কুলীন ব্ৰাহ্মণগণ অগণিত বিবাহ করত এবং স্ত্রীকে তার পিত্ৰালয়ে, রেখে দিত। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভারতচন্দ্ৰ তাঁর ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্যে লিখেছিলেন—‘আর রামা বলে আমি কুলীনের মেয়ে। / যৌবন বহিয়া গেল বর চেয়ে চেয়ে।। / যদি বা হইল বিয়া কতদিন বই। / বয়স বুঝিলে, তার বড়দিদি হই। / বিয়াকালে পণ্ডিতে পণ্ডিতে বাদ লাগে। / পুনর্বিয়া হবে কিনা বিয়া হবে। আগে৷ / বিবাহ করেছে সেটা কিছু ঘাটি ঘাটি। / জাতির যেমন হৌক কুলে বড় আটি।। / দু-চারি বৎসরে যদি আসে একবার। / শয়ন করিয়া বলে কি দিবি ব্যাভার ॥ / সূতা বেচা কড়ি যদি দিতে পারি তায়। / তবে মিষ্টি মুখ নহে। রুষ্ট হয়ে যায়।।’
এরূপ প্ৰবাসভর্তৃক সমাজে কুলীন কন্যাগণ যে সবক্ষেত্রেই সতীসাবিত্রীর জীবন যাপন করতেন, সে কথা হলপ করে বলা যায় না। উনবিংশ শতাব্দীতে রামনারায়ণ তর্করত্ন ও বিদ্যাসাগরমশায় বলে গেছেন যে এরূপ কুলীন কন্যাগণ প্রায়ই জারজ সন্তান প্রসব করতেন। কী ভাবে তা গোপন ক’রে, সে-সব সন্তানের বৈধতা কৌশলে প্ৰকাশ করা হত, তা-ও তারা বর্ণনা করে গেছেন। এর ফলে, বাঙলার কুলীন ব্ৰাহ্মণ সমাজে যে দূষিত রক্ত প্ৰবাহিত হয়েছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
***
মৈথিলী সমাজে মেয়ের বাবারা শোনপুরের মেলায় পাত্র কিনে নিয়ে আসে (লেখকের ‘সেক্স অ্যাণ্ড ম্যারেজ ইন ইণ্ডিয়া’, পৃষ্ঠা ১৭১ দ্রষ্টব্য)। সাধারণত পাত্রের বয়স ৭ থেকে ১৫ হয়। বয়স অনুযায়ী বরের দাম কম-বেশি হয়। বরের বয়স কম হলে, দাম কম লাগে; বয়স বেশি হলে, দাম বেশি হয়। মেয়ের বাবা ক্রীত পাত্ৰকে বহির্বাটীতে রাখেন। তাকে অন্দরমহলে আসতে দেওয়া হয় না। তাকে গোচারণ ও কৃষিকর্মে নিযুক্ত করা হয়। তারপর উপযুক্ত বয়স হলে, তাকে মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু বিবাহের পরও রাতদুপুর পর্যন্ত অন্দরমহলে তার প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকে। রাত-দুপুরে সে অন্দরমহলে শোবার জন্য আসে। কিন্তু প্ৰভাত হবার পূর্বেই তাকে আবার বহিৰ্বাটীতে ফিরে যেতে হয়। গৌন অনুষ্ঠানের পরই বরকনে স্বামী-স্ত্রীরূপে পৃথক সংসার পাততে পারে।
***
সেকালে দেবতার প্রীতির জন্য অনেকে নিজের মেয়েদের দেবতার সঙ্গে বিয়ে দিতেন। এরা মন্দিরে থাকত এবং এদের দেবদাসী বলা হ’ত। এদেরকে উত্তমরূপে নাচ-গান শেখানো হ’ত এবং তারা দেবতার সামনে নৃত্যগীত করত। দেবদাসী যে হিন্দু মন্দিরেই থাকত, তা নয়, বৌদ্ধ মন্দিরেও থাকত। কালক্রমে দেবদাসী প্ৰথা কদৰ্য গণিকাবৃত্তিতে পরিণত হয়েছিল। স্বাধীনোত্তরকালে আইন দ্বারা দেবদাসী প্ৰথা নিবারিত হয়েছে; কিন্তু গোপনে এ-প্রথা এখনও চালু আছে। সম্প্রতি রাজ্যসভায় নারীকল্যাণ দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী মারগারেট আলভা প্ৰকাশ করেছেন যে স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরেও দেশে দেবদাসীর সংখ্যা এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার। শুধু তাই নয়, কমার চেয়ে বরং এই সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
