***
দেবালোকের চিত্তবিনোদনের জন্য ছিল অপ্সরা ও গন্ধর্বগণ। এরা তাদের নৃত্য, গীত ও অভিনয় দ্বারা সর্বদা মুখরিত করে রাখত ইন্দ্রের দেবসভা। অপ্সরারা ছিল দেবলোকের বারযোষিৎ। রূপলাবণ্য, সৌন্দর্য ও নৃত্যগীতে পারদর্শিতার জন্য অপ্সরাদের ছিল বিশেষ প্ৰসিদ্ধি। অপসারদের মধ্যে উর্বশী ছিল অনন্যাসুন্দরী। বেদে আছে যে, উর্বশীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে মিত্র ও বরুণের রেতঃপাত হয়েছিল। উর্বশী সম্বন্ধে একাধিক কাহিনী প্ৰাচীন গ্ৰন্থসমূহে আছে। তার মধ্যে একটা কাহিনী হচ্ছে রাজা পুরুরবার সঙ্গে উর্বশীর মিলন। অপর এক কাহিনী হচ্ছে অৰ্জ্জুন যখন দিব্যাস্ত্ৰ সংগ্রহের জন্য দেবলোকে গিয়েছিল, উর্বশী তখন অনঙ্গের বশবর্তী হয়ে অৰ্জ্জুনের সঙ্গে মিলিত হতে চেয়েছিল। উর্বশী ছাড়াও দেবলোকে অপূর্ব লাবণ্যময়ী ও সুন্দরী আরও অপ্সরা ছিল; যথা— মেনকা, রম্ভ, তিলোত্তমা, ঘৃতাচী, সুকেশী, মধুঘোষা, অলম্বুষা, বিদ্যুৎপর্ণা, সুবাহু, সুপ্রিয়া, সরসা, পঞ্জিকাস্থলা ও বিশ্বাচী।
অপ্সরাদের যৌনসম্পর্ক ছিল গন্ধৰ্বদের সঙ্গে। সঙ্গীতবিদ্যায় তারা বিশেষ পারদর্শী ছিল। দেবলোকে তারা অপ্সরাদের সঙ্গে গায়ক হিসাবে যোগদান করত। অপসারদের সঙ্গে তারা অবাধে মেলামেশা করত। সেজন্য নারী ও পুরুষের মধ্যে অবাধ মেলামেশার ফলে যে বিবাহ হয়, তাকে গান্ধৰ্ব-বিবাহ বলা হয়। অন্সর ও গন্ধৰ্বদের সমৃদ্ধিশালী পুরী ও প্ৰাসাদ ছিল। সেখানেই অবস্থিত ছিল তাদের অন্দরমহল। মর্ত্যের সরোবরেও তারা মাঝে মাঝে দেবকীন্তাদের সঙ্গে প্ৰমোদ করতে আসত। (দেবলোকে প্রমীলাদের পুরুষভজনা সম্বন্ধে বিশদ বিবরণের জন্য লেখকের ‘দেবলোকের যৌনজীবন’ গ্ৰন্থ দ্রষ্টব্য।)
বিবাহের মঞ্চে প্ৰমীলা
আগেই বলেছি যে বৈধভাবে প্ৰমীলার পুরুষভজনা নির্ভর করে সামাজিক রীতিনীতি ও বিধানের উপর। এটা বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রকমের। উত্তর ভারতের হিন্দুসমাজে বিবাহ কখনও নিকট আত্মীয়ের মধ্যে হয় না। সেখানে বিবাহ গোত্র-প্রবর বিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ত৷ ছাড়া, উত্তর ভারতে সপিণ্ডদের মধ্যেও কখনও বিবাহ হয় না। দক্ষিণ ভারতের হিন্দুসমাজে কিন্তু তা নয়। সেখানে মামা-ভাগনী ও মামাতোপিসতুতো ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহ হচ্ছে বাঞ্ছনীয় বিবাহ। ওড়িশার হিন্দুসমাজে আবার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার বিধবাকে দেবর কর্তৃক বিবাহ করা বাধ্যতামূলক। হিন্দুসমাজের মতো আদিবাসী সমাজেও নিজ টটেমগোষ্ঠীর মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ। কিন্তু উত্তর-পূর্ব সীমান্তের আদিবাসী সমাজভুক্ত লাখের, বাগনী ও ডাফল জাতির লোকেরা বিধবা বিমাতাকে বিবাহ করে। আসামের গারো জাতির লোকেরা বিধবা শাশুড়ীকে বিবাহ করে। ওড়িশার আদিবাসী সমাজে শবরজাতির লোকেরা বিধবা খুড়ীকে বিবাহ করে।
