প্রমীলা কেন পুরুষ ভজে?
মেয়েরা কেন পুরুষ ভজে। মনে হবে এ প্রশ্নটা খুবই সোজা ও সরল। কিন্তু তা মোটেই নয়। প্রশ্নটা অত্যন্ত কুটিল ও জটিল। কেননা, এ প্রশ্নের অন্তরালে নিহিত আছে আরও অনেক আমুষঙ্গিক প্রশ্ন। যথা, পুরুষ-ভজন করতে গিয়ে মেয়ের কেন পুরুষের আধিপত্য মেনে নেয়? আগেকার দিনের কথা ছেড়েই দিলাম। তখন তো মেয়ের ছিল অবলা ও অসহায়। অভিভাবক বা গুরুজনরা যা বলতেন, তারাও তাই করত। কিন্তু আজকের দিনে তো মেয়েরা শিক্ষিতা হয়েছে। অনেকে স্বাবলম্বীও হয়েছে। তা সত্ত্বেও তারা কেন পুরুষের আধিপত্য মেনে নেয়? অনেকে হয়ত বলবেন, এটা এক মাদিম অভিশাপ। কেননা, মেয়ের এক যৌনবুভুক্ষ নিয়েই ধরাপুষ্ঠে আবির্ভূত হয়েছিল। সেই আদিম যৌনক্ষুধার জন্যই মেয়ের পুরুষের সঙ্গ চায়। আদিম যৌনক্ষুধা নিবৃত্তির জন্যই যদি মেয়েরা এরূপ করে, তাহলে প্রশ্ন জাগে মেয়ের পুরুষের আধিপত্য না মেনে সেটা করতে পারে কিনা। আর আমরা যদি মনে করি মেয়েদের আদৌ কোনো সহজাত আদিম যৌনক্ষুধা নেই, তবে পুরুষের আধিপত্য মেনে নিয়ে তাদের দাম্পত্যজীবন যাপনের প্রয়োজন হয় কেন? হয়ত অনেকে বলবেন দম্পত্যজীবনে প্রবৃত্ত না হলে মেয়ের জীবনে একটা নিঃসঙ্গতা ও শূন্যত অনুভব করে সে কথা বললে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, সেটা বৈধ উপায়ে, না অবৈধ উপায়ে করা উচিত? জগতের প্রায় সব সমাজই চায় যে মেয়ে-পুরুষের যৌনজীবন বৈধ উপায়ে পালিত হওয়া উচিত। বৈধ উপায়ে যৌনজীবন পালন করা মানেই বিবাহে প্রবৃত্ত হওয়া। এ সম্পর্কেও প্রশ্ন অজস্র। বিবাহের পূর্বে অধিকাংশ মেয়েই তার জীবনসঙ্গী সম্বন্ধে নানারকম স্বপ্ন দেখে। কিন্তু বাস্তবজীবনে সে কল্পলোকের স্বপ্ন তো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বপ্নবিলাসে পরিণত হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা পিতামাতা বা অভিভাবক কর্তৃক নির্বাচিত স্বামীর সঙ্গে মুখে ঘরকন্না করে কেন? আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, অভিভাবকের সম্মতিক্রমেই হোক বা বিনা সম্মতিতে হোক মেয়েরা যে স্ব-নির্বাচিত পুরুষকে বরণ করে, সেক্ষেত্রেও তাদের দাম্পত্যজীবন অসুখকর হয়। অনেক স্থলে আবার দেখা যায় যে, সুন্দরী মেয়ে কুৎসিত পুরুষকেই ভজনা করে। কেন? যেমন ভেসডেমন ওথেলোকে ভজন করেছিল। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাতৃস্থানীয়া প্রৌঢ়া রমণী কেন প্রলুব্ধ হয় অল্পবয়স্ক তরুণকে বিবাহ করতে অথবা তার সঙ্গে দাম্পত্যজীবন যাপন করতে? প্রথম বিদ্রোহী নারী জর্জ সাদ-এর (George Sand) জীবনে তো এটা বারংবার ঘটেছিল। প্রখ্যাত ফরাসী ঔপন্যাসিক বালজাকের (Honor de Balzac) জীবনেও তাই। বালজাক তে দেখতে কুৎসিতই ছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও নয় ছেলের মা ৪৫ বছরের প্রৌঢ় মাদাম বার্নি কেন ২৩ বছর বয়সের বালজাককে বিয়ে করেছিল? আবার সেই কুৎসিত ও দেনার দায়ে নিষ্পেষিত বালজাকের জীবনেই ঘটেছিল আর-এক বিচিত্র ঘটনা। চিকিৎসকদের কাছে বালজাকের মৃত্যু আসন্ন ও সুনিশ্চিত শুনেও তার মৃত্যুর মাত্র ছ’মাস পূর্বে