এর ঠিক অব্যবহিত পূর্বে ভারতীর মন ভরে গিয়েছিল পরিপূর্ণ ঘৃণায় যখন সে শুনল যে দলের সদস্য নবতার স্বামীর মৃত্যুর সাতদিন পরে আবার বিয়ে করছে। দলের কবি শশীকে। শশী বিয়েতে তাদের নিমন্ত্রণ করল। বিয়ের দিন সব্যসাচী ভারতীকে নিয়ে শশীর বাড়ি গেল। গিয়ে শুনল নবতারা সেদিন দুপুরে আহমেদ নামে কলের এক মিস্ত্রিকে বিয়ে করেছে। ভারতী আরও বিমর্ষ হয়ে পড়ল। সহসী। সেখানে এল সুমিত্রা ও ব্ৰজেন্দ্র। সুমিত্রা জানাল যে সে তার মাতামহের এক বিরাট সম্পত্তি পেয়েছে এবং সেই কারণে সুরভায়ায় ফিরে যাচ্ছে। এদিকে ব্ৰজেন্দ্ৰ সব্যসাচীকে সরিয়ে দিতে চায়, সুমিত্রাকে পাবার জন্য।
এর কয়েকদিন আগে থেকেই সব্যসাচী ভারতীকে বোঝাচ্ছিল, এ বিপ্লবের পথে ভারতীর আর থাকা উচিত নয়। ভারতীও রক্তপাতের ভিতর দিয়ে বিপ্লবের উদ্দেশ্যসাধন চাইছিল না। এখন সুমিত্রার সুরভায়ায় ফিরে যাবার সঙ্কল্পে পথের দাবীর দল ভেঙে পড়ল। সুমিত্ৰা গেল, ভারতী গেল, নবতারা গেল, তালওয়ার জেলে গেল; রইল শুধু সব্যসাচী। এদিকে ব্ৰজেন্দ্ৰ বিশ্বাসঘাতকতা করে দলের অন্যান্য যে-সব শাখা ছিল সেগুলি পুলিশকে জানিয়ে দিল। সব্যসাচী পায়ে-হাটা পথে চীনে যাবে ঘোষণা করেছিল। সেজন্য ব্ৰজেন্দ্ৰ সেপথে ওৎ পেতে রইল। সব্যসাচীকে ধরিয়ে দেবার জন্য। কিন্তু সব্যসাচী তা জানতে পেরে স্টীমারে করে জাভা চলে গেল।
***
হিন্দিতে একটা বচন আছে : ‘গাগরী মে সাগর ভর দিয়া গয়া হায়’। রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়’ তাই। এখানা দেশোদ্ধারের রঙ্গমঞ্চে এক রোমাঞ্চকর কাহিনী। এর কেন্দ্র-চরিত্র হচ্ছে এলা। এলা অপূর্বসুন্দরী। বিদ্রোহের মধ্যে দিয়ে এলার ছেলেবেলাটা কেটেছিল। মা ছিলেন বেহিসাবী মেজাজের লোক। কারণ্যে-অকারণে মেয়ের দোষ। ধরতেন। বলতেন, ‘তুই মিছে কথা বলছিস। অথচ অবিমিশ্র সত্যকথা বলাই এলার একটা ব্যসন-বিশেষ ছিল। বাবা ছিলেন বিলাত-শিক্ষিত সাইকোলজির অধ্যাপক। তীক্ষ্ণ বৈজ্ঞানিক বিচারশক্তির জন্য তাঁর ছিল সুনাম। কিন্তু সাংসারিক বিচারবুদ্ধি ছিল তাঁর কম। ভুল করে লোককে বিশ্বাস করা ও বিশ্বাস করে নিজের ক্ষতি করার বারবার অভিজ্ঞতাতেও তাঁর শোধন হয়নি। বিশ্বাসপরায়ণ ঔদার্যগুণে তার বাপকে কেবলই ঠকতে ও দুঃখ পেতে দেখে বাপের ওপর এলার ছিল ব্যথিত স্নেহ। নানা উপলক্ষে মায়ের কাছে বাবার অসম্মান দেখে এলা চোখের জলে রাত্রে তার বালিশ ভিজিয়ে ফেলত। একদিন এলা বাবাকে বলেছিল-’এরকম অন্যায় চুপ করে সহ্য করাই অন্যায়।‘ পিতা পুত্রীকে উত্তর দিয়েছিলেন—’স্বভাবের প্রতিবাদ করাও ষ, আর তপ্ত লোহায় হাত বুলিয়ে তাকে ঠাণ্ডা করতে যাওয়াও তাই।‘
পিতা দেখলেন। এইসব পারিবারিক দ্বন্দ্বে মেয়ের শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মেয়ে কলকাতার বোর্ভিঙে যেতে চাইল। বাবা পাঠিয়ে দিলেন। এল স্কুল-কলেজের সব পরীক্ষায় পাস করল। ইতিমধ্যে মাবাবা দু’জনেই মারা গেলেন। কাক ডাকবিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মচারী। ষ্ঠার ওপরই পড়ল এলার ভার। কাকীমা এলাকে ভাল চোখে দেখলেন। না। একদিন সেখানে নিমন্ত্রণে এল ইন্দ্ৰনাথ। দেশের ছাত্রসমাজের উপর ছিল তার অসীম আধিপত্য। এলা তাকে একটা কাজের কথা বলল। ইন্দ্ৰনাথ বলল-’কলকাতায় সম্প্রতি নারায়ণী হাইস্কুল মেয়েদের জন্য খোলা হচ্ছে। তোমাকে তার কত্ৰীপদ দিতে পারি। কিন্তু সংসারের বন্ধনে কোনদিন বদ্ধ হবে না, এই প্ৰতিজ্ঞ তোমাকে স্বীকার করতে হবে।‘ এলা রাজী হয়ে গেল।
