বলা বাহুল্য, আগের অনুচ্ছেদে বর্ণিত চাররকম বিবাহেরই কৌলীন্য ছিল। বাকিগুলির কোনো কৌলীন্য ছিল না। কেননা সেগুলি প্ৰাগ্য বৈদিক আদিবাসী সমাজ থেকে নেওয়া হয়েছিল। তার প্রমাণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, সেগুলি আদিবাসী সমাজে এখনও প্রচলিত আছে। আসুর-বিবাহ ছিল পয়সা দিয়ে মেয়ে কেন। তার মানে, আসুর-বিবাহে কন্যাপণ নেওয়া হ’ত। আর মেয়েকে জোর করে কেড়ে নিয়ে গিয়ে যে-বিবাহ করা হ’ত, তার নাম ছিল রাক্ষস-বিবাহ। আর মেয়েকে অজ্ঞান ও অচৈতন্য অবস্থায় হরণ করে, এনে বা প্ৰবঞ্চনা অথবা ছলনা দ্বারা যে বিবাহ করা হত, তাকে বলা হ’ত পৈশাচ-বিবাহ। আর নির্জনে প্ৰেমালাপ করে যেখানে স্বেচ্ছায় মাল্যদান করা হ’ত, তাকে বলা হ’ত গান্ধৰ্ব-বিবাহ। গঙ্গার সঙ্গে শান্তনুর বিবাহ, ভীমের সঙ্গে হিড়িম্বার বিবাহ, অর্জুনের সঙ্গে উলুপী ও চিত্রাঙ্গদার বিবাহ, দুষ্মস্তের সঙ্গে শকুন্তলার বিবাহ ও ইম্ফাকুবংশীয় পরীক্ষিতের সঙ্গে সুশোভনার বিবাহএসবই গান্ধৰ্বমতে বিবাহের দৃষ্টান্ত। তবে রাজারাজড়ার ঘরে স্বয়ম্বর প্রথায় বিবাহই ছিল আদর্শ বিবাহ। স্বয়ম্বর-বিবাহ ছিল রাক্ষস-বিবাহেরই একটা সুষ্ঠু সংস্করণ। কাশীরাজার তিন কন্যা অম্বা, অম্বিকা ও অম্বালিকার স্বয়ম্বরসভায় ভীষ্ম বলেছিলেন–‘স্মৃতিকারগণ বলেছেন, যে স্বয়ম্বরসভায় প্ৰতিদ্বন্দ্বীদের পরাহত করে কন্যা জয় করাই ক্ষত্রিয়দের পক্ষে শ্রেষ্ঠ বিবাহ।‘
ঐতিহাসিক যুগে পরাহত রাজার মেয়েকে বিবাহ করাও রাক্ষসবিবাহেরই আর এক সংস্করণ। এরূপ বিবাহ ঘটেছিল সেলুকসের মেয়ের সঙ্গে চন্দ্ৰগুপ্ত মৌর্যের এবং পালবংশীয় সম্রাট ধর্মপালের সঙ্গে রাষ্ট্ৰকুটরাজ। পরবলের মেয়ে রান্নাদেবীর ও দুর্লভরাজের মেয়ে মাহটাদেবীর বিবাহ, বিগ্রহপালের সঙ্গে হৈহয় বা কলচুরি-বংশীয় রাজকন্যা লজ্জাদেবীর বিবাহ, রাজ্যপালের সঙ্গে রাষ্ট্রকুটরাজা তুঙ্গের মেয়ে ভাগ্যদেবীর বিবাহ, তৃতীয় বিগ্রহপালের সঙ্গে কলচুরিরাজ কর্ণের মেয়ে যৌবনশ্ৰীর, ও রামপালের সঙ্গে রাষ্ট্রকূটরাজের মেয়ে মদনদেবীর বিবাহ। আবার ধর্মমঙ্গল কাব্যে দেখি কামরূপ রাজাকে যুদ্ধে পরাহত করে লাউসেন রাজকন্যা কলিঙ্গাকে বিবাহ করেছিলেন।
***
আগেকার দিনে বাঙালি সমাজে একরকম বিবাহ প্ৰচলিত ছিল, যাকে নৃতত্ত্ববিদগণ শালীবরণ বলেন। শালীবরণ মানে একই পাত্রের সঙ্গে যুক্তভাবে সকল কন্যার বিবাহ দেওয়া। নৃতাত্বিক সংজ্ঞা অনুযায়ী শালীবরণ প্ৰথাটা হচ্ছে—যদি কোনো পুরুষ কোনো মেয়েকে বিবাহ করতে চায়, তা হলে সেই বিবাহের সঙ্গে তার বিধিবদ্ধ মৌলিক অধিকার থাকে ওই মেয়ের অন্যান্য কনিষ্ঠ বোনদেরও বিবাহ করবার। মৌলিক তার মানে ‘ক’ যদি ‘খ’-কে বিবাহ করে, তা হলে ‘ক’-এর ওই অধিকার অনুযায়ী সে ‘খ’-এর অন্যান্য ছোট বোনদেরও বিবাহসূত্রে উপহার পায়। বাঙলার প্রাচীন গীতিকাব্য ‘ময়নামতীর গান’-এ আমরা দেখি যে, রাজা হরিশ্চন্দ্ৰ গোপীচন্দ্রের সঙ্গে “অদুনার বিয়া দিয়া পদুনা করিল দান”। আবার ‘ধর্মমঙ্গল’ কাব্যে দেখি যে, কামরূপরাজার সঙ্গে যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ফেরবার পথে মঙ্গলকোটে লাউসেন বর্ধমানের রাজকন্যা অমলাকে বিবাহ করে তাঁর বোন বিমলাকে উপহার পেয়েছিলেন। একসঙ্গে একাধিক ভগ্নীকে বিবাহ করবার প্রথা না থাকলে এরূপভাবে কন্যাকে দান করার কথা উঠতেই পারে না। মনে হয়। অতীতের কোনো এককালে আর্থিক বা সামাজিক কারণে এই প্রথা রহিত হয়েছিল। তখন প্রশ্ন উঠেছিল, পাত্র যখন শালীদের ওপর তার অধিকার ছেড়ে দিচ্ছে, তখন তাকে কী ভাবে গ্ৰীত করা যেতে পারে। তখনকার দিনে তাকে শ্ৰীত করবার জন্য কী প্ৰতিদানের ব্যবস্থা উদ্ভাবিত হয়েছিল, জানি না। তবে বর্তমানে প্রচলিত ‘জামাইবরণ’ প্ৰথা যে তার লুপ্ত স্মৃতি বহন করছে সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
‘জামাইবরণ’টা কী? এটা সকলেরই জানা আছে যে, বিবাহের পূৰ্বমূহুর্তে জ্যেষ্ঠ জামাই বা জামাইদের বস্ত্ৰ প্ৰভৃতির দ্বারা গ্ৰীত না করলে, কনিষ্ঠ শালীর পাণিপ্রার্থী কোনো বরই বিবাহে বসতে পারে না। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই বুঝতে পারা যাবে যে, জ্যেষ্ঠ জামাইকে গ্ৰীত করবার কারণ কী এবং তাকে গ্ৰীত না করলে কনিষ্ঠা শালীর বিবাহই বা হতে পারে না কেন? তার যে কোনো অধিকার ছিল এবং তাকে তার সে-অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে বলেই তাকে শ্ৰীত করা হচ্ছে, এটাই হচ্ছে ‘জামাইবরণ’-এর স্বাভাবিক ব্যাখ্যা। সে অধিকারটা যে শালীবরণের অধিকার সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আরও একটা কথা আছে। জ্যেষ্ঠ জামাইদের সঙ্গে শালীদের ঘনিষ্ঠতার সঙ্গে ঠাট্টা-তামাশা করবার যে সামাজিক এবং লৌকিক অধিকার আছে, তা-ও সেই লুপ্ত শালীবরণ প্রথারই স্মৃতিচিহ্ন।
মনে হয় যে, অনুরূপভাবে বাঙালি সমাজে একসময় ‘দেবরণ’ প্ৰথাও প্ৰচলিত ছিল। দেবরণ হচ্ছে শালীবরণের বিপরীত প্ৰথা। শালীবরণে স্ত্রীর কনিষ্ঠ ভগিনীদের ওপর জ্যেষ্ঠ ভগিনীপতির যৌন অধিকার থাকে। আর দেবরণে জ্যেষ্ঠ ভাবীর ওপর দেবরের অধিকার। পঞ্চপাণ্ডব যখন বীরভূম জেলার একচক্রা নগরে এসে বাস করেছিলেন, তখন তাঁরা পঞ্চাল রাজকন্যা দ্রৌপদীকে এই প্ৰথা অনুযায়ীই বিবাহ করেছিলেন। (পঞ্চাল রাজ্য যে প্ৰাচ্য ভারতেই অবস্থিত ছিল সেসম্বন্ধে আলোচনা লেখকের ‘বাঙলার সামাজিক ইতিহাস’, পৃষ্ঠা ২৫-এ দ্রষ্টব্য।)