দুইখাতে প্রবাহিত নয়নতারার জীবনকাহিনী আমাদের বিস্ময় উৎপাদন করে। তার যুগলসত্তাতে আমরা বিস্মিত। সদানন্দই যদি তার অন্তরের দেবতা হয়, সদানন্দকেই যদি সে মনেপ্ৰাণে স্বামী বলে গ্ৰহণ করে থেকে থাকে, তবে কি করে তার পক্ষে সম্ভবপর হয়েছিল দীর্ঘ পনেরো বছর নিখিলেশের সঙ্গে দাম্পত্যজীবন যাপন করা? বিশেষ করে যখন সে জানত যে নিখিলেশ একজন শঠ, প্ৰতারক ও প্ৰবঞ্চক। নবাবগঞ্জে গিয়ে সে নিজের চোখেই দেখে এসেছিল, নিখিলেশ। কত বড় মিথ্যাবাদী, কত বড় প্রবঞ্চক। নিখিলেশের এই প্রবঞ্চকতাই তাকে উত্তেজিত করেছিল, নবাবগঞ্জ থেকে ফিরে আসবার পর পৃথক ঘরে পৃথক শয্যায় রাত কাটাতে। নিখিলেশের ওপর তার এ অভিমান কেন? আবার, আর একদিন যখন সে নিখিলেশকে মদ খেয়ে বাড়ি ফিরতে দেখেছিল, তখন সে রাগে জ্বলে উঠে নিখিলেশকে ভৎসনা করেছিল। যদি নিখিলেশের প্রতি তার বিন্দুমাত্র অনুরাগ না থাকবে, তবে কিজান্য তার এই অভিমান, এই রাগ? নিখিলেশের সঙ্গে তো দাম্পত্যজীবন ব্যর্থও হয়নি। সে তো সন্তানের জননী হয়েছিল। মাতৃত্বের গর্বে গরবিনী হয়ে সে তো সমারোহের সঙ্গে উৎসব করতেও মত্ত হয়েছিল। তবে এসব কি তার অভিনয়? বলব, হ্যা, অভিনয়ই বটে। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, কেন এই অভিনয়? কিসের প্ররোচনায় তার এই অভিনয়? এ অভিনয়ের কারণ, সে তো নিজের মুখেই ব্যক্তি করেছিল। সদানন্দর মহানিস্ক্রমণের রাত্রে নবাবগঞ্জের শয়নকক্ষে। সেদিন সদানন্দকে সে বলেছিল, ‘আমার কি এখন থেকে কোন সাধ-আহ্লাদ থাকবে না? আমি কি তা হলে সারাজীবন এমনি করেই তোমাদের বাড়িতে একা এক রাত কাটাবো? আমার মনের কথা বলবার, তা হলে কোন লোকই থাকবে না? আমি কি নিয়ে থাকবে? আমি কাকে আশ্ৰয় করে বঁাচবো? আমার জীবন কেমন করে। সার্থক হবে? কাকে আশ্ৰয় করে সে বঁাচবে, কে তার জীবন সার্থক করবে, কে তার সাধ-আহলাদ মেটাবে, এসব প্রশ্নই তাকে প্ৰলুব্ধ করেছিল নিখিলেশের হাতছানিতে সাড়া দিয়ে তার কাছে নিজেকে আত্মসমৰ্পণ করতে।
এককথায় নারী চায় আশ্রয়, নারী চায় একজনকে অবলম্বন করে। তার সাধ-আহ্লাদ মেটাতে, তার জীবনকে সাৰ্থক করে তুলতে। সে চায়তার দাম্পত্যজীবনে একজন দীপ্তিমান সহযাত্রী। নয়নতারার কাছে দুই সত্তাই সত্য। কোনটাই মিথ্যা বা nonentity নয়। এই দুই সত্তাকে সার্থক করবার জন্য যদি তাকে অভিনয় করতে হয়, তা হলে অভিনয়ের জন্যও সে প্ৰস্তুত। হয়তে। এই অভিনয়ের জন্য যে চাতুর্যের ও অনুষঙ্গের প্রয়োজন হয়, তাকেই বিমল মিত্র ‘ম্যাকস ফ্যাকটর’ বলেছেন। অভিনয়ের