কিন্তু শচী পতিপরায়ণা হলেও, ইন্দ্ৰ একান্তভাবে স্ত্রীপরায়ণ ছিলেন না। অন্য দেবতাদের মতো ইন্দ্ৰ ব্যভিচারী দেবতা ছিলেন। অজাচারী হবার জন্যও তিনি একবার উদ্যত হয়েছিলেন। তাঁর ব্যভিচারের সর্বজনবিদিত দৃষ্টান্ত হচ্ছে গৌতম ঋষির অনুপস্থিতিতে তাঁর স্ত্রী অহল্যাতে উপগত হওয়া। অহল্যা ইন্দ্ৰকে চিনতে পেরেও সে-সময় কামার্তা ছিল। বলে দুর্মাতিবশত ইন্দ্রের সঙ্গে সঙ্গমে রত হয়েছিল। (এ সম্বন্ধে লেখকের ‘বাঙলা ও বাঙালী’, পৃষ্ঠা ৮৪ দেখুন)।
ইন্দ্রের অজাচারের উল্লেখ পাওয়া যায়। ঋগ্বেদের ১৫২৷৷১৩ সম্বন্ধে সায়ন ভাষ্যে। সে উল্লেখ অনুযায়ী ইন্দ্র একবার বৃষণশ্চ রাজার কন্য মেনা হয়েছিল। পরে ইন্দ্ৰ ইন্দ্ৰত্বে ফিরে আসবার পর মেনাকে প্রাপ্তযৌবনা দেখে স্বয়ং তার সঙ্গে সহবাস অভিলাষ করেছিল। কিন্তু ইন্দ্রের এসব ব্যভিচার ও অজাচারপ্রবৃত্তি নিয়ে ইন্দ্রের অন্দরমহলে শচীর সঙ্গে তার কোনদিন বাকবিতণ্ডা বা কলহ ঘটেনি।
আগেই বলেছি যে, ইন্দ্রের সংসারে বোধহয় তার পিতাও বাস করত। এটা আমরা জানতে পারি ইন্দ্রের সুরাপানের বহর থেকে। বলা হয়েছে, ইন্দ্র এমনই সুরাসক্ত ছিল যে, তার পিতার কাছ থেকেও কেড়ে নিয়ে সে সুরা পান করত।
***
সূক্তসংখ্যার দিক দিয়ে বিচার করলে, ইন্দ্রের পরেই অগ্নি ছিল আৰ্যদের দ্বিতীয় প্রধান দেবতা। অগ্নি দ্যাবাপৃথিবীর পুত্র। আবার বলা হয়েছে, অরণিদ্বয় অগ্নির জনক-জননী। জাত হওয়া-মাত্ৰই অগ্নি জনকজননীকে ভক্ষণ করেছিল। আবার মহাভারতে বলা হয়েছে যে, ধর্মের ঔরসে ও বসুভাৰ্যার গর্ভে অগ্নির জন্ম।
প্রথম উক্তি অনুযায়ী অগ্নির সংসারে তার পিতামাতার অবস্থানের প্রশ্ন ওঠে না। দ্বিতীয় উক্তি সম্বন্ধে মহাভারত নীরব। সুতরাং ধরে নিতে হবে যে, অগ্নির অন্দরমহলে ছিল মাত্র তার স্ত্রী স্বাহা ও তিন পুত্ৰ–পাবক, পবিমান ও শুচি।
ইন্দ্রের অন্দরমহলে শচী যেমন ছিল নিষ্কলঙ্কা রমণী, অগ্নির সংসারে স্বাহ ছিল তেমনই অপবিত্ৰা। স্বাহা ছিল। দক্ষের মেয়ে। বিয়ের আগেই * স্বাহা অত্যন্ত কামাসক্ত ছিল। একবার সপ্তষিদের যজ্ঞে অগ্নি সপ্তর্ষিদের স্ত্রীদের দেখে কামার্ত হয়ে ওঠে। স্বাহা এটা লক্ষ্য করে। স্বাহা তখন এক-এক ঋষিপত্নীর রূপ ধরে ছয়বার অগ্নির সঙ্গে মিলিত হয়। পরে স্বাহা অগ্নির স্ত্রী হয়। কিন্তু অগ্নির অন্তঃপুরে এসেও স্বাহার স্বভাব পরিবর্তিত হয় না। নিজের স্বামীকে ছেড়ে, স্বাহা কৃষ্ণকে স্বামিরূপে পাবার জন্য তপস্যা করতে থাকে। তার মানে, স্বাহ নিজ স্বামীর পরিবর্তে পরপুরুষ কৃষ্ণকেই ভজনা করত। বিষ্ণুর বরে স্বাহা দ্বাপরে নগ্নজিৎ রাজার মেয়ে হয়ে জন্মগ্রহণ করে ও কৃষ্ণকে স্বামিরূপে পায়।
