(কী ভাবে লিঙ্গ ও শক্তিপূজার উদ্ভব হল, সে সম্বন্ধে বিশদ বিবরণ ও ব্যাখ্যা অবগত হবার জন্য বর্তমান লেখকের ‘Pre-Aryan Elements in Indian Culture’ দ্রষ্টব্য।)
কৃষির উদ্ভবের পরই মানুষ তার যাযাবর জীবন ছেড়ে দিয়ে স্থায়ী বসবাস শুরু করল। গ্রাম, এবং গ্রামের পর নগরের পত্তন ঘটল। মেয়েরা শুধু কৃষিরই উদ্ভব ঘটালো না, তারা বয়নবিদ্যা দ্বারা ঝুড়িচুপড়ি থেকে আরম্ভ করে বস্ত্রবয়ন পর্যন্ত আরম্ভ করল। ঋগ্বেদের ষষ্ঠ মণ্ডলের প্রথম সূক্তে বলা হয়েছে : ‘মেয়েরাই বস্ত্রবয়ন করতে জানে, আমরা জানি না।’ অনেক নৃতত্ত্ববিদ বলেন যে, কুলালের কাজও মেয়েরাই প্রথম শুরু করেছিল। এক কথায়, সভ্যতার সূচনা মেয়েদের দ্বারাই সম্পাদিত হয়েছিল। এসবই ঘটেছিল নবপলীয় যুগে।
***
মেয়েরা এখন আর মাত্র বায়োলজিক্যাল জীব নয়। তারা কৃষ্টির জগতে ঘটাল এক বিস্ফোরণ। মানুষের জীবনের জয়যাত্রার পথে তারা হয়ে দাড়াল পুরুষের সক্রিয় সহযাত্রী। তারা এখন শক্তিরূপেণ সংস্থিতা। সে সম্বন্ধে তাদের মধ্যে অনেকে সচেতন হয়ে উঠল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ রব তুললো—“আমাদের দাবি মানতে হবে। কিসের দাবি? কর্ষিত ভূমির দাবি। তারা বললো, যেহেতু তারাই ভূমি কর্ষণ করে ফসল উৎপাদন করেছে, ভূমির মালিকান-স্বত্ব তাদের। তারা আরও বললো, যেহেতু ইহজগতে মাতাই সন্তানকে প্রসব করে এবং মাতাই সন্তানকে লালন-পালন করে, সেইহেতু সন্তানও মায়ের। প্রথম প্রথম পুরুষদের সে দাবি মেনে নিতে হল। এইভাবে উদ্ভূত হল মাতৃকেন্দ্রিক (matrilineal) সমাজ, অর্থাৎ যে সমাজে উত্তরাধিকার ও বংশপরিচয় মাতার দিক দিয়েই নিণীত হয়। এরূপ সমাজ বিক্ষিপ্তভাবে জগতের নানা জায়গায় ছড়িয়ে আছে। এসব সমাজে পারিবারিক সম্পত্তির উত্তরাধিকার মাতাকে ধরেই নেমে আসে। অর্থাৎ পারিবারিক সম্পত্তির মালিকানাস্বত্ব হয় মায়ের। মায়ের মৃত্যুর পর সে সম্পত্তি পায় মেয়ে, ও তারপরে মেয়ের মেয়ে। জগতের দু-চার জায়গায় এরূপ সমাজের অস্তিত্ব লক্ষ্য করে উনবিংশ শতাব্দীতে সুইটজারল্যাণ্ডের নৃতত্ত্ববিদ বাখোফেন (১৮১৫-৮৭) সিদ্ধান্ত করেছিলেন যে, মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসে একসময় মাতৃশাসিত সমাজ (matriarchal society) ছিল। অর্থাৎ তখন মেয়েরাই পুরুষের ওপর আধিপত্য করত। কিন্তু পরবর্তীকালের নৃতত্ত্ববিদরা এ মতবাদ বাতিল করে দিয়েছেন। তাঁরা বলেন, মানুষের সামাজিক বিবর্তনের ইতিহাসে কোনে সময়েই মাতৃশাসিত বা নারীশাসিত সমাজ ছিল না। যা ছিল এবং এখনও কোথাও কোথাও দেখতে পাওয়া যায়, তা হচ্ছে মাতৃকেন্দ্রিক (matrilineal) সমাজ। এসব সমাজে উত্তরাধিকার