ঐশ্বর্যশালিনী ইভেলিন তাকে কেন বিবাহ করেছিল? এরকম বৈসাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও তারা তো পরস্পরের কাছে প্রেম নিবেদন করেছিল। উপন্যাসের জগতেও আমরা মেয়ে-পুরুষের অনুরূপ আচরণ দেখি। বিমল মিত্রের ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ উপন্যাসে লক্ষ্মীর মত মার্জিতরুচিসম্পন্ন মেয়ে স্বামী দাতারবাবুর উপস্থিতিতেই কেন সুধাংশুর মত চরিত্রহীনের অঙ্কশায়িনী হয়েছিল? আবার তারই সহোদর সতী শ্বশুরবাড়ির অমানুষিক নির্যাতন সত্ত্বেও কেন স্বামীর কণ্ঠলগ্ন হয়েছিল এবং ঘোষালসাহেবের মত লম্পটের কামলালসার গ্রাস থেকে নিজেকে মুক্ত করবার জন্য চলন্ত ট্রেনের চাকার তলায় প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল? আবার শরৎচন্দ্রের পথের দাবী’-তে আমরা দেখি শশীর মত বেহালাবাদক শিল্পীকে ছেড়ে নবতারা কেন এক কারখানার মিস্ত্রিকে বিবাহ করেছিল? এরকম অগণিত প্রশ্ন নিহত আছে ‘মেয়েরা কেন পুরুষ ভজে?—এই প্রশ্নের পিছনে। এসব প্রশ্নের উত্তর মেয়েদেরই দেওয়া উচিত, আমার মত ৮৪ বছর বয়সের পুরুষের নয়। কেননা, পুরুষ প্রমীলাকে কতটুকু চেনে? মনে রাখতে হবে যে, যুগে যুগে নারী নির্যাতিত হয়েছে পুরুষের হাতে, অথচ নারী প্রেম ও সোহাগ দ্বারা পুরুষকে বেঁধে রাখতে চেয়েছে নিজের সান্নিধ্যে। হয়ত অনেকসময় সামাজিক নিন্দার ভয়ে নারী এরূপ প্রেম ও সোহাগের অভিনয় করে যায় এবং প্রকৃতপক্ষে তার মনের অন্তস্তলে অস্তঃসলিলার মত প্রবাহিত হয় অন্তরূপ ভাবনা-চিন্তা। তাহলে সেক্ষেত্রে নারী তো পুরুষের কাছে ছলনাময়ী ও রহস্যময়ী হয়ে দাড়ায়। তাই বলছিলাম, প্রমীলা কেন পুরুষ-ভজনা করে, এ প্রশ্নের উত্তর প্রমীলারই দেওয়া উচিত, কোনো পুরুষের নয়। কেননা, পুরুষ তে শত চেষ্টা করলেও প্রমীলার অবচেতন মনের গভীরে পৌছোতে পারবে না। তবুও আমি পুরাণ, ইতিহাস, বিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, উপন্যাস ও বাস্তব জীবনের সাহায্যে এ প্রশ্নের উত্তর দিতে চেষ্টা করব।
***
নারী কেন পুরুষ-ভজন করে, এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের প্রথমেই যেতে হবে সৃষ্টির সেই প্রথম দিনে, যেদিন সৃষ্ট নারী প্রথম পুরুষকে ভজনা করেছিল। এ সম্বন্ধে খ্রীস্টান পুরাণের সঙ্গে হিন্দু পুরাণের মতানৈক্য আছে। খ্রীস্টান পুরাণ অনুযায়ী ঈশ্বর পুরুষ ও নারী সৃষ্টি করে তাদের ছেড়ে দিয়েছিলেন স্বর্গের উদ্যানে বিচরণ করতে। তবে তিনি চাননি তাদের মধ্যে যৌনতৃষ্ণার উন্মেষ ঘটুক। সেজন্য তিনি নিষেধ করে দিয়েছিলেন তারা নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল যেন না খায়। কিন্তু নারী তো চির-কৌতুহলী। এক অদম্য কৌতুহলী মন নিয়ে সে জন্মগ্রহণ করেছে। তার সমগ্র সত্তাকেই আচ্ছন্ন করে আছে এই কৌতুহলী মন। সেই সহজাত কৌতুহলের বশীভূত হয়েই প্রথম নারী ইভ আস্বাদন করেছিল সেই নিষিদ্ধ বুক্ষের ফল। পরিণামে যা ঘটেছিল তা সকলেরই জানা আছে। সেটা তো অভিশাপ হয়েই দাঁড়িয়েছিল। স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে পতন, যৌনমিলনের আকাঙ্ক্ষার উন্মেষ ও প্রজাসৃষ্টি।