নারায়ণী বিদ্যালয়ে এসে এলা পড়ল স্বদেশসেবার গোপন সাধনার আবর্তে। অনেক তরুণ ও তরুণীর সংস্পর্শে এল। আদর্শ ও প্ৰতিজ্ঞা অনুযায়ী ওদের কর্মপ্রয়াস চলতে লাগল। তারপর ওদের দলে এল অতীন্দ্র। অতীন্দ্রকে এলা ভালবেসে ফেলল। প্ৰতিদ্বন্দ্বী জুটল। বটু। ঈর্ষায় বটু অতীন্দ্রের নানারকম অনিষ্ট করার চেষ্টা করতে লাগল। শেষকালে করল বিশ্বাসঘাতকতা। অতীন্দ্রের দল একজায়গায় লুঠ করে আনল এক বুড়ির যথাসর্বস্ব। বুড়ি দলের একজনকে চিনতে পারায়, ওরা বুড়ির প্রাণান্ত করল। বটু পুলিশের কাছে সব ফাস করে দিল। ভোর রাতে পুলিশ আসবে অতীন্দ্রকে ধরতে। শেষরাত্রে অতীন এল এলার ঘরে; এল অতীন্দ্রের পা জড়িয়ে ধরে বলল –মারে, অামাকে অন্তু নিজের হাতে। তার চেয়ে সৌভাগ্য আমার কিছু হতে পারে না।‘ অতীনকে বার বার চুমু খেয়ে বলল-‘মারো, এইবার মারো।‘ ছিড়ে ফেলল বুকের জামা। বলল—‘একটুও ভেবো না অন্ত। আমি যে তোমার, সম্পূর্ণ তোমার—মরণেও তোমার। নাও আমাকে। নোংরা। হাত লাগাতে দিয়ে না। আমার গায়ে, আমার এ দেহ তোমার। ’
***
যদিও পাঁচখানা উপন্যাসই বীররসে সিক্ত, তা হলেও তাদের রচয়িতারা ছিলেন আদিরসের মহাকবি। বঙ্কিম, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্ৰনাথ সকলেই। বস্তুত আদিরসের মৈনাকভিত্তিক শৈলস্তম্ভে ধাক্কা খেয়েই বিপ্লবসমূহ ধ্বসে পড়েছিল।
শান্তি ও এলা যথাক্ৰমে বঙ্কিম ও রবীন্দ্ৰনাথের অনুপম সৃজন। দু’জনেই আশৈশব বিদ্রোহী; শান্তি অদৃষ্টবিপাকে, আর এলা পারিবারিক পরিবেশের প্রতিঘাতে। প্ৰফুল্ল ও শ্ৰী ভবিতব্যের শিকার। ভবিতব্য তাদের টেনে নিয়ে গিয়েছিল বিপ্লবের আবহের মধ্যে। সুমিত্ৰা ঘটনাপ্রবাহের অগ্নিবাহিকা। এদের সকলের চরিত্রেই লক্ষ্য করা যায়। বীররস ও অাদিরসের অপূর্ব সম্মিলন। বঙ্কিমের উপন্যাসসমূহে এই দুই রসের যুগল ধারা গঙ্গা-যমুনার মিলিত ধারার মতো পরম সৌখ্যতার বেণীবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সুললিত গতিতে প্ৰবাহিত। সুমিত্রার চরিত্রে আদিরসের ধারা স্তিমিত, কিন্তু এলার চরিত্রে পূর্ণমাত্রায় প্রস্ফুটিত। আবার শান্তির চরিত্র কৌতুকরসেরও পয়ঃকুম্ভ। এর নিদর্শন আমরা পাই বনমধ্যে ক্যাপ্টেন টমাসের সঙ্গে তার কথোপকথনে ও আশ্রমমধ্যে জীবানন্দের ঘরে জীবানন্দের সঙ্গে তার সংলাপে। কৌতুকরসের অবতারণায় প্ৰফুল্লর ভূমিকাও কম নয়। এর দৃষ্টান্ত আমরা পাই বজরার মধ্যে যখন ব্ৰজেশ্বরকে ধরে এনে সাগরের পা টেপানো হয়েছিল। বা লেফটানেণ্ট ব্রেন। ান ও হরিবল্লভকে ধরে এনে তাদের সঙ্গে প্ৰফুল্লর ইঙ্গিতে দিবা ও নিশার কৌতুকপূৰ্ণ তামাসায়। এসব নাটকীয় দৃশ্য রোমান্সের বিচিত্র রঙে রঞ্জিত হয়ে সুগ্ধ কমেডি-রসের সৃষ্টি করেছে।