এবার দেবীপূজার কথা বলি। মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা, প্রভৃতি নগরে দেবীপূজার যে ব্যাপক প্ৰচলন ছিল, তা মৃন্ময়ী মাতৃকাদেবীর মূৰ্তিসমূহ থেকে প্ৰকাশ পায় । পুরুষ দেবগণ কর্তৃক অধিকৃত ঋগ্বেদের দেবতামণ্ডলীতে মাতৃদেবীর কোন স্থান ছিল না । পরবর্তীকালে যখন সাংস্কৃতিক সমন্বয় ঘটেছিল, তখনই প্ৰাগাৰ্য দেবীসমূহের হিন্দুধর্মে অনুপ্রবেশ ঘটে। যেমন বৈদিক যুগের অন্তিমে আমরা কালী, করালী প্রভৃতি দেবীর নাম পাই। কিন্তু তখনও তাঁরা তাদের মৌলিক স্বরূপ বা স্বতন্ত্রতা বজায় রেখে অনুপ্রবেশ করতে পারেন নি। তাঁরা বৈদিক অগ্নি উপাসনারই অঙ্গ হিসাবে পরিগণিত হয়েছিলেন । কিন্তু আর্যরা যত পূর্বদিকে অগ্রসর হতে লাগলেন, তাদের ধর্মীয় গোঁড়ামি ততই হ্রাস পেতে লাগল। তখন এইসব অনার্য দেবতা বেশ রীতিমত হানা দিয়ে আর্যমণ্ডলীতে তাঁদের আসন করে নিলেন। পুরাণাদি গ্রন্থে আমরা বিন্ধ্যবাসিনী, পর্ণশবরী প্রভৃতি দেবীকে অনার্যদেবীর স্বরূপেই পাই। তারপর মাতৃপূজা প্ৰাগাৰ্য তন্ত্রধর্ম ও ব্ৰাহ্মণ্য ধর্মকে প্রভাবান্বিত করে। ( লেখকের ‘সিন্ধুসভ্যতার স্বরূপ ও অবদান” জিজ্ঞাসা, পৃষ্ঠা ৫৬-৫৮ দেখুন । )
।। তিন ॥
অথর্ববেদের পঞ্চদশ কাণ্ডে যে ব্রাত্যধর্মের বর্ণনা আছে, তা প্ৰাচ্য ভারতে প্ৰচলিত তন্ত্রধর্মেরই অনুরূপ কোন ধর্ম। তঁদের ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপের জন্য আর্যরা প্ৰথমে ব্রাত্যদের ঘৃণা করতেন। আর্যরা বলতেন তারা বেদবিহিত কোন যজ্ঞাদি ক্রিয়া করবার অধিকারী নয় । কিন্তু পরে অথর্ববেদের যুগে তাদের মনোভাব পরিবর্তিত হয়। কেননা, অথর্ববেদের সমস্ত পঞ্চদশ কাণ্ডটাকেই ব্রাত্যমহিমা বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে—“ব্রাত্য পুরুষ মহানুভব, দেবপ্রিয়, ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় তেজের মূল, অধিক কি ব্রাত্য পুরুষ দেবাদিদেব।” ব্রাত্যধর্মের বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে এর অনেক উপাদানই তন্ত্রধর্মের উপাদান । এটাই প্ৰাচ্যভারতের ধর্ম ছিল । অন্যত্র আমি উল্লেখ করেছি যে বৈদিক আৰ্যদের (Nordics) এদেশে আসবার পূর্বে আর এক আর্যভাষাভাষী দল (Alpines) এদেশে এসেছিল । তাদের আদি পিতৃভূমিতে দুই দলের মধ্যে বিরোধ ঘটার দরুণ, শেষোক্ত দল নিজ পিতৃভূমি পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল । এরা (Alpines) ছিল কৃষিজীবীর দল, আর অপররা (Nordics) ছিল পশুশিকারীর দল । সুতরাং কৃষিপরায়ণ ছিল বলেই এদের মধ্যে শক্তিপূজার প্রচলন ছিল । আমি আমার “বাঙলার সামাজিক