দ্বাপরে বিষ্ণু কৃষ্ণ হয়ে যখন জন্মগ্রহণ করেছিলেন তখন তাঁর অন্তঃপুরে ষোল হাজার একশত স্ত্রী ছিল। (বিষ্ণুপুরাণ অনুযায়ী ষোল হাজার একশত, ষোল হাজার নয়)। সাধারণ লোকের ধারণা, এরা সকলেই গোপকন্যা। কিন্তু সে-ধারণা ভুল। বিষ্ণুপুরাণ (৫। ১১১৪) অনুযায়ী তারা নানা দেশ থেকে অপহৃত নারী ছিল। পুরাণে লিখিত আছে যে, একই সময় পৃথক পৃথক ভাবে কৃষ্ণ সেইসকল কন্যার ধর্মানুসারে বিধি অনুযায়ী পাণিগ্রহণ করেছিলেন, যাতে সেই কন্যাগণ, প্ৰত্যেকে মনে করেছিল যে কৃষ্ণ শুধুমাত্র তাকেই বিবাহ করলেন। তাছাড়া, প্রতি রাত্রেই তিনি তাদের প্রত্যেকের ঘরে গমনপূর্বক বাস করতেন। (‘নিশাসু চ জগৎস্রষ্টা তাসাং গেহেষু কেশবঃ’)।
***
এবার শিবের কথায় আসা যাক। শিবের নিবাস কৈলাসে। সেখানেই তার অন্দরমহল। শিবেব অনুচররা হচ্ছে নন্দী ও ভূঙ্গী, বিদ্যাধরী-বিদ্যাধরীরা ও প্রমথগণ। শিব মহাযোগী। কিন্তু শিবের ধনদৌলত অনেক। সেজন্য শিবের একজন ধনরক্ষক ছিল। নাম যক্ষরাজ কুবের। কুবেরের পিতা পৌলস্ত্য বা বিস্ৰবা, মাতা ভরদ্ধাজ-কন্যা দেববর্ণিনী। কুবেরের বৈমাত্রেয় ভাই রাবণ। রাবণ লঙ্কার অধিকার চাইলে কুবের কৈলাসে গিয়ে বাস করে। শিব তাকে তার ধনরক্ষক নিযুক্ত করে। কুবেরের স্ত্রী আহুতি; নলকুবর ও মণিগ্রীব তার দুই ছেলে ও মীনাক্ষী তার মেয়ে।
শিবকে সব দেবতাই মান্য করে। সেজন্য শিবকে মহাদেব বলা হয়। শিবের মানসন্ত্ৰম-জ্ঞান খুব বেশি। ব্ৰহ্মা একবার শিবকে অপমানসুচক কথা বলেছিলেন বলে নিজের একটা মুণ্ড হারিয়েছিলেন। (আগে ব্ৰহ্মার পাঁচ মুণ্ড ছিল, কিন্তু সেই থেকেই ব্ৰহ্মার চার মুণ্ড হয়)। শিব অত্যন্ত রাগী মানুষ। কিন্তু আবার সহজেই তুষ্ট হন। শিব সংহারকর্তা। আবার সংহারের পর সৃষ্টিকর্তাও বটে।
অন্তঃপুরের মধ্যে শিবের মতো স্বামীকে নিয়ে ঘর করা শিবানীর পক্ষে খুব মুশকিলের ব্যাপার ছিল। শিব প্রথম বিয়ে করেছিলেন দক্ষকন্যা সতীকে। ভূগুষজ্ঞে শিব শ্বশুরকে প্ৰণাম করেননি বলে, দক্ষ ক্ৰন্ধ হয়ে শিবহীন যজ্ঞ করে। সতী অনিমন্ত্রিতা হয়েও সেই যজ্ঞে উপস্থিত হয়। সেখানে সতীকে দেখে দক্ষ শিবনিন্দা শুরু করায়, সতী যজ্ঞস্থলে প্ৰাণত্যাগ করে। শিব সে-সংবাদ পেয়ে দক্ষালয়ে যায় ও দক্ষযজ্ঞ নাশ করে। দক্ষের মুগুচ্ছেদ করেন। তারপর সতীর মৃতদেহ নিয়ে প্ৰলয়-নাচন নাচতে শুরু করেন। তখন বিষ্ণু সুদর্শনচক্র দ্বারা সতীর দেহ খণ্ড-খণ্ড করে কেটে ফেলেন। যে-সব জায়গায় সতীর দেহখণ্ড পড়ে, সে-সব জায়গাই পরে পীঠস্থান হয়ে দাঁড়ায়। সতী পরে জন্মান্তরে হিমালয়-কন্যা পাৰ্বতী হয়ে জন্মগ্রহণ করে ও কঠোর তপস্যা দ্বারা শিবকে পতিরূপে পায়।
শিব অত্যন্ত সংযমী দেবতা। ব্ৰহ্মার আদেশে বিশ্বকর্ম যখন তিলোত্তমাকে সৃষ্টি করেছিল, ব্ৰহ্মা তখন তার চার মুণ্ড ও ইন্দ্ৰ তার সহস্ৰ নয়ন দিয়ে তাকে দেখেছিলেন। দেবতাদের মধ্যে শিবই তখন স্থির হয়ে বসেছিলেন। সেজন্য শিবের নাম স্থাণু।
