নয়নতারার বিদ্রোহী মন জ্বলে ওঠে। বিহারী পালের স্ত্রীকে সে বলে, ‘কাল আপনি নবাবগঞ্জের সমস্ত গণ্যমান্য ব্যক্তিদের আমাদের বৈঠকখানায় আসতে বলবেন।‘
পরের দিন বার-বাড়িতে নবাবগঞ্জের সমস্ত গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সমবেত হতে দেখে, নয়নতারার শ্বশুর বিস্মিত। জিজ্ঞাসাবাদে জানে তার বৌমা তাদের আসতে বলেছে। ক্ষণিকের মধ্যে নয়নতারা সেখানে উপস্থিত হয়ে, সমবেত জনমণ্ডলীর কাছে নবাবগঞ্জের কুৎসিত ইতিহাস বিবৃত করে যায়। তার শ্বশুর যে তার সতীত্বনাশের চেষ্টায় প্ৰবৃত্ত হয়েছে, সে-কথাও সে বলে। জনমণ্ডলী রায় দেয়, নয়নতারাকে ওর বাপের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হোক। বাপের বাড়ি যাবার আগে নয়নতারা কুয়োতলায় গিয়ে হাতের শাখা ভেঙে ফেলে, হাতের নোয়া খুলে জঙ্গলের দিকে ছুড়ে ফেলে দেয়, কুয়োর জলে সিথির সিঁদুর ধুয়েমুছে ফেলে।
কেষ্টনগরে তার বাবার সামনে গিয়ে যখন নয়নতারা দাঁড়ায়, বাবা নয়নতারার এয়োস্ত্রী চিহ্নসমূহ না দেখে স্তম্ভিত হয়ে যান। প্রশ্ন করেন, ‘আমার জামাই কোথায়? নয়নতারা উত্তর দেয়, ‘নেই, নেই, নেই। তোমার জামাই কোনদিন ছিল না, এখনও নেই। আমি তাদের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক শেষ করে চলে এসেছি। এখন আমি তোমার কাছেই থাকব।‘ নয়নতারার উক্তি বৃদ্ধ ভটচার্যি মশাইকে নিদারুণ মানসিক আঘাত দেয়। বৃদ্ধ সহ্য করতে পারেন না। স্ট্রোক হয়। মারা যান। তাঁর প্রিয় ছাত্ৰ নিখিলেশই তাঁকে শ্মশানে নিয়ে যায়,।
শ্মশান থেকে ফিরে এসেই নিখিলেশ নয়নতারার কাছে প্ৰস্তাব করে, ‘তুমি আমার বাড়িতে আমার স্ত্রী হয়ে এস।‘ নিয়নতারা তখন শোকে মুহমান। একমাত্র অবলম্বন বাবাকে হারিয়ে ভবিষ্যৎ তখন তার কাছে অন্ধকার হয়ে গেছে। নয়নতারার সমস্ত মন নিখিলেশের ওপর বিষিয়ে ওঠে। মনে হয় যেন নিখিলেশ এতদিন তার বাবার মৃত্যুর জন্যই প্ৰতীক্ষা করছিল। যেন নয়নতারার অসহায়তার সুযোগ খুঁজছিল সে। যেন নয়নতারার শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে আসাটাই তার কাছে কাম্য ছিল। কিন্তু তারপরেই মনে পড়ে তার আশ্রয়ের কথা, তার জীবিকানির্বাহের কথা, তার নিজের ভরণপোষণের কথা। তখন তার চোখের সামনে ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই, বোধহয় বর্তমান বলেও কিছু নেই। শুধু আছে একটা অতীত, তা সেটা স্মরণ করতেও তার ভয় হয়। নয়নতারা নিখিলেশের কাছে আত্মসমপণ করে। একদিন কলকাতায় এসে তাদের বিয়ে রেজেষ্ট্রি হয়ে যায়। তারা যেমন বলল, তেমনি সই করল সে। রেজেষ্ট্রি অফিসে তারা কী প্রশ্ন করল, তা তার কানে ভাল করে ঢুকল না। কালীঘাটে গিয়ে সিথিতে সিঁদুরও পরানো হল। তারপর তারা নৈহাটিতে এসে একটা