উপসংহারে বঙ্কিম বলেছেন–‘রঙ্গরাজ, দিবা ও নিশি দেবীগড়ে শ্ৰীকৃষ্ণচন্দ্রের প্রসাদ ভোজনে জীবন নিৰ্বাহ করিয়া পরলোক গমন করিলেন। ভবানী ঠাকুরের অদৃষ্টে সেরূপ ঘটিল না। ইংরেজ রাজ্যশাসনের ভার গ্ৰহণ করিল। রাজ্য সুশাসিত হইল। সুতরাং ভবানী ঠাকুরের কাজ ফুরাইল। দুষ্টের দমন রাজাই করিতে লাগিল। ভবানী ঠাকুর ডাকাইতি বন্ধ করিলেন। তখন ভবানী ঠাকুর মনে করিলেনআমার প্রায়শ্চিত্তের প্রয়োজন। এই ভাবিয়া ভবানী ঠাকুর ইংরেজকে ধরা দিলেন, সকল ডাকাইতি একরার করিলেন, দণ্ডের প্রার্থনা করিলেন। ইংরেজ হুকুম দিল, যাবজীবন দ্বীপান্তর বাস। ভবানী পাঠক প্ৰফুল্লচিত্তে দ্বীপান্তরে গেল। প্ৰফুল্পকে সম্বোধন করে বঙ্কিম বলেছেন : ‘একবার এই সমাজের সম্মুখে দাঁড়াইয়া বল দেখি, আমি নূতন নহি, আমি পুরাতন। আমি সেই বাক্যমাত্র; কতবার আসিয়াছি, তোমরা আমায় ভুলিয়া গিয়াছ, তাই আবার আসিলাম—‘পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম। ধর্মসংস্থাপনার্থীয় সম্ভবামি যুগে যুগে’।।‘
***
শ্ৰী ভূষণার জমিদার সীতারাম রায়ের স্ত্রী। বিবাহের দু-চারদিন পরে সে স্বামী কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়েছিল, কেননা তার নষ্টকোষ্ঠী উদ্ধারের পর প্রকাশ পেয়েছিল যে-তার কোষ্ঠীতে বলবান চন্দ্র স্বক্ষেত্রে অর্থাৎ কর্কট রাশিতে থেকে শনির ত্ৰিংশাংশগত হয়েছিল, যার ফলে সে প্রিয়প্ৰাণহস্ত্রী হবে। স্বামী-পরিত্যক্ত হয়ে তাকে মাতৃ-আলয়েই ফিরে আসতে হয়েছিল। মাতৃ-অ্যালয়ে বিধবা মা, সে ও ভাই গঙ্গারাম। মার অন্তিমকালে গঙ্গারাম রাত্রিকালে বেরিয়েছেন কবিরাজ ডাকতে। সরু পথের ওপর আড়াআড়িভাবে এক ফকির শুয়ে ছিল। গঙ্গারামের শত অনুরোধ সত্ত্বেও সে যখন তাকে পথ দিল না, গঙ্গারাম তখন তাকে ডিঙিয়ে যেতে গিয়ে তার গায়ে নিজের পা ঠেকিয়ে ফেলে। ফকির কাজীর কাছে গিয়ে নালিশ করে। কাজী গঙ্গারামকে জীবন্ত কবর দেবার আদেশ দেয়। পরদিন মায়ের সৎকার করে গঙ্গারাম যখন বাড়ি ফিরাছিল, ফৌজদারের পেয়াদা এসে তাকে ধরে নিয়ে যায়। শ্ৰী এই বিপদে বহুকাল পরে সীতারামের কাছে যায় ও গঙ্গারামকে রক্ষা করবার প্রার্থনা জানায়। বহুদিন পরে শ্ৰীকে দেখে সীতারামের মন টলে। সীতারাম গঙ্গারামকে বঁাচাবার প্রতিশ্রুতি দেয়। পরদিন ‘গঙ্গারামকে জীবন্ত কবর দেবার জন্য যথাস্থানে নিয়ে আসা হয়। জীবন্ত মানুষের কবর দেখবার জন্য লোকে লোকােরণ্য হয়। এদিকে শ্ৰীকে প্ৰতিশ্রুতি দেবার পর সীতারাম গঙ্গারামকে বঁাচাবার জন্য তার গুরুদেব চন্দ্রচূড় তর্কালঙ্কার ও বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে। যেখানে কবর দেওয়া হয়, সেখানে এক গাছের উপর উঠে বসলেন চন্দ্রচূড় ও নিচে গাছের দুই শাখার উপর দাড়িয়ে রইল লাল শাড়ি পরা শ্ৰী। কবর দেওয়ার জন্য যেখানে মাটি খোড়া হয়েছিল, সেখানে গঙ্গারামকে কবরের মধ্যে ফেলবার ঠিক পূৰ্বমুহুর্তে এসে