***
দেবতাদের গুরু হচ্ছে বৃহস্পতি। বৃহস্পতির অন্তঃপুরেই ঘটেছিল দেবলোকের সবচেয়ে বড় চাঞ্চল্যকর কেলেঙ্কারি। বৃহস্পতির স্ত্রী হচ্ছে তারা। তারার রূপলাবণ্যে মুগ্ধ হয়ে চন্দ্র একবার তারাকে হরণ করে। এই ঘটনায় বৃহস্পতি ক্রুদ্ধ হয়ে চন্দ্ৰকে শাস্তি দেবার জন্য দেবতাদের সাহায্য প্রার্থনা করে। তারাকে প্ৰত্যপণের জন্য দেবতা ও ঋষিগণ চন্দ্ৰকে অনুরোধ করে। চন্দ্ৰ তারাকে ফেরত দিতে অসম্মত হয় এবং দৈত্যগুরু শুক্রচার্যের সাহায্য প্রার্থনা করে। রুদ্রদেব বৃহস্পতির পক্ষ নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। দেবাসুরের মধ্যে এক ভীষণ যুদ্ধের আশঙ্কায় ব্ৰহ্মা মধ্যস্থ হয়ে বিবাদ মিটিয়ে দেন। চন্দ্ৰ তারাকে বৃহস্পতির হাতে প্রত্যপণ করে। কিন্তু তারা ইতিমধ্যে চন্দ্র কর্তৃক গর্ভবতী হওয়ায়, বৃহস্পতি তাকে গৰ্ভত্যাগ করে তার কাছে আসতে বলে। তারা গৰ্ভত্যাগ করার পর এক পুত্রের জন্ম হয়। এর নাম দসু্য সুস্তম। ব্ৰহ্মা তারাকে জিজ্ঞাসা করেন, এই পুত্র চন্দ্রের ঔরসজাত কিনা। তারা ইতিবাচকউত্তর দিলে চন্দ্ৰ সেই পুত্রকে গ্ৰহণ করে ও তার নাম রাখে বুধ।
এখানে উল্লেখনীয় যে, দেবগুরু বৃহস্পতি নিজেও সাধুচরিত্রের দেবতা ছিলেন না। তিনি কামলালসায় অভিভূত হয়ে নিজ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার স্ত্রী মমতার অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় বলপূর্বক তার সঙ্গে সঙ্গম করেছিলেন।
কচ দেবগুরু বৃহস্পতির পুত্র। সঞ্জীবনীবিদ্যা হরণ করে আনবার জন্য বৃহস্পতি কচকে দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের কাছে পাঠিয়েছিলেন। এই উপলক্ষেই সৃষ্ট হয়েছিল শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানীর সঙ্গে কচের অনুপম প্ৰেমকাহিনী।
***
দেবগুরু বৃহস্পতি ছাড়া, বৈদিক যুগের তিন প্ৰধান দেবতার অন্দরমহল সম্বন্ধে আমরা বললাম। এবার আমরা পৌরাণিক যুগের তিন শ্ৰেষ্ঠ দেবতা-ব্ৰহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের অন্দরমহল সম্বন্ধে বলব। বেদ বা ব্ৰাহ্মণ-গ্ৰন্থসমূহে ব্ৰহ্মার উল্লেখ নেই। সৃষ্টিকর্তা হিসাবে ব্ৰহ্মার স্থলে আছে হিরণ্যগৰ্ভ প্ৰজাপতির উল্লেখ। মনুসংহিতা অনুযায়ী যিনিই ব্ৰহ্মা, তিনিই প্ৰজাপতি। তার মানে, পৌরাণিক যুগে ব্ৰহ্মাই ছিলেন সৃষ্টিকর্তা।
সৃষ্টির প্রারম্ভেই ব্ৰহ্মা অজাচারে (incest) লিপ্ত হয়েছিলেন। ব্ৰহ্মা প্ৰথমে নয়জন মানসপুত্র সৃষ্টি করেন। তারপর এক কন্যা সৃষ্টি করেন। এই কন্যার নাম শতরূপা। ব্ৰহ্মা এই কন্যার রূপে মুগ্ধ হয়ে একেই বিবাহ করেন। এই কন্যার গর্ভ হতেই স্বয়ম্বুব মনুর জন্ম হয়। আবার অন্য কাহিনী অনুযায়ী মনুর সঙ্গে শতরূপার বিবাহ হয়েছিল এবং বিবাহান্তে মনু ও শতরূপ। যখন ব্ৰহ্মাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘পিতঃ, আমরা কোন কর্মের দ্বারা আপনার যথোচিত সেবা করব? ব্রহ্মা বলেছিলেন, ‘তোমরা মৈথুন কর্ম দ্বারা প্ৰজা উৎপাদন কর। তাতেই আমার তুষ্টি।’ এককথায় ব্রহ্মা এক মহান (biological truth-এর প্রবক্তা।
