স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, তবে নয়নতারা কেন নিখিলেশের সঙ্গে স্বামী-স্ত্রী রূপে ঘর করতে সম্মত হল? নিজ মুখেই সে স্বীকার করেছিল, সেদিন সে সম্মুখীন হয়েছিল আদিম মানবীর সমস্যার। উত্তরাধিকারসূত্রে প্ৰত্নোপলীয় যুগের সেই আদিম মানবীর রক্তকণিকাই সে বহন করছিল, তার শিরা-উপশিরায়। প্ৰত্নোপলীয় যুগে আশ্রয় ও প্রতিরক্ষাই তো আদিম মানবীকে প্ৰবৃত্ত করেছিল পুরুষকে ভজনা করতে। পিতার মৃত্যুর পর সেই সমস্যারই সম্মুখীন হয়েছিল নয়নতারা। একমুহুর্তে নিখিলেশ। তো সেদিন সে সমস্যার সমাধান করে দিতে পারত, বোন হিসাবে নয়নতারাকে তার বাড়ি নিয়ে গিয়ে আশ্রয় দিয়ে বোনের মতো তাকে উচ্চ-মাধ্যমিক পাস করিয়ে চাকরি সংগ্রহ করে দিয়ে। সেভাবে সে তো নয়নতারাকে স্বাবলম্বী করে তুলতে পারত। কিন্তু তা সে সেদিন করেনি। পণ্ডিতমশাইয়ের প্রতি কর্তব্যপরায়ণত সেদিন তার লুপ্ত হয়েছিল। সেদিন তার মধ্যে লেশমাত্র মানবিকতা ছিল না। নয়নতারার রূপই তার প্রতিবন্ধক হয়ে দাড়িয়েছিল। নয়নতারার বিবাহের পূর্বে নিখিলেশ তো অনবরতই তাদের বাড়ি আসত। তখনই তো নিখিলেশের অবচেতন মনের কোণে নয়নতারা বাসা বেঁধেছিল। সেদিন নয়নতারার নিজেরই মনে হয়েছিল, নিখিলেশ কি তার অসহায়তার প্রতীক্ষা করছিল? শ্বশুরবাড়ি থেকে সে চলে আসে, এটাই কি তার কাম্য ছিল? আবার সেদিন নয়নতারার আচরণও আমাদের বিস্মিত করে। সেদিন নয়নতার হারিয়ে ফেলেছিল তার সেই তেজীয়ান সত্তা, যে সত্তা জ্যোতির্ময়ী হয়ে উঠেছিল নবাবগঞ্জে তার শয়নকক্ষে সদানন্দর গৃহত্যাগের দিন, বা যার চূড়ান্ত অভিব্যক্তি সে প্ৰদৰ্শন করেছিল নবাবগঞ্জের জমিদারবাড়ির বৈঠকখানায় গণআদালতের সামনে। নিখিলেশ যেদিন তাকে তার স্ত্রী হবার প্রস্তাব করেছিল, সেদিন সে সেই কুৎসিত প্ৰস্তাব প্ৰত্যাখ্যান ক’রে, নিজেওতো স্বাবলম্বী হবার পথে পা বাড়াতে পারত। সে তো মাধ্যমিক পরীক্ষা পাস করেছিল। সে তো টিউশনি করে নিজের স্বাধীন ও সাধ্বী সত্তা অক্ষুণ্ণ রাখতে পারত। তা কিন্তু সে করেনি। বোধহয় সে তখন পিতৃশোকে কাতরা। শোকের কাতরতায় সেদিন তার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ঝাপসা হয়ে উঠেছিল। তার সামনে আর এক বিকল্পও অবশ্য ছিল। সে বিকল্প হচ্ছে, আত্মঘাতী হওয়া। আত্মঘাতী হবার কথা তো নয়নতারার মনে একাধিকবার জেগেছে। নবাবগঞ্জের শয়নকক্ষে সেই মোকাবিলার দিন, সদানন্দকেই তো সে বলেছিল, আমি আত্মঘাতী হইনি কেন, সেটাই আশ্চৰ্য। আবার আর একদিন আত্মঘাতী হবার পরিকল্পনার বশীভূত হয়েই তো নৈহাটির বাড়িতে, সদানন্দকে মারবার জন্য নিখিলেশ যে বিষ কিনে এনেছিল, তা সে তুলে রেখে