সদানন্দর এখন আশ্রয়স্থল বড়বাজারে পড়েজির ধরমশালা। পাড়েজি ধরমশালার ম্যানেজার। লোক ভালো। সদানন্দকে দুটো টুইশনি যোগাড় করে দেয়। কিন্তু সদানন্দ ছেলে পড়িয়ে যে টাকা পায়, ধরমশালায় নিয়ে আসে না। পথে ভিখারীদের বিলিয়ে দেয়। তাদের কাছে সদানন্দ ‘রাজাবাবু। ঠাণ্ডায় কষ্ট পাচ্ছে দেখে, পাড়েজি সদানন্দকে একখানা আলোয়ান কিনে দেয়। সদানন্দ সেটা এক নিরাশ্রয়া বুড়ীকে বিলিয়ে দেয়। ঠাণ্ড লেগে সদানন্দ অসুখে পড়ে। পাড়েজি চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। সুস্থ হয়ে সে পড়েজিকে বলে, আমি একবার নবাবগঞ্জ থেকে ঘুরে আসি। ক্লান্তি, অবসাদ ও অনশনে নৈহাটির কাছে সে ট্রেনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। ট্রেনের গার্ড তাকে নৈহাটি স্টেশনে নামিয়ে হাসপাতালে পাঠাবার ব্যবস্থা করছে, এমন সময়ে একজন মহিলা ভিড় ঠেলে, সামনে এসে বলে, ওঁকে আপনার হাসপাতালে পাঠাবেন না। আমি ওঁকে বাড়ি নিয়ে যাব। উনি আমার নিকট আত্মীয়। আমার নাম নয়নতারা ব্যানাজি।
অচৈতন্য সদানন্দকে নিজ বাড়িতে এনে, নয়নতারা তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। কিন্তু দিনের পর দিন কেটে যায়। গড়িয়ে গড়িয়ে দু’মাস গত হয়, তবুও সদানন্দর জ্ঞান ফেরে না। নিরলসভাবে রাত জেগে৷ নয়নতারা তার সেবা করে যায়। চাকরি হবার পর নয়নতারা কিছু টাকা ব্যাঙ্কে জমিয়েছিল। নয়নতারার ইচ্ছে ছিল। কয়েক বছর পরে যখন আরও কিছু টাকা হবে তখন কলকাতা শহরে তারা একটা বেশ ছোটখাটো সাজানো-গোজানো বাড়ি করবে। কিন্তু সদানন্দর চিকিৎসার জন্য সে-সব টাকা নিঃশেষিত হয়ে যায়। নিখিলেশের দেওয়া দশ ভরির সোনার হারটাও সে বাধা দেয়। দিনের পর দিন, রাত জেগে সদানন্দের মাথার ওপর সে আইস-ব্যাগ ধরে বসে থাকে। ডাক্তারবাবু তো দেখে অবাক। বলেন, লোকের স্ত্রী তো দূরের কথা, নিজের মা-ও এমনভাবে সেবা করতে পারে না।
কিন্তু নিখিলেশ চটে লাল। তার মনে হয় তার জীবনটা যেন ছত্ৰখান হয়ে গেছে। নয়নতারাকে সে বলে, ওকে তুমি হাসপাতালে পাঠিয়ে দাওনা। তারপর যখন দেখে যে তার কথায় কোন কাজ হল না, তখন সে সদানন্দকে মারবার জন্য ওষুধের বদলে বিষ কিনে নিয়ে আসে। কিন্তু ডাক্তারবাবুর নজরে পড়ায় সদানন্দ বেঁচে যায়। নয়নতারা শিশিটা তুলে রাখে, যদি কোনদিন ওটা তার নিজের কোন কাজে লাগে!
