তাঁর “বাঙলার ইতিহাস।”
এদিকে বাঙালীকে সম্যকরূপে বুঝবার চেষ্টাও চলতে লাগল। ১৯১৬ খ্রীষ্টাব্দে রমাপ্রসাদ চন্দ তাঁর “ইণ্ডো-আরিয়ান রেসেস্” বইয়ে বাঙালীর দৈহিক গঠনে আল্পীয় উপাদানের কথা বললেন। এর পনেরো বছর পরে ডঃ বিরজাশঙ্কর গুহ বাঙালীর দৈহিক গঠনে আল্পীয় রক্ত ছাড়া, দিনারিক রক্তের কথাও বললেন। ডঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত অ ক্ষিতিশপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ও এ-বিষয়ে অনুশীলন করলেন। নূতন তথ্যের ভিত্তিতে বাঙালীর প্রকৃক নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের একটা প্রয়োজন অনুভূত হল। এই প্রয়োজন মেটাবার জন্যে ১৯৪২ খ্রীষ্টাব্দে হিন্দু মহাসভার অনুরোধে বর্তমান লেখক লিখলেন তাঁর “বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয়” (জিজ্ঞাসা, পুনর্মুদ্রন ১৯১৭ ও ১৯১৯)। অপর দিকে সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ব সম্বন্ধে কাজ চালালেন প্রবোধচন্দ্র ভৌমিক প্রভুখ নৃতত্ত্ববিদগণ।
অনেক আগেই বাঙালী সংস্কৃতির সাত-পাঁচের সংগে পরিচয় করিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। কিন্তু তার সবচেয়ে বড় অবদান ছিল নেপাল, তিব্বত প্রভৃতি রাজ্য পরিভ্রমণ করে বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন অবহট্ট ভাষায় ‘সন্ধ্যা’-রীতিতে রচিত লুইপাদের “চর্যাপদ-বিনিশ্চয়,” সরোজ বজ্রের “দোহাকোষ,” ও কাহ্নপাদের “দোহাকোষ” ও “ডাকার্ণব”, এই চারখানা বই আবিষ্কার করা। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সম্বন্ধে আরও অনেকে অনুশীলন করলেন, যথা রামগতি ন্যায়রত্ন, দীনেশচন্দ্র সেন, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেন, বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ, বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়, পঞ্চানন চক্রবর্তী, আশুতোষ ভট্টাচার্য, শশিভূষণ দাসগুপ্ত, তমোনাশ দাসগুপ্ত, সজনীকান্ত দাস ও আরও অনেকে। তাঁদের সকলের অনুশীলনের ফলে, আজ আমরা সম্পূর্ণরূপে পরিচিত হয়েছি বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশ, ও বাংলা সাহিত্যের বিবর্তনের ইতিহাসের সঙ্গে।
।।দুই।।
বাঙলা অতি প্রাচীন দেশ। ভূতাত্ত্বিক গঠনের দিক দিয়ে বাঙলাদেশ গঠিত হয়ে গিয়েছিল প্লাওসিন যুগে (প্রায় দশ থেকে পঁচিশ লক্ষ বৎসর পূর্বে)। পৃথিবীতে নরাকার জীবেরও বিবর্তন ঘটে এই প্লাওসিন যুগে। এর পরের যুগকে বলা হয় প্লাইস্টোসিন যুগ। এই যুগেই মানুষের আবির্ভাব ঘটে।
যদিও প্লাইস্টোদিন যুগের মানুষের কোনও নরকঙ্কাল আমরা ভারতে পাই নি, তবুও তার আগের যুগের নরাকার জীবের কঙ্কাল আমরা এশিয়ার তিন জায়গা থেকে পেয়েছি। জায়গাগুলো হচ্ছে ভারতের উত্তর-পশ্চিম কেন্দ্রস্থ শিবলিক গিরিমালা, জাভা ও চীনদেশের চুংকিঙ। এই তিনটি বিন্দু সরলরেখা দ্বারা সংবদ্ধ করলে যে ত্রিভুজের সৃষ্টি হয়, বাঙলাদেশ তার কেন্দ্রস্থলে পড়ে। সুতরাং এরূপ জীবসমূহ যে সে-যুগে বাঙলাদেশের ওপর দিয়েও যাতায়াত করত, সেরূপ অনুমান করা যেতে পারে। (লেখকের “বাঙলার সামাজিক ইতিহাস,” জিজ্ঞাসা, দ্রষ্টব্য)। সাম্প্রতিক কালে মেদিনীপুর জেলার রামগড় সিজুয়ায় যে মানুষের অশ্মীভূত চোয়াল পাওয়া গিয়েছে, তা বৈজ্ঞানিক মহলে যদি চূড়ান্তরূপে গ্লাইস্টোসিন যুগের বলে স্বীকৃত হয়, তবে এটাই হবে এশিয়ার প্রাপ্ত প্রাচীন প্রকৃত মানবের একমাত্র নিদর্শন।
সিজুয়ায় প্রাপ্ত চোয়ালের অনুশীলন সাপেক্ষে, বলা যেতে পারে যে, প্লাইস্টোসিন যুগের মানুষের কঙ্কাল আমরা এদেশে পাইনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেই প্রাচীন যুগ থেকেই মানুষ যে বাঙলাদেশে বাস করে এসেছে, তার প্রমাণ আমরা পাই বাঙলাদেশে পাওয়া তার ব্যবহৃত আয়ুধ সমূহ থেকে। এই আয়ূধ সমূহের অন্তর্ভূক্ত হচ্ছে প্লাইস্টোসিন যুগের পাথরের তৈরি হাতিয়ার, যা দিয়ে সে-যুগের মানুষ পশু শিকার করত তার মাংস আহারের জন্য। এগুলো পাওয়া গিয়েছে বাঁকুরা, বর্ধমান, মেদিনীপুর প্রভৃতি জেলার নানা স্থান থেকে। এগুলোকে প্রত্ন-প্রস্তর যুগের আয়ুধ বলা হয়। প্রত্নপলীয় যুগের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল আনুমানিক দশ হাজার বছর আগে। তারপর সূচনা হয় নব প্রস্তর বা নবপলীয় যুগের। নবপলীয় যুগের প্রাদুর্ভাবের পর, অভ্যুদয় হয় তাম্রাশ্ম যুগের। তাম্রাশ্ম যুগেই সভ্যতার সূচনা হয়। বাঙলায় তাম্রাশ্ম যুগের ব্যাপক বিস্তৃতি ছিল মেদিনীপুর ও বর্ধমান জেলায়। এই যুগের সভ্যতার প্রতীক হচ্ছে সিন্ধুসভ্যতা। বাঙলা এই সভ্যতার নিদর্শন হচ্ছে পাণ্ডু রাজার টিবি। (পরের নিবন্ধ ‘বাঙলা কি সভ্যতার জন্মভূমি?’ দ্রষ্টব্য)।