কিন্তু হিন্দু পুরাণে প্রথম নারী এরকম কোন নিষেধাজ্ঞ দ্বারা শৃঙ্খলিত হয়নি। স্মৃষ্টির সূচনাতেই তারা স্রষ্টা কর্তৃক আদিষ্ট হয়েছিল ‘তোমরা উভয়ে রমণে প্রবৃত্ত হয়ে প্রজাস্বষ্টি কর।’ হিন্দু পুরাণে আছে জীবন-বিজ্ঞানের এক পরম সত্যের কথা। আদিতে স্ত্রী-পুরুষ বিভেদ ছিল না। বায়োলজিতেও আমরা সেই কথাই পড়ি আদিতে তাদের ইনফিউসরিয়া, অ্যামেব, স্পরোজেয়ান প্রভূতি এককোষীয় রূপ ছিল। তাদের যৌনজীবন ছিল না। এককোষগুলিই শতধা হয়ে সৃষ্টি বজায় রাখত। তারপর আসে স্ত্রী-পুরুষ বিভেদ ও যৌনজীবন। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী আদিতে স্রষ্টার নিজের কোনো যৌন-সত্তা ছিল না। স্রষ্ট হচ্ছেন প্রজাপতি ব্ৰহ্ম। তিনি প্রথম সৃষ্টি করেছিলেন সনৎকুমার, সনন্দ, সনক, সনাতন ও বিভু নামক পাঁচ ঋষিকে। তখন ষ্ট্রপুরুষ বিভেদ ছিল না বলে তাদের থাকতে হয়েছিল উধ্বরেতা হয়ে। সে অবস্থায় তো প্রজাসৃষ্টি হয় না। তাই ব্রহ্ম নিজেকে দু’ভাগে বিভক্ত করলেন। তাঁর এক অংশ পুরুষ ও অপর অংশ নারী হল। পুরুষের তিনি নাম দিলেন মনু, আর নারীর নাম দিলেন শতরূপা। তারা ব্ৰহ্মাকে জিজ্ঞাসা করল—‘পিতঃ, কোন কর্মের দ্বারা আমরা আপনার যথোচিত সেবা করব?’ ব্রহ্মা বললেন, ‘তোমরা মৈথুন কর্ম দ্বারা প্রজা উৎপাদন কর। তাতেই আমার তুষ্টি।’ তখন থেকে মৈথুন কর্মের প্রবর্তন হল। মনু ও শতরূপার পুত্রকন্যা থেকেই মানবজাতির বিস্তার হল।
***
দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুর কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ করতে বলেছিলেন। তন্ত্রমতে নারীর দুই স্বরূপ—কামিনী ও জননী। শেষের স্বরূপটাই ঠাকুর গ্রহণ করেছিলেন সারদামণি সম্পর্কে। কিন্তু একই নারীর আরএকটা স্বরূপ আছে বলে তিনি সংসারী ভক্তদের পরিহার করেননি। যাদের পক্ষে নৈতিক হিসাবের স্ত্রী ও জননী পৃথক সংস্কার, তাদের পক্ষে এ ধারণা করা খুবই কঠিন। একজন ভৈরবের কথায় বলি–মাতৃভাবই বলে আর কামিনীভাবই বলো, দুই তো আরোপিত ভাব, আসলে তো সে একই কামিনীর দুই রূপ বা ভাব। গোড়াতেই তো প্রকৃতি কামিনী, সৃষ্টিতে সম্ভোগার্থেই তার সার্থকতা। তারপর যখন সৃষ্টি হয়ে গেল, সেই স্থষ্ট জীবের অসহায় ও তুর্বল অবস্থায় তার লালনপালন ও বৃদ্ধির জন্যই তো জননী-ভাবটি। নারীমাত্রই পরমাপ্রকৃতি, আদ্যাশক্তির অংশ। মনুষ্যসমাজের একটা নৈতিক সংস্কারকে সনাতন সত্য বলে মেনে নিলে তত্ত্বের দিক থেকে সত্য উদ্ধার করা অসম্ভব হবে। প্রকৃতির আসল ভাব অতি গুহ, অনির্বচনীয়। কেবলানন্দময়ী ভাব। তার বর্ণনা নেই। এজন্যই পরমহংসদেব একসময় মা-ঠাকরুনকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন—“আমি তোমার কে? সে প্রশ্নের উত্তর তিনি নিজেই দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘তুমি আমার আনন্দময়ী গে৷’
***
এক কথায়, নারী আনন্দময়ী | কামিনী হিসাবেও সে আনন্দময়ী। জননী হিসাবেও সে আনন্দময়ী। কামিনীরূপে নারী স্মৃষ্টির অধিষ্ঠাত্রী; জননীরূপে নারী সৃষ্ট জীবের পালয়িত্রী। সেজন্যই অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় মানুষের ক্ষেত্রে একটা ব্যতিক্রম দেখি। অন্যান্ত প্রাণীর ক্ষেত্রে আমরা দেখি সন্তান-উৎপাদনের জন্য যৌনমিলনের একটা বিশেষ ঋতু আছে। মাত্র সেই ঋতুতেই তাদের মধ্যে যৌনমিলনের আকাঙ্ক্ষা জাগে। তখন স্ত্রী ও পুরুষ একত্রে মিলিত হয়ে সন্তান-উৎপাদনে