তারপর রাত্ৰে সঁতারামের শয্যাগৃহে শ্ৰীর আবির্ভাব হয়। কিন্তু এ তো সে শ্ৰী নয়। যে শ্ৰীকে সীতারাম চেয়েছিল, এ সে নয়। এ সন্ন্যাসিনী শ্ৰী। সীতারাম বললেন- ‘এখন তুমি আমার মহিষী হইয়া রাজপুরী আলো কর।‘ শ্ৰী উত্তর দিল—’মহারাজ! নন্দার প্রশংসা বিস্তর শুনিয়াছি। তোমার সৌভাগ্য যে তুমি তেমন মহিষী পাইয়াছ। অন্য মহিষীর কামনা করিও না। যেদিন তোমার মহিষী হইতে পারলে আমি বৈকুণ্ঠের লক্ষ্মীও হইতে চাহিতাম না, আমার সেদিন গিয়াছে। আমি সন্ন্যাসিনী; সর্বকৰ্ম ত্যাগ করিয়াছি।‘ রাজা বললেন’তোমাকে দেখিলেই আমি সুখী হইব। ’ শ্ৰী বলল—’তুমি স্বামী, তুমি রাজা, তুমি উপকারী। তোমার আজ্ঞা শিরোধার্য। তবে আমাকে রাজপুরী মধ্যে স্থান না দিয়া আমাকে একটু পৃথক কুটির তৈয়ার করিয়া দিবেন।‘ শ্ৰী কিছুতেই রাজপুরী-মধ্যে থাকতে রাজী হল না। তখন ‘সীতারাম ‘চিত্তবিশ্ৰাম’ নামে এক ক্ষুদ্র অথচ মনােরম প্রমোদভবন শ্ৰীর নিবাসার্থ নির্দিষ্ট করিয়া দিলেন। শ্ৰী তাহাতে বাঘছাল পাতিয়া বসিল। রাজা প্ৰত্যহ তাহার সাক্ষাৎ জন্য যাইতেন। পৃথক আসনে বসিয়া তাহার সঙ্গে আলাপ করিয়া ফিরিয়া আসিতেন।‘ প্ৰথমে প্ৰহরেক থেকে চলে আসতেন, তারপর ক্রমশ রাত্রি বেশী হতে লাগল। তারপর চিত্তবিশ্রামেই নিজের সায়াহ্ন। আহার এবং রাত্রিতে পৃথক শয়নের ব্যবস্থা করলেন। রাজকাৰ্যে অমনোযোগী হলেন। রাজকর্মচারীরা চুরি করে রাজ্য দেউলিয়া করে দিল। এদিকে রাজা কর্তৃক অবহেলিত হয়ে রমার মৃত্যু ঘটল।
সন্ন্যাসিনী যে রাজার প্রথম স্ত্রী শ্ৰী, তা কেউই জানািল না। রাজ্যময় রটনা হল যে, সে রাজার উপপত্নী। কেউ বলল ডাকিনী, রাজাকে বশ করে রেখেছে।
রাজ্যময় বিশৃঙ্খলা প্ৰকাশ পেল। রাজ্য যায়-যায় অবস্থা। এমন সময় জয়ন্তী এসে শ্ৰীকে অন্যত্র সরিয়ে দিল। রাজা শ্ৰীকে না পেয়ে, জয়ন্তীকে বন্দী করলেন। ক্রুদ্ধ রাজা তাকে বিবসনা করে প্রকাশ্যে বেত্ৰাঘাতের আদেশ দিলেন। নন্দ ও অন্যান্য পুরনারীরা এসে জয়ন্তীকে ঘিরে দাঁড়াল। নন্দা বলল – ‘মহারাজ! আমি পতি-পুত্ৰবতী। আমি জীবিত থাকিতে তোমাকে কখনও এ পাপ করিতে দিব না। তাহ হইলে আমার কেহ থাকিবে না।‘
