***
এসব থেকে মনে হয় যে, মেয়ের পুরুষের আধিপত্যটা দাম্পত্যজীবনের আনুষঙ্গিক ব্যাপার হিসাবেই গ্রহণ করে। আমি আবার সেই ভৈরব ও দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুর রামকৃষ্ণের কথাতেই ফিরে আসছি। নারীর দুটি ভাব—নারী কামিনী ও জননী। মানুষের পারিবারিক জীবনে এ-ফুটি ভাবই গঙ্গা-যমুনার মতো সম্মিলিত ধারাতে প্রবাহিত। কামিনী হিসাবে নারীর আছে যৌনক্ষুধা। সেটার নিবৃত্তি করতে গিয়েই সে সন্তানবতী হয়। তখনই তার জননীরূপ প্রকাশ পায়। কিন্তু জননীরূপে সন্তানকে প্রতিপালন করতে হলে পুরুষকে তার দরকার হয়। সুতরাং পুরুষের আধিপত্য তাকে মানতেই হয়। এককথায় পুরুষ তার মাত্র প্রণয়ী নয়, পুরুষ তার সস্তানের জনক ও পালক, পুরুষ তার হাতিয়ার-বিশেষ।
জননী-ভাবটা যদি ছেড়েই দিই, কামিনী হিসাবে তার আদিম যৌনক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য পুরুষ তার কাছে অপরিহার্য। সেজন্যই আমরা প্রথম বিদ্রোহী নারী সাদ (George Sand)-কে দেখি বারবার পুরুষের হাতে আত্মসমপণ করতে। বিংশ শতাব্দীতেও আমরা দেখেছি অস্তিবাদী লেখিকা সিমোন দ্য বভোয়ার (যিনি নারীজীবন সম্বন্ধে সবচেয়ে বেশি অনুশীলন করেছেন) কুমারী হয়েও আত্মসমপণ করেছেন পল দ্য সারতার (Paul de Sartre) কাছে। এ সম্পর্কে মনে পড়ে যায় শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত ও রাজলক্ষ্মীকে। কিন্তু শরৎচন্দ্র শ্রীকান্ত ও রাজলক্ষ্মীর মধ্যে যে সম্পর্ক চিত্রিত করেছেন, সে সম্পর্কট সম্পূর্ণ অবাস্তব সম্পর্ক। এটা Platonic love-এর সম্পর্ক। বাস্তব জীবনে স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে এরকম Platonic love-এর সম্পর্ক একেবারেই বিরল। সেদিক থেকে রবীন্দ্রনাথ তার চার অধ্যায়?-এ একেবারেই বাস্তব। সেখানে রবীন্দ্রনাথ বাস্তব ও জৈব সত্যের বাসরঘরে শেষ চুম্বন দিয়েই তাঁর কাহিনী শেষ করেছেন।
সারা পৃথিবীতে যদিও নারী ও পুরুষের সংখ্যা প্রায় সমান সমান, তা সত্ত্বেও নারী যে পুরুষের সমান নয়—অসমান, সে বিষয়ে সে খুবই সচেতন। শিক্ষাদীক্ষা, খেলাধুলা, পেশা ও কর্মনিযুক্ততায় নারী অনেকদূর এগিয়ে গেলেও সে তার জৈব জীবনে স্বাবলম্বী নয়। জৈব জীবনে নারী তখনই স্বাবলম্বী হয়, যখন সে পুরুষের কণ্ঠলগ্ন হয়ে থাকে। এজন্যই মধ্যযুগের নারী তার আর্তি প্রকাশ করেছিল এক গীতের মাধ্যমে। করুণ কণ্ঠে সে গেয়ে উঠেছিল—‘ওপার হতে বাজাও বাঁশী, এপার হতে শুনি।/ অভাগিয়া নারী আমি, সাঁতার নাহি জানি॥’
পুরুষকে না পেয়ে সে নিজেকে অভাগী বলেই মনে করেছিল।
