ইন্দ্রকে বলা হ’ত দেবরাজ। সেজন্য ইন্দ্রের অন্দরমহলাই ছিল আদশ অন্দরমহল। ইন্দ্রের অন্দরমহলে বাস করত ইন্দ্রের স্ত্রী ও সন্তান। বোধহয় ইন্দ্রের পিতাও ওই একই সংসারে থাকত।
ইন্দ্রের স্ত্রী ইন্দ্ৰাণী নামে পরিচিত। ইন্দ্রের স্ত্রী বলেই তাকে ইন্দ্ৰাণী বলা হ’ত। তা না হলে, তার আসল নাম ছিল শচী। তৈক্তিরীয় ব্ৰাহ্মণ অনুযায়ী ইন্দ্ৰ যৌন আবেদনে আকৃষ্ট হয়ে অন্য সুন্দরীদের প্রত্যাখ্যান করে ইন্দ্ৰাণীকে বিয়ে করেছিল। কিন্তু অন্যান্য গ্রন্থে আছে যে, ইন্দ্ৰ ইন্দ্রাণীর সতীত্ব নষ্ট করে ও তার পিতা পুলোমাকে হত্যা করে ইন্দ্ৰাণীকে বিবাহ করেছিল।
প্ৰজাপতির ন্যায় ইন্দ্র স্বয়ম্বু দেবতা নয়। ত্বষ্টা তার পিতা, অদিতি তার মাতা। স্বাভাবিকভাবে মায়ের গর্ভদ্বার দিয়ে ইন্দ্ৰ নিৰ্গত হয়নি। ইন্দ্ৰ মায়ের পেট বিদীর্ণ করে পেটের পাশ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল।
ইন্দ্রের মতো স্বামীকে নিয়ে ঘর করায় শচীয় যথেষ্ট কৃতিত্ব ছিল। শুধু তাই নয়, দেবলোকের অন্য মেয়েদের মতো শচীর চরিত্র কলঙ্কিত ছিল না। শচী ছিল পতিপরায়ণ স্ত্র, যদিও অন্দরমহলে শচীর স্বস্তি ছিল না। স্বামী ছিল সুরাপায়ী ও ব্যভিচারী। দেবতাদের সুরা ছিল সোমরস, যা মনুষ্যলোকেও ঋষিয়া ও মানুষেরা পান করত। ঋগ্বেদে বলা হয়েছে ইন্দ্র এত সোমরস পান করত যে, তার উদর ছিল সোমরসের হ্রদ। অত্যধিক সোমরস পানের ফলে তার উদর সবসময়। স্ফীত হয়ে থাকত। সুরাপায়ী, দেবতা হলেও, যৌনজীবনে ইন্দ্ৰ ইন্দ্ৰাণীর প্ৰতি অমনোযোগী ছিল না। এর কারণ মনে হয় ইন্দ্ৰাণী এক বিশেষ রকম রমণ-পদ্ধতিতে অভিজ্ঞা ছিল। এটা আমরা জানতে পারি বাৎস্যায়নের কামসূত্র থেকে। নাগরিক সমাজের লোকেরা কিভাবে তাদের যৌনজীবনকে সুখময় করে তুলত, তার পরিচয় দিতে গিয়ে, বাৎস্যায়ন তাঁর ‘কামসূত্ৰ’-তে মানুষ যতরকম পদ্ধতিতে (coital postures) রতিক্রিয়ায় প্ৰবৃত্ত হতে পারে তার এক বিবরণ দিয়েছেন। বাৎস্যায়ন এক বিশেষ রকম পদ্ধতিতে রমণের নাম দিয়েছেন ‘ইন্দ্রাণিক রতি’। তিনি বলেছেন, যেহেতু ইন্দ্ৰাণী শচী এই বিশেষ পদ্ধতিতে রতিক্রিয়া করতে ভালবাসতেন, সেইহেতু এই পদ্ধতির নাম ‘ইন্দ্রাণিক রতি’। পদ্ধতি যাই হোক, ইন্দ্রের ঔরসে শচীর এক পুত্র হয়েছিল, নাম জয়ন্ত।
মনুষ্যসমাজে মানুষ যেমন ব্যাধি ও মহামারীতে বিব্রত হয়, ইন্দ্রের অন্দরমহলেও একবার তাই ঘটেছিল। ইন্দ্রের একমাত্র পুত্র জয়ন্তু একবার বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। কাহিনীটা সুন্দরভাবে বিবৃত করেছেন দাশু রায় তাঁর পাঁচালীতে। এই কাহিনী অনুযায়ী রাজা নহুষ একবার পুত্ৰেষ্টি যজ্ঞ করেছিলেন। যজ্ঞাগ্নি নিৰ্বাপিত হয়ে শীতল হলে, তা থেকে এক পরমাসুন্দরী রমণী আবির্ভূত হন। ব্ৰহ্মা ষ্ঠার নাম দেন শীতলু, এবং বলেন, ‘তুমি পৃথিবীতে গিয়ে বসন্তের কালাই ছাড়াও। এরূপ করলে লোকে তোমার পূজা করবে।‘ শীতলা বললেন, ‘আমি এক পৃথিবীতে গেলে লোকে আমার পূজা করবে না, আপনি আমার একজন সঙ্গী দিন।