***
এ-সম্পর্কে পরবর্তীকালের মুঘল-অন্তঃপুরের একটা রীতি উল্লেখের দাবি রাখে। মুঘল বাদশাহগণের মেয়ের (বাদশাজাদীরা) সাধারণত পবিত্র বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হ’ত না। তার আজীবন অবিবাহিত থেকে বিবাহিত জীবনের দৈহিক সুখ গোপনে উপভোগ করত। কথিত আছে, সম্রাট আকবর নাকি এই ঘৃণিত প্রথা প্রবর্তন করেছিলেন। মনে হয়, বাদশাজাদীর স্বামী ভবিষ্যতে সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে বিবাদ করতে পারে এবং অসীম শক্তিশালিনী বাদশাজাদী স্বামীর স্বার্থের জন্য ভ্রাতা বা পিতার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করতে পারে, এই আশঙ্কায় মুঘল সম্রাটগণ তাদের মেয়েদের বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করতেন না।
আদিবাসী সমাজে অবিবাহিত ছেলেমেয়েদের মধ্যে যৌনাচার অনুমোদিত। যৌথ ঘুমঘরগুলিতে ছেলেমেয়েরা একত্রে রাত্রিযাপন করে। এগুলি তরুণ-তরুণীদের যৌনচর্চায় দক্ষতা অর্জনের সংস্থা হিসাবে ব্যবহৃত হয়। মধ্যপ্রদেশের গোণ্ডদের মধ্যে প্রচলিত ঘুমঘরগুলিকে ঘোটুল’ বলা হয়। মুণ্ড ও বিরহোড়রা এগুলিকে ‘গিতিওড়া’ বলে। আসামের গারো জাতিরা এগুলিকে লোকপণ্ডে’ বলে। নাগাদের মধ্যে এগুলিকে বলা হয় ‘মোরাং। যৌথ ঘুমঘরগুলির মধ্যে প্রসিদ্ধ হচ্ছে মুরিয়াদের ভেতর প্রচলিত ঘাটুল। মুরিয়াদের মধ্যে বিদ্যমান ঘোটুল পূর্ণবিকশিত ঘুমঘরের প্রতীক। ঘোটুলের ভিতরটায় নানারকম চিত্র অঙ্কিত ও খোদিত থাকে। অনেকস্থলেই এসকল চিত্র যৌন-অর্থব্যঞ্জক। কোনো কোনো ঘোটুলে প্রকাণ্ড আকারের পুরুষাঙ্গবিশিষ্ট এক তরুণ একটি তরুণীকে আলিঙ্গন করে ধরে আছে-এরূপ চিত্রও অঙ্কিত থাকে। ঘোটুলের মধ্যে যৌনজীবন অনুস্থত হলেও, প্রকৃত বিবাহের বয়স এলে তাদের অপরের সঙ্গে নিয়মানুগ বিবাহ করতে হয়। ঘোটুলের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, কী সুন্দরী কী কুৎসিতা—সকল মেয়েই যৌনচর্চায় সমান অধিকার পায়। তবে তরুণ-তরুণীদের একই জুড়িদারের সঙ্গে তিনদিনের বেশি শুতে দেওয়া হয় না। (ঘোটুলের যৌনচর্চার পূর্ণ বিবরণের জন্য লেখকের ‘ভারতে বিবাহের ইতিহাস’ দ্রষ্টব্য)। ঘোটুল ছেলেমেয়েদের যৌনাচার অনুশীলনের একটা মাধ্যম-বিশেষ। এরূপ যৌনাচারের মধ্যে মেয়েদের পুরুষের আধিপত্য মেনে নেবার, বা পুরুষের মেয়েদের ওপর আধিপত্য প্রকাশের কোনো অবকাশই থাকে না। কেননা,সকল ছেলেমেয়েরই যৌনাচারে সমান অধিকার থাকে। তাছাড়া, এসব যৌনাচার শাশ্বত নয়। ঘোটুলের জীবন শেষ হলে মেয়ের অন্ত পুরুষকে বিবাহ করে এবং তার সঙ্গে মুখেই ঘর করে। ঘোটুল-জীবনের জুড়িদারের কোনো প্রভাব তাদের মনের ওপর ছাপ ফেলে না।