তারপর একদিন সদানন্দর জ্ঞান ফিরে আসে। সামনে নয়নতারাকে দেখে সে বিস্মিত হয়। তার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। ট্রেনের মধ্যে কিভাবে সে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল, নয়নতারা তাকে দেখতে পেয়ে নিজের বাড়িতে এনে কিভাবে তাকে ভাল করে তুলেছে, সব শোনে। একমুহূর্তও তার সেখানে থাকতে ভালো লাগে না। নিখিলেশের আচরণ থেকে সে বোঝে যে তার উপস্থিতির ফলে, নয়নতারার সুখের সংসারে চিড় ধরেছে। একদিন কাউকে কিছু না বলে সে সেখান থেকে সরে পড়ে। নয়নতারা নিখিলেশকে পাঠায় তার খোজে। নবাবগঞ্জে। নিখিলেশ নবাবগঞ্জে না গিয়ে, ফিরে এসে নয়নতারাকে বলে, সদানন্দ আবার বিয়ে করে দিব্যি সুখে আছে। কিন্তু নয়নতারার মনে সংশয় জাগে। সে নিজে নবাবগঞ্জে গিয়ে দেখে, নিখিলেশ তাকে সব মিছে কথা বলেছে। নিখিলেশের ওপর তার বিতৃষ্ণা হয়। সে আলাদা ঘরে শুতে থাকে। তারপর সে ঠিক করে, সে কলকাতায় গিয়ে মেয়েদের এক বোডিং-এ থাকবে।
এদিকে নৈহাটি থেকে চলে আসবার পর, সদানন্দর সঙ্গে তার প্রকাশ মামার দেখা হয়। প্রকাশ মামা তাকে নিয়ে যায়, হরনারায়ণ ও কীর্তিপদীর একমাত্র ওয়ারিসন হিসাবে সদানন্দকে দিয়ে সাকসেশন সার্টিফিকেট বের করবার জন্য। সদানন্দ এখন আট লক্ষ টাকার মালিক। চার লক্ষ টাকা সে দান করে নবাবগঞ্জের লোকদের স্কুলকলেজ ও হাসপাতাল করবার জন্য, আর বাকী চার লক্ষ টাকা নিয়ে সে আসে। নৈহাটিতে নয়নতারার বাড়ি। ঠিক সেই মুহুর্তেই নয়নতারা বেরিয়ে যাচ্ছিল কলকাতায় মেয়েদের বোডিং-এ থাকবার জন্য। সদানন্দকে সে বাড়ির ভিতরে এনে নিজের ঘরে বসায়। নিখিলেশ সেদিন সকাল-সকাল বাড়ি ফিরে নয়নতারার ঘরে সদানন্দকে দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। সদানন্দকে সে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। তারপর দেখে টেবিলের ওপর। সদানন্দ একটা প্লাষ্টিকসের ব্যাগ ফেলে গেছে। ব্যাগ খুলে দেখে তার ভিতর রয়েছে একখানা চার লক্ষ টাকার চেক নিখিলেশ ও নয়নতারার নামে। চেকখানা পাবার পর নিখিলেশ ও নয়নতারার মধ্যে সমস্ত মনোমালিন্য কেটে যায়। আবার তাদের মধ্যে ভাব হয়।
