জরায়ুই হচ্ছে মেয়েদের প্রধান গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র, কেননা এরই মধ্যে ভ্রূণোদ্গম হয়ে শিশু তার অবয়বের পূর্ণতা পায়। প্রতিবার মাসিক রজঃনিঃসরণের সময় ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু নির্গত হয়। সে সময় যৌনমিলনের ফলে পুরুষের শিশু-নির্গত শুক্রাণু ডিম্বাণুকে নিষিক্ত বা ফলবতী করে। তখন সেই নিষিক্ত ডিম্বাণু জরায়ুর মধ্যে প্রবেশ করে ভ্রূন স্মৃষ্টি করে।
সুতরাং জরায়ু ও ডিম্বাশয় নারীদেহে এক বায়োলজিক্যাল কারখানা-বিশেষ। এ কারখানার মালিকানা-স্বত্ব একমাত্র নারীর। কিন্তু এ কারখানা সম্পূর্ণ অচল ও অকৰ্মণ্য অবস্থায় থাকে যদি-না সে পুরুষের সংস্পর্শে আসে। সেজন্য জননী হতে হলে নারীকে সম্পূর্ণ পুরুষনির্ভর হতে হয়।
অবশ্য মেয়েরা মুখ্যভাবে পুরুষনির্ভর না হয়েও জননী হতে পারে। সেটা নলের (test tube) সাহায্যে। কিন্তু সেরূপ ক্ষেত্রে নলজাতককে নিয়ে নানারূপ উৎকট সামাজিক সমস্ত উঠতে পারে। যথা, সে শিশুর প্রকৃত পিতা কে? সে শিশু বৈধ, না অবৈধ? সোশিওলজিক্যালি সে শিশু হয়ত বৈধ, কিন্তু আদালত বলবে যে বায়োলজিক্যালি সে-শিশু অবৈধ। তাহলে সে-শিশুকে তো ললাটে জারজ সন্তানের কালিমা নিয়েই জন্মগ্রহণ করতে হয়।
***
মানুষের আবির্ভাবের দিন থেকেই তো মেয়ের পুরুষ ভজছে। সে কত দিন? মানুষের প্রথম আবির্ভাব ঘটে আজ থেকে প্রায় পাঁচ লক্ষ বৎসর পূর্বে। আবির্ভাবের সময় থেকেই মানুষকে দুই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল—আত্মরক্ষা ও খাদ্যসংগ্রহের সমস্যা। মানুষকে বলা হয় . বুদ্ধিসম্পন্ন জীব বা homo sapiens | কিন্তু গোড়া থেকেই মানুষকে আত্মরক্ষা ও খাদ্যসংগ্রহ-সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল বলে তার সমাধানের জন্য তাকে কারিগর বা homo faber-ও হতে হয়েছিল। ফলমূল ছাড়া তার প্রধান খাদ্য ছিল মাংস। মাংস আহরণের জন্য তাকে পশুশিকারে বেরুতে হ’ত। পশুশিকার ও আত্মরক্ষা-এই উভয়ের জন্যই তাকে আয়ুধ তৈরি করতে হত। এ আয়ুধগুলো মানুষ পাথর দিয়ে তৈরি করত। আয়ুধগুলো পুরুষরাই তৈরি করত। তাতে মেয়েদের কোনো ভূমিকা ছিল না। সেজন্যই প্রথম মানুষের বৈষয়িক জীবনে পুরুষের প্রাধান্ত এসে পড়েছিল। যেহেতু একমাত্র পুরুষই হচ্ছে homo faber ও বৈষয়িক কর্মকাণ্ডের হর্তাকর্তা, সেহেতু নারীকে পুরুষের প্রাধান্ত স্বীকার করে নিয়ে পুরুষের বশীভূত হয়ে থাকতে হত। নারীর তখন মাত্র একটাই সত্তা ছিল। সেটা হচ্ছে তার বায়োলজিক্যাল সত্তা। আর পুরুষের ছিল ছুটে সত্তা—বায়োলজিক্যাল ও বৈষয়িক বা ইকনমিক সত্তা। পুরুষের এই শ্রেষ্ঠত্বের জন্যই নারী তখন থেকেই পুরুষভজনা শুরু করে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, নারী পুরুষ-ভজনা করতে শুরু করেছিল দুই কারণে। প্রথমত, তার বায়োলজিক্যাল সত্তাকে রূপায়িত করবার জন্য সন্তান-উৎপাদনে পুরুষের সহযোগিতা। আর দ্বিতীয়ত, নারীকে ও তার সন্তানদের পুরুষ রক্ষা করে এবং তাদের জন্য খাদ্যসংগ্রহ করে দেয়। সেজন্য নারীর কাছে পুরুষ নমস্ত হয়ে দাড়ায় এবং নারী তার প্রেম ও সোহাগ দিয়ে পুরুষকে নিজ সান্নিধ্যে বেঁধে রাখতে সচেষ্ট হয়। নারী তার বায়োলজিক্যাল সত্তা নিয়েই ব্যস্ত থাকে। তাতেই তার সন্তুষ্টি। তাতেই তার আনন্দ।
