- বইয়ের নামঃ বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয়
- লেখকের নামঃ অতুল সুর
- প্রকাশনাঃ হাওলাদার প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয় – এক
অতি প্রাচীনকাল থেকেই নানা জাতির লোক নানা দিগ্দেশ হতে এসে ভারতের মহাক্ষেত্রে মিলিত ও মিশ্রিত হয়েছে। এই মিশ্রণ ও মিলনের ফলে ভারতের বিভিন্ন অংশের অধিবাসীদের নৃতাত্ত্বিক জ্ঞাতিত্ব নিরুপণ করা বর্তমানে সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। তা হলেও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের নৃতাত্ত্বিক জ্ঞাতিত্ব নিরুপণের একটা চেষ্টা আমরা এখানে করব।
নৃতাত্ত্বিক জ্ঞাতিত্ব নিরুপণের জন্য প্রধানতঃ তিনটি বিষয়ের উপর নির্ভর করতে হয়—
১. প্রাচীনতম মানবের কঙ্কালাস্থি।
২. জাতি ও উপজাতি সম্পর্কে প্রাচীন সাহিত্য ও ঐতিহাসিক নজির।
৩. বর্তমানে দৃষ্ট জাতিগুলির নৃতত্ত্বমূলক বৈজ্ঞানিক পরিচয়।
স্যর আরথার কীথ তাঁর সুপ্রসিদ্ধ Antiquity of Man নামক গ্রন্থের প্রথম সংস্করণে বলেছিলেন—‘India is a part of the world from which the student of early man has expected so much and so far has obtained so little.’ (‘প্রাচীন মানুষের সম্বন্ধে যাঁরা অনুসন্ধান করেন, তাঁরা ভারতের দিকেই আশার দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন, কিন্তু এ পর্যন্ত তাঁদের নিরাশ হতে হয়েছে।’) স্যর আরথারের এই উক্তি এখন আর সম্পূর্ণ সত্য নয়। কারণ, এ বিষয়ে অনুসন্ধান এখন অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। এবং ভারতের কোথাও কোথাও প্রাচীন উপমানব ও মানবের কঙ্কালাস্থি পাওয়া গেছে। বাংলার নৃতাত্ত্বিক আলোচনার পূর্বে আমরা সে বিষয়ে পাঠকবর্গের কাছে সংক্ষেপে আলোচনা করব।
ভারতে যাঁরা প্রাচীন কঙ্কালাস্থির অনুসন্ধান করেছেন, তাঁদের মধ্যে বহির্ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অনুসন্ধান-প্রচেষ্টা উল্লেখযোগ্য। আমেকার ইয়েলের ন্যাচারাল মিউজিয়ামের অধ্যাপক ডক্টর টেরের এ বিষয়ে অনুসন্ধান-প্রচেষ্টা সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। যদিও তাঁর প্রথম অভিযানে প্রাচীন যুগের প্রকৃত মানবের কঙ্কালাস্থি পাওয়া যায় নি, তথাপি মানবের বিবর্তনের কতকগুলি মূল্যবান সূত্র তিনি এখানে আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। এক কথায় বলতে গেলে মানবাস্থির সন্ধান না পেলেও, মানবের পূর্ববর্তী পুরুষদের অস্থিত সন্ধান তিনি পেয়েছিলেন। উত্তর-পশ্চিম ভারতের পর্বতমালায় তিনি রামপিথেকাস, সুগ্রীবপিথেকাস, ব্রহ্মপিথেকাস প্রভৃতি নামধেয় নরাকার জীবগণের জীবাশ্মের সন্ধান পেয়েছিলেন। তাঁর এই আবিষ্কারগুলি নৃতত্ত্বের উপর নূতন আলোকপাত করে; কারণ তৎপূর্বে এই পর্যায়ের জীবগণের তথ্য অজ্ঞাত ছিল। ইয়েল অভিযানের সদস্য লুইস সাহেবের মতে এই জাতীয় জীবগুলি (higher primates) জগতের এই অঞ্চলেই প্রথম প্রাদুর্ভূত হয়েছিল। এদের চিবুকাস্থি ও দাম্ভিক সংস্থান অনেকটা মানবেরই কাছাকাছি। এ থেকে মনে হয় যে, মানবের বিবর্তন এই অঞ্চলেই ঘটেছিল।
কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ডক্টর টেরা ভারতে তাঁর দ্বিতীয় অভিযান পরিচালনা করেন। কিন্তু এই দ্বিতীয় অভিযানেও তিনি আদিম যুগের মানবের জীবাশ্ম পান নি। তথাপি এই প্রথম ও দ্বিতীয় অভিযানের একটা বিশেষত্ব হচ্ছে এই যে, এই অভিযানদ্বয়ে এই লক্ষ থেকে পাঁচ লক্ষ বৎসরের পুরাতন ভূ-স্তর হতে তৎকালীন ভারতে মানব-বাসের প্রকৃষ্ট প্রমাণ মেলে। এ থেকে মনে হয় যে ভারতে আদিম মানবের জীবাশ্মের সন্ধান নিতান্ত বৃথা স্বপ্নবিলাসমাত্র নয়। জগতের অপরাপর অংশে ক্রমশ সে সন্ধান যেমন মিলছে, একদিন ভারতেও সেরূপ সন্ধান সফল হবে। দ্বিতীয় ইয়েল-কেম্ব্রিজ অভিযানের অন্যতম সদস্য ড্রামণ্ড সাহেব বলেন, প্রাগৈতিহাসিক মানব মধ্য-এশিয়ায় উদ্ভূত হয়েছে। এরূপ ধারণা করা হলেও, প্রাগৈতিহাসিক মানবের বিষয় আলোচনা করতে হলে, ভারতেও গবেষণা চালান আবশ্যক। সুদূর প্রাচীনতম যুগ হতে আদিম মানবের সন্ধান আজকে পাওয়া আদৌ বিচিত্র নয়।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, অনুরূপ নরাকার জীবের কঙ্কাল, আমরা এশিয়ার তিন জায়গা থেকে পেয়েছি। ভারতের উত্তর-পশ্চিম কেন্দ্রস্থ গিরিমালা ছাড়া, জাভা ও চীনদেশের চুংকিঙ-এ। এই তিনটি বিন্দু সরলরেখা দ্বারা সংবদ্ধ করলে যে ত্রিভুজের সৃষ্টি হয়, বাঙলাদেশ তার কেন্দ্রস্থলে পড়ে। সুতরাং এরূপ জীবসমূল যে বাঙলা দেশের উপর দিয়েও যাতায়াত করত, সেরূপ অনুমান করা যেতে পারে।
জগতের অন্যত্র আদিম মানবের জীবাশ্মের সঙ্গে তার সাংস্কৃতিক পরিচয়ের নিদর্শন (cultural relics) আবিষ্কৃত হয়েছে। ভারতে আদিম মানবের জীবাশ্ম পাওয়া না গেলেও তার সাংস্কৃতিক পরিচয়ের নিদর্শন বহুল পরিমাণে পাওয়া গেছে, এবং এখনও পাওয়া যাচ্ছে। সুতরাং আদিম মানব যে ভারতে বহু বিস্তৃতভাবে বাস করত সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। বস্তুতঃ প্রত্ন-প্রস্তর যুগের নানা স্তরের আয়ুধ ও ব্যবহার্য বস্তুর নিদর্শন যেমন পশ্চিম ইওরোপ খণ্ডে পাওয়া যায়, তেমনই বঙ্গদেশ, মাদ্রাজ, গোদাবরী, নর্মদা ও কৃষ্ণার অববাহিকায়, মধ্য ভারতে, বর্তমান কর্ণাটক, ছোটনাগপুরে, বিহারের কোন কোন স্থানে, আসাম, পাঞ্জাবে ও সীমান্ত প্রদেশে পাওয়া গেছে। নবপলীয় যুগেরও নিদর্শন ভারতের নানা অঞ্চলে পাওয়া গেছে। মাত্র নবপলীয় যুগের ও তৎপরবর্তী যুগের (chalcolithic and megalithic ages) মানব জীবাশ্মই ভারতে আবিষ্কৃত হয়েছে। এই সকল জীবাশ্মের পরিচয় দেবার পূর্বে, আমাদের এখানে বিজ্ঞানসম্মত নৃতাত্ত্বিক গবেষণার জন্য যে সকল পরিমাপ বা মাপজোকের প্রয়োজন হয়, তার একটা পরিচয় দেওয়া দরকার।