শিব সংযমী দেবতা বলে, সব সময়েই কঠোর তপস্যায় রত থাকতেন। অন্দরমহলে শিবানীর সঙ্গে তাঁর মিলন বড় একটা হ’ত না। এই মিলন ঘটাবার জন্য দেবতারা কামদেবকে নিযুক্ত করেছিল। এই মিলনের ফলে দেবসেনাপতি কাৰ্তিকেয়ার জন্ম হয়। এছাড়াও শিব ও শিবানীর আরও ছেলেপুলে হয়েছিল; যথা, পুত্র গণেশ ও দুই কন্যা লক্ষ্মী ও সরস্বতী। কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব’ অনুযায়ী শিব ও শিবানীর রমণক্রিয়া দেখবার জন্য অগ্নিদেবের একবার কৌতূহল হয়েছিল। সেজন্য অগ্নি পারাবতাকারে সেই রমণক্রিয়া দেখতে এসেছিল। শিবানী অগ্নিদেবকে দেখে রমণক্রিয়া হতে নিবৃত্ত হন। শিব তখন ক্রোধবশত তাঁর বীর্য অগ্নিদেবের প্রতি নিক্ষেপ করেন। অগ্নিদেব সে-বীর্ষের তেজ সহ্য করতে না পেরে তা গঙ্গায় বিসর্জন দেয়। আর একবার শিবানীকে দেখে ফেলবার জন্য কুবেরের এক চক্ষু বিনষ্ট হয়েছিল।
মহাযোগী হলেও শিব খুব আমুদে দেবতা ছিলেন। সঙ্গীত ছিল তার প্রিয় বিনোদনের উপায়। সঙ্গীতজ্ঞ হিসাবে শিবের খুবই সুনাম ছিল। সঙ্গীতবিদ্যায় শিব নারদকেও পরাহত করেছিলেন। শিবের সঙ্গীতের শ্ৰোতা ছিলেন ব্ৰহ্মা ও বিষ্ণু। একবার নারদের গর্ব খর্ব করবার জন্য রাগরাগিণীগণ পথে বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে থাকে। নারদ কারণ জানতে চাইলে তারা বলে, নারদের সুরাহীন গানের জন্যই তাদের এই দুর্দশা; শিব সুললিত কণ্ঠে গান করলে তারা আবার পূর্বরূপ ফিরে পেতে পারে। নারদ তখন শিবকে বহুভাবে তুষ্ট করে, শিবকে গান করতে রাজি করান, কিন্তু শিব বলেন যে, উপযুক্ত শ্রোতা না পেলে তিনি গান করবেন না। তখন ব্ৰহ্মা ও বিষ্ণু শ্রোতা হন।
নৃত্যেও শিবের প্রসিদ্ধি সর্বজনবিদিত। নৃত্যকুশলী বলেই শিবের নাম নটরাজ।
অন্দরমহলে শিবানী শিবের সঙ্গে কৌতুক-পরিহাস করতে ছাড়তেন না। শিবানী একবার পরিহাসচ্ছলে শিবের দুই নেত্রী হস্তদ্বারা আবৃত করেন। তখন সমস্ত পৃথিবী তমাচ্ছন্ন ও আলোকবিহীন হয়। তাতে পৃথিবীর সব মানুষ বিনষ্ট হবার উপক্রম হয়। পৃথিবীর লোকদের রক্ষা করবার জন্য শিব তখন ললাটে তৃতীয় নেত্ৰ উদ্ভব করেন।
স্বামী ও পুত্রদের খাওয়াতে শিবানীকে বেশ বেগ পেতে হ’ত। এর এক মনোরম চিত্র মধ্যযুগের কবি রামেশ্বর তার ‘শিবায়ন কাব্যে দিয়েছেন। রামেশ্বরের বর্ণনা : ‘তিন ব্যক্তি ভোক্ত এক অন্ন দেন সতী। / দুটি সুতে সপ্তমুখ, পঞ্চমুখ পতি ॥ / তিন জনে বার মুখে পাঁচ হাতে খায়। / এই দিতে এল নাঞি হাঁড়ি পানে চায়৷। / সুক্ত খায়্যা ভোক্তা যদি হস্ত দিল শাকে। / অন্নপূর্ণ অন্ন আনি রুদ্রমূর্তি ডাকে।। / কাৰ্তিক গণেশ বলে অন্ন আন মা। / হৈমবর্তী বলে বাছা ধৈৰ্য হইয়া খা।। / উল্বন চর্বণে ফির্যা ফুরাইল ব্যঞ্জন। এককালে শূন্য থালে ডাকে তিনজন॥ / চটপট পিষিত মিশ্রিত কর্য যুষে। / বাউবেগে বিধুমুখী ব্যস্ত হয়্যা আসে।। / চঞ্চল চরণেতে নূপুর বাজে আর। / রিনি রিনি কিঙ্কিণী কঙ্কণ ঝনকার। ৷’