***
এটা নারীর দুর্বলতা হোক বা আদিম অভিশাপই হোক, নারী শিক্ষিতাই হোক বা অশিক্ষিতাই হোক, সে চায় পুরুষের সান্নিধ্য; তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকুক না কেন পুরুষের আধিপত্য। অশিক্ষিত নারীদের কথা ছেড়েই দিলাম; শিক্ষিত নারীদের প্রবণতা এ-সম্পর্কে সবাক সাক্ষ্য বহন করে। খবরের কাগজে পাত্র-পত্রিী চাই স্তম্ভটা দেখলেই এটা বুঝতে পারা যায়। আমার সামনে যে কাগজখানা পড়ে রয়েছে, সেখান খুলে দেখি শিক্ষিত মেয়েদের জন্য পাত্রের সন্ধান অসংখ্য। গুনে দেখি মাত্র একদিনের কাগজেই রয়েছে ১৫৩টা বিজ্ঞাপন। যাদের জন্য পাত্র খোজা হচ্ছে, তারা এম. এ, বি. টি. থেকে স্নাতক ও ফাস্ট-ক্লাস স্নাতক অনার্স। একজন আছে বি. কম., ম্যানেজমেণ্ট ডিপ্লোমাপ্রাপ্ত মেয়ে। তিনজন লাইব্রেরিয়ান ডিপ্লোমাপ্রাপ্ত। একজন ডাক্তার। বয়স ১৯ থেকে ৩৭। অধিকাংশ বিজ্ঞাপনেই বলা হয়েছে যে, পাত্রী ফর্সা ও সুশ্রী। ১৫৩ জনের মধ্যে ৬৫ জন চাকরিতে রত। কেউ অধ্যাপিকা, কেউ কেন্দ্রীয় সংস্থায় চাকরি করে, কেউ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের স্টেনোগ্রাফার, আবার কেউ-বা শিক্ষিকা। দু-একজন আইনজ্ঞও আছে। কেউ কেউ অসবর্ণ বিবাহ করতেও রাজি। এককথায় সকলেই শিক্ষিতা ও আধুনিক স্ত্রী-স্বাধীনতার প্রতীক। কিন্তু সকলেই বিবাহিতা হবার জন্য লালায়িত। সকলেই পুরুষের সঙ্গিনী হতে চায়, যদিও জানে এর মানে পুরুষের আধিপত্য স্বীকার করা। এটা যে নিছক পাগলামি নয়, তা সকলেই স্বীকার করবেন। পুরুষ-ভজনার জন্য কেন এই প্রবণতা? তার কারণ আর কিছুই নয়, নারী কামিনী ও জননী। কামিনী হিসাবে আছে তার আদিম যৌনক্ষুধা, আর জননী হিসাবে আছে তার মাতৃত্বের গর্ব। মাতৃত্বের গর্ব যে কত গভীর, তা উনিশ শতকের ঔপন্যাসিক মিসেস উড-এর ‘ইস্ট লীন’ উপন্যাসখান পড়লেই বুঝতে পারা যায়। মাতৃত্বের গর্বই হচ্ছে ‘প্রমীলা কেন পুরুষ ভজে?’—প্রশ্নের উত্তর। তবে বৈধতার সঙ্গে প্রমীলা কাকে ভজবে, সেটা নির্ভর করে সামাজিক রীতিনীতি ও বিধানের ওপর।
দেবালোকে প্রমীলা
মাত্র ইহলোকেই যে প্রমীলা পুরুষ ভজে, তা নয়। দেবলোকেও সে ঘরকন্না করে পুরুষ দেবতাদের সঙ্গে, দেবলোকের অন্তঃপুরে। মানুষ তার দেবতাদের নিজ প্রতিরূপেই কল্পনা করে নিয়েছিল। সেজন্য আমরা মনুষ্যলোকের অন্তঃপুরের সঙ্গে দেবতাদের অন্তঃপুরের কোনো প্ৰভেদ দেখি না। মনুষ্যলোকের অন্তঃপুরে যেমন একদিকে দেখা যায় পাতিব্ৰত্য ও অপরদিকে ব্যভিচার, দেবলোকের অন্তঃপুরেও তেমনই একদিকে দেখা যায় পতিভক্তির চরম নিদর্শন ও অপরদিকে ব্যভিচারী স্বামী ও স্ত্রী। মনুষ্যলোকে যেমন সাধী স্ত্রী বিব্রত হয় মুরাপায়ী স্বামীকে নিয়ে এবং ব্যাধি ও মহামারীর প্রকোপে, দেবলোকেও তাই।