ইতিহাস”-এ বলেছি যে এরা শেষ পর্যন্ত বাঙলা দেশে এসে কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। বাঙলা দেশে এসে যখন তারা পৌঁছেছিল তখন তাদের সেখানে সাক্ষাৎ হয়েছিল অপর এক কৃষিপরায়ণ জাতির সঙ্গে, যাদের মধ্যেও মাতৃপূজার প্রচলন ছিল। (আনন্দবাজার পত্রিকার ১৯৭৯ সালের বার্ষিক সংখ্যায় লেখকের ‘বাঙলা কি সভ্যতার জন্মভূমি’ প্রবন্ধ দেখুন )। সান্নিধ্যে থাকার দরুন পরস্পরের মধ্যে যে মাত্র রক্তের সংমিশ্রণ ঘটেছিল ( লেখকের ‘বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয়”, জিজ্ঞাসা, দেখুন ) তা নয়, তাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক সংশ্লেষণও ঘটেছিল। এই সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণের যুগেই তান্ত্রিক ধর্মের উদ্ভব ঘটেছিল ।
।। চার ।।
তন্ত্রধর্মের উৎপত্তি সম্বন্ধে নানা মত প্ৰচলিত আছে। হিন্দুরা বলেন যে, তন্ত্রধর্মের বীজ বৈদিক ধর্মের মধ্যেই নিহিত ছিল। আর, বৌদ্ধরা দাবী করেন যে, তন্ত্রের মূল ধারণাগুলি ভগবান বুদ্ধ যে সকল, মুদ্রা, মন্ত্র মণ্ডল, ধারণা, যোগ প্রভৃতির প্রবর্তন করেছিলেন তা থেকেই উদ্ভূত। মনে হয় তন্ত্রধর্মের আসল উৎপত্তি সম্মন্ধে সূত্ৰকৃতঙ্গ’ নামে এক প্ৰাচীন জৈনগ্রন্থ বিশেষ আলোকপাত করে । এটা সকলেরই জানা আছে যে, তন্ত্রের আচার-অনুষ্ঠান ও পদ্ধতি অত্যন্ত গূঢ় এবং উক্ত প্ৰাচীন জৈনগ্রন্থ অনুযায়ী গূঢ় সাধন পদ্ধতি শবর, দ্রাবিড়, কলিঙ্গ ও গৌড় দেশবাসীদের এবং গন্ধৰ্বদের মধ্যেই প্রচলিত ছিল। মনে হয় এই জৈন গ্রন্থের কথাই ঠিক, কেননা, তান্ত্রিক সাধনসদৃশ ধৰ্মপদ্ধতি পূর্ব ভারতের প্রাক্-বৈদিক জনগণের মধ্যেই প্রচলিত ছিল এবং উহাই ‘ব্রাত্যধৰ্ম’ বা অনুরূপ কোন ধর্ম হবে । ( লেখকের “History & Culture of Bengal” গ্রন্থ দেখুন )। পরে বৌদ্ধ ও ব্ৰাহ্মণ হিন্দুরা যখন উহা গ্রহণ করেছিল, তখন তারা দার্শনিক আবরণে তাকে মণ্ডিত করেছিল । প্ৰায় ষাট বছর আগে এ সম্বন্ধে বক্ৰেশ্বরের বিখ্যাত তান্ত্রিক অঘোরীবাবা যা বলেছিলেন তাও এখানে প্ৰণিধানযোগ্য । তিনি বলেছিলেন, “বেদের উৎপত্তির বহু শতাব্দী পূর্বে তন্ত্রের উৎপত্তি । তন্ত্র মন্ত্রমূলক নয়, ক্রিয়ামূলক । অনার্য বলে আর্যরা যাদের ঘৃণা করতেন, সেই দ্রাবিড়দের ভাষাতেই তন্ত্রের যা কিছু ব্যবহার ছিল । পুঁথিপুস্তক তো ছিল না, বেদের মতই লোকপরম্পরায় মুখে মুখে তার প্রচার ছিল । সাধকদের স্মৃতির মধ্যেই তা বদ্ধ ছিল । তার মধ্যে ব্ৰাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র জাতির নামগন্ধও ছিল না। কারণ, তন্ত্রের ব্যবহার যে-সব