বিমল মিত্রের ৮৫৫ পাতার বই ‘আসামী হাজির’ উপন্যাসের এটাই হচ্ছে একটা সংক্ষিপ্ত কঙ্কাল বা কাঠামো। কিন্তু কুলাল-শিল্পী যেমন কাঠামোতে মাটি লেপে, রঙ চাপিয়ে, তাকে সুন্দর মূর্তিতে পরিণত করে, বিমল মিত্রও তাই করেছেন। বস্তুত বইখানির ‘ইসথেটিক বিউটি’ (aesthetic beauty) বা নান্দনিক সৌন্দৰ্য উপলব্ধি করতে হলে, সমগ্র বইখানি পড়া দরকার। এক ছাদের তলায় স্ত্রীর দুই স্বামীর সহাবস্থান, এবং দু’জনের প্রতি কর্তব্যপরায়ণতা পালনের melody আমি আর কোন উপন্যাসে পড়িনি। বেদ-পুরাণেও নয়। এ বই প্ৰমাণ করে, কথাশিল্পী হিসাবে বিমল মিত্ৰ কত বড় প্ৰতিভাশালী লেখক। বাংলা ভাষায় পূর্বে এরূপ বই লেখা হয়নি, পরেও হবে না। জীবন সম্বন্ধে এখনি এক মহাকাব্য-এ হিউম্যান স্টোরি। একমাত্র বিমল মিত্রের পক্ষেই এ-রকম বই লেখা সম্ভবপর হয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন যে অ-সাধারণ লোককে, ‘ভালো মানুষ’কে জগতের লোক ভুল বোঝে। মানুষ সৎ হলে, তার যে কি শোচনীয় পরিণতি হয়, এখানা তারই এক বিশ্বস্ত দলিল। আর দেখিয়েছেন নারী চরিত্র কত দুর্ভেদ্য। নারী চরিত্রের এই দুৰ্ভেদ্যতাই নারীকে রহস্যময়ী করে তুলেছে। নারীর অবচেতন মনের গভীরে যে বাসনা বাসা বাধে, সেখানে যে দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ চলে, তা অনুধাবন করা খুবই কঠিন। কিন্তু বিমল মিত্ৰ নারীর সেই অবচেতন মনকে আমাদের সামনে উন্মোচিত করে। ধরেছেন, উচ্ছাস বা আবেগময়ী বক্তৃতার মাধ্যমে নয়,-সংলাপ ও আচরণের মাধ্যমে, চরিত্র অঙ্কনের বিশিষ্ট মুন্সিয়ানাতে, বিচিত্র ও জটিল ঘটনাপ্রবাহের বিন্যাসে ও নারীর বাহ্যিক আচরণের ভিতর দিয়ে।
সদানন্দর পাশাপাশি তিনি চিত্রিত করে গেছেন, একজন কদাচারী ইতয়া ব্যক্তিকে, নিখিলেশ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। নিখিলেশ যে একজন দুনীতিপরায়ণ ইতর ব্যক্তি সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। নৈহাটির বাড়িতে একদিন সামান্য কথা-কাটাকাটির মধ্যে নিখিলেশ নয়নতারাকে ‘স্কাউণ্ডেল’ বলে গালি দিয়ে অপমান করেছিল। কিন্তু সে নিজে যে কতবড় স্কাউণ্ডেল, তা সে নিজে কোনদিনই বুঝতে পারল না। তা না হলে যে পণ্ডিতমশাইয়ের সে ছিল প্রিয় ও বিশ্বাস্ত ছাত্র, সেই পণ্ডিতমশাইয়ের মৃত্যুতে তার বিন্দুমাত্ৰ শোক হল না। পণ্ডিতমশাইকে শ্মশানে দাহ করে ফিরে আসবার পরমুহুর্তেই সে পণ্ডিতমশাইয়ের অসহায় ও শোকে মুহ্যমান কন্যা নয়নতারার কাছে বিবাহের প্ৰস্তাব করে বসল। সব জেনেশুনেই সে পরস্ত্রীকে স্ত্রীরূপে গ্ৰহণ করবার লোভ সামলাতে পারল না। নয়নতারার রূপই তাকে লুব্ধ করল। মাত্র রূপ নয়। অর্থগৃধুতাও। নয়নতারার কোনদিনই কোন বিধিসম্মত বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটেনি। সুতরাং শেষমূহুর্ত পর্যন্ত নয়নতারা পরস্ত্রীই ছিল। শেষমূহুর্তে