প্ৰজার রাজাকে ধিক্কার দিয়ে মহম্মদপুর ত্যাগ করতে লাগল। এসব খবর পেয়ে মুসলমানরা সীতারামের রাজ্য আক্রমণ করল। সেনাপতি মৃন্ময় মুসলমান সেনার হাতে নিহত হল! মুসলমানের লক্ষ্য যোদ্ধা। সীতারামের তখন একশতও নাই। সকলেই পলাতক। গত্যন্তর না দেখে সীতারাম সর্বাঙ্গে অস্ত্রদ্বারা শোভিত হয়ে বীরদৰ্পে মৃত্যুকামনায় একাকী দুৰ্গদ্বারাভিমুখে চললো। দুৰ্গদ্বারে গিয়ে দেখলেন, যে বেদীতে জয়ন্তীকে বোত্রাঘাতের জন্য আরূঢ় করেছিলেন, সেই বেদীতে কে বসে আছে। দেখলেন ত্ৰিশূল হস্তে গৈরিকভম্মরুদ্ৰাক্ষবিভূষিত ভৈরবীবেশে জয়ন্তী ও শ্ৰী। মঞ্চ হতে শ্ৰী নেমে সীতারামের চরণের ওপর পড়ে উচ্চস্বরে বলতে লাগল-’এই তোমার পায়ে হাত দিয়ে বলছি, আমি আর সন্ন্যাসিনী নই। আমার অপরাধ ক্ষমা কর। আমাকে আবার গ্ৰহণ কর।‘ সীতারাম বললেন- ‘তুমিই আমার মহিষী।‘ জয়ন্তী বলল –’আজ থেকে অনন্তকাল আপনারা উভয়ে জয়যুক্ত, হউন।‘ সীতারাম জয়ন্তীকে বললেন- মা, আমি তোমার কাছে অপরাধী, আমি বুঝেছি তুমি যথার্থ দেবী। আমায় বল তোমার কাছে কি প্ৰায়শ্চিত্ত করলে তুমি প্ৰসন্ন হও। ওই শোন মুসলমানের কামানের গর্জন। আমি ওই কামানের মুখে এখনই এই দেহ সমৰ্পণ করব। আর সময় নেই। তুমি বল কি করলে তুমি প্ৰসন্ন হও।‘ শ্ৰী বললো-’মহারাজ! আমি বা নন্দ। মরতে প্রস্তুত আছি। কিন্তু নন্দ ও রমার কতকগুলি পুত্রকন্যা আছে, তাদের রক্ষার কিছু উপায় করুন।‘ সীতারাম বললেন–’আমি নিরুপায়।‘ জয়ন্তী বলল-—‘মহারাজ, নিরুপায়ের এক উপায় আছে। আপনি ঐশ্বৰ্যমদে নিরুপায়ের সেই উপায়কে ভুলে গেছেন।‘ সীতারাম তখন নিরুপায়ের সেই উপায় ‘ঈশ্বরী’ চিন্তা করলেন। জয়ন্তী ও শ্ৰী মঞ্চের ওপর জানু পেতে সেই মহাদুর্গের চারদিক প্ৰতিধ্বনিত করে গগনবিদারী কলবিহঙ্গনিন্দী কণ্ঠে গেয়ে উঠল—’ত্বমাদিদেবঃ পুরুষঃ পুরাণত্ত্বমস্য বিশ্বস্য পরং নিধানম। বেত্তাসি বেদ্যঞ্চ পরঞ্চ ধাম ত্বয়া ততং বিশ্বমনস্তরূপ ॥’ যে ক’জন যোদ্ধা তুর্গমধ্যে ছিল, তারা সেই গীত শুনে অনুপ্ৰাণিত হল। তাদের সঙ্গে মহারাজ অগ্রসর হয়ে দুর্গের দ্বার খুলে দিলেন। সম্মুখেই ত্রিশূলধারিণী গৈরিকভস্মরুদ্রাক্ষবিভূষিত জয়ন্তী ও শ্ৰীকে দেখে শত্রুসৈন্য মন্ত্ৰমুগ্ধ ভুজঙ্গের ন্যায় নিশ্চল হয়ে গেল। শ্ৰী ও জয়ন্তী দ্রুতপদে এসে কামানের সামনে দাঁড়াল। হকচকিয়ে গোলন্দাজের হাত থেকে পলতে পড়ে গেল। সে কামান থেকে সরে দাঁড়াল। সীতারাম একলম্ফে এসে তার মাথা কেটে ফেললেন। দেখা গেল গোলন্দাজ আর কেউই নয়, স্বয়ং গঙ্গারাম; শ্ৰী সহোদরেরই প্রাণঘাতিনী হল। এইভাবে বিধিলিপি ফলল ৷ জয়ন্তী ও শ্রী আর সীতারামের সঙ্গে দেখা করল না। সেই রাত্রে তারা কোথায় অন্ধকারে মিলিয়ে গেল কেউ জানল না।
