তবে মেয়েরা যে একজন পুরুষকেই ভজন করত, তা নয়। কোনে। কোনো সময়ে একসঙ্গে অনেক পুরুষকেও ভজনা করত। এটা আমরা পূর্বে উল্লিখিত নায়ার রমণীদের ক্ষেত্রে দেখেছি। বৈদিক যুগে আমরা জটিলাকে এরূপ করতে দেখি। জটিলার ছয় স্বামী ছিল। আবার মহাভারতীয় যুগে দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামী ছিল। পরবর্তীকালের সমাজে একাধিক পুরুষকে ভজনা করবার ঘটনা হামেশাই ঘটেছে, তবে স্বামীঅন্তর পুরুষকে উপপতি বলা হত। এরূপ সম্পর্কের কথা আমরা পরে আলোচনা করব। উপস্থিত আমরা স্মৃতির যুগে যেতে চাই।
***
স্মৃতির যুগে মেয়েদের পুরুষ-ভজনা নানারকম বিধিনিষেধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে দেখি। বিবাহ-ই পুরুষ-ভজনার একমাত্র মাধ্যম হয়ে দাড়ায়! সুতরাং বিবাহপ্রথার উস্তবের আলোচনা এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। স্ত্র ও পুরুষের মধ্যে সমাজ-স্বীকৃত যৌনসম্পর্ককেই বিবাহ বলা হয়। মানুষের ইতিহাসের প্রথম অধ্যায়ে স্ত্রী ও পুরুষ পরিবার গঠন করে বাস করত বটে, কিন্তু ‘বিবাহ’ নামে এর কোনো সামাজিক স্বীকৃতি ছিল না। মনে হয় এটা এসেছিল একই নারীকে নিয়ে দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ ও রক্তপাতের পদক্ষেপে। এরূপ দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ ও রক্তপাত এড়াবার জন্যই “বিবাহপ্রথার উদ্ভব হয়েছিল। এরূপ দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ ও রক্তপাত প্রত্নোপলীয় যুগে একটা স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। পশুশিকারের জন্ম পুরুষকে তখন দূর-দূরাস্তরে যেতে হ’ত। নারীকে তখন অসহায় অবস্থায় থাকতে হত। নারীর সেই অসহায় অবস্থার সুয়োগ নিয়ে অন্ত পুরুষের পক্ষে তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া একটা সম্ভবপর স্বাভাবিক ঘটনা ছিল। এটা এড়াবার জন্যই মনে হয় মনুষ্যসমাজে পরিবারকে স্বীকৃতি দেবার একটা প্রয়োজন হয়েছিল। নৃতত্ত্ববিদগণ বিবাহপ্রথা’র উদ্ভবের এই কারণই দেন।
মহাভারতে এ-সম্বন্ধে যে কাহিনী অাছে সেটা উল্লেখ করা এখানে প্রাসঙ্গিক হবে। সে কাহিনী উল্লেখ করে, পরে আমি এ-সম্বন্ধে . আলোচনা করতে চাই ৷ মহাভারতের আদিপর্বে উল্লেখিত এই কাহিনীটিকে শ্বেতকেতু-কাহিনী বলা হয়। কাহিনীটি হচ্ছে এই : একদিন শ্বেতকেতু যখন পিতামাতার কাছে বসে ছিল তখন এক ব্রাহ্মণ এসে তার মায়ের সঙ্গে যৌনমিলন কামনা করে তাকে কক্ষান্তরে নিয়ে যায়। শ্বেতকেতু এতে ক্রুদ্ধ হয়। কিন্তু পিতা উদালক বলেন, স্ত্রীলোক গাভীর মত স্বাধীন। সহস্র পুরুষে আসক্ত হলেও তাদের অধৰ্ম হয় না। এটাই সনাতন ধর্ম। এই অবাধ যৌনমিলন নিবৃত্ত করবার জন্যই শ্বেতকেতু ভারতবর্ষে প্রথম বিবাহপ্রথার প্রবর্তন করেন।
