মাতৃকেন্দ্রিক নায়ার পরিবারের মেয়েদের সস্তানের অভিভাবক হচ্ছে মাতুল। সুতরাং পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে মাতৃকেন্দ্রিক (matrilineal) সমাজ মাতৃশাসিত (matriarchal) নয়। পুরুষরাই সেই সমাজের অধিপতি। তবে স্ত্রীলোক সমাজ বা রাষ্ট্রের অধিপতি হলেই যে সে-সমাজ মাতৃশাসিত (matriarchal) হবে, তা নয়। তা যদি হবে, তাহলে রানী এলিজাবেথের আমলে ইংরেজ সমাজ বা ইন্দিরা গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে ভারতীয় সমাজকে মাতৃশাসিত (matriarchal) সমাজ বলতে হয়! বস্তুত নৃতত্ত্ববিদগণ পুখামুপুঙ্খরুপ পর্যালোচনার পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, যদিও মাতৃকেন্দ্রিক (matrilineal) সমাজ জগতের স্থানে স্থানে পরিলক্ষিত হয়েছে, বাখোফেনের কল্পিত মাতৃশাসিত (matriarchal) সমাজের সন্ধান আজ পর্যন্ত কোথাও পাওয়া যায়নি। সুতরাং কৃষির উদ্ভবের পর মেয়েরা কোনো কোনো জায়গায় ভূমির স্বত্বাধিকার সম্বন্ধে যে দাবি তুলেছিল এবং ক্ষেত্রবিশেষে তাদের সে দাবি মেনে নেওয়া হয়েছিল, ত৷ সত্ত্বেও তারা পুরুষশাসিত সমাজেই বাস করত।
***
দেবতামণ্ডলীতে মাতৃদেবীর প্রাধান্ত মাতৃশাসিত (matriarchal) সমাজের ইঙ্গিত করে না। আমরা দেখি যে, কৃষির উদ্ভাবনের পর যখন মহাদেবীর (the Great Mother) পূজার সূচনা হয়েছিল, তখন মাতৃদেবীকে ‘কুমারী’ (virgin goddess) দেবতারূপে কল্পনা করা সত্ত্বেও ওই কুমারী-মাতৃদেবীকে একজন ভর্তা দেওয়া হয়েছিল। এটা আমরা প্রাচীন সুমের ও ভারত—এই উভয় দেশেই লক্ষ্য করি। ভারতে মাতৃদেবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ পূজা হচ্ছে দুর্গাপূজা। দুর্গ শিবজায় হিসাবে কল্পিত হলেও আদিতে তিনি যে কুমারী—তা মহাষ্টমীর দিন ‘কুমারীপূজা’ থেকেই বুঝতে পারা যায়।
আমাদের মূল প্রশ্ন–“মেয়েরা কেন পুরুষ ভজে?—সেই প্রশ্ন সম্বন্ধে পৌরাণিক কাহিনীসমূহ বিশেষ আলোকপাত করে। দেবীর উদ্ভবের কাহিনীটিই এখানে বিবৃত করা যাক। দেবতা ও অসুরদের মধ্যে প্রচণ্ড লড়াই চলছিল। প্রতিবারেই দেবতারা পরাহত হচ্ছিল। এমন হল যে অমুরাধিপতি মহিষাসুর দেবতাদের স্বর্গ থেকে তাড়িয়ে দিয়ে স্বৰ্গরাজ্য অধিকার করে নিল। তখন দেবতারা বিষ্ণুর কাছে গিয়ে তাদের দুর্গতির কথা জানাল, এবং এই বিপর্যয় থেকে তাদের রক্ষা করবার অনুরোধ করল। তখন বিষ্ণু দেবতাদের উপদেশ দিলেন— তোমরা সকলে নিজ নিজ স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয়ে নিজ নিজ তেজের কাছে প্রার্থনা কর যে তোমাদের সমবেতভাবে উৎপন্ন তেজ থেকে যেন এক নারীমূতি আবির্ভূত হন। সেই নারীই এই অস্থরকে বধ করবেন। সমবেত তেজ থেকে যে নারীমূর্তি আবির্ভূত হলেন, তিনিই ছৰ্গা। দেবী মহিষাসুরের কাছে এলে, মহিষাসুর দেবীকে বলল–আপনার হাতে মরতে আমার কোনো দুঃখ নেই, কিন্তু আমি যেন আপনার সঙ্গে পূজিত হই। এই কাহিনী থেকে ছুটি জিনিস পরিষ্কার পরিস্ফুট হচ্ছে। প্রথম, জগৎ রক্ষার জন্য স্ত্রী-পুরুষের পরস্পর মিলিত হওয়া একান্ত প্রয়োজন। আর দ্বিতীয়, পুরুষ যেন নারীর সঙ্গে সমান পূজা পায়। এখানে নারীর কামিনী ও জননী-—এই দুই ভাবেরই সমন্বয় দেখি।
