***
স্মৃতির যুগে মেয়েদের পুরুষ-ভজা কী ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল, সেসম্বন্ধে বলতে গিয়ে আমরা অন্য প্রসঙ্গে চলে গিয়েছিলাম। স্মৃতির যুগে মেয়েদের পুরুষ-ভজনা স্মৃতিকারদের অমুশাসন দ্বারা নিয়ন্ত্রণমূলক গণ্ডির মধ্যে অবরুদ্ধ করা হয়েছিল। বৈদিক যুগে যে-কোনো মেয়ে যে-কোনো পুরুষকে ভজনা করতে পারত। এ-বিষয়ে কোনোরূপ সামাজিক বিধিনিষেধ ছিল না। কিন্তু চাতুৰ্বণ্য সমাজের অভু্যত্থানের সঙ্গে সঙ্গে এবিষয়ে বিধিনিষেধ এসে যায়। পুরুষ-নির্বাচন সম্বন্ধে নারী তার স্বাধীনতা হারায়। নিজ বর্ণের মধ্যে ভজনা করাই ‘বিধিসম্মত যৌনাচার’ বলে পরিগণিত হয়। তবে নিজ বর্ণের বাইরে যে বিবাহ করতে পারত না, তা নয়। নিজ বর্ণের বাইবেও বিবাহ করতে পারত। সেরকম বিবাহকে ‘অমুলোম’ ও ‘প্রতিলোম’ বিবাহ বলা হ’ত। যখন কন্যা নিজ বর্ণ অপেক্ষা উচ্চবর্ণের পুরুষকে বিবাহ করত, তাকে অমুলোম বিবাহ বলা হত। আর উচ্চবর্ণের কন্স যখন নীচবর্ণের পুরুষকে বিবাহ করত, তখন তাকে প্রতিলোম বিবাহ বলা হ’ত। কিন্তু প্রতিলোম বিবাহে উৎপন্ন সন্তানের ললাটে পড়ত কালিমা। কেননা, এরূপ অসবর্ণ বিবাহের ফলে বহু সঙ্কর জাতির উদ্ভব ঘটেছিল ও সমাজ এক সম্প্রসারিত রূপ ধারণ করেছিল। নতুন সামাজিক সংগঠনের মধ্যে এরূপ অসবর্ণ মিলনের ফসল হিসাবে যে-সকল নতুন জাতির উদ্ভব ঘটেছিল, তাদের স্থান ও মর্যাদা নির্দেশের পিছনে ব্রাহ্মণদের বেশ কিছু উষ্মা ছিল। কেননা, ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় যদি পিত হতেন, তাহলে তাকে অম্বষ্ঠ বা উগ্র নামে অভিহিত করে সমাজে উচ্চ স্থান দেওয়া হ’ত। আর ব্রাহ্মণকন্যা যদি মাতা হতেন এবং পিতা শূদ্র হতেন, তাহলে তাদের সন্তানদের চণ্ডাল নাম দিয়ে সমাজেব একেবারে নীচে তার স্থান নির্দিষ্ট হ’ত। এককথায়, চণ্ডালের মা হ’ত ব্রাহ্মণকস্তা, আর অম্বষ্ঠের পিত হ’ত ব্রাহ্মণ। যেহেতু পিতৃকেন্দ্রিক সমাজে নারীর কোনো স্বাতন্ত্র্য ছিল না, সেজন্য ব্রাহ্মণকহাকে সমাজের এই বিধান মাথা পেতে নিতে হ’ত (লেখকের ‘হিন্দু সভ্যতার মৃতাত্ত্বিক ভাষ্য’ দ্রষ্টব্য)।
স্মৃতিকারদের দৃষ্টিভঙ্গিতে বিবাহ ছিল ধর্মবিহিত কর্তব্যকর্ম বা ‘সংস্কার’। সকল ব্যক্তির পক্ষেই এই কর্তব্যপালন বাধ্যতামূলক ছিল, বিশেষ করে পুত্র উৎপাদন করে নরক থেকে পিতৃপুরুষদের উদ্ধার করার জন্য। কেননা, সে-যুগের বুলিই ছিল ‘পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভাৰ্যা’। যদিও মনুর মানবধর্মশাস্ত্রে আটরকম বিবাহের কথা বলা হয়েছে, এবং আপস্তম্ব ও বশিষ্ঠ ছয়রকম বিবাহের অনুমোদন করেছেন, তথাপি নীতির কারণে মাত্র সেই বিবাহকেই শাস্ত্রসম্মত বিবাহ বলে গণ্য করা হ’ত, যে-বিবাহে মন্ত্র উচ্চারিত হ’ত, হোম ও যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হ’ত ও সপ্তপদীগমন