১৯৬৫ খ্রীস্টাব্দে আমি আমার ‘প্রি-হিস্ট্রি অ্যাণ্ড বিগিনিংস অভ_ সিভিলিজেশন’ পুস্তকে বলেছিলাম—‘মিশর, ক্রীট, সুমের, এশিয়া মাইনর, সিন্ধু উপত্যকা ও অন্যত্র যে তাম্রাশ্ম সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছিল, খুব সম্ভবত সে-সভ্যতার আদি জন্মস্থান পূর্বভারতে, এবং পশ্চিমবঙ্গের সামুদ্রিক বণিকরাই তার বীজ ও মাতৃকাদেবীর উপাসনা পৃথিবীর দূরদেশসমূহে নিয়ে গিয়েছিল। কেননা, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, তাম্রাশ্ম সভ্যতার উন্মেষ এমন কোন জায়গায় ঘটেছিল যেখানে প্রচুর পরিমাণে তামা পাওয়া যেত। ধলভূমে ভারতের অন্যতম বিরাট তাম্রখনির বিদ্যমানত ও প্রাচীন বাঙলার প্রধান বন্দরের নাম ‘তাম্রলিপ্তি’, আমার সেই মতবাদকেই সমর্থন করে।
যেহেতু তাম্রাশ্ম সভ্যতাই প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিপ্লব ঘটিয়েছিল, সেহেতু এটা মনে করা যেতে পারে যে, পশ্চিমবঙ্গই সভ্যতার ইতিহাসে সংঘটিত এই বিপ্লবে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। তাম্রাশ্ম যুগের পূর্বে যে-সব কৃষ্টির উদ্ভব ঘটেছিল,যথা নবোপলীয়, মধ্যপলীয়, প্রত্নোপলীয় ইত্যাদি, এগুলির অস্তিত্ব আমরা পশ্চিমবঙ্গের নানাস্থানে, যেমন—বীরভূমের মালতি, পিতনউ, সুবর্ণরেখার অববাহিকা, কংসাবতী ও ময়ূরাক্ষী নদীর উপত্যক, ঝাড়গ্রামে দুলুর নদীর ধারে, বনকাটি প্রভৃতি স্থানে পেয়েছি।
তাম্রাশ্ম যুগের সভ্যতার একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল যে, ওই সভ্যতার ধারকদের অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে খাদ্য-উৎপাদনের স্বয়ম্ভরতার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। আগেকার যুগের মানুষের মত তাদের শিকার, ফলমূল ও মৎস্য আহরণের অনিশ্চয়তার ওপর নির্ভর করতে হত না। অবশু, নবোপলীয় যুগের অভু্যত্থানের পর থেকেই এই অনিশ্চয়তা অনেকটা কেটে গিয়েছিল, কিন্তু তাম্রাশ্ম যুগে এই অনিশ্চয়তা সম্পূর্ণ ভাবে নিশ্চয়তার পরিস্থিতিতে পরিণত হয়েছিল। এ যুগের লোকেরা নগর-নির্মাণ করতে জানত এবং নগরেই বাস করত। এ যুগের নগরগুলি ( যেমন হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো, লোথাল, কালিবঙ্গান প্রভৃতি) গ্রামীণ কৃষিজাত ফসলসমূহ গোলাজাত করত এবং গোলাজাত শস্য নগরবাসৗদিগকে খাদ্য-উৎপাদনের সমস্যা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করে তাদের শিল্পজাত দ্রব্য উৎপাদনে নিযুক্ত করাতে সক্ষম হত।
