আমি যখন মহেঞ্জোদারোয় যাই, তখন নগরীর যে অঞ্চলে খননকার্য চলছিল, তার নামকরণ করা হয়েছিল : DK Area–Intermediate III period | মহেঞ্জোদারোর প্রশস্ত রাজপথ ও সমান্তরাল রাস্তাগুলি তখনই আবিষ্কৃত হয়েছিল। প্রশস্ত রাজপথটি উত্তর-দক্ষিণমুখী। রাজপথটি তখন মাত্র এক কিলোমিটার পর্যন্ত খুঁড়ে বের করা হয়েছিল। এই পথটি ৩১ থেকে ৩৬ ফুট প্রশস্ত, আর সমান্তরাল পথগুলি ২০ থেকে ২৫ ফুট। সে বৎসর আরও আবিষ্কৃত হয়েছিল নগরীর পয়ঃপ্রণালী। পোড়া ইট দিয়ে তৈরি এই পয়ঃপ্রণালী অনেকটা পথ রাস্তার পশ্চিম ধার দিয়ে এসে, একজায়গায় রাস্তা অতিক্রম করে, রাস্তার পূর্বপাশ ধরে চলে গিয়েছিল। বাড়ির দূষিত জল এই পয়ঃপ্রণালীতে এসে পড়ত, তবে অনেক বাড়িতে ‘সোক্পিট’ও ছিল। প্রতি বাড়ির প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকলেই সামনে পড়ত বাড়ির প্রাঙ্গণ। প্রবেশপথের নিকট প্রাঙ্গণের একপাশে থাকত বাড়ির কূপ। স্নানের সময় আবরু রক্ষার জন্য কূপগুলিকে দেওয়াল দ্বারা বেষ্টিত করা হত। রাজপথের দিকে বাড়ির যে দোকান-ঘরগুলি ছিল, তার অনেকগুলির সামনে আমরা আবিষ্কার করেছিলাম ইটের গাথা পাটাতন। বোধ হয় পাটাতনগুলির ওপর বিক্রেতার দিনের বেলা তাদের পণ্যসম্ভার সাজিয়ে রাখত, এবং রাত্রিকালে সেগুলিকে দোকান-ঘরে তুলে রাখত। ছোট ছোট যে-সব দ্রব্যসামগ্ৰী আমরা সে-বৎসর পেয়েছিলাম, তার মধ্যে ছিল মেয়েদের মাথার কাটা। তা থেকে আমরা সহজেই অনুমান করেছিলাম যে, মেয়ের খোপায় কাটা গুজত। তারা যে বেণী ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াত, তার প্রমাণও আমরা পেয়েছিলাম।
ব্যাপকভাবে খননকার্যের ফলে এখন হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো ছাড়া তাম্রাশ্ম যুগের সভ্যতার আরও অনেক কেন্দ্র খুঁজে বের করা হয়েছে। এর ফলে আমরা জানতে পেরেছি যে এই সভ্যতার বিকাশ পনেরো লক্ষ বর্গ মাইল ব্যাপী এক বিস্তৃত এলাকায় ঘটেছিল। ১৯৪৭ খ্রীস্টাব্দে দেশ-বিভাগের পর এইসকল কেন্দ্রের কিছু পাকিস্তানে ও কিছু ভারতের মধ্যে পড়েছে। সিন্ধু সভ্যতার যে-সব কেন্দ্র ভারতের মধ্যে পড়েছে সেগুলি হচ্ছে—কালিবঙ্গান, লোথাল, রূপার, চণ্ডীগড়, স্বরকোটড়া, দেশলপুর, নবিনাল, রঙপুর, ভগৎরাও, মাও, বরা, বরগাওন, বাহাদারাবাদ, শিশওয়াল, মিটাথাল, আলমগিরপুর, কায়াথা, গিলাণ্ড, টড়িও, দ্বারকা, কিনডারখেদ, প্রভাস, মাটিয়ালা, মোটা, রোজড়ি, আমরাফল, জেকডা, সুজনপুর, কানাস্থতারিয়া, মেহগাওন, কাপড়খেদা ও সবলদা। এ ছাড়া তাম্রাশ্ম যুগের সভ্যতার নিদর্শন আমরা পেয়েছি—লালকিলা, নোয়া, মানাটি, দৈমাবাদ, মহিষদল, বাণেশ্বরডাঙ্গা, পাণ্ডুরাজার ঢিবি প্রভৃতি স্থান থেকেও। ১৯২৯-৩১ খ্রীস্টাব্দে আমি যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈতনিক গবেষক হিসাবে সিন্ধু সভ্যতা সম্বন্ধে অনুশীলন করছিলাম, তখন আমার প্রতিবেদনের প্রথম অনুচ্ছেদেই বলেছিলাম—‘এ সম্পর্কে বুকি নিয়ে এ-কথা বলা যেতে পারে যে, পরবর্তীকালে অনুরূপ সভ্যতার নিদর্শন গঙ্গা উপত্যকতেও পাওয়া যেতে পারে, যার দ্বারা প্রমাণিত হবে যে এ-সভ্যতা উত্তর ও প্রাচ্য ভারতেও বিস্তারলাভ করেছিল।’ আজ খননকার্যের ফলে আমার সে অনুমান বাস্তবে পরিণত হয়েছে।
