দেবরণ এখনও বাঙলার সাঁওতাল সমাজে ও ওড়িশার জাতিসমূহের মধ্যে প্ৰচলিত আছে। বর্তমান বাঙালির বিবাহপ্রথার মধ্যেও এর নিদর্শন আছে। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা যখন বিবাহ করে নববধূকে নিয়ে গৃহে ফিরে আসে, তখন কনিষ্ঠ ভ্রাতা তার পথরোধ করে তাকে প্রশ্ন করে–‘দাদা, আমার বিয়ে দেবে তো?’ জ্যেষ্ঠ সম্মতি জ্ঞাপন করলে, তবেই নববধূকে নিয়ে সে গৃহে প্রবেশ করতে পারে। এটাও কনিষ্ঠের অধিকার সমর্পণ করার নিদর্শন। ভাবীর সঙ্গে কনিষ্ঠ দেবরের যে ঘনিষ্ঠ ব্যবহার ও সংলাপ, তা-ও কোনো এক সুদূর প্রাচীনকালে বাঙালি সমাজে ‘দেবরণ’ প্ৰথা প্ৰচলন থাকার লুপ্ত চিহ্নমাত্র। এটাই এর নৃতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা। (যারা এ সম্বন্ধে বেশি কিছু জানতে আগ্রহী, তাঁরা আমার ‘ডিনামিকস অফ সিনথেসিস ইন হিন্দু কালচার’ গ্রন্থে পুনমূদ্রিত ১৯২৮ খ্ৰীস্টাব্দে ‘ম্যান ইন ইণ্ডিয়া’ পত্রিকায় প্ৰকাশিত ‘সাম বেঙ্গলি কিনশিপ ইউসেজেস নিবন্ধটি পড়ে নিতে পারেন।)
মনে হয় শালীবরণ ও দেবরণ প্ৰথা একমাত্র বাঙলা দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বাঙলার বাইরেও ছিল। কেননা, মহাভারতে পড়ি, বিচিত্ৰবীৰ্য অম্বিকা ও অম্বালিকাকে একসঙ্গেই বিবাহ করেছিলেন। আবার নাভিও দুই যমজ ভগিনীকে বিবাহ করেছিলেন। অর্ধমাগধী ভাষায় রচিত জৈন সাহিত্যেও এরূপ বিবাহের উল্লেখ আছে। এরূপে বিবাহিত দুই যমজ ভগিনীর অন্যতরা মরুদেবী জৈন তীৰ্থংকর ঋষভের মাতা ছিলেন। শ্ৰীকৃষ্ণের পিতা বসুদেব দেবকীরাজার সাত কন্যাকে বিবাহ করেছিল। কংসও জরাসন্ধের দুই কন্যাকে বিবাহ করেছিল।
ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের এক স্তোত্র থেকে বোঝা যায় যে, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মৃত্যুর পর তার বিধবা স্ত্রী দেবরের সঙ্গেই স্ত্রীরূপে বাস করত। সেখানে বিধবাকে বলা হচ্ছে–’তুমি উঠে পড়, যে দেবু তোমার হাত ধরছে তুমি তারই স্ত্রী হয়ে তার সঙ্গে বসবাস কর।‘ অথর্ববেদের (১০|৩|১-২) এক স্তোত্রেও অনুরূপ কথা ধ্বনিত হয়েছে। তবে এখানে বলা প্রয়োজন যে, ভাবীর ওপর দেবরের এই যৌন অধিকার পরবর্তীকালের নিয়োগ প্ৰথা থেকে স্বতন্ত্র। এ অধিকার সাধারণ রমণের অধিকার। আর নিয়োগ প্ৰথা মাত্ৰ সন্তান উৎপাদনের অধিকার।
***
বৌদ্ধ সাহিত্য থেকে আমরা জানতে পারি যে, প্ৰাচ্য ভারতে একসময় নিজ ভগিনীকে বিবাহ করার প্রথাও প্রচলিত ছিল। ‘সূত্রনিপাত’ (৪২০) অনুযায়ী বৈশালীর রাজা ওক্ককের প্রধান মহিষীর গর্ভে পাঁচ ছেলে ও চার মেয়ে জন্মগ্রহণ করে। ওই প্ৰধান মহিষীর মৃত্যুর পর রাজা এক যুবতীকে বিবাহ করেন। এই রানীর যখন এক পুত্র হয়, তখন তিনি রাজাকে বলেন যে, তাঁর ছেলেকেই রাজা করতে হবে। রাজা তার প্রথম মহিষীর পাঁচ পুত্র ও চার কন্যাকে হিমালয়ের পাদদেশে নিৰ্বাসিত করেন। সেখানে কপিলমুনির সঙ্গে তাদের দেখা হয়। কপিলমুনি তাদের সেখানে একটি নগর স্থাপন করে বসবাস করতে বলেন। এই নগরের নামই কপিলাবস্তু হয়। ভ্রাতাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ অকৃতদার থাকে। আর বাকি চার ভাই চার বোনকে বিবাহ করে।