***
হিন্দুসমাজে বৃক্ষ বা জড় পদার্থের সঙ্গেও বিকল্প বিবাহের প্রথা প্ৰচলিত আছে। হিন্দুরা বিশ্বাস করে যে, বিবাহে অযুগ্ন সংখ্যা অত্যন্ত অশুভ। সেই কারণে কোনো ব্যক্তি যখন তৃতীয়বার বিবাহে প্ৰবৃত্ত হয়, তখন সে অযুগ্ম তৃতীয়বারের অশুভ্যুত্ব খণ্ডন করবার জন্য কোনো বৃক্ষ বা জড় পদার্থের সঙ্গে বিকল্প বিবাহের পর নির্বাচিত কন্যাকে বিবাহ করে।
গণিকাদের মধ্যেও এরূপ বিকল্প বিবাহ প্ৰচলিত অাছে। এক্ষেত্রে হিন্দু গণিকাদের মধ্যে বিবাহ সাধারণত কোনো জড়বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি বা ভাড়া-করা বৈষ্ণব অথবা কোনো গাছের সঙ্গে দেওয়া হয়। মুসলমান গণিকারা এরূপ বিবাহ তরবারি বা ছুরিকার সঙ্গে করে।
বিপ্লবের সাথী প্ৰমীলা
অন্তঃপুরে থেকেই যে প্ৰমীলা পুরুষ ভজে, তা নয়। বিপ্লবেও সে পুরুষের সাথী হয়। অন্তত বাংলা উপন্যাসে আমরা তাই দেখি। বাংলা উপন্যাসে বিপ্লবী নারীর সংখ্যা খুবই কম। এখানে আমরা মাত্র, পাঁচজন বিপ্লবী নারীর কাহিনী বিবৃত করছি। যে পাঁচখানা উপন্যাসে আমরা এদের সাক্ষাৎ পাই, সে পাঁচখানা উপন্যাস হচ্ছে বঙ্কিমের ‘ত্ৰয়ী’-যথা আনন্দমঠ, দেবী চৌধুরানী ও সীতারাম, শরৎচন্দ্রের পথের দাবী ও রবীন্দ্রনাথের চার অধ্যায়। বঙ্কিমের নায়িকারা হচ্ছে শান্তি, প্ৰফুল্ল ও শ্ৰী, শরৎচন্দ্রের সুমিত্রা ও রবীন্দ্রনাথের এলা। প্ৰথম তিনজন নায়িকার আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর বিস্রস্ত ইতিহাসের বিশৃঙ্খলতার মধ্যে, আর শেষের দুজনের বিংশ শতাব্দীর স্বাধীনতা-সংগ্রামের চঞ্চলতার মধ্যে। প্ৰথম তিনজন ছিল বিবাহিতা; শেষের দুজন অবিবাহিত।
শান্তি ও প্ৰফুল্লর কর্মব্যঞ্জনার অভিকেন্দ্র ছিল ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের বিভীষিকাময় পরিস্থিতির অভ্যন্তরে। অনাবৃষ্টির জন্য ফসল হয়নি। দুর্ভিক্ষের করালা ছায়ায় সমগ্ৰ দেশ আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল। অনশনে ও মহামারীতে দেশের এক-তৃতীয়াংশ লোক মারা গিয়েছিল। মহম্মদ রেজা খাঁ তখন রাজস্ব-আদায়ের কর্তা। দেশের এই নিদারুণ দুঃসময়ে রেজা খাঁ একেবারে শতকরা দশ টাকা হারে রাজস্ব বাড়িয়ে দিয়েছিল। জমিদাররা রাজস্ব দিতে পারল না। হেষ্টিংস ও গঙ্গাগোবিন্দ সিংহের কৃপায় ইজারাদার দেবীসিংহ জমিদারীসমূহ জলের দামে কিনে নিল। জমিদারদের ঋণ শোধ হল না। দেনার ওপর দেন হল। দেবীসিংহের