অবলম্বিত হ’ত। ব্রাহ্মণের পক্ষে এই বিবাহই ছিল প্রশস্ত বিবাহ। তবে ব্রাহ্মণেতর জাতির মধ্যে আমুর-বিবাহের প্রচলন ছিল। আস্থর-বিবাহে মূল্যদান করে কন্যার পাণিগ্রহণ করা হত। সেজন্যই ‘মানবগৃহ্যসূত্রে বলা হয়েছে যে, বিবাহ মাত্র দুইপ্রকার—ত্ৰাহ্ম ও আমুর। যদিও মহাভারতীয় যুগে গান্ধৰ্ব ও রাক্ষস বিবাহ আদর্শবিবাহ বলে গণ্য হ’ত, স্মৃতির যুগে এই উভয়প্রকার বিবাহ অপ্রচলিত হয়ে গিয়েছিল। ধর্মশাস্ত্রসমূহে বলা হয়েছে যে, এরূপ বিবাহ করলে মানুষকে মহাপাপে লিপ্ত হতে হয়।
স্মৃতির যুগে মেয়েদের বিবাহ যে কেবল সর্বজনীন ছিল, তা নয়— বিবাহ বাধ্যতামূলকও ছিল। অর্থাৎ স্মৃতির যুগে মেয়েদের পুরুষ-ভজন করতেই হ’ত। যথাসময়ে মেয়েদের বিবাহ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে সমস্ত স্মৃতিগ্রন্থেই বিশেষভাবে জোর দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে যে, মেয়েদের পক্ষে বিবাহের উপযুক্ত বয়স হচ্ছে দশ, যখন মেয়ে ‘কথা’ আখ্যালাভ করে। পরাশর বিধান দিয়ে বলেছেন— ‘যথাসময়ে যদি মেয়ের বিবাহ দেওয়া না হয়, তাহলে সেই কন্যার মাসিক রজঃ অপর জগতে তার পিতৃপুরুষদের পান করতে হয়, এবং যে তাকে বিবাহ করে তাকে হতভাগা হতে হয়। বশিষ্ঠ, বৌধায়ন, নারদ ও যাজ্ঞবল্ক্য এ সম্পর্কে বেশ রুষ্ট হয়েই বলেছেন, ‘কুমারী অবস্থায় কষ্ঠা যতবার রজঃস্বলা হবে, ততবার তার পিতামাতা ও অভিভাবকদের ভ্রূনহত্যার পাপে লিপ্ত হতে হবে। গৌতম এ-সম্বন্ধে অন্ত স্মৃতিকারদের সঙ্গে মতৈক্য প্রকাশ করে বলেছেন, রজঃস্বলা হবার আগেই কন্যার বিবাহ হওয়া চাই।’
এখানে স্মৃতিযুগের প্রধান বুলি পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভাৰ্যা’র সঙ্গে স্মৃতিকারদের বিধানের একটা বিরোধ দেখা যায়। কেননা, পুত্রউৎপাদনের জন্যই যদি ভাৰ্যারূপে নারীর প্রয়োজন হয়, তবে বিবাহের জন্য সে-নারীকে কেন প্রয়োজন হয় রজঃস্বলা হবার পূর্বে? এটা তো বায়োলজিক্যাল-বিরোধী বিধান। কেননা, নারী রজঃস্বলা না হওয় পর্যন্ত কখনও পুত্র-প্রজননে সমর্থ হয় না। সেদিক থেকে বৈদিক যুগের নারীর বিবাহ অনেক পরিমাণে যুক্তিসম্মত ছিল, কেননা বৈদিক যুগে সমর্থ যুবতী মেয়েরই বিবাহ হ’ত।
আজকের দিনে নারী অবশু স্মৃতিযুগের বায়োলজি-বিরোধী বিধানের শিকার নয়। ফুলমণির সেই শোকাবহ দুর্ঘটনার পর ১৮৯২ খ্রীস্টাব্দে বিবাহে সঙ্গমের বয়স বেঁধে দেওয়া হয়। তারপর ১৯২৮ খ্রীস্টাব্দের পর থেকে বিবাহের নূ্যনতম বয়সও বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিবাহের এই নূ্যনতম বয়স বৃদ্ধির ফলে আজকের দিনে মেয়ে-পুরুষের বিবাহের বয়স ক্রমশই উধ্বগতি লাভ করছে। এ-বিষয়ে মেয়ে-পুরুষ আজ সমান। পিতৃশাসিত সমাজের মধ্যে বাস করলেও বিবাহের বয়স সম্বন্ধে মেয়েপুরুষ আজ সমান রীতির অধিকারী হয়েছে।