বৌদ্ধ সাহিত্যের আর এক কাহিনী (অশ্বতথ্য সূক্ত ১/১৬, কুণাল জাতক ৫৩৬) অনুযায়ী শাক্যরা ছিল পাঁচ বোন ও চার ভাই। জ্যেষ্ঠা ভগিনীকে তারা মাতৃরূপে বরণ করে, আর চার ভাই চার বোনকে বিবাহ করে। জ্যেষ্ঠ পরে কুষ্ঠব্যাধিগ্রস্ত হয়, এবং তাকে বনমধ্যে এক গর্তের মধ্যে ফেলে দিয়ে আসা হয়। একদিন সে ব্যাঘ্র কর্তৃক আক্রান্ত হলে, বারাণসীর রাজা রাম এসে তাকে উদ্ধার করেন। রামও কুষ্ঠরোগাক্রান্ত হয়ে বনে নির্বাসিত হয়েছিলেন। কিন্তু পরে তিনি নিজেকে নিরাময় করেন। তিনি নিরাময় করবার উপায় জানতেন এবং সেই উপায় দ্বারা ওই মেয়েটিকে সম্পূৰ্ণ রোগমুক্ত করেন। তারপর তাঁদের দুজনের মধ্যে বিবাহ হয় এবং তঁদের যে সন্তান হয়, তাদেয় কপিলাবস্তু নগরে তাদের মাতুলকন্যাদের বিবাহ করবার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়। (তুলনীয় : দক্ষিণ ভারতে মাতুলকন্যা বিবাহ)
বৌদ্ধ সাহিত্যের (বুদ্ধঘোষের ‘পরমথজ্যোতিকা,’ ‘ক্ষুদ্দকপথ’) আর এক কাহিনী অনুযায়ী বারাণসীর রাজার প্রধান মহিষী একখণ্ড মাংসপিণ্ড প্রসব করেন। তিনি ওই মাংসপিণ্ডটিকে একটি পেটিকায় করে নদীতে ভাসিয়ে দেন। এটা যখন ভেসে যাচ্ছিল, তখন একজন মুনি ওটাকে তুলে সংরক্ষণ করেন। পরে ওই মাংসপিণ্ড থেকে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে জন্মায়। তাদের নাম লিচ্ছবী দেওয়া হয়। এদের দুজনের মধ্যে বিবাহ হয় এবং তারা বৈশালী রাজ্য স্থাপন করে।
বৌদ্ধ সাহিত্যের এইসকল কাহিনী থেকে আমরা জানতে পারি যে, হিমালয়ের পাদদেশের রাজ্যসমূহে সহোদরা ও মাতুলকন্যা বিবাহ প্রচলিত ছিল।
(বৌদ্ধ সাহিত্যের এই অংশ ‘প্রমীলা কেন পুরুষ ভজে?’ নিবন্ধেও বিবৃত হয়েছে। পুনরুক্তির প্রয়োজন আছে বলেই দেওয়া হল)।
***
মধ্যযুগের সমাজকে কলঙ্কিত করেছিল কৌলীন্য প্রথার ওপর প্রতিষ্ঠিত বিবাহ। কৌলীন্য প্ৰথা এনেছিল এক অসামান্য জটিলতা। এ প্ৰথা বিশেষ করে। প্ৰচলিত ছিল বাঙলা ও মিথিলায়। বাঙালি ব্ৰাহ্মণ সমাজে রাঢ়ী, শ্রেণীর মুখোপাধ্যায়, বন্দ্যোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায় ও গঙ্গোপাধ্যায়দের কুলীনের মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। এই প্রথাটি ছিল কন্যাগত। তার মানে কুলীনের ছেলে অকুলীনের মেয়েকে বিবাহ করতে পারত, কিন্তু কুলীনের মেয়ের বিবাহ কুলীনের ছেলের সঙ্গেই দিতে হ’ত। অকুলীনের সঙ্গে তার বিয়ে দিলে, মেয়ের বাবার কৌলীন্য ভঙ্গ হ’ত। সুতরাং কুলরক্ষার জন্য কুলীন ব্ৰাহ্মণ পিতাকে যেন-তেন প্রকারে কুলীন পাত্রের সঙ্গে মেয়ের বিবাহ দিয়ে, নিজের কুলরক্ষা করতে হ’ত। তার কারণ, অনুঢ়া মেয়েকে ঘরে রাখা বিপদের ব্যাপার ছিল। একদিকে তো সমাজ তাকে একঘরে করত, আর অপরদিকে ছিল যবনের নারী-লোলুপতা। অনেকসময় যবনেরা নারীকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে (এমনকি বিবাহমগুপ থেকে) নিকা করতে কুষ্ঠাবোধ করত না।