শান্তি বালক সন্ন্যাসীবেশে এক সন্ন্যাসীর দলে গিয়ে ভিড়ল। বঙ্কিম বলেছেন : ‘তখনকার দিনের সন্ন্যাসীরা দলবদ্ধ, সুশিক্ষিত, বলিষ্ঠ, যুদ্ধবিশারদ এবং অন্যান্য গুণে গুণবান ছিল। তাহারা সচরাচর একপ্রকার রাজবিদ্রোহী-রাজার সর্বস্ব লুঠিয়া খাইত। ’ বলিষ্ঠ বালক পেলেই তারা তাকে নিজেদের দলভুক্ত করে নিত। শান্তির বুদ্ধির চাতুৰ্য, চতুরতা এবং কর্মদক্ষতা দেখে, তারা তাকে নিজেদের দলভুক্ত করে নিল। তাদের দলে থেকে শান্তি ব্যায়াম করত এবং পরিশ্রমসহিষ্ণু হয়ে উঠল। ক্রমশ শান্তির যৌবনলক্ষণ দেখা দিল। সন্ন্যাসীরা সচরাচর জিতেন্দ্ৰিয়। কিন্তু সবাই নয়। একজন সন্ন্যাসী শান্তিকে প্রলুব্ধ করবার চেষ্টা করলে শাস্তি সন্ন্যাসীর দল ছেড়ে পালিয়ে নিজের গৃহে ফিরে এল। শাশুড়ী তাকে স্থান দিল না। জীবানন্দের বোন নিমাইয়ের বিবাহ হয়েছিল। ভৈরবপুরে। ভগ্নীপতির সঙ্গে জীবানন্দের খুবই সদ্ভাব; জীবানন্দ শান্তিকে ভৈরবপুরে নিয়ে গেল এবং সেখানেই সুখে বসবাস করতে আরম্ভ করল। তারপর জীবানন্দ একদিন সন্তানধর্ম গ্ৰহণ করে শান্তিকে ছেড়ে চলে গেল। শান্তি একাই রুক্ষকেশে ছিন্নবসনে নিজের পর্ণকুটিরে বাস করতে লাগল।
ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের অনুবর্তনে বাঙলায় বড় গুরুতর ব্যাপার ঘটেছিল। সন্ন্যাসী বিদ্রোহ তার অন্যতম প্ৰকাশ। বঙ্কিমের আনন্দমঠে সন্ন্যাসী-বিদ্রোহের যে চিত্ৰপট দেওয়া হয়েছে, সেই চিত্ৰপট অনুযায়ী বিদ্রোহী সন্ন্যাসীদের নেতা ছিলেন সত্যানন্দ। তাঁর তিন উপযুক্ত সহকর্মী ছিলেন। তঁরা হচ্ছেন জীবানন্দ, ভবানন্দ ও জ্ঞানানন্দ। গভীর অরণ্যের মধ্যে তাঁরা নিজেদের আস্তানা করেছিলেন। আশ্রমবাসী ও গৃহী সন্ন্যাসীর সংখ্যা ছিল হাজার হাজার। আশ্রমবাসী সন্ন্যাসীদের। ব্ৰত ছিল যতদিন না, যবনের হাত থেকে দেশমাতার উদ্ধায় হয়, ততদিন। তারা ব্ৰহ্মচৰ্য পালন করবে ও গৃহধর্ম ত্যাগ করবে। আত্মীয়স্বজন সকলের সংস্রব ত্যাগ করবে ও ইন্দ্ৰিয় জয় করবে। বঙ্কিম সত্যানন্দের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন—’আমরা রাজ্য চাহি না-কেবল মুসলমানরা ভগবানের বিদ্বেষী বলিয়া তাহাদের সবংশে নিপাত করিতে চাই।‘
রাজসরকার থেকে কলকাতায় যে খাজনা চালান যাচ্ছিল, সন্ন্যাসীরা তা লুঠে নিল। নিকটে সত্যানন্দকে পেয়ে সিপাহীরা তাকে বন্দী করল। সত্যানন্দকে উদ্ধার করতে বেরিয়েছেন জীবানন্দ। সত্যানন্দের সমীপবর্তী হলে জীবানন্দ শুনলেন, সত্যানন্দ গাইছেন— ‘ধীর সমীরে তটিনীতীরে বসতি বনে বরনারী’। এটা সত্যানন্দের সঙ্কেত বুঝতে পেরে জীবানন্দ নদীর ধারে গেলেন। সেখানে দেখলেন এক স্ত্রীলোকের মৃতদেহ আর এক জীবিত শিশুকন্যা। জীবানন্দ শিশুকন্যাটিকে তুলে নিয়ে ভৈরবপুরে তাঁর ভগিনী নিমাইয়ের নিকট রাখতে এলেন। নিমাই কৌশলে জীবানন্দের সঙ্গে শান্তির সাক্ষাৎ ঘটিয়ে দিল। শান্তিকে দেখে জীবানন্দের বড় দুঃখ হল। জীবানন্দ বললেন, ‘দেশ নিয়ে আমি কি করব? তোমা হেন স্ত্রীকে আমি কেন ত্যাগ করলাম।‘ জীবানন্দ সন্তানধর্ম ত্যাগ করতে মনস্থ। শান্তি বলল-’ছি—তুমি বীর! আমার পৃথিবীতে বড সুখ যে, আমি বীরপত্নী। তুমি অধম স্ত্রীর জন্য বীরধর্ম ত্যাগ করবে? তোমার বীরধর্ম কখনও তুমি ত্যাগ কোরো না।‘