নিখিলেশ তাকে নয়নতারার বাড়ি থেকে বের করে দেবার পর, সদানন্দ আবার চলতে থাকে। শেষে এসে দাঁড়ায় ও আশ্রয় পায় চৌবেড়িয়ায় রসিক পালের আড়তবাড়িতে। কিছুকাল পরে সেখানে আবির্ভাব ঘটে সদানন্দর দ্বিতীয় সত্তার-হাজারি বেলিফের, যে এতদিন ছায়ারূপে তার সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। হাজারি বেলিফ বলে, আপনি আপনার পিতাকে খুন করেছেন, আপনার নামে ওয়ারেন্ট আছে। হাজারি বেলিফকে সে অনুরোধ করে একবার তাকে যেন সুলতানপুর, নবাবগঞ্জ ও নৈহাটিতে নিয়ে যায়। আত্মগোপন করে সে সুলতানপুরের লোকদের জিজ্ঞাসা করে, সদানন্দ চৌধুরীকে তারা চেনে কিনা। একবাক্যে সকলে বলে, সদানন্দ চৌধুরী তো তার বোপকে খুন করবার পর থেকে পলাতক। নবাবগঞ্জে এসে দেখে অন্তদ্বন্দ্বে স্কুল-কলেজ ও হাসপাতাল সব জ্বলছে আর এই অশান্তির কারণ হিসাবে নবাবগঞ্জের লোক সদানন্দকে অভিশাপ দিচ্ছে। নৈহাটিতে এসে শোনে, নিখিলেশ ও নয়নতারা সেখানে থাকে না। লটারিতে চার লক্ষ টাকা পেয়ে, তারা থিয়েটার রোডে বাড়ি করে সেখানে থাকে। থিয়েটার রোডে এসে দেখে সেখানে সেদিন উৎসব, নয়নতারার প্রথম সন্তানের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে। এমবেসির লোক, পুলিশের বড়সাহেবরা, আরও কত কে বিশিষ্ট অতিথি সেখানে আসছে। সদানন্দ ও হাজারি বেলিফকে দারোয়ানরা সামনের গেট থেকে তাড়িয়ে দেয়। পিছনের সিড়ি দিয়ে উঠে তারা দাঁড়ায় মুখোমুখি হয়ে নয়নতারার সামনে। নয়নতারা প্ৰথমে সদানন্দকে চিনতে পারেনি, ভেবেছিল ডেকরেটরের লোক। তারপর সদানন্দকে চিনতে পেরে বলে, ওঃ তুমি, আজ আমি খুব ব্যস্ত, তুমি কাল এস। এই কথা বলে সে অতিথি আপ্যায়নের কাজে চলে যাচ্ছিল, হঠাৎ এক আর্তনাদের শব্দ শুনে ছুটে আসে। সদানন্দ তার দ্বিতীয় সত্তা হাজারি বেলিফকে খুন করেছে। পুলিশ তাকে অ্যারেস্ট করতে যাচ্ছে এমন সময় দু’হাত বাড়িয়ে নয়নতারা বাধা দিতে যায় } বলে, ‘তোমরা ওঁকে অ্যারেস্ট কোরোনা। যত টাকা লাগে আমি দেব, আমার যথাসৰ্বস্ব দেব। উনি আমার স্বামী। ’ থিয়েটার রোডের বাড়িটার পরিবেশ একমুহুর্তে বদলে যায়। সকলেই স্তম্ভিত। কেবল নিখিলেশ নয়। সে নয়নতারাকে বলে, কী পাগলামি করছি! কথাটা শুনে নয়নতারা অজ্ঞান হয়ে মেঝের ওপর পড়ে যায়। তার চোখের জলে তার মুখের ও গালের ম্যাকস ফ্যাকটর’ ধুয়ে মুছে যায়। তার কানে কেবল বাজতে থাকে সদানন্দর বলা শেষ কথাগুলো-’আমি আসামী, আমি মানুষকে বিশ্বাস করেছিলুম, আমি মানুষকে ভালবেসেছিলুম, আমি মানুষের শুভ কামনা করেছিলুম, আমি চেয়েছিলুম। মানুষ সুখী হােক, আমি চেয়েছিলুম মানুষের মঙ্গল হোক। কিন্তু আজি এই পনেরো বছর পরে জানলুম মানুষকে বিশ্বাস করা, মানুষকে ভালবাসা, মানুষের শুভ কামনা করা পাপ, আমি তাই আজ পাপী, আমি তাই আজ অপরাধী, আমি তাই আজ আসামী, আমাকে আপনার আমার পাপের শাস্তি দিন, আমাকে ফাঁসি দিন–।‘ বইখানির এইখানেই ইতি।