***
পুরুষের আধিপত্য না মেনে মেয়েরা যৌনাচারে লিপ্ত হতে পারে তু’রকমে। এক হচ্ছে সামান্যা’ বা বারাঙ্গনার জীবন যাপন করে। আরএকরকম হচ্ছে পুরুষ-ব্যতিরেকে বিকল্প উপায়ে। কিন্তু সমাজের স্বাস্থ্য ও সংহতির দিক থেকে এ-দুটোর কোনোটাই কাম্য নয়। সামান্ত বা বারাঙ্গনাদের সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা করেছেন বাৎস্যায়ন তার “কামসূত্রে। বাৎস্যায়ন বারাঙ্গনাদের ছয় শ্রেণীতে ভাগ করেছেন; যথা— (১) পরিচারিকা, (২) কুলটা, (৩) স্বৈরিণী, (৪) নটী, (৫) শিল্পকারিকা ও (৬) প্রকাশবিনষ্ট। এদের প্রত্যেকেরই নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য আছে। কোনো বারাঙ্গন-তুহিত বিবাহিত হয়ে যদি একবৎসর নিজ পতির কাছে ‘সতী হয়ে থাকে, এবং তারপর নিজের ইচ্ছেমত যৌনাচারে প্রবৃত্ত হয়,কিন্তু প্রাক্তন স্বামী এলে তার সঙ্গে একরাত্রি বাস করে তার পরিচর্যায় রত হয়, তবে সেরূপ নারীকে পরিচারিকা’ বলা হয়। ভরত-নাট্যশাস্ত্রে পরিচারিকা’র অবশ্য অন্য সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। যে নারী স্বামীর ভয়ে অপরের গৃহে গিয়ে অপর পুরুষের সঙ্গে যৌনাচারে লিপ্ত হয়, তাকে কুলটা বলা হয়। যে নারী নিজ স্বামীকে গ্রাহা না করে নিজ গৃহে বা অন্য গৃহে অপর পুরুষের সঙ্গে যৌনাচারে লিপ্ত হয়, তাকে স্বৈরিণী” বলা হয়। যে নারী নাচগান করে, অথচ বেশ্বাবৃত্তিও করে, তাকে “নটী” বলা হয়। রজক, তন্তুবায় প্রভৃতি শিল্পীর ভাৰ্য যখন পতির অনুমতি নিয়ে বিত্তবান লোকের সঙ্গে যৌনাচারে লিপ্ত হয়, তাকে ‘শিল্পকারিকা’ বলা হয়। যে নারী স্বামী জীবিত থাকাকালীন বা তার মৃত্যুর পর প্রকাশ্যে অপরের সঙ্গে যৌনাচারে লিপ্ত হয়, তাকে ‘প্রকাশবিনষ্টা’ বলা হয়।
ৰৰ্তমানকালে আমরা তাদেরই বারাঙ্গন বলি, যারা অর্থপ্রাপ্তির আশায় অপর পুরুষগণের সঙ্গে কামাচারে প্রবৃত্ত হয়। এরূপ বারাঙ্গনা অবশ্য আমাদের দেশে ঋগ্বেদের আমল থেকেই ছিল। ‘সমন’ উৎসবে তাদের উপস্থিতির কথা আমি আগেই বলেছি। বাজসনেয়ী সংহিতা – থেকে আমরা জানতে পারি যে, তখন গণিকাবৃত্তি প্রচলিত ছিল। রামায়ণেও আমরা পাই, গণিকাদের নিযুক্ত করেই বিভাগুকমুনির পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গকে অঙ্গরাজ্যে আনা হয়েছিল। মহাভারতে আমরা দেখি যে, রণক্ষেত্রে সৈনিকগণের মনোরঞ্জনের জন্য গণিকাদের শিবির স্থাপন করা হত। বৌদ্ধসাহিত্য থেকেও আমরা গণিকাবৃত্তি প্রচলনের কথা জানতে পারি। অম্বপালী, পত্নমাবতী, সালবতী, সিরিম, বিমলা, অৰ্ধকাশী প্রভৃতি গণিকাদের কথা আমরা বৌদ্ধসাহিত্যে পাই। একমাত্র আদিবাসী সমাজেই গণিক অনুপস্থিত।
পুরুষের আধিপত্য অস্বীকার করে মেয়েরা অবশু স্বাধীনভাবে সামান্সার জীবন যাপন করতে পারে, কিন্তু সেটা তো সামাজিক সংহতি ও স্বাস্থ্যের দিক থেকে কাম্য নয়। তাছাড়া, সৃষ্টি বজায় রাখতে হলে স্ত্রী ও পুরুষকে পরস্পরের সংলগ্ন থাকতেই হয়।