এরূপ অনুমান করবার সপক্ষে যথেষ্ট কারণ আছে যে, সিন্ধু সভাত আর্য সভ্যতার হ্যায় আগন্তক সভ্যতা ছিল না। এ সভ্যতার উন্মেষ ও বিকাশ ভারতেই ঘটেছিল। মূলগতভাবে সিন্ধু সভ্যতা ছিল তাম্রাশ্ম যুগের সভ্যতা (chalcolithic civilization)। তার মানে, প্রস্তর যুগের শেষে এই সভ্যতার ধারকদের মধ্যে তামার ব্যবহার প্রচলিত হয়েছিল। অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতার সঙ্গে প্রস্তর যুগ পর্যন্ত স্তরবিন্যাস আমরা হরপ্পায় পাই। প্রস্তর যুগের যে স্তর থেকে তাম্রাশ্ম যুগের উদ্ভব হয়েছিল, তাকে আমরা নবোপলীয় যুগের (neolithic) সভ্যতা বলি। এই নবোপলীয় যুগের মানুষই প্রথম ভূমিকৰ্ষণ ও স্থায়ী বসতি স্থাপন শুরু করে। তা ছাড়া, নবোপলীয় যুগের মানুষরা পশুপালন করত, মৃৎপাত্র তৈরি করত, বস্ত্রবয়ন করত ও নিজেদের নিত্যনৈমিত্তিক প্রয়োজন মেটাবার জন্য যে-সকল আয়ুধ বা যন্ত্রাদি ব্যবহার করত, সেগুলিকে বেশ মসৃণ বা ‘পালিশ করত। বস্তুত নবোপলীয় যুগেই প্রথম সভ্যতার সূচনা হয়।
এখন প্রশ্ন উঠতে পাবে, হরপ্পা সভ্যতা যদি প্রাক্-হরপ্পীয় যুগের নবোপলীয় সভ্যতারই স্বাভাবিক পরিণতি হয়, তাহলে নবোপলীয় সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছিল কোথায় ? আমি আগেই বলেছি যে কিছুদিন আগে পর্যন্ত পণ্ডিতমহলে এ-সম্বন্ধে বিভ্রান্তি ছিল। প্যালেস্টাইনের ‘ডেড সী’ উপত্যকায় জেরিকো নামক স্থানে একটি প্রাচীন নবোপলীয় গ্রাম আবিষ্কৃত হয়েছিল। রেডিয়ো-কার্বন-১৪ পরীক্ষায় এর বয়স নিণীত হয় খ্রীস্টপূর্ব ৭০০০ অব্দ। সেখানে নবোপলীয় ও প্রত্নোপলীয় যুগদ্ধয়ের সন্ধিক্ষণের (mesolithic) দ্রব্যাদি পাওয়া যায়। এই সন্ধিযুগের বয়স প্রায় ৮০০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দ। সুতরাং এ থেকে অনুমান করা হত যে খ্রীস্টপূর্ব অষ্টম সহস্ৰকে জেরিকোতেই নবোপলীয় যুগের সভ্যতার উদ্ভব ঘটেছিল। ইরাকের জারমো ও ইরানের টোপ সবাব নামক স্থানদ্বয় থেকেও খ্রীস্টপূর্ব ৭০০০ থেকে ৬৫০০ অব্দের মধ্যেকার ছ’টি নবোপলীয় যুগের গ্রামের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। এসব প্রমাণের ভিত্তি থেকে সিদ্ধান্ত করা হয়েছিল যে, নবোপলীয় যুগের কৃষ্টি নিকটপ্রাচীতেই উদ্ভূত হয়ে জগতের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক কালের খনন এবং রেডিয়ো-কার্বন-১৪ পরীক্ষা থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে, মধ্য-প্রাচীর নবোপলীয় কৃষ্টির সমসাময়িক কালেই বা তার কিছু আগে নবোপলীয় গ্রাম থাইল্যাণ্ডেও ছিল। আরও জানতে পারা গিয়েছে যে, নিকট-প্রাচীর নবোপলীয় মানুষদের আগেই জাপানের আদিম অধিবাসীরা মৃৎপাত্র তৈরি করতে জানত। এখন এটা একরকম প্রায় স্বীকৃতই হয়ে গিয়েছে যে নবোপলীয় যুগের কৃষ্টি জগতের একাধিক স্থানে উদ্ভূত হয়েছিল। ভারতে আমরা প্রত্নোপলীয় ও নবোপলীয় এই উভয় যুগের বহু কৃষ্টি-কেন্দ্র আবিষ্কার করেছি। সুতরাং ভারতের তাম্রাশ্ম যুগের কৃষ্টি যে দেশজ নবোপলীয় ও প্রত্নোপলীয় যুগের কৃষ্টি থেকে উদ্ভূত, সে-সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই।