নরনারায়ণ চায় এইভাবে তার জমিদারীর প্রসার ঘটুক। নিরবচ্ছিন্নভাবে তার বংশধারা চলুক। এই জমিদারীর ধারা সংরক্ষণে। সেজন্যই তিনি সদানন্দর বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু বিয়ের দিন সদানন্দ হল নিরুদেশ। তার প্রকাশ মামা তাকে ধরে নিয়ে এল। কালীগঞ্জের বউয়ের বাড়ি থেকে। সদানন্দ বলে, আগে তোমরা কালীগঞ্জের বউয়ের টাকা দাও, তবে আমি বিয়ে করব। নরনারায়ণ বলে, তুই বিয়ে করে এলেই আমি কালীগঞ্জের বউয়ের টাকা দিয়ে দেব। বিয়ে করে এসে সদানন্দ কালীগঞ্জের বউয়ের টাকা চায়। কিন্তু নরনারায়ণ কথার খেলাপ করে।
বিয়ের ফুলশয্যার দিন রবাহুত হয়ে আসে কালীগঞ্জের বউ, সদানন্দের বউকে আশীৰ্বাদ করতে। আবার টাকার কথা ওঠে। নরনারায়ণ তাকে কড়া কথা বলে। উঠোনে দাড়িয়ে কালীগঞ্জের বউ অভিশাপ দেয়, ‘নারায়ণ, তুমি নির্বংশ হবে। ’
নরনারায়ণ বংশী ঢালীকে ডেকে গোপনে কি নির্দেশ দেয়। ইতিহাসের পাতা থেকে চিরকালের মতো কালীগঞ্জের বউ ও তার চার পালকিবাহক উধাও হয়ে যায়। সদানন্দ গোপনে পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ আসে। কিন্তু অতীতের আবার পুনরাবৃত্তি ঘটে। টাকা পেয়ে পুলিশ চলে যায়।
সদানন্দ এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চায়। বিতৃষ্ণায় তার মন ভরে ওঠে। এর প্রতিঘাত গিয়ে পড়ে নয়নতারার ওপর। ফুলশয্যার দিন রাত্রে সে নয়নতারার সঙ্গে এক-বিছানায় শোয় না। সে ঘর থেকে পালায়। নিয়নতারার মন বিষাদে ভরে যায়। এদিকে খবর আসে যে ওই ফুলশয্যার দিন রাত্রেই কেষ্টনগরে তার মা কন্যা-বিচ্ছেদ সইতে না পেরে মারা গেছেন।
বাবাকে শান্ত করার জন্য নয়নতারাকে বাপের বাড়ি পাঠানো হয়। নয়নতারা আবার ফিরে আসে ৷ ভট্টাচাৰ্যমশাইও একদিন নিজে নয়নতারার বাড়ি আসেন। যাবার সময়ে মেয়েকে আশীৰ্বাদ করে যান —‘মুখে থাক মা, স্বামীর সংসারে লক্ষ্মী হয়ে থাকো, মনেপ্রাণে স্বামীর সেবা কর, মেয়েমানুষের জীবনে এর চেয়ে বড় আশীৰ্বাদ আর নেই। তুমি মনেপ্ৰাণে স্বামীর ঘর কর, তাই দেখেই তোমার মায়ের স্বৰ্গত আত্ম সুখী হবে।‘
এদিকে নবাবগঞ্জে সদানন্দর শয়নঘরে সেই একই দৃশ্য। শাশুড়ী রুষ্ট হয়ে বউকে ভৎসনা করে বলে,’তোমার রূপ নিয়ে কি আমরা ধুয়ে খাব ৷ আমাদের এই বিরাট ঐশ্বৰ্য ভোগ করবার জন্য চাই নাতি। সেজন্যই তো তোমাকে আমরা এনেছি। তুমি যেরকমভাবে পারি, তোমার রূপ দিয়ে সদাকে বশীভূত করে, আমাকে নাতি এনে দাও।‘
নয়নতারা সেদিন বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সে আর শোবার ঘরে নিৰ্বাক দৰ্শক হয়ে থাকে না। আজ সদানন্দকে সে বশীভুত করবেই। আজ তাকে সে বিছানায় টেনে আনবেই। আর তা নয়তো, সে একটা হেস্তনেস্ত করবে। একটা মোকাবিল এর চাই-ই।
