***
স্মৃতির যুগে আদর্শ বিবাহের জন্য নারীর যে মাত্র সবণেই বিবাহ হ’ত, তা নয়। তাকে গোত্র, প্রবর ও জ্ঞাতিত্ব পরিহার করতে হ’ত। স্মৃতি-পূর্ব যুগে মেয়েদের পুরুষ-ভজন। সম্বন্ধে কিন্তু সে-বিধিনিষেধ ছিল
না। জ্ঞাতিত্বের কথাই আমরা প্রথম ধরছি। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের এক সূক্ত থেকে বোঝা যায় যে, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মৃত্যুর পর তার বিধবা স্ত্রী দেবরের সঙ্গেই স্ত্রীরূপে বাস করত। সেখানে বিধবাকে বলা হচ্ছে : ‘তুমি উঠে পড়, যে দেবু তোমার হাত ধরেছে, তুমি তার স্ত্রী হয়েই তার সঙ্গে বসবাস কর। অথর্ববেদের একজায়গাতেও ঠিক অনুরূপ কথা ধ্বনিত হয়েছে। এককথায়, ঋগ্বেদের যুগে দেবর-ভজনার রীতি প্রচলিত ছিল। বস্তুত ভাবীর সঙ্গে দেবরের যে যৌন-ঘনিষ্ঠতা (leviration) থাকত, তা ঋগ্বেদের বিবাহ-সম্পর্কিত সূক্তও ইঙ্গিত করে। উক্ত সূক্তে দেবতাগণের নিকট প্রার্থনা করা হচ্ছে যে, তারা যেন নববধূকে দেবুর প্রিয়া ও অনুরাগের পাত্রী করে তোলেন। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের অপর একস্থানেও বর্ণিত হয়েছে যে, বিধবা ভাবী দেবুকে তার দাম্পত্যুশয্যায় নিয়ে যাচ্ছে। ঋগ্বেদ ও অথর্ববেদ, এই দুই গ্রন্থেই স্বামীর কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে দেবৃ’ বা দেবর’ বলা হয়েছে। এই শব্দদ্বয় থেকেও ভাবীর সঙ্গে দেবরের এইরূপ সম্পর্ক সূচিত হয়। কেননা, দেবর’ মানে দ্বি-বর বা দ্বিতীয় বর। এককথায়, মেয়েদের দেবরকে ভজনা করা সেযুগের রীতি ছিল।
এই সম্পর্কে স্বভাবতই আমাদের পরবর্তীকালের নিয়োগ-প্রথা’র কথা মনে পড়ে। কিন্তু নিয়োগ-প্রথাটা ছিল স্বতন্ত্র প্রথা। বৈদিক যুগে ভাবীর ওপর দেবরের যে যৌন-অধিকার থাকত, তা সাধারণ ও সৰ্বকালীন রমণের অধিকার। আর পরবর্তীকালের নিয়োগ-প্রথা ছিল মাত্র সন্তান-উৎপাদনের অধিকার। সন্তান-উৎপাদনের পর এ অধিকার আর থাকত না। আরও লক্ষ্য করবার বিষয় হচ্ছে এই যে, বিধবা ভাবীর ওপর দেবরের এই যৌন অধিকার অবিকৃত থাকার দরুন ঋগ্বেদে বিধবা-বিবাহের কোনো উল্লেখ নেই, যা পরবর্তীকালের গ্রন্থসমূহে দেখতে পাওয়া যায়। বেদে ব্যবহৃত জ্ঞাতিবাচক কয়েকটি শব্দ থেকেও আমরা বুঝতে পারি যে স্ত্রীলোকের একাধিক স্বামী থাকত।
তবে নিয়োগ-প্রথায় অ-সীমিত রমণ থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে নারীর যে একটা অধিকার ছিল, তা পাণ্ডুর নিকট কুন্তীর নিবেদন থেকে আমরা বুঝতে পারি। বহুবার এরূপ রমণে প্রবৃত্ত হতে কুন্তী অস্বীকৃত হয়েছিল।