দিয়েছিল, যদি কোনদিন সেটা তার নিজের কাজে লাগে। কিন্তু কোনদিন সে আত্মঘাতী হয়নি। কেননা, আত্মঘাতী হবার জন্য যে মনোবল দরকার, সে মনোেবল তার ছিল না। অস্তিবাদী লেখিকা সিমোন দ্য বিভোয়ার যিনি নারীচরিত্র সম্বন্ধে বিশেষভাবে অনুশীলন করেছেন, তিনি বলেছেন পুরুষের তুলনায় আত্মঘাতী হবার মনোেবল মেয়েদের অনেক কম। সে মনোবল ছিল কাদম্বরীর। শোনা যায়, স্বামীর জামার পকেটে এক অভিনেত্রীর প্ৰেমপত্র দেখে সে বিশুকে দিয়ে আফিম কিনে আনিয়ে আত্মঘাতী হয়েছিল। সে কেন আত্মঘাতী হয়েছিল, সে-কথা সে লিখে রেখে গিয়েছিল। সে-চিঠি যদি সেদিন মহৰ্ষি সঙ্গে সঙ্গে না। বিনষ্ট করতেন, তা হলে আজ আমরা নারীর জীবনের মর্মস্থলের বেদনার একটা সন্ধান পেতাম-নারী কেন আত্মঘাতী হয়?
পণ্ডিতমশাই যখন নবাবগঞ্জে মেয়েকে দেখতে গিয়েছিলেন, তখন ফিরে আসবার সময় তিনি নয়নতারাকে আশীৰ্বাদ করেছিলেন, ‘মা, স্বামীর সেবা কর, মেয়েমানুষের জীবনে এত বড় আশীৰ্বাদ আর নেই, এই দেখেই তোমার মার স্বৰ্গস্থ আত্মা সুখী হবে।‘ বোধহয় যেদিন অফিস যাবার জন্য ট্রেন ধরতে গিয়ে নয়নতারা নৈহাটি স্টেশনে সদানন্দকে অচৈতন্য অবস্থায় প্লাটফরমের ওপর পড়ে থাকতে দেখেছিল এবং তার বাড়িতে তাকে তুলে নিয়ে এসে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিল, সেদিন তাঁর অবচেতন মন জাগ্রত হয়ে উঠেছিল তার বাবার সেই আশীৰ্বাদকে সার্থক করবার জন্য। সেদিন তার সচেতন মন উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছিল, কাগজের স্বামী’র পরিবর্তে প্ৰকৃত স্বামীর সেবা করবার জন্য। সেটাই ছিল তার অন্তরের আহবান। বাবার কথামতোই সে স্বামীর সেবা করেছিল, তার সর্বস্ব দিয়ে, নিখিলেশের ঈর্ষাকাতর বিরোধিতার বিপক্ষে। তার সেবা দেখে ডাক্তারবাবুও অবাক হয়ে গিয়ে বলেছিলেন, ‘লোকের স্ত্রী তো দূরের কথা, লোকের নিজ মা-ও এরকম সেবা করে না।‘ ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আচ্ছা, এর কি স্ত্রী নেই? নয়নতারা বলেছিল, হঁ্যা, আছে। আবার তারই কয়েকদিন পরে তার সহকমিণী মালা যখন তার বাড়ি এসেছিল এবং তাকে প্রশ্ন করেছিল, ওই মানুষটার জন্য তুই এতদিন অফিস কামাই করে রয়েছিস, তা ওর কি নিজের স্ত্রী নেই? তার উত্তরে নয়নতারা বলেছিল, না। এই পরস্পরবিরোধী উক্তিই তো নারী-মনের এক গভীর রহস্যকে অনাবৃত করে। নারী নিজ আচরণের জন্য প্ৰায়ই লাজ-ঘেন্নায় মরে যায়! লাজঘেন্নাবশতই মালাকে ‘না’ বলা তার পক্ষে স্বাভাবিক ছিল, কেননা ‘হঁ্যা’ বললে মালা আরও কৌতুহলী হয়ে উঠত, এবং প্রকৃত সত্য জানতে পারলে অফিসমহলে প্ৰচারিত হ’ত যে নয়নতারা ও নিখিলেশের সম্পর্ক অবৈধ। এখানে সংযত