থিয়েটার রোডের বাড়ির উৎসবের সমারোহের মধ্যে যখন নয়নতারা প্ৰকাশ্যে সদানন্দকেই স্বামী বলে ঘোষণা কয়ল, তখনও সে নয়নতারার ওপর তার লোভ পরিহার করতে পারল না। সে ভালো করেই জানত যে, যে-সমাজের মধ্যে তার ও নিয়নতারার অবস্থান সে-সমাজে এক নারীর দুই স্বামীর সহাবস্থান অবৈধ। এ কথা জেনেও সে নয়নতারার হাত ধরতে গিয়েছিল, বলেছিল-কী পাগলামি করছি। নয়নতারা নিখিলেশের ভুল ভাঙেনি দেখেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল। নয়নতারা নিখিলেশকে ভালোরূপেই জানত। জানত তার ওপর নিখিলেশের অবৈধ আসক্তি ও লোলুপতা, জানত তার অর্থগৃষ্ণুতা, যার জন্য সে নয়নতারাকে চাকরি করতে বাধ্য করেছিল, জানত নিখিলেশ তার গহনাগুলোর লোভে নির্লজভাবে সেগুলো তার শ্বশুরবাড়িতে চাইতে গিয়েছিল, জানত সদানন্দকে বিষ খাইয়ে মারবার জন্য নিখিলেশ বিষ কিনে এনেছিল। এসব জেনেও সে নিখিলেশের সঙ্গে পনেরো বছর ‘কাগজের বউ’ সেজে ঘর করেছিল! এখানেই নয়নতারা রহস্যময়ী হয়ে উঠেছে। অথচ তার অন্তরাত্মা বা অবচেতন মন নিখিলেশকে চায়নি, চেয়েছিল। সদানন্দকে। সেজন্যই আয়নার সামনে সে যখন সিথিতে সিঁদুর পরতে যেত তখন সে নিজের পিছনে সদানন্দকে দেখত। রাত্রে নিখিলেশের পাশে সে যখন শুয়ে থাকত, সদানন্দর মুখখানাই তখন তার চোখের সামনে ভেসে উঠত। সে স্বপ্ন দেখত সদানন্দ এসেছে তাকে নিয়ে যাবার জন্য। সদানন্দ যেদিন নৈহাটিতে শেষবারের জন্য তার বাড়ি গিয়েছিল, সেদিন নয়নতারা নিজেই সদানন্দকে বলেছিল, তুমি আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে চল। সে মনে-প্ৰাণে জানত যে সদানন্দই তার প্রকৃত স্বামী, নিখিলেশ নয়। নিখিলেশের সঙ্গে তার সম্পর্কটা যে অবৈধ, তা সে ভালভাবেই জানত। সেজন্যই আয়নায় সে যখন তার পিছনে সদানন্দর মুখ দেখত, তখন লজ্জায় ঘেন্নায় সে শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজের মুখখান ঢেকে ফেলত। কিন্তু নিখিলেশের শেষ পৰ্যন্ত কোন লজা-ঘেন্না ছিল না। কেননা, নয়নতারা যখন সদানন্দকে স্বামী বলে প্রকাশ্যে ঘোষণা করল সমবেত বিশিষ্ট অতিথিদের সামনে, তখন সমবেত অতিথিমণ্ডলী স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। তাদের স্তম্ভিত হবার তো কথাই। কেননা, তারা একমুহুর্তের মধ্যে বুঝে নিয়েছিল। যে, যে-সন্তানের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তারা সেখানে সমবেত হয়েছে, সে-সন্তান এক জারজ সন্তান-পরাস্ত্রীতে উপগত সন্তান। কিন্তু নিখিলেশের কিছুমাত্ৰ মনের বিকৃতি ঘটেনি। তা না হলে সে নয়নতারার হাত ধরতে গিয়ে বলে, কী পাগলামি করছি! হ্যা, যে সমাজের চিত্র বিমল মিত্র এঁকেছেন, সে সমাজে সত্যবাদিতার কোন স্থান নেই, সত্যবাদিতার কোন মূল্য নেই, সত্যবাদিত তো সে-সমাজে নিছক পাগলামি ছাড়া আর কিছুই নয়। এই সত্যবাদিতার জন্যই তো সদানন্দকে আসামী হতে হয়েছিল।