নায়িকারা সকলেই অসীম বীরত্ব ও সাহসিকতার মূৰ্তিময়ী প্রতীক। শান্তি এক লহমায় বিদ্যুদবেগে কেড়ে নেয় ক্যাপ্টেন টমাসের বন্দুক ও বিনা ক্লোশে ইস্পাতের ধনুকে লোহার গুণ পর্যায়। দেবী চৌধুরানীর বীরত্ব ও সাহসিকতায় ইংরেজ সন্ত্রস্ত। শ্ৰী বৃক্ষশাখায় আরোহণ করে লাল শাড়ির আচল ঘুরিয়ে উৎসাহ দেয় হিন্দু জনতাকে মেচ্ছনিধনে, ও শেষ যুদ্ধে কামানের মুখে দাঁড়িয়ে। সুমিত্রা ও এলারও সাহসের অন্ত নেই। বীরাঙ্গনা হলেও এরা সকলেই ছিল বাঙালী ঘরের কুলাঙ্গনা। এমনকি পথের দাবীর আনুষঙ্গিক চরিত্র ভারতী বিজাতীয় ক্রীশচান সমাজভূক্ত হলেও আমরা তাকে দেখি বাঙালী ঘরের চিরপরিচিত মেয়েরূপে। বাঙালী কুলাঙ্গনা বলেই শান্তি, প্ৰফুল্প ও শ্ৰী পতিপ্ৰাণী। সুমিত্রা ও এল অনুঢ়া, সেজন্য তার প্ৰেম নিবেদন করেছে দায়িতের পাদপদ্মে। শান্তি যেমন সত্যানন্দের কাছে বলছে–সে সহধর্মিণী হিসাবে স্বামী যে ধর্ম অবলম্বন করেছে, সেই ধর্মপালনের জন্যই সন্তান সম্প্রদায়ে যোগ দিয়েছে; চার অধ্যায়ে এলাও তেমনই অতীনকে বলছে—আমি স্বয়ংবরা, আমাকে বিয়ে কর অন্তু। আর সময় নেই-গান্ধৰ্ব বিবাহ হোক, সহধর্মিণী করে নিয়ে যাও তোমার পথে। সব্যসাচীর প্রতি সুমিত্রার মনের প্রগাঢ় অনুরাগ ভারতীর কাছে অজ্ঞাত ছিল না, যদিও শরৎচন্দ্ৰ সুমিত্ৰা চরিত্রকে সেরকম জীবন্ত করতে পারেননি, যেরকমভাবে তিনি সজীব করে তুলেছেন ভারতীর বেদনাসিক্ত অন্ত ঘন্দ্বের দাবদাহকে।
উপন্যাস হিসাবে চার অধ্যায় স্বল্পপরিমিত হলেও তাতে পূৰ্ণ প্ৰকাশিত হয়েছে এলার চরিত্র। অতীন্দ্ৰ ও ইন্দ্ৰনাথের সঙ্গে এলার ংলাপের ভিতর দিয়ে রবীন্দ্রপ্রতিভা এল চরিত্রকে পুণবিকশিত ও মহীয়সী করে তুলেছে। এল সুমিত্রার মতো বিপ্লবের রঙ্গমঞ্চে নেপথ্যবর্তিনী নয়। সমগ্র বিশ্বের সামনে সে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করেছে, তার অন্তরের গুহায় অবরুদ্ধ হৃদয়বৃত্তির প্রচণ্ড দহন ব্যক্ত করে।
প্ৰমীলা রহস্যময়ী
অনেকসময়ই তার আচরণের দিক দিয়ে নারী রহস্যময়ী হয়ে দাঁড়ায়। এরূপ এক রহস্যময়ী নারীর বিশ্বস্ত চিত্র এঁকেছেন বাঙলার অপরাজেয় কথাশিল্পী বিমল মিত্ৰ তাঁর ‘আসামী হাজির’ উপন্যাসে। এই উপন্যাসের নায়িকা নয়নতারা এক রহস্যময়ী নারী। বিমল মিত্র তার এই উপন্যাসে নয়নতারার যে জীবনকাহিনী বিবৃত করেছেন, তার আকে-বাকে নয়নতারার আচরণ নয়নতারাকে এক রহস্যময়ী নারী করে তুলেছে। অথচ এই জীবনকাহিনীর মধ্যে কাল্পনিক কিছু নেই। আমাদের বাস্তবজীবনে আমরা নয়নতারাকে এখানে সেখানে সর্বত্রই দেখতে পাই। সেদিক থেকে বিমল মিত্রের এই কাহিনী এক চলমান সমাজের জীবন্ত চিত্র। এই অসামান্য উপন্যাসখানা র্যারা পড়েননি, ভঁাদের সকলকেই অনুরোধ করব, উপন্যাসখানা পড়তে। অবশ্য র্যারা বিমল মিত্রের অন্যান্য উপন্যাস পড়েছেন, তঁরা জানেন যে বিমল মিত্ৰ গত তিনশো বছরের বাঙালী জীবনের প্রশস্ত রাজপথ ও তার আলিগলির ভিতর প্রবেশ করে বিভিন্ন প্রজন্মের বাঙালী নারীর যে স্বরূপ দেখেছেন ও আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরেছেন, তাতে নারী সর্বত্রই রহস্যময়ী হয়ে উঠেছে। তার মানে নারীর একটা কালজয়ী রূপ আছে। সে রূপ হচ্ছে নারী রহস্যময়ী।