নিজ কুটিরে প্রত্যাগমন করেই শান্তি সিদ্ধান্ত করে ফেলল যে স্বামী যে-ধর্মে দীক্ষিত হয়েছেন, সহধর্মিণী হিসাবে তার পক্ষেও সেই– ধর্মই অনুসরণ করা কর্তব্য। একখানা শাড়ির পাড় ছিড়ে কাপড়খানাকে গেরিমাটি দিয়ে গেরুয়া বসনে পরিণত করল। নিজের মাথার চুল কেটে নকল গোফ-দাড়ি তৈরি করল। তারপর সেই গৈরিক বসনখানি অর্ধেক ছিড়িয়া ধড়া করিয়া চারু অঙ্গে শান্তি পরিধান করিল। অবশিষ্ট অর্ধেকে হৃদয় আচ্ছাদিত করিল।‘ এভাবে সজ্জিত হয়ে সেই নূতন সন্ন্যাসী রাত্রি দ্বিপ্রহরের অন্ধকারে একাকিনী গভীর বনমধ্যে প্ৰবেশ করল। চলতে চলতে গাইতে লাগল-’সমরে চলিনু আমি হামে না ফিরাও রে/হরি হরি হরি বলি রণরঙ্গে/ঝাঁপ দিব প্ৰাণ আজি সমর তরঙ্গে/তুমি কার, কে তোমার, কেন এসে সঙ্গে/রমণীতে না সাধ, রণজয় গাওরে।।‘
পরদিন প্ৰভাতে আনন্দমঠের সন্তান সম্প্রদায় দেখল যে মঠে এক নূতন সন্ন্যাসী এসেছে সন্তানধর্মে দীক্ষিত হবার জন্য। মঠাধ্যক্ষ সত্যানন্দ তাকে দীক্ষিত করলেন ও তার নাম দিলেন নবীনানন্দ। কিন্তু সত্যানন্দকে সে প্রতারিত করতে পারল না। নূতন নাম দেবার পর সত্যানন্দ তাকে জিজ্ঞাসা করলেন–’একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, তোমার পূর্বে কি নাম ছিল? শান্তি বলল—’আমার নাম শান্তিরাম দেবশৰ্মা।‘ উত্তরে সত্যানন্দ বললেন—’তোমার নাম শান্তিমণি পাপিষ্ঠ।‘ এই বলে সত্যানন্দ শান্তির জাল দাড়ি টেনে খসিয়ে দিলেন। তারপর স্ত্রীলোকের বাহুবলের প্রশ্ন উঠল। সত্যানন্দ বললেন- ‘সন্তানরা বাহুবলের পরিচয় দেয় এই ইস্পাতের ধনুকে এই লোহার তারের গুণ দিয়ে। যে গুণ দিতে পারে, সে-ই প্ৰকৃত বলবান। এই ধনুকে মাত্র চারজন গুণ দিতে সমর্থ-আমি, আর জীবানন্দ, ভবানন্দ ও জ্ঞানানন্দ ‘’ শান্তি অবহেলে ধনুকে গুণ দিলে, সত্যানন্দ বিস্মিত, ভীত ও স্তম্ভিত হলেন। সত্যানন্দ জানলেন শান্তি জীবানন্দের গৃহিণী। তিনি বললেন—’তুমি কেন পাপাচার করতে এসেছ? সামান্ত মনুষ্যদিগের মন স্ত্রীলোকে আসক্ত এবং কাৰ্যে বিরত করে। এই জন্য সন্তানের ব্ৰতই এই যে, রমণী জাতির সঙ্গে একাসনে উপবেশন করিবে না। জীবানন্দ আমার দক্ষিণ হস্ত। তুমি আমার ডান হাত ভাঙ্গিয়া দিতে আসিয়াছ।‘ শান্তি বলল-’আমি আপনার দক্ষিণ হস্তে বল বাড়াইতে আসিয়াছি। আমি ব্ৰহ্মচারিণী, প্রভুর কাছে ব্ৰহ্মচারিণীই থাকিব। আমি সহধর্মিনী হিসাবে কেবল ধর্মাচরণের জন্য আসিয়াছি। ’ তারপর শান্তি আশ্রমের নিকট বনমধ্যে এক পর্ণকুটিরে জীবানন্দের সঙ্গে অবস্থান করতে লাগল। কিন্তু কোনদিন স্বামীর সঙ্গে একাসনে বসিল না।