কিন্তু সদানন্দ অচল অটল। নয়নতারার কথার উত্তর না দিয়ে, সে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু নয়নতারা পিঠ দিয়ে কপাট চেপে ধরে, সদানন্দর মুখোমুখি হয়ে বলে–’তুমি না-হয় তোমার বাপঠাকুরদার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছ, কিন্তু আমি কেন তোমার সঙ্গে প্ৰায়শ্চিত্ত করতে যাব? তারপর কথা-কাটাকাটি হয়। হঠাৎ সদানন্দ টেবিল থেকে একটা কাঁচের দোয়াতদানি তুলে নিয়ে কপালে ঠুকতে থাকে। কপাল ফুঁড়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে ঘরের মেঝে ভাসিয়ে দেয়। তাই দেখে নয়নতারা অজ্ঞান হয়ে ঘরের মেঝেতে পড়ে যায়। সদানন্দ ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। তারপর থেকেই সে হয়। নিরুদ্দেশ।
এদিকে শব্দ শুনে শাশুড়ী প্রীতিলতা ছুটে এসে দেখে রক্তাক্ত মেঝের ওপর নয়নতারা অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে। চৈতন্য ফেরবার সঙ্গে সঙ্গেই নয়নতারা প্রশ্ন করে, উনি কেমন আছেন? গ্ৰীতিলতা বলে, সদানন্দ ভাল আছে, উপরের ঘরে শুয়ে আছে। নয়নতারা বলে, আমি ওঁকে একবার দেখতে যাব। শ্ৰীতি বলে, ডাক্তারের মানা আছে, তুমি পরে দেখা কোরে।
রাত্রে যখন সকলে ঘুমিয়ে পড়েছে, নয়নতারা সদানন্দকে দেখবার জন্য চুপিচুপি উপরে উঠে যায়। কিন্তু যা দেখে, তা তার চােখের সামনে খুলে দেয় নবাবগঞ্জের ইতিহাসের আর এক কদৰ্য পৃষ্ঠা। কিছুদিন যাবৎ নরনারায়ণ অসুস্থ হয়েছেন। কৃপণ পুত্র হরনারায়ণ চিকিৎসার খরচে বিব্রত হয়ে পড়েছে। নয়নতারা জানালার ফঁাক দিয়ে দেখে খরচের হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য তার শ্বশুর তার পিতাকে গলা টিপে মেরে ফেলছে।
সদানন্দ আর ফেরেনি। নয়নতারা একলাই শয়নঘরে শোয়। শাশুড়ী বলে—বউম শোবার অাগে ভাল করে দরজায় খিল দেবে। একদিন শাশুড়ী হঠাৎ বলে বৌমা, আজ থেকে তুমি দরজায় খিল না। দিয়েই শোবে। নয়নতারা তো অবাক। কেন এরকম বিন্দকুটে নির্দেশ! রাত্রে ভয়ে তার ঘুম এল না। বিহুনায় জেগেই পড়ে রইল। রাত্রে দেখে ঘরের দরজাটা খুলে একজন পুরুষমানুষ তার ঘরে ঢুকল। নয়নতারা তাকে চিনতে পারল-তার শ্বশুর। নয়নতারা আঁতকে ওঠে। লোকটা ভয় পেয়ে বেরিয়ে যায়। পরের দিন লোকটা ঘরে ঢুকে তার গায়ে হাত দেয়। এক ঝটকা মেরে নয়নতার হাতটা সরিয়ে দেয়। তারপর বিছানা থেকে উঠে জানালার ধারে দাড়িয়ে পাশে বিহারী পালের বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে। বিহারী পালকে নবাবগজের – জমিদাররা দেখতে পারে না, কেননা ইদানিং কালে লড়াইয়ের মৌকায় বিহারী পালের সমৃদ্ধি বেড়েছে। কিন্তু বিহারী পালের স্ত্রী নয়নতারাকে খুব ভালবাসে। নয়নতারা তাকে দিদিমা বলে। শ্বশুরের কুৎসিত প্রয়াসে সন্ত্রস্তা হয়ে নয়নতারা পরের দিন বিহারী পালের বাড়ি গিয়ে দিদিমার কাছে আশ্রয় নেয়। ভোরের আগেই নিজের ঘরে ফিরে আসে। কিন্তু শাশুড়ী সব টের পেয়ে নয়নতারাকে শাসায় সে যেন বিহারী পালের স্ত্রীর সঙ্গে কোন সম্পর্ক না রাখে।