উত্তর ভারতের নানা স্থানে বিবাহ রাত্রিকালেই সম্পাদিত হয়। বাঙলা দেশেও তাই। কিন্তু তামিলনাডু ও গুজরাটে রাত্রিকালে বিবাহ নিষিদ্ধ। সেখানে বিবাহ দিনের বেলাতেই হয়। আবার উত্তর ভারতে কনের সিঁথিতে সিন্দুরদানই বিবাহের প্রধান অনুষ্ঠান। সিঁথিতে সিন্দুর থাকাই সেখানে সধবার লক্ষণ। দক্ষিণ ভারতে কিন্তু তা নয়। সেখানে সিঁথিতে সিন্দুর লেপার কোনো বালাই নেই। গলায় ‘তালি’ বন্ধন করে দেওয়াই দক্ষিণ ভারতে বিবাহের প্রধান অনুষ্ঠান। গলায় ‘তালি’ থাকাই সেখানে সধবার লক্ষণ। উত্তর ভারতের আদিবাসী সমাজে সাঁওতাল প্ৰভৃতি জাতির মধ্যেও সিন্দুরদানই বিবাহের প্রধান অনুষ্ঠান। এমনকি কোনো পুরুষ যদি কোনো মেয়ের সিঁথিতে জোর করে সিন্দুর লেপে দেয়, তা হলে তাদের স্বামী-স্ত্রীরূপে গণ্য করতে হয়। দক্ষিণ ভারতের আদিবাসী সমাজে কিন্তু তালিবন্ধনই বিবাহের লক্ষণ। সেখানে গলায় তালি থাকলেই বুঝতে হবে যে, সে মেয়ে সধবা। তাছাড়া, পোশাক-আশাকের ব্যাপারেও এই স্বাতন্ত্র্য লক্ষিত হয়। উত্তর ভারতে সধবারা পাড়ওয়ালা (বিশেষ করে লাল পাড়) শাড়ি পরে। বিধবারা সাদা থান ধুতি পরে। দক্ষিণ ভারতে সে নিয়ম নেই। রাজস্থানের শাহাপুর গ্রামে কোনো লোক যদি কোনো অনুঢ়া মেয়ের কাছ থেকে জল (পানি) চায়, তা হলে তাকে সেই মেয়েকে বিবাহ (পাণিগ্রহণ) করতে হয়।
***
ভারতে বিবাহের ইতিহাস ভারী চমকপ্ৰদ। সে ইতিহাস আমি দিয়েছি আমার ‘ভারতে বিবাহের ইতিহাস’ ও ‘সেকস অ্যাণ্ড ম্যারেজ ইন ইণ্ডিয়া’ নামে বই দু’খানায়। ঋগ্বেদের যুগে মাত্র দু’রকমের বিবাহ প্ৰচলিত ছিল। একরকম বিবাহে বাপ-মা নিজের নির্বাচন করে। ছেলেমেয়েদের বিবাহ দিত। আর একরকম বিবাহে ‘সমান’ উৎসবে (এই উৎসব অনেকটা আজকালের ‘অলিম্পিক উৎসবের মতে) ছেলেমেয়েরা ‘অবাধে মেলামেশা করে নিজেরাই মনোমতো স্বামী-স্ত্রী নির্বাচন করত। তারপর চাররকম বিবাহের উদ্ভব হয়; যথা -ব্ৰাহ্ম, গান্ধৰ্ব, আসুর ও রাক্ষস -বিবাহ। এর মধ্যে মাত্র ব্ৰাহ্ম-বিবাহেই মন্ত্র উচ্চারণ ও যজ্ঞ সম্পাদনের প্রয়োজন হ’ত। বাকি তিনরকম বিবাহে এসবের কোনো বালাই ছিল না। কিন্তু যাজ্ঞবল্ক্য ও মনু স্মৃতিতে আমরা আটরকম বিবাহের উল্লেখ পাই। এই আটরকম বিবাহ হচ্ছে যথাক্রমে ব্ৰাহ্ম, দৈব, আৰ্য, প্রাজাপত্য, আসুর, গান্ধৰ্ব, রাক্ষস ও পৈশাচ। ব্ৰাহ্ম-বিবাহ ছিল ব্ৰাহ্মণ্য আচারসম্পৃক্ত বিবাহ। এই বিবাহে মন্ত্র উচ্চারণ ও যজ্ঞানুষ্ঠান করে সবস্ত্রা, সালঙ্কার ও সুসজ্জিতা কন্যাকে বয়ের হাতে সম্প্রদান করা হ’ত। আর প্রাচীন ঋষিদের মধ্যে যে বিবাহ প্রচলিত ছিল, তার নাম ছিল আর্য-বিবাহ। এই বিবাহে যজ্ঞে ব্যবস্থাত ধৃত প্ৰস্তুতের জন্য মেয়ের বাবাকে বর একজোড়া গোমিথুন উপহার দিত। যজ্ঞের ঋত্বিককে দক্ষিণ হিসাবে যেখানে কন্যা দান করা হ’ত, তাকে বলা হ’ত দৈব-বিবাহ।‘তোমরা দুজনে যুক্ত হয়ে ধর্মাচরণ কর’-এই উপদেশ দিয়ে যেখানে বরের হাতে মেয়েকে। দেওয়া হ’ত, তাকে বলা হ’ত প্ৰাজাপত্য-বিবাহ। ঋগ্বেদ, অথর্ববেদ ও গৃহসূত্রসমূহ থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, বৈদিক যুগে বিবাহ প্ৰাপ্তবয়স্ক বর-কনের মধ্যেই সংঘটিত হ’ত। বিবাহ কনের বাড়িতেই হ’ত। ঋগ্বেদের যুগে বিবাহের কোনো আনুষ্ঠানিক বাহুল্য ছিল না। আনুষ্ঠানিক বাহুল্য গৃহসূত্রের যুগে উদ্ভূত হয়।