উপস্থিত হল। অশ্বারোহণে সীতারাম। অশ্ব থেকে অবরোহণ করে। সীতারাম কাজী ও ফকিরের কাছে ছুটে গেল। প্রার্থনা করল, যেকোন মূল্যে, এমনকি তার নিজের প্রাণের পরিবর্তে গঙ্গারামের প্ৰাণভিক্ষা। কিন্তু প্রার্থনা মঞ্জুর হল না। এমন সময় কামার (যে রাত্রিশেষে চন্দ্রচূড় ঠাকুরের কাছ থেকে কিছু টাকা খেয়েছিল) কাজী সাহেবকে বলল-’আজিকাল ভাল লোহা পাওয়া যাচ্ছে না; রাজ্যে দুস্কৃতকারীদের সংখ্যা বাড়ছে, আমি আর হাতকড়া ও পায়ের বেড়ি যোগাতে পারছি না। যদি হুকুম দেন তো কয়েদীকে কবরে গাড়বার আগে হাতকড়া ও পায়ের বেড়ি খুলে নিই; সরকারী হাতকড়া ও বেড়ির লোকসান হবে কেন? হাতকড়া ও বেড়ি খুলে নেবার হুকুম হল। মুক্ত হয়ে গঙ্গারাম একবার এদিক-ওদিক চাইল। তারপর চকিতের মধ্যে সীতারামের হাত হতে চাবুক কেড়ে নিয়ে, একলাফে সীতারামের ঘোড়ায় চেপে সেই জনারণ্য থেকে বেরিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে গেল। সিপাহীরা তার পিছনে ছুটতে গেল। কিন্তু কালান্তক যমের মতো কতকগুলি বলিষ্ঠ অস্ত্ৰধারী হিন্দু এসে তাদের পথরোধ করল। হিন্দু ও মুসলমানে ঘোরতর দাঙ্গা লাগল। এমন সময় হিন্দুরা দেখল গাছের উপর লাল শাড়ি পরে দাড়িয়ে চণ্ডীর মতো এক দেবী শাড়ির আঁচল ঘুরিয়ে বলছেন—’মার, মার’। সকলেই বলল ‘চণ্ডী এসেছেন, চণ্ডীর হুকুম মার, মার, মার, জয় চণ্ডিকে’। নিমেষের মধ্যে হিন্দুদের জয় হল, মুসলমানরা পালাল, ফকিরের মুণ্ডচ্ছেদ হল। বিদ্রোহদমনার্থ ফৌজদার কামান গোলাগুলি নিয়ে আসছে শুনে, লোকেরা সব সরে পড়ল। সীতারাম শ্ৰীকে নিয়ে, গঙ্গারাম যেখানে ছিল সেখানে এসে গঙ্গারামকে বলল, ‘তুমি বড় নদী পার হয়ে ভূষণার বাইরে আমার জমিদারী শ্যামপুরে চলে যাও। আমি তোমার ভগিনীকে নিয়ে সেখানে যাচ্ছি। ’ পথিমধ্যে শ্ৰী বলল—’আমি কুলটা নই, জাতিভ্ৰষ্টাও নই, তোমার সহধর্মিণী, তুমি যখন আমাকে ত্যাগ করেছ, তখন আমি তোমার সঙ্গে যাব না।‘ শ্ৰী আগুহিতা হয়ে গেল। শ্ৰী শ্ৰীক্ষেত্রের পথ ধরল। পথে বৈতরণীতীরে তার সমবয়স্ক এক অপরূপ লাবণ্যময়ী সন্ন্যাসিনীর সঙ্গে দেখা হল। নাম তার জয়ন্তী ৷ জয়ন্তীর প্রভাবে শ্ৰীও সন্ন্যাসিনী হল। এদিকে সীতারাম শ্যামপুরে এসে এক নগর নির্মাণ, করল। সেখানে হিন্দুরাজ্য স্থাপন করল। ভূষণ এবং নিকটস্থ অঞ্চলের হিন্দুরা সেখানে এসে বসবাস ও দোকানপাট স্থাপন করল। মুসলমানদের রোষ এড়াবার জন্য সীতারাম নগরের নাম দিল মহম্মদপুর। গঙ্গারামকে সে কোতোয়াল নিযুক্ত করল, আর মৃন্ময় নামে এক ব্যক্তিকে সৈন্যধ্যক্ষ করল। দিন দিন সীতারামের রাজ্য বাড়তে লাগল। সীতারাম চিন্তা করল দিল্লির বাদশাহের কাছ থেকে ‘রাজা’ উপাধি না পেলে, তার রাজ্যের স্বীকৃতি নেই। সেই কারণে সীতারাম দিল্লি যাত্রা করল। শ্রীকে পরিত্যাগের পর সীতারাম আরও দুই বিবাহ করেছিল,—রানী নন্দ ও রানী রম! সীতারামের দিল্লীযাত্রার অনুপস্থিতিতে গঙ্গারাম কনিষ্ঠ রানী রামার রূপলাবণ্যে আকৃষ্ট হয়ে তাকে পাবার জন্য দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হল। এদিকে সীতারামের অনুপস্থিতিতে মুসলমানরা সীতারামের রাজ্য আক্রমণ করবার পরিকল্পনা করল। রামাকে পাবার জন্য গঙ্গারাম বিশ্বাসঘাতকতা করে মুসলমানদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হল। স্থির হল গঙ্গারাম এমন ব্যবস্থা করবে যাতে মুসলমানরা বিনা প্রতিরোধে সীতারামের রাজ্য জয় করতে পারে এবং পুরস্কারস্বরূপ পাবে রামাকে। আক্রমণের আগের দিন মহম্মদপুরে আবির্ভূত হল ত্রিশূলধারিণী ভৈরবীবেশে শ্ৰী ও জয়ন্তী! জয়ন্তী গঙ্গারামের কক্ষে গিয়ে উপস্থিত হল। গঙ্গারাম তাকে দেবী ভেবে ভয় পেয়ে গেল! জয়ন্তীর নির্দেশমতো তাকে দিল কিছু কামান, গোলাবারুদ ও একজন দক্ষ গোলন্দাজ। এদিকে মৃন্ময়কে বলল যে মুসলমানরা দক্ষিণের পথে আক্রমণ করতে আসছে। মৃন্ময় সৈন্য নিয়ে, নগর অরক্ষিত রেখে, সেইদিকে রওনা হল। কিন্তু গঙ্গারামের পরামর্শ অনুযায়ী মুসলমানরা সৈন্যসামন্ত নিয়ে উত্তরদিকে ঠিক নগরের বিপরীত তীরের ঘাটে হাজির হয়। নৌকাযোগে মুসলমান সিপাহীরা নদী পার হতে শুরু করে। হঠাৎ নদীর এপার থেকে আওয়াজ হল ‘গুডুমী’। আবার ‘গুডুমা, আবার ‘গুডুম’। নদীবক্ষে সিপাহী-বোঝাই নৌকাসমূহ ধ্বংস হল। মুসলমান সৈন্য পালাল। হিন্দুদের জয়জয়কার। বলা বাহুল্য, গোল বারুদ কামান সবই জয়ন্তী কর্তৃক পুর্বরাত্রে গঙ্গারামের কাছ থেকে সংগৃহীত, আর গোলন্দাজ স্বয়ং সীতারাম। দিল্লী থেকে ফিরে আসামাত্রই নদীর ঘাটে জয়ন্তীর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়েছিল। সীতারাম নিজ রাজ্যে ফিরে এসে প্ৰথমেই গঙ্গারামকে বন্দী করেন। এদিকে দেশের মধ্যে গঙ্গারাম ও ছোট রানীকে নিয়ে নানারকম রটনা হতে থাকে। নিরপরাধিনী রমা প্ৰাণত্যাগ করতে চাইল। নন্দার অনুরোধে সীতারাম বিচার আহবান করলেন। অনেকেই গঙ্গারামের বিপক্ষে এবং রম যে নিরপরাধিনী সে-বিষয়ে সাক্ষ্য দিল। রামাও প্ৰকাশ্য দরবারে এসে সাক্ষ্য দিল। গঙ্গারাম সকলের সাক্ষী অস্বীকার করল। সভায় জয়ন্তীর আবির্ভাব ঘটল। জয়ন্তী এসে গঙ্গারামের বুকে ত্ৰিশূল রেখে, তাকে সত্য কথা বলতে বলল। গঙ্গারাম জয়ন্তীকে দেবী ভেবে সত্য কথা বলল। গঙ্গারামকে শূলে দেবার আদেশ হল। কিন্তু জয়ন্তী সীতারামের কাছে তার প্রাণভিক্ষা চাইল। জয়ন্তীকে রাজলক্ষ্মী ভেবে সীতারাম বললেন-গ্ৰী নামে আমার প্রথম মহিষী আমার জীবনস্বরূপ। আপনি দেবী, সব দিতে পারেন। আমার জীবন আমায় দিয়া, সেই মূল্যে গঙ্গারামের জীবন ফিরিয়া লউনা।‘ জয়ন্তী বলল-’মহারাজ! আপনি আজ অন্তঃপুর-দ্বার সকল মুক্ত রাখিবেন, আর অন্তঃপুরের প্রহরীদিগকে আজ্ঞা দিবেন, ত্ৰিশূল দেখিলে যেন পথ ছাড়িয়া দেয়। আপনার শয্যাগৃহে আজ রাত্ৰিতেই মূল্য পৌছিবে। গঙ্গারামের মুক্তির হুকুম হউক।‘ গঙ্গারাম মুক্তি পায়, এবং তৎক্ষণাৎ রাজ্য ত্যাগ করে।