নয়নতারা কেষ্টনগরের পণ্ডিতমশাই কৃষ্ণকান্ত ভট্টাচার্যের একমাত্র সন্তান। পণ্ডিতমশাইয়ের কোন পুত্রসন্তান ছিল না। সেজন্য তিনি তাঁর প্রিয় ছাত্ৰ নিখিলেশকেই সবসময়ে ডাকেন নিত্যনৈমিত্তিক জিনিসপাত্তর কেনাকাটার জন্য, অসুস্থ হলে ডাক্তার ডাকবার জন্য, ওষুধপত্তর কিনে আনার জন্য।
নয়নতারা অপরূপা সুন্দরী। তার রূপ দেখেই নবাবগঞ্জের জমিদার নরনারায়ণ চৌধুরীর পরিবার তাকে পছন্দ করেছিল, নরনারায়ণের নাতি সদানন্দের সঙ্গে বিয়ে দেবার জন্ম। বিয়ে কয়ে সদানন্দ যখন বউ নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল, নবাবগঞ্জের লোক তখন অবাক হয়ে গিয়েছিল নয়নতারার রূপ দেখে। সকলে একবাক্যে বলেছিল, এ যেন ডানাকাটা পরী। কথাটা শুনে নয়নতারার আনন্দ হয়েছিল। তখন সে ভাবেনি যে তার এত রূপ ব্যর্থ হবে সদানন্দকে তার সান্নিধ্যে আনতে।
সদানন্দ বিদ্বান ছেলে। বি. এ. পাস করেছে। কিন্তু তার মনোভাব এলোমেলো, আচার-আচরণ ছন্নছাড়া। নরনারায়ণের বিরাট ঐশ্বর্যের প্ৰতি সে বিমুখ। সে জেনেছিল নরনারায়ণের এই বিরাট বৈভবের রস্ত্ৰে রন্ধে লুকিয়ে আছে পাপের শাখা-প্ৰশাখা।
প্ৰথমজীবনে নরনারায়ণ ছিল কালীগঞ্জের জমিদার হর্ষনাথ চক্রবর্তীর পনেরো টাকা মাইনের নায়েব। হর্ষনাথের ছিল অগাধ বিশ্বাস নরনারায়ণের ওপর। কিন্তু শেষজীবনে হৰ্ষনাথের চৈতন্যোদয় হয়েছিল। তিনি সজ্ঞানে নবদ্বীপের গঙ্গায় দেহত্যাগ করেন। মরবার সময় তিনি নরনারায়ণকে বলেছিলেন-বাবা, আমি চললাম, তুমি আমার বিধবাকে। দেখো। কয়েকদিনের মধ্যেই রহস্যজনকভাবে হর্ষনাথের ওয়ারিশনদের মৃত্যু ঘটল। নরনারায়ণ জমিদারীটা গ্ৰাস করে নিয়ে, নিজে জমিদারী পত্তন করল নবাবগঞ্জে। হর্ষনাথের অসহায়া বিধবা ‘কালীগঞ্জের বউ মামলা করল। নরনারায়ণ সে-মামলা ভঙুল করে দিল, তাকে দশ হাজার টাকা নগদ দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে।
দশ বছর ধরে কালীগঞ্জের বউ এসেছে নরনারায়ণের কাছে ওই টাকার জন্য। কিন্তু নরনারায়ণ তাকে দেয়নি। দিয়েছে কেবল স্তোকবাক্য ও আশা। সদানন্দ নিজের চোখে দেখেছে তার দাদুর এই প্রতারণামূলক আচরণ। আরও দেখেছে যে, মাত্র চার পয়সার জন্য নিরীহ নিরপরাধ পায়রাপোরাকে ঠগ বানিয়ে তার সর্বনাশ করা হয়েছে। মনের দুঃখে সে আত্মহত্যা করেছে গলায় দড়ি দিয়ে। অথচ প্ৰকৃত ঠগ হচ্ছে কৈলাস গোমস্তা। সে বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করে বাবুদের নেকনজরে রয়ে গিয়েছে। সদানন্দ আরও দেখেছে যে একইভাবে সর্বনাশ করা হয়েছে মানিক ঘোষ ও ফটিক প্রামাণিকদেরও! বিতৃষ্ণায় ভরে গেছে সদানন্দের মন, পাপের ওপর প্রতিষ্ঠিত নরনারায়ণের জমিদারীর ওপর।