সুসভ্য সমৃদ্ধিশালী সভ্যতার যে-সকল লক্ষণ, তার সবই আমরা সিন্ধু সভ্যতার নগরসমূহে লক্ষ্য করি। পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গ্রেগরি পসেল বলেন যে চীন, সুমের ও মিশরের প্রাচীন সভ্যতাসমূহের তুলনায় সিন্ধু সভ্যতা অনেক উন্নত ছিল। কেননা, সিন্ধু সভ্যতার কেন্দ্রসমূহেই আমরা জগতের প্রাচীনতম পয়ঃপ্রণালী ও পোতাশ্রয় আবিষ্কার করেছি। নগরগুলির রাস্তাঘাট বেশ সুপরিকল্পিত ছিল। ঘরবাড়ি দগ্ধ-অদগ্ধ ইট ও পাথর দ্বারা নির্মিত হত। নগরের মধ্যে ছিল সুদৃঢ় উচ্চ প্রাকার-বিশিষ্ট দুর্গ, শস্যাগার, দেবালয় ও সমাধিস্থান। এককথায়, সংবদ্ধভাবে নাগরিক জীবন যাপনের সব লক্ষণ এই সভ্যতার কেন্দ্রসমূহে উপস্থিত ছিল। শৃঙ্খলাযুক্ত শাসনব্যবস্থাও ছিল। দৈনন্দিন জীবনে অস্ত্রশস্ত্র ও গৃহসামগ্ৰী নির্মাণে তামা ও ব্রোঞ্জের বহুল ব্যবহার ছিল। পরিবহণের জন্য চক্রবিশিষ্ট যান ছিল। ভাষার রূপদানের জন্য লিখন-প্রণালীরও ব্যাপক ব্যবহার ছিল। তার মানে, সমাজে লেখাপড়ার প্রচলন ছিল ও তার জন্য শিক্ষায়তনও ছিল। নগরগুলির নির্মাণরীতি ও বিন্যাসের ঐক্য দেখে মনে হয় যে, বাস্তু বা, স্থাপত্যবিদ্যা সম্পর্কিত কোন সাধারণ শাস্ত্র ছিল, যার নির্দেশ, অনুযায়ীই নগরগুলি নির্মিত হত। সিন্ধু সভ্যতার ধারকদের যে পাটীগণিত, দশমিক গণন ও জ্যামিতির বিশেষরকম জ্ঞান ছিল তার বহুল নিদর্শন আমরা পেয়েছি। ধাতুবিদ্যাতেও তাদের অসাধারণ পারদর্শিত ছিল (অতুল স্থর, ‘সিন্ধু সভ্যতার স্বরূপ ও অবদান’ দ্রঃ)।
অনেকেই বলেন যে সিন্ধু সভ্যতা ও বৈদিক আর্য সভ্যতা অভিন্ন। কিন্তু এটা যে ভ্রান্ত মত সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এই তুই সভ্যতার মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করলেই এটা বুঝতে পার যাবে। দুই সভ্যতার মূলগত পার্থক্যগুলি নীচে দেওয়া হল :
১. সিন্ধু সভ্যতার বাহকরা শিশ্ন-উপাসক ছিল ও মাতৃকাদেবীর আরাধনা করত। আর্যরা শিশ্ন-উপাসক ছিল না ও শিশ্ন-উপাসকদের ঘৃণা ও নিন্দ করত। আর্যর পুরুষ-দেবতার উপাসক ছিল। মাতৃকাদেবীর পূজার কোন আভাসই আমরা ঋগ্বেদে পাই না।
২. আর্যরাই প্রথম ঘোড়াকে পোষ মানিয়েছিল। ঘোড়াই ছিল তাদের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ জন্তু। এখানে বলা দরকার যে, ঘোড়ার কোন অশ্মীভূত (fossilized ) অস্থি আমরা সিন্ধু সভ্যতার কোনও কেন্দ্রে পাইনি। সিন্ধু সভ্যতার বাহকদের কাছে বলীবর্দই প্রধান জন্তু ছিল। এটা সীলমোহরসমূহের ওপর পুনঃ পুনঃ বলীবদের প্রতিকৃতি ক্ষোদন থেকে বুঝতে পারা যায়। পশুপতি শিব আরাধনার প্রমাণও মহেঞ্জোদারো থেকে পাওয়া গিয়েছে। বলীবর্দ শিবেরই বাহন। সুতরাং সিন্ধু সভ্যতার কেন্দ্রসমূহে বলীবদের প্রাধান্য সহজেই অনুমেয়।
৩. সিন্ধু সভ্যতার বাহকরা নগরবাসী ছিল। আর্যরা নগর নির্মাণ করত না। তারা নগর ধবংস করত। সেজন্য তারা তাদের প্রধান দেবতা ইন্দ্রের নাম পুরন্দর রেখেছিল।