বাড়ি ভাড়া করে। নিখিলেশ তাকে যা বলত, সে তাই-ই করতে চেষ্টা করত। সে যেন এক কলের পুতুল। নিখিলেশ তাকে দম দিয়ে ছেড়ে দিত, আর সে কলের পুতুলের মতো শুত, ঘুমোত, ভাৰত, হাসত, নড়ত-সবকিছু করত। কিন্তু তার মধ্যে কোন প্ৰাণ ছিল না। নিখিলেশ তাকে বাড়িতে পড়িয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করিয়ে, একটা সরকারী চাকরিও যোগাড় করে দেয়। নিখিলেশের অফিস আগে শুরু হয়। সেজন্য সে আগের ট্রেনে কলকাতায় আসে। নয়নতারা পরের ট্রেনে কলকাতায় আসে অফিস করতে। দু’জনে একসঙ্গেই বাড়ি ফেরে। মনে হয় নয়নতারার জীবন সহজ সরল হয়ে গেছে। কিন্তু আয়নার সামনে দাড়িয়ে সে যখন সিঁথিতে সিন্দুর পরে, মনে হয় কে যেন তার পিছনে দাড়িয়ে রয়েছে। লজ্জায় ঘেন্নায় শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখটা ঢেকে ফেলে। রাত্রে নিখিলেশের পাশে সে যখন শুয়ে থাকে, এক এক দিন একটা পুরানো মুখের ছবি তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সে চমকে ওঠে।
এদিকে নবাবগঞ্জের ইতিহাসে ওলট-পালট ঘটে যায়। নয়নতারার শাশুড়ী গ্ৰীতিলতা মারা যায়। শ্ৰীতিলতা ছিল সুলতানপুরের জমিদার কীৰ্তিপদ মুখোপাধ্যায়ের একমাত্র সন্তান। গ্ৰীতিলতাই ছিল তাঁর বিরাট জমিদারির একমাত্র ওয়ারিসান। গ্ৰীতিলতার মৃত্যুর পর, কীৰ্তিপদবাবুও একদিন মারা যান। নবাবগঞ্জে নিঃসঙ্গ জীবন হরনারায়ণের পক্ষে অসহনীয় হয়ে ওঠে। নবাবগঞ্জের সমস্ত সম্পত্তি প্ৰাণকৃষ্ণ শা’কে চার লক্ষ টাকায় বেচে দিয়ে, হরনারায়ণ সুলতানপুর চলে যায়। কিন্তু ওই সম্পত্তি ভোগ করা প্ৰাণকৃষ্ণর সাইল না। সেও একদিন মারা গেল। তারপর নবাবগঞ্জের জমিদারদের বাড়ি ভগ্নকূপে পরিণত হয়।
হরিনারায়ণ সুলতানপুরে কৃচ্ছতা অবলম্বন করে পাউরুটি ও দুধ খেয়ে জীবন কাটাতে থাকে। একদিন সুলতানপুরের লোক দেখে, হরিনারায়ণ আর শোবার ঘরের দরজা খোলে না। শাবল দিয়ে দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে তারা দেখে হরনারায়ণের জীবনাবসান ঘটেছে।
এদিকে সদানন্দর জীবনেও বিচিত্ৰ ঘটনাপ্রবাহ ঘটে যায়। বউবাজারের বিরাট ধনশালী ব্যক্তি সমরজিৎবাবু একদিন সদানন্দকে রানাঘাট স্টেশন থেকে তাঁর বাড়ি নিয়ে আসেন। সমরজিৎবাবু নিঃসন্তান বলে সুশীল সামন্ত নামে একটি ছেলেকে পুষ্যি নিয়েছিলেন। তাকে মানুষ করে তার বিয়েও দিয়েছিলেন। কিন্তু সুশীল সামন্ত পুলিশের চাকরিতে ঢুকে মদ্যপ ও বেশ্যাসক্ত হওয়ায়, সমারজিৎবাবু তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে তাকে ত্যাজ্যপুত্র করে, তার সমস্ত সম্পত্তি সদানন্দকে দেবার মতলব করেন। টের পেয়ে সদানন্দ কাউকে কিছু না বলে সমরজিৎবাবুর বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়।