প্রবৃত্ত হয়। পশুজগতে সন্তান-উৎপাদন এভাবে সীমিত না হলে সমস্ত পৃথিবীই তো পশুতে ভরে যেত। সেটা প্রকৃতির অভিপ্রেত নয়। অন্তপক্ষে মানুষই শ্রেষ্ঠ জীব। মানুষই জগৎ পরিপূর্ণ করুক—এটাই প্রকৃতির অভিপ্রেত। সেজন্যই মনুষ্যসমাজে সন্তান-উৎপাদনের জন্য কোনো নিদিষ্ট ঋতু নেই। মানুষের ক্ষেত্রে সৃষ্টির উদ্দেশ্যে যৌনমিলনের বাসনা সকল ঋতুতেই জাগ্রত থাকে। এটা প্রকৃতির নির্দেশ। মানুষের ক্ষেত্রে নারীদেহ যেসব যৌন হরমোন (oestrogen) দ্বারা গঠিত হয় তাতে নারীর মনে যৌনমিলনের আকাঙ্খা (oestrus) সবসময়েই জাগ্রত থাকে। সেজন্যই নারী সবসময়েই পুরুষের সান্নিধ্য কামনা করে। এক কথায়, মানুষের মধ্যে স্ত্রী-পুরুষের পরস্পরের সান্নিধ্যে থাক। এক সহজাত প্রবৃত্তি। সুতরাং কামিনী হিসাবে নারীর আনন্দময়ী হবার পিছনে একটা বৈজ্ঞানিক কারণ আছে। আর জননী হিসাবে নারী আনন্দময়ী হয়ে যে বিরাজমান থাকে, তার পিছনেও বৈজ্ঞানিক কারণ বিদ্যমান। সে কারণটা হচ্ছে বায়োলজিক্যাল বা জীবজনিত। কারণ। শিশুকে লালনপালন এবং স্বাবলম্বী করে তুলতে অন্ত প্রাণীর তুলনায় মানুষের অনেক বেশি সময় লাগে। এ-সময় প্রতিপালন ও প্রতিরক্ষণের জন্য নারীকে পুরুষের আশ্রয়ে থাকতে হয়। এর জন্যই পরিবার-গঠনের প্রয়োজন হয়। মনে করুন, অন্য প্রাণীর মত যৌনমিলনের অব্যবহিত পরেই স্ত্রী-পুরুষ যদি পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হ’ত, তাহলে মনুষ্যসমাজে মা ও সন্তানকে কতই না বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হ’ত।
***
প্রসঙ্গত আগের অনুচ্ছেদে আমরা নারীদেহে বিশেষ যৌন হরমোন বা oestrogen থাকার কথা বলেছি। নারীদেহে এসব যৌন হরমোন থাকার দরুন নারীমনে শুধুমাত্র যে যৌনমিলনের বাসনা শাশ্বত থাকে, তা নয়। নারীর সমস্ত দেহগঠনের ওপর এবং বিশেষ করে নারীদেহের আনুষঙ্গিক (secondary) বৈশিষ্ট্য প্রকাশের ওপরও এর প্রভাব বিস্তারিত হয়। এই প্রভাবের দরুনই নারীদেহ পুরুষদেহ থেকে পৃথকভাবে গঠিত হয়। তবে কতকগুলি গ্রস্থি বা glands-ও—এই বৈশিষ্ট্য রচনায় সাহায্য করে। প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যৌনযন্ত্রের। সন্তান ছেলে না মেয়ে সেটা প্রকাশ পায় তার জন্মের সঙ্গে সঙ্গে। সেটা যোনি-চিহ্ন থেকেই বুঝতে পারা যায়। কিন্তু সেটা বাহ্যিক চিহ্নমাত্র। গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য নারীদেহের অভ্যন্তরে গ্রথিত থাকে। নারীদেহের অভ্যন্তরে যে সহজাত বৈশিষ্ট্যমূলক যন্ত্র থাকে, তা হচ্ছে ডিম্বাশয় (ovary) ও গর্ভাশয় বা জরায়ু (uterus)। দশ-বারো বছর বয়স পর্যন্ত, তার মানে প্রথম রজঃনিঃসরণের সময় পর্যন্ত ছেলে ও মেয়েরা নিজেদের পরস্পরের সমকক্ষ মনে করে। সে সময় পর্যন্ত তারা পরস্পরের সঙ্গে স্বচ্ছন্দে মেলামেশা ও খেলাধুলা করে এবং দৈহিক শক্তি প্রদর্শনে পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। কিন্তু তারপর যখন আনুষঙ্গিক লক্ষণসমূহ (secondary characters) প্রকাশ পায়, তখন তারা বুঝতে পারে যে তারা পরস্পরের সমকক্ষ নয়। মেয়েদের এ-সকল আনুষঙ্গিক লক্ষণ হচ্ছে মাসিক রজঃনিঃসরণ, স্তনের স্ফীতি এবং সন্তান-প্রজননের পর সেই ফাত-স্তন ছদ্ধভাণ্ডারে পরিণত হওয়া, মুখমণ্ডলে কেশের অভাব ইত্যাদি। অপরপক্ষে, পুরুষের এরূপ মাসিক রজঃনিঃসরণ হয় না, স্তনের স্ফীতি ঘটে না এবং মুখমণ্ডল কেশাচ্ছন্ন হয়।