ক্ষেত্রে নারী অসাধারণ পটুতার অধিকারিণী। তার এ অভিনয় চলচ্চিত্রের অভিনয়ের মতো। চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকাদের দাম্পত্যজীবনের অভিনয় করতে দেখে দর্শকের কি একবারও মনে হয় যে বাস্তবজীবনে এদের আর একটা সত্যিকারের দাম্পত্যজীবন আছে? নারীর দুটো সত্তা আছে। একটা আটপৌরে বা বাহ্যিক সত্তা, যেটা সে লোকসমাজে প্ৰকট করে। অপরটা তার অন্তরের সত্তা, যে সত্তা তার অবচেতন মনে সুপ্ত হয়ে থাকে, কচিৎ-কদাচিৎ অনাবৃত করে। এই যুগল। সত্তার বিদ্যমানতাই আমরা নয়নতারার মধ্যে দেখি। নয়নতারার বিসদৃশ আচরণ দেখে ডাক্তাররা হয়তো বলবেন, নয়নতারা ‘সিজেফ্রেনিয়া’ (Schizophrenia) ব্যাধিগ্ৰস্ত। কিন্তু আমি বলব, প্রমীলার ক্ষেত্রে সিজোফ্রেনিয়া মোটেই কোন ব্যাধি নয়। এটা প্ৰমীলার সহজাত বৈশিষ্ট্য। এই বিশিষ্টতার জন্যই বিধাতা প্ৰমীলাকে রহস্যময়ী করে তুলেছেন। মনে হয় এ-সম্বন্ধে সত্যিকথাটা বলেছেন জার্মান দার্শনিক নিটসে। তিনি বলেছেন, ‘নারী-সৃষ্টি বিধাতার দ্বিতীয় ভুল’ (‘Woman was God’s second mistake’)
প্ৰমীলার এই সহজাত বৈশিষ্ট্য, নারীদেহে কোন বিশেষ হরমোন’- এর বিদ্যমানতার জন্য ঘটে না। এটা ঘটে অবস্থাবিপাকে, যে ঘটনা বা মনের বিশেষ অবস্থার (situation) সে সম্মুখীন হয়, তারই ঘাতপ্ৰতিঘাতে। আদিমকাল থেকেই তার পারিপাৰ্থিক অবস্থা বা পরিবেশই তার চরিত্রগঠনে তাকে সহায়তা করেছে। সে যে রহস্যময়ী, এটা তার শাশ্বত ধৰ্ম। সেজন্যই সিমোন দ্য বিভোয়ার বলেছেন-‘She revels in immanence, she is contrary, she is prudent and petty, she has no sense of fact or accuracy, she lacks morality, she is contemptibly utilitarian, she is false, theatrical, self-seeking and so on.’ এটা এমন এক অস্তিবাদী নাবীর উক্তি, যে সারাজীবন অনুশীলন করে গেছে নারী-চরিত্র নিয়ে। এই উক্তির মধ্যেই আমরা নয়নতারার সত্তাকে খুঁজে পাই, তার বিচিত্র আচরণের ব্যাখ্যা পাই। মনে পড়ে কনফুসিয়াস-এর কথা। তিনি বলেছিলেন-চাদের ওপিঠে কি আছে তা পুরুষমানুষের পক্ষে জানা সম্ভবপর; কিন্তু মেয়েদের মাথায় কী ভাবনা চিন্তা বিরাজ করছে, তা জানা সম্ভবপর নয়। সেজন্যই আমাদের দেশের ঋষির বলেছেন – নারীর মনের মধ্যে যে কী আছে তা ‘দেবা; ন জানাচ্ছি। কুতে মনুষ্যাঃ’। তাদের মাথায় কী পোকা কিলবিল করছে, তা যদি আমরা জানতে পারতাম, তা হলে তো নারীকে আমরা রহস্যময়ী বলে মনে করতাম না। তা হলে তো নয়নতারাও আমাদের কাছে রহস্যময়ী হয়ে উঠত না।