‘ ব্ৰহ্মা পৃষ্ঠাকে কৈলাসে শিবের কাছে যেতে বলেন। শীতলা কৈলাসে গিয়ে শিবের কাছে তার প্রয়োজনেয়। কথা বলেন। মহাদেব চিন্তিত হয়ে ঘামতে থাকেন। তঁরা ঘাম থেকে জরামুর নামে এক ভীষণাকার অসুর স্বষ্টি হয়। জরাসুর শীতলার সঙ্গী হয়। কিন্তু শীতলা বলেন, ‘দেবতারা যদি আমার পূজা না করেন, তাহলে পৃথিবীর লোক আমার পূজা করবে। কেন? তখন শিব তাঁকে বৃদ্ধ ব্রাহ্মণীর বেশে ইন্দ্রপুরীতে যেতে বলেন। ইন্দ্রপুরীর রাস্তা দিয়ে যাবার সময় জ্বরাসুরের মাথা থেকে বসন্তের কলাইয়ের ধামাটা রাস্তায় পড়ে যায়। সে-সময় ইন্দ্রের ছেলে জয়ন্ত সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। শীতলা তাকে ধামাটা জ্বরাসুরের মাথায় তুলে দিতে বলেন। ইন্দ্রের ছেলে এটা তার পক্ষে মৰ্যাদাহানিকর মনে করে ব্ৰাহ্মণীকে ঠেলে ফেলে দেয়। শীতলার আদেশে জরাসুর ইন্দ্রের ছেলেকে আক্রমণ করে। এর ফলে ইন্দ্রের ছেলে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়। তারপর শীতলা দেবসভায় গিয়ে ইন্দ্ৰকে আশীৰ্বাদ করেন। ইন্দ্ৰ তো চটে লাল! ভাবেন, সমস্ত জগতের লোক তাঁকে পূজা করে, আর এ কোথাকার এক বুড়ী এসে র্তাকে আশীৰ্বাদ করছে! এর আস্পর্ধা তো কম নয়! ইন্দ্র তাকে মেরে তাড়িয়ে দেন। তারপর ইন্দ্র নিজেও বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। অন্য দেবতারাও হন। মহামায়ার দয়া হয়। তিনি গিয়ে শিবের শরণাপন্ন হন। শিব বলেন, ‘দেবতারা সকলে শীতলার পূজা করুক, তাহলে রোগমুক্ত হবে।‘ তখন দেবতারা ঘটা করে শীতলার পূজা করে। (সম্পূর্ণ কাহিনীটির জন্য লেখকের ‘বাঙলা ও বাঙালী’ গ্রন্থের ১০২-১০৩ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)।
ইন্দ্র ও তার পুত্র জয়ন্ত দুজনেই যখন বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়েছিল, তখন ইন্দ্রের অন্দরমহলে ইহলোকের স্ত্রী ও জননীদের মতো, ইন্দ্রাণীকেও বিনিদ্র রজনী কাটাতে হয়েছিল। আবার ইহুলোকের মেয়েদের মতো ইন্দ্ৰাণীকেও শীতলা। পুজার ব্যবস্থা করতে হয়েছিল।
ইন্দ্ৰাণী অত্যন্ত পতিপরায়ণা রমণী ছিল। এটা আমরা জানতে পারি রাজা নহুষের কাহিনী থেকে। একবার দেবতা ও মহৰ্ষিরা ব্ৰহ্মহত্যা ও মিথ্যাচারে বৃত্ৰাসুরকে নিহত করার জন্য ইন্দ্রকে স্বৰ্গ থেকে বিতাড়িত করেন। তঁরা রাজা নহুষকে ইন্দ্রের আসনে বসান। কিন্তু ইন্দ্র ছিল ব্যভিচারী দেবতা। সুতরাং আসনের দোষ যাবে কোথায়? নহুষ কামার্তে হয়ে ইন্দ্রের স্ত্রী শচীকে হস্তগত করবার চেষ্টা করে। শচী বিপদাপন্ন হয়ে নিজেকে নহুষের কামলালসা থেকে রক্ষা করবার জন্য দেবগুরু বৃহস্পতির শরণাপন্ন হয়। বৃহস্পতির পরামর্শে শচী নহুষকে বলে যে, নাহুষ যদি সপ্তর্ষি-বাহিত যনে তার কাছে আসে, তাহলে সে নহুষের সঙ্গে মিলিত হতে পারে। নাহুষ সপ্তর্ষি-বাহিত শিবিকায় যাবার সময় অগস্ত্যের মাথায় পা দিয়ে ফেলে। এর ফলে, অগস্ত্যের শাপে নহুষ অজগরসর্পরূপে বিশাখাযুপ বনে পতিত হয়। এভাবে শচীর সতীত্ব রক্ষা পায়।