এরপর চলল প্ৰফুল্পর জীবনের ক্রান্তিপর্ব। কঠোর নিয়মানুবর্তিতার ভিতর দিয়ে প্ৰফুল্পর পরবর্তী পাঁচ বৎসর অতিবাহিত হল। প্ৰফুল্লর সঙ্গে থাকবার জন্য দুজন শ্ৰীলোক দেওয়া হল। একজন গোবরার মা, সে মাত্র হাটবাজার করে। আর একজন নিশি, সে প্ৰফুল্পর সখীরূপে রইল। প্রফুল্ল নিরক্ষর ছিল। নিশি তাকে বর্ণশিক্ষা, হস্তলিপি, কিঞ্চিৎ শুভঙ্করী আঁক শিক্ষা দিল। পরে ভবানী ঠাকুর তাকে ভট্টি, রঘু, কুমার, নৈষধ, শকুন্তলা প্ৰভৃতি পড়ালেন। তারপর সাংখ্য, বেদান্ত, ন্যায়, যোগশাস্ত্র ও শ্ৰীমদ্ভগবদগীতা। অশনে-বসনেও প্রফুল্পকে নিয়মামুবর্তিতার ভিতর দিয়ে চলতে হল। প্ৰথম বৎসর তার আহার মোটা চাউল, সৈন্ধব, ঘি ও কঁচকলা। দ্বিতীয় বৎসরেও তাই। তৃতীয় বৎসরে নুন, লঙ্কা ও ভাত। চতুর্থ বৎসরে প্রফুল্লর প্রতি উপাদেয় ভোজ্য খাইতে আদেশ হইল, কিন্তু প্ৰফুল্ল প্ৰথম বৎসরের মতো খাইল। পরিধানে প্ৰথম বৎসর চারিখানা কাপড়, দ্বিতীয় বৎসরে দুইখানা, তৃতীয় বৎসরে গ্ৰীষ্মকালে মোটা গড়া, অঙ্গে শুকাইতে হয়, শীতকালে একখানি ঢাকাই মলমল অঙ্গে শুকাইয়া লইতে হয়। চতুর্থ বৎসরে পাট কাপড়, ঢাকাই কলকাদার শান্তিপুৱী। প্ৰফুল্ল সে-সকল ছিড়িয়া খাটাে করিয়া পরিত। পঞ্চম বৎসর বেশ ইচ্ছামতো। প্ৰফুল্ল মোটা গড়াই বাহাল রাখিল ৷ মধ্যে মধ্যে ক্ষারে কাচিয়া লইত! কেশবিন্যাস ও শয়ন সম্বন্ধেও এইরূপ কঠোর বিধানের ভিতর দিয়া প্ৰফুল্ল তার ধর্ম, কর্ম, সুখ, দুঃখ সবই শ্ৰীকৃষ্ণকে সমর্পণ করল। ভবানী ঠাকুর বললেন’এদেশে রাজা নাই। মুসলমান লোপ পাইয়াছে। ইংরেজ সম্প্রতি ঢুকিতেছে—তাহার রাজ্যশাসন করিতে জানে না, করেও না। আমি দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন করি। এ জঙ্গলে ডাকাইতি করে ধর্মাচারে প্ৰবৃত্ত থাকি।‘
প্ৰফুল্ল ভবানী ঠাকুরের অনুগত শিষ্য হয়ে ধর্মাচরণে প্ৰবৃত্ত হল। নূতন নাম হল দেবী চৌধুরাণী। নিপীড়িত, অত্যাচারিত, দুঃখী লোকদের কাছে রানীমা নামে পরিচিত হল। দু’হাতে তাদের ধন বিলাতে লাগল।
ইজারাদার দেবীসিংহের অত্যাচারে দেশ প্ৰপীড়িত। একবার হরবল্লভের তালুক হতে টাকা চালান আসছিল। ডাকাতের তা লুঠে নিল। সেবার দেবীসিংহের খাজনা দেওয়া হল না। হরিবল্লাভের দশ ‘ হাজার টাকা মূল্যের একখানা তালুক দেবীসিংহ আড়াইশত টাকায় নিজে কিনে নিল। তাতে বাকী খাজনার কিছুই পরিশোধ হল না, দেনার জের চলল। দেবীসিংহের পীড়াপীড়িতে কয়েদের