শীঘ্রই বিদ্রোহ দমন করবার জন্য ক্যাপ্টেন টমাসের অধীনে ইংরেজের ফৌজ এসে হাজির হল। বনমধ্যে টমাসের সঙ্গে শাস্তির দেখা হল। টমাস জিজ্ঞাসা করল-’তুমি কে?’ শান্তি উত্তর দিল।‘আমি সন্ন্যাসী’। টমাস বলল-’তুমি rebel। আমি তোমায় গুলি করিয়া মারিব।‘ বিদ্যুদ্বেগে শান্তি তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তার হাত থেকে বন্দুক কেড়ে নিল। শান্তি বলল–’সাহেব আমি স্ত্রীলোক, কাহাকেও আঘাত করি না। তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতেছি, হিন্দু-মুসলমানে মারামারি হইতেছে, তোমরা মাঝখানে কেন?’ তারপর ইংরেজের সঙ্গে সন্ন্যাসীদের যুদ্ধ হল। শান্তিও যুদ্ধে গেল, কিন্তু অলক্ষ্যে রইল। যুদ্ধে ইংরেজ সৈন্য পরাহত হল। সন্তানরা উচ্চনিনাদে গাইল-’বন্দে মাতরম’।
***
রাষ্ট্রীয় বিপ্লবে শান্তি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সম্পূর্ণ প্ৰস্তুতি নিয়ে। সে টোলে পড়েছিল, শাস্ত্ৰ অনুশীলন করেছিল, শারীরিক ব্যায়ামে দক্ষতালাভ করেছিল। প্ৰফুল্লর ক্ষেত্রে এসব কিছুই ছিল না। সে সম্পূর্ণ নিরক্ষরা ছিল। বিধবার সে একমাত্ৰ অনিন্দ্যসুন্দরী রূপসী মেয়ে ছিল। তার রূপের জন্যই ভূতপুরের জমিদার হরিবল্লভ, তাঁর পুত্ৰ ব্ৰজেশ্বরের সঙ্গে তার বিবাহ দিয়েছিলেন। কিন্তু তার অদৃষ্ট সুখ ছিল না। বড়ঘরে বিবাহ হচ্ছে বলে তার মা যথাযথ মৰ্যাদা রাখবার জন্য নিজের যাবতীয় সম্পত্তি বিক্রয় করে বিবাহের রাত্রে বরযাত্রীদের যথোচিত সমাদরের সঙ্গে উপযুক্ত আহারের ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু কন্যাপক্ষীয়দের জন্য ব্যবস্থিত আহারের নিকৃষ্টতা দেখে, কন্যাপক্ষীরা তাঁৱ। বাড়িতে সমাগত হয়েও আহার গ্ৰহণ করল না। প্ৰফুল্পর মাকে শাস্তি দেবার জন্য তারা পাকস্পর্শের দিন হরিবল্লাভের বাড়িতে নিমন্ত্রিত হয়ে, সেখানে রটনা করল ষে প্ৰফুল্পর মা কুলটা।
কিছুকাল পরে প্রফুল্লর মা প্রফুল্পকে নিয়ে হরবল্লভের বাড়ি যায়। হরিবল্লাভের গৃহিণী প্ৰথমে তাদের দেখে বিমুখ হলেও, পরে প্রসন্না হয়ে পুত্রবধূকে গ্ৰহণ করবার জন্য হরিবল্লাভের কাছে অনুনয়-বিনয় করে। হরবল্লভের পুত্র ব্রজেশ্বরও এ-সম্বন্ধে প্রয়াস করে। কিন্তু তাদের। সব চেষ্টাই বিফল হয়। হরিবল্লভ তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়। সে কি-ভাবে খাবে, প্রশ্ন করলে, হরিবল্লভ প্ৰফুল্লকে বলে—’চুরিডাকাতি করে খাবে’। প্ৰফুল্ল মায়ের সঙ্গে বাড়ি ফিরে আসে। মা অসুস্থ হয়ে পড়ে, এবং কিছুদিন পরে মারা যায়। তার অসহায় অবস্থা দেখে, স্থানীয় জমিদারের নায়েব পরাণ চক্রবর্তী তাকে অপহরণ করে। কিন্তু পথিমধ্যে অন্য লোক দেখে, তাদের