মনুষ্যলোকের মতো অগ্নিও ব্যাধিমুক্ত ছিল না। মহাভারতে আছে অগ্নি শ্বেতকী রাজার যজ্ঞে অতিরিক্ত হব ভক্ষণ করে দুঃসাধ্য অগ্নিমান্দ্য রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। পরে কৃষ্ণ ও অৰ্জ্জুনের সাহায্যে রোগমুক্ত হয়।
***
বৈদিক যুগের অপর প্রধান দেবতা হচ্ছে সূৰ্য। সূর্যের সংসারেও ছিল অশান্তি। তার স্ত্রী সংজ্ঞা তাকে ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। সংজ্ঞা বিশ্বকৰ্মার মেয়ে। সূর্যের সঙ্গে তার বিবাহ হয়েছিল। সংজ্ঞার গর্ভে সূর্যের তিন সন্তান হয়-বৈবস্বত মনু, যম ও যমুনা। কিন্তু সূর্যের অসহ্যু তেজ সহ্য করতে না পেরে, সংজ্ঞা নিজের অনুরূপ ছায়া নামে এক নারীকে সূর্যের কাছে রেখে, উত্তর কুরুবর্ষে ঘোটকীর রূপ ধারণ করে বিচরণ করতে থাকে। সূৰ্য প্রথম এটা বুঝতে পারেনি। ছায়ার সঙ্গেই সূর্য ঘর করতে থাকে এবং ছায়ার গর্ভে সাবর্ণি মনু ও শনি নামে দুই পুত্র ও তপতী নামে এক কন্যা হয়। পরে সূৰ্য যখন এটা জানতে পারে, তখন সূৰ্য বিশ্বকৰ্মার কাছে গিয়ে নিজের তেজ হ্রাস করে অশ্বরূপ ধারণ করে ঘোটকীরূপিণী সংজ্ঞার কাছে এসে তার সঙ্গে সঙ্গমে রত হয়। * এই মিলনের ফলে প্ৰথম যুগল-দেবতা অশ্বিনীকুমার ও পরে রেবন্তের জন্ম হয়। সূর্যের তেজ সংহত হয়েছে দেখে, সংজ্ঞা তখন নিজের রূপ। ধারণ করে স্বামিগুহে ফিরে আসে।
সূৰ্যও পরস্ত্রীতে উপগত হ’ত। মহাভারত অনুযায়ী সূর্যের ঔরসে ও কুন্তীর গর্ভে কর্ণের জন্ম হয়। আবার রামায়ণ অনুযায়ী ঋক্ষরজার গ্রীবায় পতিত সূর্যের বীর্য থেকে সুগ্ৰীবের জন্ম হয়।
সূর্যের অন্দরমহলে ঘটেছিল এক অজাচারের (incest) ঘটনা। যম সূর্যের পুত্র। ঋগ্বেদ অনুযায়ী যমী তার যমজ ভগিনী। ঋগ্বেদে দেখি, যমী তার যমজ ভ্রাতা যমের কাছে সঙ্গম প্রার্থনা করছে। কাহিনীটি ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের দশম সুক্তে আছে। সেখানে যমী। যমকে বলছে, ‘চল আমরা এক নির্জন স্থানে গিয়ে সহবাস করি, কেননা বিধাতা মনে মনে চিন্তা করে রেখেছেন যে তোমার ঔরসে আমার গর্ভে আমাদের পিতার এক সুন্দর নপ্ত (নাতি) জন্মিবে।‘ যম তার উত্তরে বলে, ‘তোমার গর্ভসহচর তোমার সঙ্গে এ-প্রকার সম্পর্ক কামনা করে না। যেহেতু তুমি সহোদর ভগিনী, তুমি অগম্যা৷’ যমী তার উত্তরে বলছে, ‘যদিও মানুষের পক্ষে এরূপ সংসৰ্গ নিষিদ্ধ, দেবতারা এরূপ সংসৰ্গ ইচ্ছাপূর্বক করে থাকে। তুমি আমার প্রতি অভিলাষযুক্ত হও, এস এখানে আমরা উভয়ে শয়ন করি। আমি তোমার নিকট আমার নিজ দেহ সমৰ্পণ করে দিই।‘ যমের উক্তি : ‘তোমার ভ্রাতার এরূপ অভিলাষ নেই।‘ উত্তরে যমী বলে, ‘তুমি নিতান্ত দুর্বল পুরুষ দেখছি।‘ (ঋগ্বেদ ১০.১০.৭-১৪)