উনবিংশ শতাব্দীর নৃতত্ত্ববিদগণ, যথা—-বাখোফেন (Bachofen) মরগান (Morgan) প্রমুখ বলতেন যে, আদিম অবস্থায় মনুষ্যসমাজে অবাধ-যৌনমিলন (promiscuity) প্রচলিত ছিল। তাদের মত অনুযায়ী বিবাহপ্রথা উদ্ভব হবার পূর্বে স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে কোনোরূপ স্থায়ী যৌনসম্পর্ক ছিল না। তারা বলতেন যে অন্যান্য পশুর মত মানুষও অবাধ-যৌনমিলনে প্রবৃত্ত হ’ত। তাদের মতে আদিম অবস্থায় মামুষের মধ্যে যৌনাচার নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো অমুশাসন ছিল না। র্তারা বলতেন যে অনুশাসনের উদ্ভব হয়েছিল অতি মন্থরগতিতে, ধীরে ধীরে ও ক্রমান্বয়ে। তাদের সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যে নানারকম বিবাহপ্রথা প্রচলিত ছিল, সেগুলিকে তারা এক বিবর্তনের ঠাটে সাজিয়ে প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছিলেন, মানুষের বর্তমান একপত্নীক বিবাহপ্রথা এইসকল ক্রমিক স্তরের ভেতর দিয়ে বিকাশলাভ করেছে। কিন্তু সন্তানকে লালন-পালন ও স্বাবলম্বী করে তোলবার জন্য মানুষের যে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়, একমাত্র এই জীবজনিত কারণই এ-কথা প্রমাণ করবার পক্ষে যথেষ্ট সহায়ক যে, মনুষ্যসমাজে গোড়া থেকেই স্ত্রী-পুরুষ পরস্পরের সংলগ্ন হয়ে থাকত। বস্তুত আদিম অবস্থায় স্ত্রীপুরুষ যে অবাধ যৌনাচারে রত ছিল, এই মতবাদ পূর্বোক্ত নৃতত্ত্ববিদগণের এক নিছক কল্পনামূলক অনুমান ছাড়া আর কিছুই নয়। এরূপ অবাধ যৌনমিলন মনুষ্যসমাজে কোনোদিনই প্রচলিত ছিল না। এমনকি বর্তমান সময়েও অত্যন্ত আদিম অবস্থায় অবস্থিত অরণ্যবাসী জাতিসমূহের মধ্যেও অবাধ যৌনমিলনের রীতি নেই। বস্তুত এইসকল অরণ্যবাসী জাতিসমূহের মধ্যে যে-সকল বিবাহপ্রথা প্রচলিত অাছে, তা অতি কঠোর অনুশাসন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। প্রকৃতির মধ্যে পর্যবেক্ষণ করলেও আমরা এর সমর্থন পাই। বনমানুষ, গরিলা প্রভৃতি যে-সকল নরাকার জীব আছে, তারাও দাম্পত্য-বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বাস করে। কখনও অবাধ 1মলনে রত হয় না। এইসকল কারণ থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, “বিবাহ’ আখ্যা দিয়ে তাকে সামাজিক স্বীকৃত দেওয়া হয়ে থাকুক আর নাই থাকুক, স্ত্রী-পুরুষ একত্রে মিলিত হয়ে ‘পরিবার’ গঠন করে সহবাস করবার রীতি মনুষ্যসমাজে গোড়া থেকেই প্রচলিত ছিল (লেখকের ‘ভারতে বিবাহের ইতিহাস’, তৃতীয় সংস্করণ দ্রষ্টব্য)। প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ ওয়েস্টারমার্ক (Westermarck) বলেন, পরিবার গঠন করে স্ত্রী-পুরুষের একত্র বাস করা থেকেই বিবাহপ্রথার উদ্ভব হয়েছে; বিবাহপ্রথা থেকে পরিবারের সূচনা হয়নি।’ মহাভারতে বিবৃত শ্বেতকেতু-উপাখ্যান থেকেও আমরা এর সমর্থন পাই। কেননা, বিবৃত কাহিনী থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, বিবৃত কাহিনীর আগেই শ্বেতকেতু তার পিতামাতার সঙ্গে পরিবার-মধ্যেই বাস করত।