মানুষকে নিয়ে, তার মধ্যে জাত কোথায় ? সাধারণ মানুষের ধৰ্মকৰ্ম নিয়েই তো তন্ত্রের সাধন । তন্ত্রের জগতে বা অধিকারে ঘৃণার বস্তু বলে কিছুই ছিল না । শবসাধন, পঞ্চমুণ্ডি আসন, মদ্য-মৎস্যমাংসের ব্যবহার এ সবই তো তন্ত্রের, আর্য ব্ৰাহ্মণদের ধারণায় ভ্ৰষ্টাচার । শুদ্ধাচারী ব্ৰাহ্মণরা যতদিন বাঙলায় আসেন নি, ততদিন তাঁদের এ ভাবের যে একটা ধর্ম সাধনা আছে, আর সেই ধর্মের সাধন প্রকরণ তাদেরই একদল গ্রহণ করে ভবিষ্যতে আর একটি ধর্ম গড়ে তুলবেন, একথা তারা কল্পনায়ও আনতে পারেন নি। তারপর তন্ত্রের ধর্ম গ্রহণ করে ক্রমে ক্রমে তারা অনার্যই হয়ে পড়লেন–তাঁদের বৈদিক ধর্মের গুমোর আর কি রইল ?” ( প্ৰমোদকুমার চট্টোপাধ্যায়, “তন্ত্রাভিলাষীর সাধুসঙ্গ” ) । বস্তুত খ্রীস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে বুদ্ধ যখন প্ৰাচ্যভারতে ধর্মপ্রচারে ব্যাপৃত ছিলেন, তখন লোকায়ত ধর্ম হিসাবে তন্ত্রধর্মেরই এখানে প্ৰচলন ছিল । এটা আগে উদ্ধত জৈনসূত্র থেকেই আমরা জানতে পারি । নারীসঙ্গমই হচ্ছে তন্ত্রধর্মের একটা প্ৰধান অঙ্গ । বুদ্ধ প্ৰথমে সঙ্ঘের মধ্যে নারীদের প্রবেশের বিরোধী ছিলেন । কিন্তু পরে তিনি তার ধর্মের প্রতি জনপ্ৰিয়তালাভের জন্য, এটা এড়াতে পারেন নি। বুদ্ধ সঙ্ঘে নারীকেও স্থান দিয়েছিলেন । তখন থেকেই ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীর সৃষ্টি হয় । বৌদ্ধ সঙ্ঘে নারীর প্রবেশ ঘটেছিল বটে, কিন্তু তান্ত্রিক বা তৎসদৃশ কোন গুহ্য সাধনপদ্ধতির অনুপ্রবেশ ঘটে নি। এটা ঘটেছিল অনেক পরে । কি করে সেটা ঘটেছিল, সেটা জানতে হলে, বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসটা সংক্ষেপে বলা দরকার । বুদ্ধের ধর্মমত বুদ্ধের জীবনকালে লিপিবদ্ধ হয় নি। এর ফলে তাঁর মৃত্যুর পর তার ধর্মমত নানাভাবে ব্যাখ্যাত হতে থাকে । বিশেষ করে ‘নির্বাণ’ ও’করুণা’- এই দুটি শব্দের অর্থ নিয়ে । এর ফলে সঙ্ঘের মধ্যে নানা শাখার উদ্ভব হয় । সম্রাট অশোকের পূর্বেই বৌদ্ধসঙ্ঘের মধ্যে আঠারটি শাখার উদ্ভব ঘটেছিল। পরে এগুলি দুই প্ৰধান সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়— হীনযান ও মহাযান । মহাযানীদের মধ্যে তান্ত্রিক ক্রিয়াকাণ্ডের অনুপ্ৰবেশ ঘটে । এর ফলে বজ্রযান নামে এক নূতন যানের উদ্ভব ঘটে । বজ্ৰযানের আবার বিবর্তন হয় কয়েকটি শাখাতে । তার মধ্যে সহজযান ও কালচক্রযান বিশেষ প্রভাবশালী হয় । যদিও হীনযানীদের গ্রন্থসমূহে কিছু কিছু হিন্দুদেবতার, যথা–ইন্দ্ৰ, ব্ৰহ্মা, কুবের, বসুধারা প্ৰভৃতির নাম পাওয়া যায়, তাদের কিন্তু কোন দেবতামণ্ডলী ছিল না । ভগবান বুদ্ধের ন্যায় তারা মূর্তিপূজার বিরোধী ছিল । তবে তারা বুদ্ধের ব্যবহৃত জিনিস এবং প্রতীকের, যেমন পদচিহ্ন, বোধিবৃক্ষ, ধৰ্মচক্ৰ ইত্যাদি বহুবিধ চিহ্ন পাথরে খোদাই করে, তৎপ্রতি তাদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করত। তারপর বুদ্ধের মূৰ্তি তৈরি করা হয়। কোথায় এবং কাদের দ্বারা বুদ্ধের মূতি প্ৰথম তৈরি হয়েছিল সে সম্বন্ধে মতভেদ আছে । অনেকে বলেন যে, গ্ৰীক বৌদ্ধরাই গান্ধার ভাস্কর্ষে প্ৰথম বুদ্ধের মূতি তৈরি করেছিল । আবার অনেকে বলেন, এটা মথুরা ভাস্কর্যেই প্ৰথম আত্মপ্ৰকাশ করেছিল । গান্ধার ভাস্কর্যে শুধু বুদ্ধের নয়, জম্ভল, হারতী ও বোধিসত্ত্বদের মূর্তিও তৈরি হয়েছিল । অবশ্য মথুরা ভাস্কর্যেও এ সব মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়, এবং তা ছাড়া কুবের, যক্ষ, নাগ প্ৰভৃতির মূর্তি দৃষ্টিগোচর হয় । গুপ্তযুগের আগে পর্যন্ত হীনযানের প্রভাবই খুব বেশি ছিল । মহাযানের দু-একটি বোধিসত্ত্ব ছাড়া, আর কোন দেবতার মূর্তি বড় একটা দেখা যায় না। মহাযান যখন বজ্ৰযানে বিকশিত হয় তখনই এক বিশাল বৌদ্ধ দেবতামণ্ডলীর উদ্ভব হয় । বজ্রযান ছিল বৌদ্ধ তান্ত্রিক ধর্ম। এই ধর্মের উদ্ভব ঘটেছিল পূর্বভারতে বাঙলাদেশে, এবং নিঃসন্দেহে বাঙলার লোকায়ত তান্ত্রিক ধর্মের প্রভাবে । তারানাথের মতে তন্ত্রের উৎপত্তি বহু পূর্বেই হয়েছিল, কিন্তু উহা সুপ্ত অবস্থায় ছিল, এবং গোপনভাবে গুরুশিষ্য পরম্পরায় লুক্কায়িত ছিল। পালরাজগণের পৃষ্ঠপোষকতায় ও সিদ্ধাচার্যদের সক্রিয় প্রভাবে উহা জনপ্রিয় হয়ে উঠে । বাজ্রযানের চারটি কেন্দ্র বা পীঠস্থান ছিল, উড্ডীয়ান, কামাখ্যা, শ্ৰীহট্ট ও পূর্ণগিরি। এই চারটি পীঠস্থানেই একটা করে বজ্রযোগিনীর মন্দির ছিল। অষ্টম শতাব্দীতে বজ্রযানের বিশেষ শ্ৰীবৃদ্ধি হয় এবং খ্রীস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রবলভাবে চলে । বৌদ্ধরাই তন্ত্রের গূঢ় সাধন-পদ্ধতি লিখিতভাবে প্রথম প্ৰকাশ করে। তারা যে তন্ত্রগ্রন্থ প্রথম রচনা করে তার নাম হচ্ছে গুহ্যসমাজতন্ত্র । সম্ভবত খ্ৰীষ্ট্ৰীয় চতুর্থ শতাব্দীতে অসঙ্গ কর্তৃক এ-খানা রচিত হয়েছিল । বইখানি বরোদার গায়কোয়াড় ওরিয়েণ্টাল সিরিজে প্ৰকাশিত হয় । এই সিরিজে বজ্রযান সম্বন্ধে আরও তিনখানা বই প্ৰকাশিত হয়েছিল, যথা ‘অদ্বয়বজ্রসংগ্রহ’, ‘নিষ্পন্নযোগাবলী’ ও ‘সাধনমালা’ ; কিন্তু সবগুলিই এখন দুষ্প্রাপ্য। এছাড়া আরও বৌদ্ধ তন্ত্রগ্রন্থ ছিল। যদিও বলা হয় যে, বৌদ্ধ তন্ত্রগ্রন্থের সংখ্যা ৭৪ ; তা হলেও বিনয়তোষ ভট্টাচার্যের মতে এদের সংখ্যা বহু সহস্ৰ ।