বংশপরম্পরায় মাতাকে ধরেই নেমে আসে। এরকম সমাজ আমাদের দেশে কেরল-এ নায়ারদের মধ্যে প্রচলিত আছে। কিন্তু এসব সমাজে পরিবার বা গোষ্ঠীর ওপর আধিপত্য থাকে পুরুষের (মাতার ভ্রাতার), মেয়েদের নয়। বলা যায়, পরিবার বা গোষ্ঠী মাতৃশাসিত হয় না, কেবল পারিবারিক বা গোষ্ঠীগত সম্পত্তির মালিকানা মাতৃগত হয়। এসব সমাজের বিবাহপদ্ধতি লক্ষ্য করলেই এটা বুঝতে পারা যায়; আমি এখানে কেরল-এর মাতৃকেন্দ্রিক নায়ার সমাজের বিবাহপদ্ধতির বর্ণনা দিচ্ছি। নায়াররা ক্ষত্ৰিয়। নায়ার কুমারীদের যৌবনারস্তের সঙ্গে সঙ্গে নিজ জাতির কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীভুক্ত পুরুষের সঙ্গে বিবাহ হয়। পরে এই বিবাহের বিচ্ছেদ ঘটিয়ে নায়ার মেয়েরা পিতৃকেন্দ্রিক নাম্বুদ্রি ব্রাহ্মণদের সঙ্গে এক বিচিত্র যৌনসম্পর্কে আবদ্ধ হয়। এরূপ সম্পর্ককে ‘সম্বন্ধম” বলা হয়। ‘সম্বন্ধম’-সম্পর্ক অবিনশ্বর নয়। অনেকসময় কোনো কোনো নায়ার রমণীকে পর পর দশ-বারো জন নাম্বুদ্রি ব্রাহ্মণের সঙ্গে ‘সম্বন্ধম’-সম্পর্ক স্থাপন করতে দেখা যায়। এখানে বলা দরকার, প্রথম বিবাহের পর নায়ার রমণী কখনও তার স্বামীর পরিবারে বাস করতে যায় না। স্বামীই স্ত্রর পরিবারে কখনও কখনও রাত্রিবাস করতে আসে। আবার যখন সম্বন্ধম’-সম্পর্ক স্থাপিত হয়, তখনও নায়ার রমণী কখনও তার নাম্বুদ্রি প্রণয়ীর গৃহে বাস করতে যায় না। নাম্বুদ্রি ব্রাহ্মণও কখনও তার নায়ার প্রণয়িনীর গৃহে বাস করতে আসে না। সাধারণত নাম্বুদ্রি প্রণয়ী সন্ধ্যার পর যৌনমিলনের জন্য নায়ার রমণীর গৃহে আসে এবং মিলনাস্তে পুনরায় নিজ পিতৃকেন্দ্রিক পরিবারে ফিরে যায়। অনেকসময় নায়ার রমণী একই কালে একাধিক নাম্বুদ্রি ব্রাহ্মণের সঙ্গে ‘সম্বন্ধম’-সম্পর্ক স্থাপন করে। এরূপ ক্ষেত্রে এমন আচরণ বহুপতিক (polyandrous) রূপ ধারণ করে। যেক্ষেত্রে ‘সম্বন্ধম’সম্পর্ক এভাবে বহুপতিক রূপ ধারণ করে, সেক্ষেত্রে সকল পুরুষেরই ওই নায়ার রমণীর ওপর সমান যৌনাধিকার থাকে। একজন প্রণয়ী এসে দ্বারদেশে যদি অপর প্রণয়ীর ঢাল বা বশ দেখতে পায় তাহলে সে প্রত্যাগমন করে এবং পরবর্তী সন্ধ্যায় পুনরায় নিজের ভাগ্যপরীক্ষা করতে আসে।
মাতৃকেন্দ্রিক নায়ার পরিবারের মধ্যে বিবাহিত মেয়ের স্বামী, যেমন সেই পরিবারের মধ্যে বাস করে না, সেরূপ বিবাহিত পুরুষের স্ত্রীও সেই পরিবারের মধ্যে বাস করতে আসে না। ‘সম্বন্ধম’ ছাড়াও নায়ারদের মধ্যে নিয়মানুগ সাধারণ বিবাহপ্রথা প্রচলিত আছে। তবে নায়ার স্ত্রীরা স্বামিগুহে গিয়ে বাস করে না। সেক্ষেত্রে নায়ার স্বামী সন্ধ্যার পর স্ত্রীর সঙ্গে যৌনমিলনের জন্য স্ত্রর গৃহে এসে উপস্থিত হয়।