শিবজায়া সম্বন্ধে আর-এক পৌরাণিক কাহিনী শুমুন। শিব প্রথমে দক্ষরাজ-কন্ত সতীকে বিবাহ করেছিল। কিন্তু পিতার যজ্ঞস্থলে পতিনিন্দ শুনে সতী দেহত্যাগ করে। পরে সতী হিমালয়-পত্নী মেনকার গর্ভে জন্মগ্রহণ করে এবং মহাদেবকে পাবার জন্য কঠোর তপস্যায় রত হয়। এদিকে দেবতারা তারকাসুরের অত্যাচারে উৎপীড়িত হয়ে জানতে পারে যে মহাদেবের ঔরসে যে পুত্র জন্মাবে, সেই-ই তারকাসুরকে বধ করবে। সেজন্য পার্বতী ও মহাদেবের মিলন ঘটাতে মদন আসে, কিন্তু সে মহাদেবের কোপে ভস্মীভূত হয়। তারপর পার্বতী ও মহাদেবের মিলন হলে মদন পুনর্জীবন লাভ করে। এই মিলনের ফলেই কাতিকেয়র জন্ম হয় এবং কার্তিকেয় তারকাসুরকে বধ করে। এসব পৌরাণিক কাহিনীতে স্ত্রী-পুরুষের মিলনের ওপরই জোর দেওয়া হয়েছে এবং তার মধ্যেই নিহিত আছে ‘প্রমীলা কেন পুরুষ ভজে?’— এই প্রশ্নের উত্তর।
***
পৌরাণিক যুগের পূর্বে বৈদিক যুগ। বৈদিক যুগের মেয়েরা কি করত, সে সম্বন্ধে এখন কিছু বলি। সাধারণ বিবাহ তো বৈদিক যুগে প্রচলিত ছিলই, কিন্তু অনেকসময় মেয়েরা নিজেরাই স্বামী নির্বাচন করে নিত। এটা ঘটত সমন’ উৎসবে। ঋক্ ও অথর্ব বেদে এবং যজুর্বেদের বাজসনেয়ী সংহিতায় এই উৎসবের কথা উল্লিখিত হয়েছে। এ উৎসবটি অনেকটা ‘অলিম্পিক উৎসবের মত ছিল। এই উৎসবে যে যে-বিষয়ে দক্ষ, সে সে-বিষয়ে প্রতিযোগিতায় নিজ কৌশল দেখিয়ে পুরস্কার লাভ করত। ধনুর্বেত্তা, রথী, অশ্বারোহী, কবিগণ, মল্ল ও নটগণ, শস্ত্রজীবী সকলেই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হ’ত। এটা সর্বজনীন উৎসব ছিল এবং সেই কারণে নানারকম আমোদ-প্রমোদের আয়োজন হ’ত। বারাঙ্গনারাও এই উৎসবে ধনলাভের আশায় উপস্থিত থাকত। কিন্তু যেটা আমাদের প্রাসঙ্গিক ব্যাপার, সেটা হচ্ছে কুমারী মেয়েরা মনোমত পাতলাভের আশায় স্থসজ্জিত হয়ে তথায় উপস্থিত থাকত ও পতি-নির্বাচন করত। ঋগ্বেদের সপ্তম মণ্ডলের জুয়ের সূক্তের পঞ্চম মন্ত্রে বলা হয়েছে, এরূপ কুমারীর যুবত। মেয়ে হ’ত। সুতরাং এ-থেকে পরিষ্কার বুঝতে পার। যাচ্ছে যে, বৈদিক যুগে যুবতী কুমারী মেয়ের কোন পুরুষকে ভজবে তা নিজেরাই নির্বাচন করত। সে অধিকার তাদের ছিল। মনে হয়, পরবর্তীকালে এটাই স্বয়ংবরপ্রথার রূপ নিয়েছিল। স্বয়ংবরপ্রথাতেও পুরুষকে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়ে। নিজ কৌশল প্রদর্শন করতে হত। তবেই অনুঢ়া কন্যা কোন পুরুষকে ভজনা করবার জন্ম গ্রহণ করবে, তা স্থরীকৃত হ’ত। ‘সমন’ উৎসবে যেমন স্ব-ইচ্ছা ও স্ব-মনোনয়নের একটা মূল্য ছিল, স্বয়ংবরপ্রথায় তা ছিল না। তবে পরবর্তীকালে স্বেচ্ছায় কোনো পুরুষকে ভজনা করার রীতি যে একেবারে ছিল না, তা নয়। তখন মেয়েরা যে পুরুষকে ভজনা করত, তাকে দিয়ে একটা শর্তপালন স্বীকার করিয়ে নিত। এটা আমরা গঙ্গা-শান্তনু ও শকুন্তলা-দুষ্মন্তের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করি। প্রেমে পড়ে পুরুষরা সে-সব শর্ত মেনে নিত।