প্রাক্কথন – সিন্ধু সভ্যতার স্বরূপ ও সমস্যা
সিন্ধু সভ্যতাকে আজ আমরা ‘হরপ্পা সভ্যতা’ বলে অভিহিত করি। তার কারণ, সিন্ধু সভ্যতার কেন্দ্ৰসমূহের মধ্যে হরপ্পা থেকেই আমরা সিন্ধু সভ্যতার বৈশিষ্ট্যমূলক প্রত্নদ্রব্য প্ৰথম পাই। তবে সে আজ ( ১৮৫৩ ) থেকে ১৬৯ বছর আগেকার কথা । ১৮২৬ খ্ৰীষ্টাব্দে ওই জায়গাটা প্ৰথম চালাস ম্যাসন-এর নজরে আসে। তিনি ওই জায়গাটাকে কোন দুৰ্গনগরীর ধ্বংসাবশেষ বলে মনে করেন। এরপর ১৮৩২ খ্ৰীষ্টাব্দে আলেকজাণ্ডার বার্নস জায়গাটি পরিদর্শন করেন। তখন জায়গাটি প্রাকৃতিক পাহাড়ের আকার ধারণ করেছিল। তবে তিনিও জায়গাটিকে কোন দুৰ্গনগরীর ধ্বংসাবশেষ বলে বিবেচনা করেছিলেন । কিন্তু জায়গাটির প্রকৃত প্ৰাচীনত্ব সম্বন্ধে এঁরা দুজনেই কিছু বলতে পারেন নি ।
এখানে উৎখনন কার্য প্ৰথম শুরু হয়। ১৮৫৩ খ্ৰীষ্টাব্দে । সেই বৎসরই এখানে উৎখনন শুরু করেন তৎকালীন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধিকর্তা স্যাব আলেকজাণ্ডার কানিংহাম । স্যার আলেকজাণ্ডার কানিংহাম পুনরায় এখানে উৎখনন করেন। ১৮৫৬ খ্ৰীষ্টাব্দে । ওই সময় তিনি যা দেখেছিলেন এবং উৎখনন করে যা পেয়েছিলেন, তার বিবরণ তিনি প্ৰকাশ করেন ১৮৭২-৭৩ খ্ৰীষ্টাব্দের ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রতিবেদনে ।
কানিংহাম যে সময় হরপ্পায় গিয়েছিলেন সে সময় তিনি ইরাবতী নদীর তীরে বহু ধ্বংসস্তুপ দেখেছিলেন। বস্তুত তিনি ইরাবতী নদীর উত্তর, পশ্চিম, ও দক্ষিণে ৩,৫০০ ফুট ব্যাপী দীর্ঘ স্থানে ধ্বংসস্তুপের সমারোহ দেখেন। পূর্বদিকেও তিনি ২০০০ ফুট ব্যাপী দীর্ঘ স্থানে অনুরূপ ঢিবির সারি লক্ষ্য করেন। যদিও ঢিবিগুলি অবিচ্ছিন্নভাবে অবস্থিত ছিল, তাহলেও একস্থানে তিনি ৮০০ ফুট ব্যাপী জায়গায় ঢিবির অভাব লক্ষ্য করেন । এই ৮০ ০ ফুট টিবিহীন শূন্য ব্যবধানের কারণ সম্বন্ধে তিনি কিছু বলতে পারেন নি।
ইরাবতী নদীর তীরে কানিংহাম যে টিবির সমারোহ দেখেছিলেন, তা আড়াই মাইল আয়তনের মত এক পরিমণ্ডল সৃষ্টি করেছিল।
উত্তর-পশ্চিমে সবচেয়ে বড় টিবিটার উচ্চতা ছিল ৬০ ফুট । দক্ষিণপশ্চিমের ও দক্ষিণের ঢিবিগুলির উচ্চতা ছিল ৪৫ থেকে ৫০ ফুট, এবং ইরাবতী নদীর প্রাচীন খাতের দক্ষিণে অবস্থিত ঢিবিগুলি ২৫ থেকে ৩০ ফুট ।
১৮৫৩ এবং ১৮৫৬ খ্ৰীষ্টাব্দে কানিংহাম যে উৎখনন করেছিলেন তার ফলে তিনি পূর্ব ও পশ্চিম উভয় দিকেই সিড়ির ভগ্নাবশেষ এবং ধ্বংসস্তুপের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে এক চতুষ্কোণ বৃহৎ অট্টালিকার ভিত্তির সন্ধান পেয়েছিলেন। লোকমুখে তিনি শুনেছিলেন যে রাজা হরপালের নাম থেকেই জায়গাটার নাম হরপ্পা হয়েছে। রাজা