ডাকাত ভেবে, ডাকাতের ভয়ে পরাণ ও তার পালকিবাহকরা পালিয়ে যায়। সেই অবসরে প্ৰফুল্ল পালকি থেকে বেরিয়ে নিকটস্থ জঙ্গলে প্ৰবেশ করে এবং এক পায়ে-হাটা শীর্ণ পথের রেখা ধরে এক ভগ্ন অট্টালিকায় এসে পৌছায়। সেখানে এক বৃদ্ধিকে মৃত্যুশয্যায় শায়িত দ্যাখে। মৃত্যুর পূর্বে বৃদ্ধের সেবাশুশ্ৰষা করে। শ্ৰীত হয়ে বুদ্ধ তার সঞ্চিত ধনের গুপ্তকক্ষের সন্ধান প্ৰফুল্পকে দেয়। বুদ্ধের মৃত্যুর পর প্রফুল্ল তার শেষকৃত্যাদি সম্পন্ন করে ও মাটির তলার সেই গুপ্তকক্ষ থেকে কুড়ি ঘড়া মোহর ও ধনরত্নাদি পায়।
ধনরত্নাদি পেয়ে প্রফুল্প ভাবল—‘এখন কি করি? কোথায় যাই? এ নিবিড় জঙ্গল ত থাকিবার স্থান নয়, এখানে একা থাকিব কি প্রকারে? যাই বা কোথায়? বাড়ী ফিরিয়া যাইব? আবার ডাকাইত ধরিয়া লইয়া যাইবে। আর যেখানে যাই, এ ধনগুলি লইয়া যাইব কি প্রকারে? লোক দিয়া বহিয়া লইয়া গেলে জানাজানি হইবে, চোরডাকাত কাড়িয়া লইবে। লোকই বা পাইব কোথায়? যাহাকে পাইব, তাহাকেই বা বিশ্বাস কি? আমাকে মারিয়া ফেলিয়া টাকাণ্ডাল কাড়িয়া লইতে কতক্ষণ? এ ধনরাশির লোভ, কে সম্বরণ করিবে?’ এরূপ নানারূপ চিন্তা করে, শেষ পর্যন্ত প্রফুল্ল জঙ্গলে থাকাই সিদ্ধান্ত করল এবং গৃহকর্মে প্ৰবৃত্ত হল। কিন্তু হাড়ি, কাঠ, চাল-ডাল সকলেরই অভাব। প্ৰফুল্ল একটা মোহর নিয়ে হাটের সন্ধানে বেরুল। পথিমধ্যে এক ব্ৰাহ্মণের সঙ্গে দেখা হল। প্ৰফুল্ল ব্ৰাহ্মণকে হাটের পথ জিজ্ঞাসা করল। ব্ৰাহ্মণ বলল-‘হাট এক বেলার পথ, তুমি একা যেতে পারবে না।‘ ব্ৰাহ্মণ বলল-’এই জঙ্গলে আমার একটা দোকান আছে। তুমি সেখান থেকে চাল-ডাল, হঁড়ি ইত্যাদি কিনতে পার। দোকান থেকে চাল-ডাল, হাড়ি ইত্যাদি কিনে প্ৰফুল্ল তাকে একটা মোহর দিল। ব্ৰাহ্মণ বলল-’মোহর ভাঙ্গিয়ে দিই, এত টাকা আমার কাছে নাই। তুমি পরে দাম দিও, চল তোমার ঘর চিনে আসি।‘ প্রফুল্ল বলল— ‘আমার ঘরেও পয়সা নেই, সবই মোহর।‘ ব্ৰাহ্মণ বলল-’সবই মোহর? তা হোক চল তোমার ঘর চিনে আসি।‘ প্ৰফুল্লর সন্দেহ হল। ব্ৰাহ্মণ বুঝল। বলল–’মা, আমি তোমার সঙ্গে প্রতারণা করবো না, আমার নাম ভবানী পাঠক, আমি ডাকাইতের সর্দার।‘ ভবানী পাঠকের নাম প্ৰফুল্প নিজগ্রাম দুর্গাপুরেও শুনেছিল। ভবানী পাঠক বিখ্যাত দলু্য। প্ৰফুল্লর বাক্যক্ষুতি হল না। ইতিমধ্যে ব্ৰাহ্মণ ঘরের ভিতর হতে একটা দামামা বের করে তাতে গোটাকতক ঘা দিল। মূহুর্তমধ্যে পঞ্চাশ-যাটজন কালান্তক যমের মতো জওয়ান লাঠি-সড়কি নিয়ে উপস্থিত হল। ভবানী তাদের বলল—’তোমরা এই বালিকাকে চিনে রােখ। আমি ঐকে মা বলেছি। ঐকে তোমরা সকলে মা বলবে, মার মত দেখবে, ঐর কোন অনিষ্ট করবে না, আর কাকেও করতে দেবে না। এখন তোমরা বিদায় হও।