আশঙ্কায় হরিবল্লভ আর একটা সম্পত্তি বন্ধক দিয়ে ঋণ পরিশোধ করল। আবার দেবীসিংহের পঞ্চাশ হাজার টাকা বাকী পড়ল। হরিবল্লভ রায়কে গ্রেপ্তার করবার পরওয়ানা বের হল। পুত্ৰ ব্ৰজেশ্বরের মধ্যম স্ত্রী সাগরের পিতা ধনীলোক! বাপকে গ্রেপ্তারের হাত থেকে বঁাচাবার জন্য ব্ৰজেশ্বর শ্বশুরের কাছে গেল। টাকার ব্যাপার নিয়ে কথা কাটাকাটি হল। শ্বশুর রুক্ষভাবে বললেন—’তোমার বাপ বাঁচলে আমার মেয়ের কি? আমার মেয়ের টাকা থাকলে দুঃখ ঘুচবে-শ্বশুর থাকলে দুঃখ ঘুচিবে না।‘ ব্ৰজেশ্বর রাগ করে চলে যাচ্ছে দেখে শাশুড়ী জামাইকে ডাকলেন। তিনি জামাইকে অনেক বুঝালেন, কিন্তু জামাইয়ের রাগ পড়ল না। তারপর সাগরের পালা, সাগব ব্ৰিজেশ্বরের পায়ে পড়তে গেল। ব্ৰজেশ্বর তখন রাগে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য। পা টানতে গিয়ে সাগরের গায়ে লাগল। সাগর বলল—’তুমি আমায় লাথি মারবে নাকি?’ কুপিত ব্ৰজেশ্বর বলল—’যদি মারিয়াই থাকি? তুমি না হয় বড়মানুষের মেয়ে, কিন্তু পা আমার-তোমার বড়মানুষ বাপও এ পা একদিন পূজা করিয়াছিলেন।‘ সাগর রাগে জ্ঞান হারাল। বলল—’ঝকমারি করেছিলেন। আমি তার প্রায়শিচত্ত করব। ’ ব্ৰজেশ্বর বলল-’পালটে লাথি মারবে নাকি?’ সাগর বলল-’আমি তাত অধম নই। কিন্তু আমি যদি বামুনের মেয়ে হই, তবে তুমি আমার পা—’। এমন সময় পিছনের জানালা হতে কে বলল-’আমার পা কোলে নিয়ে চাকরের :মত টিপে দিবে। ’ ব্ৰজেশ্বর চলে গেল। পিছনের জানালা হতে যে কথা বলেছিল, সে এখন ঘরে প্রবেশ করল। সাগর জিজ্ঞাসা করল-’তুমি কে? স্ত্রীলোক, উত্তর দিল—’আমি দেবী চৌধুরাণী’। নাম শুনে সাগর প্রথম ভয় পেল। কিন্তু পরমুহুর্তে প্ৰফুল্পকে চিনতে পারল। প্ৰফুল্ল সাগরকে নিজ বজরায় নিয়ে গেল।
দেবী চৌধুরাণী নিজ বজরায় ফিরে এসে অমুচর রঙ্গরাজকে আদেশ দিল ব্ৰজেশ্বরকে বজরায় ধরে নিয়ে আসতে। আদেশমতে ব্ৰজেশ্বরকে বজরায় ধরে নিয়ে আসা হল। পর্দার আড়াল থেকে দেবীর সঙ্গে তার কথা হল। ব্ৰজেশ্বর মুক্তিপণ জানতে চাইল। উত্তর-’এক কড়া কানাকড়ি’ ৷ ব্ৰজেশ্বর কানাকড়ি দিতে পারল না। তখন কামরার ভিতরে আর-এক স্ত্রীলোক বলল-’রানীজি, যদি এক কড়া কানাকড়িই এই মানুষটার দর হয়, তবে আমি এক কড়া কানাকড়ি দিচ্ছি। আমার কাছে ওকে বিক্রয় করুন।