হরপালের সময় ওখানে এক বৃহৎ হিন্দু মন্দির ছিল। লোকমুখে তিনি আরও শুনেছিলেন যে রাজা হরপালের সময় ‘রাজপ্ৰসাদী’ প্ৰথা প্ৰচলিত ছিল। প্ৰসঙ্গক্রমে এই প্ৰথা সম্বন্ধে কিছু বলি । নৃতত্ত্ববিদগণ এই প্ৰথাকে ‘jus prima noctis’ নামে অভিহিত করেন । দু’শ বছর আগে পর্যন্ত এই প্ৰথা স্কটল্যাণ্ডে প্ৰচলিত ছিল । এই প্ৰথা অনুযায়ী সকল প্ৰজাকেই তাদের নবপরিণীত। স্ত্রীকে –প্রথম রাত্ৰিতে জমিদারের বা রাজার সম্ভোগের জন্য তার শয়নকক্ষে পাঠিয়ে দিতে হত। প্ৰথাটা আমাদের দেশে এক সময় প্ৰচলিত ‘গুরুপ্ৰসাদী’ প্রথার অনুরূপ । এই শেষোক্ত প্ৰথা অনুযায়ী কুলগুরু সম্ভোগ না করলে, কেউ নবপরিণীত স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গম করতে পারত না । ( কীভাবে এই প্রথার অবলুপ্তি ঘটেছিল, তা ‘হুতোম প্যাচার নকশা’য় বিবৃত হয়েছে । )
রাজা হরপালের সময় এই প্ৰথা প্ৰচলিত থাকার দরুন রাজা একবার তার কোন এক নিকট আত্মীয়ার সঙ্গে অজাচারে লিপ্ত হন। কেউ কেউ বলেন সেই আত্মীয়া তাঁর ভগিনী, আবার কেউ কেউ বলেন সেই আত্মীয়া তার শ্যালিকা বা শ্যালিকার কন্যা । সে যাই হোক, এই দুষ্কর্মের জন্য মেয়েটি ভগবানের কাছে এর সমুচিত প্ৰতিশোধ প্রার্থনা করে। কেউ কেউ বলেন সেই মেয়ের্টির প্রার্থনা অনুযায়ী ভগবান হরপালের রাজধানী অগ্নিদগ্ধ করেন । আবার কেউ কেউ বলেন ভগবান ভূমিকম্পের দ্বারা হরপালের রাজ্য বিনষ্ট করেছিলেন। আবার মতান্তরে কোন বহিরাগত শত্রুর আক্রমণে রাজা হরপাল নিহত হন এবং তাঁর রাজ্য ধবংসপ্ৰাপ্ত হয়। জনশ্রুতি অনুযায়ী ১২০০ বা ১৩০০ বৎসর পূর্বে রাজা হরপালের রাজ্য ধবংসপ্ৰাপ্ত হয়েছিল । কানিংহাম বলেছিলেন যে এই তারিখটা যদি নির্ভুল হয়, তাহলে বলতে হবে যে ৭১৩ খ্ৰীষ্টাব্দে মহম্মদ-বিন-কাসিম কর্তৃক রাজা হরপালের রাজ্য বিনষ্ট হয়েছিল। কানিংহাম বলেছেন–‘I am inclined to put some faith in this belief of the people, as they tell the same story of all the ruined cities in the plains of the Punjab, as if they had all suffered at the same time from some sudden catastrophe, such as the overwhelming invasion of the Arabs under Muhammad-bin-Qasim. The story of the incest also belongs to the same period, as Raja Dahir of Alor is said to have married his own sister.’
উৎখননের ফলাফল সম্বন্ধে কানিংহাম বলেছিলেন যে রেলপথ নির্মাণের জন্য ঠিকাদাররা এই সকল টিবি থেকে ইট সংগ্রহ করে ঢিবিগুলিকে এমনভাবে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল যে তিনি এই সকল স্থান থেকে বিশেষ কিছু প্ৰত্নদ্রব্য সংগ্ৰহ করতে পারেন নি । ( এই সকল স্থান থেকে ঠিকাদাররা এত বিপুল পরিমাণ ইট সংগ্রহ করেছিল যে ১০০ মাইল পরিমিত রেলপথ সম্পূর্ণভাবে হরপ্পা থেকে সংগৃহীত ইষ্ট দ্বারা নির্মিত হয়েছিল । )
বিশেষ কিছু প্ৰত্নদ্রব্য কানিংহাম না পেলেও তিনি যা পেয়েছিলেন ( চিত্র দেখুন )। তা আজকের দিনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি পাথরের তৈরি কয়েকটি ছুরির ফলাকা ( কোনো কোনোটির একদিকে শান দেওয়া ও কোনো কোনটির দুদিকেই ), প্ৰাচীন মৃৎপাত্র, এবং মেজর ক্লার্ক কর্তৃক সংগৃহীত সিন্ধু সভ্যতার কেন্দ্ৰসমূহে প্ৰাপ্ত সীলমোহরের অনুরূপ লিপি ও বলদের প্রতিকৃতি যুক্ত একটি সীলমোহর ( চিত্ৰ দেখুন ) পেয়েছিলেন ।
(চলবে)