পাঁচ লক্ষ বৎসর পূর্বে তার আবির্ভাবের সময় থেকে চার লক্ষ নব্বই হাজার বৎসর পর্যন্ত নারী এভাবেই পুরুষের বশীভূত হয়ে থাকে। এই চার লক্ষ নকবই হাজার বৎসরকে প্রত্নপলীয় যুগ বলা হয়। তারপর নবপলীয় যুগের সূচনা হয়। নবপলীয় যুগেই নারীর বায়োলজিক্যাল সত্তা ছাড়া আর একটা সত্তা প্রকাশ পায়। এটা হচ্ছে তার বৈষয়িক বা ইকনমিক সত্তা। এটা কী ভাবে ঘটেছিল তা এবার বলছি।
আগেই বলেছি যে, প্রত্নপলীয় যুগে মানুষের প্রধান খাদ্য ছিল পশুমাংস। পশুশিকার ছিল পুরুষের কর্ম। পশুশিকারের জন্য তাকে স্থান থেকে স্থানান্তরে যেতে হ’ত এজন্য সে-যুগের মানুষ ছিল যাযাবর। কোনো এক জায়গার পশুসম্পদ নিঃশেষিত হলে তাকে আবার নতুন জায়গায় যেতে হ’ত। অনেকসময়ে শিকারে বেরিয়ে পড়ার পর পুরুষের ফিরতে দেরি হত। এরকম সময়ে মেয়েরা ক্ষুধার তাড়নায় গাছের ফল, এবং ফলাভাবে বহু অবস্থায় উৎপন্ন খাদ্যশস্য খেয়ে প্রাণধারণ করত। তারপর মেয়েদের ভাবনা-চিন্তায় স্থান পায় এক কল্পনা। সন্তান-উৎপাদনের প্রক্রিয়া তাদের জামাই ছিল। যেহেতু ভূমি বন্য অবস্থায় শস্য উৎপাদন করে, সেইহেতু তারা ভূমিকে মাতৃরূপে কল্পনা করে নেয়। যুক্তির আশ্রয় নিয়ে তারা ভাবতে থাকে— পুরুষ যদি নারীরূপ-ভূমি (আমাদের সমস্ত ধর্মশাস্ত্রেই মেয়েদের ‘ক্ষেত্র’ বা ভূমি বলে বর্ণনা করা হয়েছে) কর্ষণ করে সন্তান উৎপাদন করতে পারে, তবে মাতৃরূপ-পৃথিবীকে কর্ষণ করে শস্ত উৎপাদন করা যাবে না কেন? তখন তারা পুরুষের লিঙ্গস্বরূপ এক যষ্টি বানিয়ে নিয়ে ভূমিকৰ্ষণ করতে থাকে। এখনও পৃথিবীর অনেক আদিম জাতি এরূপ কর্ষণ-যষ্টি দ্বারাই ভূমি কর্ষণ করে। Przyluski তার ‘Non-Aryan Loans in Indo-Aryans’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে ‘লিঙ্গ’, ‘লাঙ্গুল’ ও ‘লাঙ্গল’ এই তিনটি শব্দ একই ধাতুরূপ থেকে উৎপন্ন। মেয়ের এইভাবে ভূমিকৰ্ষণ করে শস্য উৎপাদন করল। যখন ফসলে মাঠ ভরে গেল তখন পুরুষরা তা দেখে অবাক হল। লক্ষ্য করল যষ্টি হচ্ছে passive, আর ভূমিরূপী পৃথিবী ও তাদের মেয়েরা হচ্ছে active। Active মানেই হচ্ছে শক্তির আধার। ফসল তোলার পর যে প্রথম নবান্ন উৎসব হল, সেই উৎসবেই জন্ম নিল লিঙ্গ ও ভূমিরূপী পৃথিবীর পূজা। এ সম্বন্ধে Clodd তার ‘Animism’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘…in earth worship is to be found the explanation of the mass of rites and ceremonies to ensure fertilization of the crops and cattle and woman herself.’