হয়ে গিয়ে বিমল মিত্ৰ এক অসামান্য মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। কেননা, মেয়েদের স্বভাবসুলভ অভ্যাস অনুযায়ী তিনি যদি মালার সঙ্গে নয়নতারাকে খোলা-মন নিয়ে আলোচনায় প্ৰবৃত্ত করাতেন, তা হলে নয়নতারার পক্ষে সেটা কী লজা-ঘেন্নার ব্যাপার হ’ত! নয়নতারা সেদিন তার অবচেতন মনকে মালার কাছে উন্মুক্ত করেনি। এই হ্যা’ ও ‘না’র মধ্যেই আমরা প্ৰত্যক্ষ করি নারীর রহস্যময়ী স্বরূপ। সেজন্যই সারভেনটিস ষ্ঠার ‘ডন কুইকসোট’ উপন্যাসে বলেছেন-’Between a woman’s ‘yes’ or ‘no’, there is no room for a pin to go.’ নৈহাটিতে থাকাকালীন সদানন্দকে সে স্বামী বলেই গ্ৰহণ করেছিল, সদানন্দ সম্বন্ধে নিখিলেশ তাকে যাই বলুক-না কেন। কেননা, বিমল মিত্র নয়নতারাকে দিয়ে স্বগতোক্তি করিয়েছেন : ‘নয়নতারা বুঝতে পারে ও-মানুষটা যে এ-বাড়িতে শয্যাশায়ী হয়ে রয়েছে, ও-মানুষটার জন্যে যে এতগুলো টাকা খরচ হচ্ছে, নয়নতারার অফিস কামাই হচ্ছে, এটা নিখিলেশের পছন্দ নয়। কিন্তু পুরুষমানুষ এত অবুঝ কেন? এইটুকু বোঝে না কেন যে আজ না হয় ওর সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখা উচিত নয়, কিন্তু এককালে ওর সঙ্গেই তো অগ্নিসাক্ষী রেখে তার বিয়ে হয়েছিল।‘ কিন্তু সদানন্দ জানত যে, যাকে সে স্ত্রীর মৰ্যাদা দেয়নি, তার কাছ থেকে সেবা নেবার তার অধিকার নেই। এই অধিকারের প্রশ্ন নিয়েই তো নৈহাটির বাড়িতে রোগশয্যায় সদানন্দর সঙ্গে নয়নতারার বিতর্ক হয়েছিল। নয়নতারা তার অধিকার প্ৰতিষ্ঠিত করবার জন্যই তো সেদিন সদানন্দকে বলেছিল, ‘সাতপাক ঘুরে তোমার সঙ্গে আমার বিবাহ হয়েছিল, আমার অধিকার নেই, তুমি এ কি কথা বলছ? যদিও সে তার এ অধিকার সম্বন্ধে সম্পূর্ণভাবে সচেতন ছিল, তবুও সে জানত যে নিখিলেশের কাছে এটা অপ্রিয় ব্যাপার, সেজন্যই সদানন্দ যখন চলে যেতে চেয়েছিল এবং বলেছিল, ‘আমার জ্ঞান থাকলে আমি কিছুতেই এখানে আসতুম না’, তখন সে সদানন্দকে বলেছিল, ‘তুমি আগে ভালো হও, তারপর চলে যেও, আমি তোমাকে এখানে আটকে রাখবো না, তুমি থাকতে চাইলেও আমি তোমাকে এখানে থাকতে দেবো না-’। আবার সেই নয়নতারাই একদিন সদানন্দকে বলেছিল, ‘যেখানে তুমি যাবে, সেখানেই আমি যাবো। তোমার সঙ্গে কোথাও চলে যেতে পারলে, আমি বেঁচে যাই, আমার আর কিছু ভাল লাগছে না। এ-বাড়ি আমার কাছে এখন বিষ হয়ে গেছে। এ বাড়ির প্রত্যেকটা ইট আমার কাছে এখন অসহ্য হয়ে উঠেছে, এখানে আর একদিন থাকলে আমি পাগল হয়ে যাবো, সত্যি। এর থেকে একমাত্ৰ তুমিই আমাকে বঁাচাতে পারে।‘ প্ৰমীলা যে এক রহস্যময়ী জীব, তা নয়নতারার এই পরস্পরবিরোধী উক্তি থেকেই বুঝতে পারা যায়।