‘Besides the grave-stones, monumental stones are set up outside the village to the memory of men of note. The Kherias have collections of these monuments in the little enclosure round their houses and libations are constantly made to them’. মনে হয়, বাঙলাদেশে মানুষের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের পর গ্রামের বাইরে যে ‘বৃষকাষ্ঠ’ স্থাপন করা হয়, সেগুলি এরূপ প্রস্তরফলকেরই কাষ্ঠনির্মিত উত্তর-সংস্করণ। (A. K. Sur, “History & Culture of Bengal’ (1963), pages 20-21, ‘বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন, পৃষ্ঠা ৫৭-৫৮ দ্রঃ)।
বস্তুত নবোপলীয় যুগের অনেক কিছুই আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ধরে রেখেছি ; যথা—ধাম, চুবড়ি, কুলা, ঝাপি, বাটনা বাটবার শিল-নোড়া ও শস্য পেষাইয়ের জন্য জাতা ইত্যাদি। তা ছাড়া, বর্তমান শতাব্দীর গোড়া পর্যন্ত ( জোড়াসাকোর ঠাকুরবাড়িতেও সেই প্রথা ছিল) আমরা আমাদের গৃহস্থালিতে পাথরের থালা, গেলাস, বাটি ইত্যাদি ব্যবহার করতাম। এগুলি সবই নবোপলীয় যুগের ‘টেকনোলজি অনুযায়ী, যদিও লৌহনির্মিত যন্ত্রের সাহায্যে তৈরি হত।
প্রত্নোপলীয় যুগের যে-সব আয়ুধ ভারতে পাওয়া গিয়েছে তার একটা বৈশিষ্ট্য এই যে, সেগুলির সঙ্গে একদিকে পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকায় ও অপরদিকে জাভায় প্রাপ্ত আয়ুধসমূহের অসাধারণ মিল আছে। এছাড়া, ভারতে যে flake tools শিল্প গড়ে উঠেছিল, তার সঙ্গে চীন ও ব্রহ্মদেশের flake tools শিল্পেরও সাদৃশ্য আছে। নবোপলীয় যুগের কৃষ্টি সম্বন্ধেও ওই একই কথা বলা চলে। তবে নবোপলীয় যুগে পূর্ব-ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হয়েছিল। ( ‘দি গেজেটিয়ার অভ ইণ্ডিয়ান ইউনিয়ন’, প্রথম খণ্ড দ্রঃ)। এ থেকে বুঝতে পারা যায় যে ভারতের প্রস্তর যুগের কৃষ্টি যে মাত্র দেশজ ছিল, তা নয়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও তার বিস্তারলাভ ঘটেছিল। তা ছাড়া, ভারতের যে-সব জায়গায় খননকার্য চালানো হয়েছে, তাদের মধ্যে অনেক জায়গাতেই নবোপলীয় যুগের পরেই তাম্রাশ্ম যুগের অভু্যত্থান লক্ষ্য করা যায়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য মহারাষ্ট্রের দৈমাবাদ, নেভাসা, সোনাগাওন প্রভৃতি ও বাঙলাদেশের পাণ্ডুরাজার ঢিবি, মহিষদল প্রভৃতি। সুতরাং ভারতে তাম্রাশ্ম যুগের সভ্যতা যে দেশজ সভ্যতা, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
ভারতের তাম্রাশ্ম সভ্যতাকে আমরা ‘সিন্ধু সভ্যতা’ বা ‘হরপ্পা সভ্যতা’ নামে অভিহিত করি। ১৯২২ খ্রীস্টাব্দে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলায় মহেঞ্জোদারো নামক স্থানে এক ঢিবি উৎখনন করে ভারতের এই লুপ্ত সভ্যতা আবিষ্কার করেন। এই সভ্যতার সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ পরিচয় হয় ১৯২৮ খ্রীস্টাব্দে। ওই বৎসর ভারতের প্রত্নতত্ত্ব সমীক্ষা অধিকরণের সর্বময় কর্তা স্যার জন মারশাল আমাকে নিয়োগ করেন ‘হিন্দু সভ্যতার গঠনে সিন্ধু সভ্যতার অবদান’ সম্বন্ধে গবেষণা করবার জন্য। ওই গবেষণার কাজ দু’পর্যায়ে সমাপ্ত হয়েছিল। প্রথম পর্যায়ে মহেঞ্জে দারোয় ও দ্বিতীয় পর্যায়ে কলকাতায়। প্রথম পর্যায়ে আমি যখন মহেঞ্জোদারোতে সরেজমিনে গবেষণা চালাচ্ছি, তখন এক বাঙালী-বিদ্বেষী অফিসারের হাতে নিপীড়িত হবার ভয়ে আমাকে কলকাতাতে পালিয়ে আসতে হয়েছিল। সে-কথাটা যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট-গ্রাজুয়েট ডিপার্টমেন্টের প্রেসিডেণ্ট ডঃ সৰ্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন ও সেনেটের সবচেয়ে প্রভাবশালী সদস্য শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের কানে যায়, তখন তাঁরা আমাকে বৈতনিক গবেষক নিযুক্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ওই অনুশীলন চালিয়ে যেতে বলেন। দু’বৎসর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুশীলন চালিয়ে আমি এই তথ্য উপস্থাপন করলাম যে হিন্দু সভ্যতার গঠনের মূলে বারো-আনা ভাগ আছে সিন্ধু উপত্যকার প্রাক্-আর্য সভ্যতা ; আর মাত্র চার-আনা ভাগ মণ্ডিত আর্য সভ্যতার আবরণে। আমার গবেষণালব্ধ তথ্যসমূহ আমি স্যার জন মারশালের কাছে পাঠাতাম, আর বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে বিশদ প্রতিবেদন পেশ করতাম। আমার সতীর্থ ডঃ নীহাররঞ্জন রায় ১৯৩১ খ্রীস্টাব্দে যখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত ‘ক্যালকাটা রিভিউ পত্রিকার সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেন, তখন তিনি আমার গবেষণা-সম্পকিত প্রতিবেদনের অংশবিশেষ ওই পত্রিকায় প্রকাশ করেন। কিছু অংশ “ইণ্ডিয়ান হিস্টরিক্যাল কোয়াটারলি’ পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়েছিল। পরে এগুলি পুস্তকা কারে প্রকাশিত হয়।
১৯৩৫ খ্রীস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রধান ডঃ দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকার ইণ্ডিয়ান কালচারেল কনফারেনসে প্রদত্ত তাঁর সভাপতির ভাষণে ( পৃষ্ঠা ১০ ) বলেন–‘হিন্দু সভ্যতা যে আর্য ও অনার্য সভ্যতার মিশ্রণে উদ্ভূত এটা যে চারজন বিশিষ্ট প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ করেছেন তারা হচ্ছেন স্যার জন মারশাল, রায়বাহাদুর রমাপ্রসাদ চন্দ, ডঃ স্টেল ক্রামরিশ ও শ্রীঅতুলকৃষ্ণ সুর।’
তারপর অনেক বছর কেটে গেল। ভারতের ইতিহাসের ওপর প্রাক-বৈদিক সভ্যতার প্রভাব যে কতখানি, তা আমাদের ঐতিহাসিকরা বুঝলেন না। গতানুগতিকভাবে ভারতের ইতিহাস রচনা করে যেতে লাগলেন, মাত্র বৈদিক যুগের আগে সিন্ধু সভ্যতা সম্বন্ধে একটা অধ্যায় যোগ করে দিয়ে।