***
‘পথের দাবী’তে ঘটনা অপেক্ষা সংলাপের বাহুল্যই বেশি। সংলাপ সবই ‘বিপ্লব’ সম্পর্কিত। অপূর্ব বাঙলাদেশের ছেলে। চাকরির সন্ধানে ব্ৰহ্মদেশে গিয়ে যে বাসায় আশ্রয় নিয়েছে, তার ওপরতলার বাসিন্দা এক ক্রীশ্চন পরিবারের সঙ্গে তার ঝগড়া হয়। ঝগড়া আদালত পৰ্যন্ত গড়ায়। অপূর্ব নিগৃহীত হয়। কিন্তু পরে ওই পরিবারের মেয়ে ভারতী তার প্রতি প্ৰণয়াসক্ত হয়। অপূর্ব পাঁচশত টাকা মাহিনায় বোথা কোম্পানীর ম্যানেজার নিযুক্ত হয়। ভারতীর মাধ্যমে অপূর্ব বিপ্লবী ‘পথের দাবী’ দলের সভানেত্রী সুমিত্রার সংস্পর্শে আসে। সুমিত্রার পিতা ছিলেন একজন বাঙালী ব্ৰাহ্মণ, সুরভায়া রেল স্টেশনে চাকরি করতেন। মা ছিলেন একজন ইহুদী মহিলা। সুমিত্রার শিক্ষাদীক্ষা সবই মিশনারী স্কুলে। সুমিত্ৰা অসামান্য সুন্দরী। পিতার মৃত্যুর পর চোরা অহিফেন কারবারীদের প্রভাবে পড়ে। তারা সুমিত্ৰাকে নিযুক্ত করে রেলপথে অহিফেনের পেটিক এক জায়গা থেকে অপর জায়গায় স্থানান্তরিত করত। একবার এক রোল-স্টেশনে সে অহিফেনের পেটিকা সমেত পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। সেখানে পথের দাবী দলের নেতা সব্যসাচী সুমিত্রাকে স্ত্রী বলে স্বীকার করে ও ওই অহিফেন-পেটিকার স্বত্ব অস্বীকার করে। সুমিত্ৰা মুক্তি পায়। কিন্তু অহিফেনের চোরা কারবারীদের দল তাদের পিছন নেয়। এক হোটেলের ওপরতলার ঘরে অবস্থান করছিল সুমিত্ৰা, আর নীচের তলার ঘরে সব্যসাচী। সেখানে চোরাকারবারী দলের আট-দশজন দুর্দান্ত প্ৰকৃতির লোক এসে সুমিত্ৰাকে স্ত্রী বলে দাবী করে। সুমিত্ৰা তাদের অস্বীকার করে। পরদিন রাত্রে তারা সুমিত্রাকে বলপূর্বক অপহরণ করতে আসে। কিন্তু সব্যসাচীর গুলিতে তারা আহত ও দু-একজন নিহত হয়। সব্যসাচী বেপরোয় নিৰ্ভীক বিপ্লবী। সে বহুরূপী। পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে সে জাপান থেকে জাভা পর্যন্ত সমগ্ৰ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিপ্লবী দল গঠন করে। সুমিত্ৰাকে চোরাচালানীরা সহজে ছাড়বে না এবং প্ৰতিশোধ নেবে এই চিন্তা করে