‘ ব্ৰজেশ্বর ভিতরে প্রবেশ করে দেখল, যে স্ত্রীলোক তাকে কিনল সে মসনদের ওপর শুয়ে আছে। –তার মুখের ওপর একখানা বড় মিহি জরির বুটাদার ঢাকাই রুমাল ফেলা। তার আদেশমতে ব্ৰজেশ্বর তার পা টিপতে লাগল। তারপর রুমালখানা সরাবার পর ব্ৰজেশ্বর দেখল সে-স্ত্রীলোক আর কেউই নয়, সাগর। সাগরের প্রতিজ্ঞারক্ষা হল। ব্ৰজেশ্বর বিস্মিত হল। সাগর বলল-’দেবী চৌধুরাণী তার সম্পর্কিত বোন। তারপর ব্রজেশ্বরকে দেবী চৌধুরাণীর কাছে নিয়ে যাওয়া হল। ব্ৰজেশ্বর আবার বিস্মিত হল। প্ৰফুল্লর সঙ্গে তার সাদৃশ্য লক্ষ্য করল। দেবী ব্ৰজেশ্বরকে এক কলসী মোহর দিল, যার মূল্য পঞ্চাশ হাজার টাকার ওপর; দেবী বলল-’টাকা আমার নয়, টাকা দেবতার, দেবত্র সম্পত্তি থেকে এ টাকা আপনাকে কার্জ দিচ্ছি।‘ দেবী বলল-’আগামী বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের সপ্তমীর রাত্রে এই ঘাটে টাকা আনবেন।‘ দেবী উপহারস্বরূপ ব্ৰজেশ্বরকে একটা আংটি দিল। ফেরবার পথে ব্ৰজেশ্বর আংটি পরীক্ষা করে দেখল ‘এ ংটি, তারই আংটি, প্ৰফুল্পকে সে-ই এই আংটি দিয়েছিল। আংটিটা তার অভিজ্ঞান বা ‘আইডেন্টিটি’র সূত্র হয়ে দাঁড়াল। ব্রজেশ্বরের মারফত টাকা পেয়ে হরিবল্লভ খুশী হল। কিন্তু টাকা শোধ করবার উদ্যোগ করল না। ভাবল—’বৈশাখী শুক্ল সপ্তমীতে যদি দেবীকে ধরিয়ে দিতে পারি, তা হলে টাকাও শোধ করতে হবে না, বরং ইংরেজদের কাছ থেকে কিছু পুরস্কার পাওয়া যাবে।‘ সেরূপই উদ্যোগ করল। পিতা ঋণ পরিশোধের কোনরূপ উদ্যোগ করছেন না। দেখে, নির্দিষ্ট দিনে ব্ৰজেশ্বর আরও কিছু সময় প্রার্থনার জন্য দেবীর বজরায় এসে হাজির হল। এদিকে হরিবল্লাভের কথামতো ইংরেজরা বৈশাখী শুক্লা সপ্তমীতে দেবীকে ধরবার জন্য পাঁচশত সিপাহী সমেত লেফটানেণ্ট ব্রেনানকে পাঠিয়ে দিল। দেবী প্ৰথমে নিজেকে ধরা দেওয়াই সিদ্ধান্ত করেছিলেন। নিজের দলের সমস্ত লোককে তিনি বিদায় দিলেন।‘একটা মেয়ে মানুষের প্রাণের জন্য এত লোক তোমরা মরিবার বাসনা করিয়াছ—তোমাদের কি কিছু ধৰ্মজ্ঞান নাই? অামার পরমায়ু শেষ হইয়া থাকে, আমি একা মরিব—আমার জন্য এত লোক মরিবে কেন? অামায় কি তোমরা এমন অপদার্থ ভাবিয়াছ যে আমি এত লোকের প্রাণ নষ্ট করিয়া আপনার প্রাণ বঁাচাইব।‘ কিন্তু ঘটনাচক্রে ও ভগবানের ইচ্ছায় কালবৈশাখীর ঝড় উঠে দেবীর সব সিদ্ধান্ত ওলট-পালট করে দিল। ইংরেজ সৈন্য ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। দেবীর মরা হল না। দেবী ব্ৰজেশ্বরের সঙ্গে আবার নিজ শ্বশুরবাড়িতে ‘নতুন বৌ’ হিসাবে ফিরে এল।