তবে অধিকাংশ পুরাণ অনুযায়ী আমরা ব্ৰহ্মার অন্দরমহলে দেখি শতরূপার পরিবর্তে তাঁর স্ত্রী হিসাবে সরস্বতীকে। ব্ৰহ্মার দুই কন্যাদেবসেনা ও দৈত্যসেনা। দেবসেনা বিয়ে করেছিল শিবানীর পুত্ৰ কাৰ্তিকেয়াকে। আর দৈত্যসেনাকে কেশী দানব বলপূর্বক হরণ করে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিল।
নারীর সৌন্দৰ্য দেখবার জন্য ব্ৰহ্মা লালায়িত। পুরাণে আছে, বিশ্বকর্ম যখন অপ্সরা তিলোত্তমাকে সৃষ্টি করে এবং সৃষ্টির পর তিলোত্তম। যখন দেবতাদের প্রদক্ষিণ করে, তখন তাকে দেখবার জন্য ব্ৰহ্মার চারদিকে চারটি মুখ সৃষ্টি হয়েছিল।
***
পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী প্ৰজাপতি কশ্যপের ঔরসে অদিতির গর্ভে বিষ্ণু জন্মগ্রহণ করেন। বিষ্ণুর দুই স্ত্রী লক্ষ্মী ও সরস্বতী। বিষ্ণুর পুত্ৰ কামদেব। কামদেবের স্ত্রী রতি। অথর্ববেদ অনুযায়ী কামদেব মঙ্গলময় দেবতা। কিন্তু পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী তিনি প্রেম ও প্ৰণয়ের দেবতা।
শ্ৰীমদভাগবত অনুযায়ী পঞ্চম (রৈবত) মন্বন্তরে বিষ্ণু শুক্রের ঔরসে ও তাঁর স্ত্রী বৈকুণ্ঠার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। লক্ষ্মী তার স্ত্রী। লক্ষ্মীর ইচ্ছা অনুযায়ী বিষ্ণু বৈকুণ্ঠলোকে তার আবাসস্থল ও অন্তঃপুর স্থাপন করেন। লক্ষ্মী সাধ্বী স্ত্রী। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিষ্ণু ব্যভিচারে লিপ্ত হতেন। তিনি তুলসী ও বৃন্দার সতীত্ব নাশ করেছিলেন।
দ্বাপরে বিষ্ণুই কৃষ্ণ। রাধিকা তার প্রণয়িনী। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ অনুযায়ী, গোলোকে একদিন রাধিকা কৃষ্ণকে তুলসীর সহিত রতিক্রিয়ায় রত দেখে তুলসীকে অভিশাপ দেয়, ‘তুই মানবীরূপে জন্মগ্রহণ করবি।‘ কিন্তু কৃষ্ণ তুলসীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, ‘তুমি মানবীরূপে জন্মগ্রহণ করলেও তপস্যা দ্বারা আমার এক অংশ পাবে।‘ তুলসী শঙ্খচূড়ের স্ত্রীরূপে মনুষ্যলোকে জন্মগ্রহণ করে। বিষ্ণু ছলনা দ্বারা তুলসীর সতীত্বনাশ করে। পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী শিলারূপী বিষ্ণু সর্বদ তুলসীযুক্ত হয়ে থাকেন। মতান্তরে, বিষ্ণু যখন জলন্ধরের স্ত্রী বৃন্দার সতীত্ব নাশ করেন, তখন বৃন্দা বিষ্ণুকে অভিশাপ দিতে উদ্যত হলে বিষ্ণু বৃন্দাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘তুমি স্বামী জলন্ধরের সঙ্গে সহমৃতা হও। তোমার ভস্মে তুলসী, ধাত্রী, পলাশ ও অশ্বখ এই চারিপ্ৰকার বৃক্ষ উৎপন্ন হবে। ’ এই কাহিনী অনুযায়ী বৃন্দা থেকেই তুলসীর উৎপত্তি।