সব্যসাচী তাকে ব্ৰহ্মদেশে নিয়ে আসে এবং সেখানে দল গঠনের কাজে তাকে নিযুক্ত করে। ভারতীকে সে সহায় পায় এবং তাকে নিয়ে সে ব্ৰহ্মদেশের কলকারখানার মজুরদের নিয়ে দল গঠন করবার সঙ্কল্প করে। কলকারখানার শোষিত মজুরদের দীন-হীন অবস্থা ও পশুর মতো জীবনযাত্ৰা তাদের সহায়ক হয়। ভারতীর মাধ্যমে অপূর্বও পথের দাবী দলে যোগ দেয়। দলের প্ৰথম দিনের সভায় অপূর্বই হয় প্রধান বক্তা। জনসভায় অপূর্ব কখনও এর আগে বক্তৃতা দেয়নি। কিন্তু প্ৰথম দিনের সাফল্য সম্বন্ধে সুমিত্রার কাছ থেকে প্ৰশংসাসূচক চিঠি পেয়ে, সে দ্বিতীয় দিনের সভার বক্তৃতার মহড়া দিতে থাকে তার অফিসে } এটা লক্ষ্য করে অফিসে তার প্রিয় বন্ধু চীফ অ্যাকাউণ্টটেণ্ট রামদাস তালওয়ার। অপূর্ব তাকে সব কথা বলে। তখন সে জানল যে তালওয়ারও একজন পাকা বিপ্লবী। ভারতে সে জেলও খেটেছে। তালওয়ার এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেয়। রাজদ্রোহের অপরাধে সে গ্রেপ্তার হয়। নিজের চাকরির নিরাপত্তার জন্য অপূর্ব পুলিশের কাছে পথের দাবী দল সম্বন্ধে সব কথা বলে। পথের দাবীর দল তাই জেনে অপূর্বকে ধরে নিয়ে যায়। তার বিচারের জন্য। ভারতীকে সেখানে ডেকে পাঠানো হয়। ভারতী সেখানে গিয়ে দেখে যে বিচারকমণ্ডলীর সভানেত্রী সুমিত্ৰা। সব্যসাচীও সেখানে উপস্থিত। আরও উপস্থিত ব্ৰজেন্দ্ৰ নামে একজন কুৎসিত দুর্ধর্ষ প্রকৃতির লোক। বিচারে রায় দেওয়া হয় ‘ডেথ’। ব্রজেন্দ্র অপূর্বক মেরে এক পুরাতন কুপের মধ্যে ফেলে মাটি চাপ। দেওয়ার জন্য প্ৰস্তুত হয়। ভারতীর সজলনয়নের দিকে তাকিয়ে সব্যসাচীর মন টলে। পিস্তল দেখিয়ে সে দুর্ধর্ষ ব্ৰজেন্দ্রকে নিরস্ত করে। অপূৰ্বকে মুক্তি দেয়, এবং তিনদিনের মধ্যে ব্রহ্মদেশ ত্যাগ করে নিজের দেশে ফিরে যেতে আদেশ দেয়। দেশে ফিরে অপূর্ব দেখে মা অন্তিমশয্যায় শায়িত, ও অন্য পুত্ৰগণ কর্তৃক অবহেলিত। মাকে নিয়ে অপূৰ্ব আবার ব্ৰহ্মদেশে ফিরে যায়। ভারতীর সঙ্গে দেখা করতে যায়। কিন্তু অপূৰ্বর আচরণে ভারতী তখনও ক্ষুব্ধ। সে অপূৰ্বর সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকৃত হয়। কিন্তু বিকালে সে যখন দাসীর মুখে অপূৰ্বর মায়ের মৃত্যুসংবাদ পায়, তখন সে নিজেই ছুটে যায় অপূৰ্বর বাসায়। অপূৰ্বকে সে নিজ বাসায় নিয়ে আসে।