***
বর্তমানে উত্তর-ভারতের হিন্দুসমাজে বিবাহ কখনও নিকট-আত্মীয়ের মধ্যে হয় না। সেখানে বিবাহ গোত্র-প্রবর বিধির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাছাড়। উত্তর-ভারতে সপিণ্ডদের মধ্যেও কখনও বিবাহ হয় না। দক্ষিণভারতের হিন্দুসমাজে কিন্তু তা নয়। সেখানে মামা-ভাগনী ও মামাতোপিসতুতে ভাইবোনের মধ্যে বিবাহ হচ্ছে বাঞ্ছনীয় বিবাহ। আবার ওড়িশার হিন্দুসমাজে কোনো কোনো জাতির মধ্যে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার বিধবাকে দেবর কর্তৃক স্ত্রীরূপে গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক।
হিন্দুসমাজের মতে আদিবাসী সমাজেও নিজ টোটেম-গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ। কিন্তু উত্তর-পূর্ব সীমান্তের আদিবাসী সমাজভুক্ত লাখের, বাগনী ও ডাফল জাতির লোকের বিধবা বিমাতাকে বিবাহ করে। আবার গারে জাতির লোকেরা বিধবা শাশুড়ীকে বিবাহ করে। ওড়িশার আদিবাসী সমাজে শবর জাতির লোকেরা বিধবা খুড়ীকে বিবাহ করে।
সুতরাং মেয়ের যে কাকে ভজবে—দেবরকে, না জামাতাকে, না সপত্নী-পুত্রকে, না দেবর-পুত্রকে, না পিসতুতো ভাইকে, না মামাকে— সে-সম্বন্ধে সমাজ যা বিধান দেয়, তাদের তাই মানতে হয়। তবে বৌদ্ধসাহিত্য থেকে প্রকাশ পায় যে উত্তর-ভারতে একসময় তারা নিজ সহোদর ভাইকেই ভজনা করত। বৌদ্ধসাহিত্যের (স্বত্তনিপাত) একজায়গায় আমরা পাই, রাজা ওক্ককের (ইক্ষাকুর) প্রধান মহিষীর পাঁচ ছেলে ও চার মেয়ে জন্মগ্রহণ করে। ওই প্রধান মহিষীর মৃত্যুর পর রাজা এক যুবতীকে বিবাহ করেন। এই রানীর যখন এক পুত্র হয় তখন সে বলে যে, তার ছেলেকেই রাজা করতে হবে। রাজ তার প্রথম মহিষীর পাঁচ পুত্র ও চার মেয়েকে হিমালয়ের পাদদেশে নির্বাসিত করেন। সেখানে কপিলমুনির সঙ্গে তাদের দেখা হয়। কপিলমুনি তাদের সেখানে একটি নগর স্থাপন করে বসবাস করতে বলেন। এই নগরের নামই কপিলাবস্তু। ভ্রাতাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ অকৃতদার থাকে। আর অপর চার ভাই চার বোনকে বিবাহ করে। এ কাহিনীটি ‘মহাবস্তু’তেও আছে।
বৌদ্ধসাহিত্যের অপর এক কাইনী অনুযায়ী (অত থসূত্ত ও কুণালজাতক) অনুযায়ী শাক্যর ছিল পাঁচ বোন ও চার ভাই। এই কাহিনী অনুযায়ী জ্যেষ্ঠ ভগিনীকে তার মাতৃরূপে বরণ করে, আর চার ভাই চার বোনকে বিবাহ করে।
বৌদ্ধসাহিত্যের (বুদ্ধঘোষের ‘পরমজোতিকা’, ‘ক্ষুদ্দকপথ’) আরএক কাহিনী অনুযায়ী বারাণসীর রাজার প্রধান মহিষী একখণ্ড মাংসপিণ্ড প্রসব করেন। তিনি ওই মাংসপিণ্ডটিকে একটি পেটিকায় করে নদীতে ভাসিয়ে দেন। ওটা যখন ভেসে যাচ্ছিল তখন একজন মুনি ওটাকে তুলে সংরক্ষণ করেন। পরে ওই মাংসপিণ্ড থেকে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে উৎপন্ন হয়। তাদের নাম লিচ্ছরী দেওয়া হয়। এদের ফুজনের মধ্যে বিবাহ হয় এবং ওরা বৈশালী রাজ্য স্থাপন করে।